দবির খেঁকিয়ে উঠে বলল, বৃষ্টি পড়বে না তো কি রসগোল্লার সিরা পড়বে?
জব্বার আর কিছু বলার সাহস পেল না, সে সাবধানে রাস্তার পাশে গাড়িটার গতি কমিয়ে থামিয়ে ফেলল। ইঞ্জিনটা বন্ধ করবে কি না বুঝতে পারছিল না। দবিরের দিকে তাকাতেই সে বলল, ডিকি খোল। দুইটা প্যাকেট আছে, প্যাকেট দুইটা নামা।
জব্বার তখন ইঞ্জিনটা বন্ধ করে দেয়, ডিকি খুলতে গাড়ির চাবি লাগবে। অন্ধকারে তার ভুরু কুঞ্চিত হয়ে উঠল। গাড়ির পিছনে কোনো প্যাকেট থাকার কথা নয়, দবির ঠিক কী চাইছে? অন্ধকার জগতের প্রাণীর মতো হঠাৎ করে সে সতর্ক হয়ে যায়। সে সাবধানে গাড়ির ডিকি খুলল এবং চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেল দবিরও দরজা খুলে নেমে আসছে। ডিকির ভিতরে কিছু জঞ্জাল–কোনো প্যাকেট নেই, জব্বার সোজা হয়ে ঘুরে দাঁড়াল এবং হঠাৎ করে তার সমস্ত শরীর শীতল হয়ে এল। এবারের দুই হাত পিছনে দবির তার ভালো হাত দিয়ে একটা বেঁটে রিভলবার ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না কিন্তু জব্বারের এটি চিনতে অসুবিধে হল না, মাত্র এক সপ্তাহ আগে একটা টেন্ডারের বখরা নিয়ে গোলমালের কারণে দবির এই বেঁটে রিভলবার দিয়ে ট্যারা রতনকে পরপর ছয়বার গুলি করে মেরেছে। প্রথম গুলিটি ছিল হত্যাকাণ্ডের জন্য, বাকি পাঁচটি ছিল শুধুমাত্র মজা করার জন্য। জব্বার হঠাৎ করে বুঝতে পারল তার গৌরবহীন ক্ষুদ্র জীবনটি এই অন্ধকার রাতে রাস্তার পাশে কাদা মাটিতে শেষ হয়ে যাবে। দবিরের বিশ্বস্ত অনুচর হিসেবে সে অসংখ্যবার দবিরকে শীতল চোখে এবং কঠিন মুখে হাতে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়াতে দেখেছে–তখন তার মুখের অভিব্যক্তিটি নিষ্ঠুর না হয়ে কেমন যেন বিষণ্ণ মনে হয়। অন্ধকারে দবিরের মুখটি দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু জব্বর জানে এখন তার মুখে এক ধরনের বিষণ্ণতা এসেছে।
জব্বার পরিষ্কার করে চিন্তা করতে পারছিল না, ভাঙ্গা গলায় বলল, আমি কী করেছি। ওস্তাদ?
তুই খুব ভালো করে জানিস তুই কী করেছিস।
আমি জানি না–আল্লাহর কসম।
চুপ কর হারামজাদা–এখানে আল্লাহকে টেনে আনবি না।
বিশ্বাস করেন ওস্তাদ–আপনি বিশ্বাস করেন।
কে বলেছে আমি তোর কথা বিশ্বাস করি নাই? অবশ্যই করেছি, সেই জন্য তোরে আমি কোনো কষ্ট দিব না। তুই ঘুরে দাঁড়া, পিছন থেকে মাথায় গুলি করে ফিনিশ করে দিব। তুই টেরও পাবি না।
জব্বারের সামনে হঠাৎ করে সমস্ত জগৎ–সংসার অর্থহীন হয়ে গেল, সে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারছে না, মনে হচ্ছে সময় যেন স্থির হয়ে গেছে। দবিরের প্রত্যেকটি কথা যেন অন্য কোনো জগৎ থেকে খুব ধীরে ধীরে ভেসে আসছে, আদি নেই, অন্ত নেই, শুরু নেই, শেষ নেই– বিস্ময়কর এক অতিপ্রাকৃত জগৎ।
হঠাৎ করে সমস্ত আকাশ চিরে একটি নীল বিদ্যুৎঝলক ছুটে এল, কিছু বোঝার আগে তীব্র আলোতে চারদিক দিনের মতো আলোকিত হয়ে যায়। বাতাস কেটে কিছু একটা ছুটে যাবার শব্দ হল, জব্বার দেখতে পায় দবির বিস্ময়ে হতচকিত হয়ে এক মুহূর্তের জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা দেখছে। কী দেখছে সে জানে না, তার এই মুহূর্তে জানার কোনো কৌতূহলও নেই। দবিরের এক মুহূর্তের জন্য হতচকিত হওয়ার সুযোগে জব্বার তার ওপর সমস্ত শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে দবিরের মুখে আঘাত করে তাকে নিচে ফেলে দিল। দবিরের হাত থেকে রিভলবারটি ছিটকে পড়ে গেছে, জব্বার সেই সুযোগে দবিরের বুকের ওপর চেপে বসে আবার তার মুখে আঘাত করে। অন্ধকারে দেখা যায় না। কিন্তু দবিরের নাক দিয়ে রক্ত বের হয়ে জব্বারের হাত চটচটে হয়ে যায়।
জব্বার অমানুষিক নিষ্ঠুরতায় দবিরকে আঘাত করতে করতে একটি হাত দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে রিভলবারটি খুঁজে বের করে ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে সেটা হাতে নিয়ে সরে দাঁড়াল। দবির কাটা হাতটি দিয়ে মুখ মুছে সোজা হয়ে বসে প্রথমে জব্বারের দিকে তারপর পিছনে দূরে তাকাল।
জব্বারও দবিরের দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকাল, নীল আলোর ছটা ছড়িয়ে যে বিচিত্র জিনিসটি নেমে এসেছে সেটি পানিতে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। জব্বার নিরাপত্তার জন্য আবার ঘুরে দবিরের দিকে তাকাল বলে দেখতে পেল না বিচিত্র জিনিসটির উপরের অংশ খুলে গেছে এবং সেখান থেকে ধাতব পিচ্ছিল এক ধরনের ঘিনঘিনে প্রাণী বের হয়ে আসছে। দবির বিস্ফারিত চোখে সেই প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে রইল এবং জব্বারের গুলিতে তার মস্তিষ্ক চূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরও তার মুখ থেকে সেই বিস্ময়াভিভূত ভাবটি সরে গেল না।
জব্বার রিভলবারের পুরো ম্যাগাজিনটি দবিরের ওপর খালি করল–এই মানুষটিকে সে জীবন্ত অবস্থায় বিশ্বাস করে নি, মৃত অবস্থাতেও তাকে সে বিশ্বাস করে না।
জব্বার রিভলবারটি প্যান্টে খুঁজে নিয়ে টলতে টলতে গাড়িতে ফিরে গিয়ে হাতড়ে হাতড়ে চ্যাপ্টা বোতলটা বের করে ঢকঢক করে তার অর্ধেকটা খালি করে দেয়। খুব ধীরে ধীরে তার স্নায়ু শীতল হয়ে আসছে, এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না শহরতলির ত্রাস অন্ধকার জগতের একচ্ছত্র অধিপতি কব্জি কাটা দবিরকে সে নিজে খুন করে ফেলেছে। বিচিত্র একটা আলোর ঝলকানি দিয়ে আকাশ থেকে কিছু একটা নেমে এসেছে, সেটি কী সে জানে না। সেই মুহূর্তে আকাশ থেকে সেটি নেমে না এলে কেউ তাকে তার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারত না। জব্বার পুরো ব্যাপারটা নিয়ে এখন চিন্তা করতে পারছে না, দবিরের। মৃতদেহটি পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে তার এখন ফিরে যেতে হবে–আকাশ থেকে নেমে আসা জিনিসটা কাছাকাছি পানিতে ডুবে গেছে, তার গুলির শব্দও নিশ্চয়ই শোনা গেছে; কৌতূহলী মানুষ এসে যেতে পারে। রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে ট্রাক ছুটে যাচ্ছে, কোনো একটি ট্রাক থেমে গেলেই বিপদ হয়ে যাবে। জব্বারকে এখনই উঠতে হবে কিন্তু সে উঠতে পারছে না। এক বিচিত্র ক্লান্তিতে তার শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে। জব্বার চ্যাপ্টা বোতল থেকে পানীয়টুকু আবার গলায় ঢেলে শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করতে থাকে।