মোজাম্মেল হক নরম গলায় বললেন, নিশীতা, তুমি আমাদের এত বড় জাঁদরেল একজন সাংবাদিক, তুমি যদি ছেলেমানুষের মতো কথা বল তা হলে তো মুশকিল। সন্দেহ থেকে তো খবর হয় না। খবর হতে হলে তার প্রমাণের দরকার।
আপনি কী প্রমাণ চান?
সবচেয়ে ভালো হয় তুমি যদি মহাজাগতিক প্রাণীটাকে ধরে প্রেসক্লাবে নিয়ে এসে তাকে দিয়ে একটা সাংবাদিক সম্মেলন করাতে পার। মোজাম্মেল হক নিজের রসিকতায়। নিজেই হা হা করে হাসতে শুরু করলেন।
নিশীতা রেগে বলল, মোজাম্মেল ভাই আপনি আমার সাথে ঠাট্টা করছেন কেন?
মোজাম্মেল হক নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে প্রাণীটাকে যদি ধরে না আনতে পার অন্ততপক্ষে তার একটা ছবি তো দেবে? তা না হলে কেমন করে হবে?
ঢাকা শহর যে আমেরিকান সায়েন্টিস্ট দিয়ে গিজগিজ করছে, রাতারাতি এত বড় একটা। এলাকা ইলেকট্রিক তার দিয়ে ঘিরে ফেলল আপনার কাছে সেটা সন্দেহজনক মনে হচ্ছে না?
হচ্ছে।
তা হলে? সে জন্যই তো তোমরা আছ। তোমরা সত্যটা খুঁজে বের করে দাও।
ঠিক আছে মোজাম্মেল ভাই, আপনাকে আমি সত্য খুঁজে বের করে এনে দেব।
বেশ।
টেলিফোনটা রেখে দিয়ে নিশীতা প্রায় স্পষ্ট অনুমান করতে পারল মোজাম্মেল হক দুলে দুলে হাসছেন–তার একটা কথাও বিশ্বাস করেন নি।
.
বাংলাদেশ পরিক্রমার অফিস থেকে ভাইরাস আক্রান্ত এলাকাটা দেখতে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু কাজকর্ম শেষ করে বের হতে হতে নিশীতার দেরি হয়ে গেল। পথে কিছু খেয়ে নেবে বলে এলিফ্যান্ট রোডে একটা ভালো ফাস্টফুডের দোকানে থেমে আবিষ্কার করল সেখানে এত ভিড় যে বসার জায়গা নেই, লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে। কয়েকজন মিলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাওয়া যায়—সত্যি কথা বলতে কী, কয়েকজন মিলে শুধু দাঁড়িয়ে কেন হেঁটে বসে বা ছুটতে ছুটতেও খাওয়া যায়, কিন্তু একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাওয়ার মাঝে কেমন যেন হ্যাংলাপনা রয়েছে। নিশীতা তাই খাবারের একটা প্যাকেট কিনে নিল, কোথায় বসে কিংবা কার সাথে খাবে চিন্তা করে তার ড, রিয়াজ হাসানের কথা মনে পড়ল, মানুষটিকে যেটুকু দেখেছে তাতে মনে হচ্ছে নাওয়া-খাওয়া ঠিক নেই। নিশীতা তাই তার জন্যও একটা খাবারের প্যাকেট কিনে নিয়ে রিয়াজ হাসানের বাসার দিকে রওনা দেয়। সেদিন রাত্রিবেলা এপসিলনকে প্রশ্ন না করে প্রশ্নের উত্তর দিতে দেখে রিয়াজ হাসান এত অবাক হয়েছিল যে বলার মতো নয়। ব্যাপারটি কীভাবে হয়েছে বোঝার জন্য তখন তখনই সে কাজে লেগে গিয়েছিল এরপর আর তার সাথে যোগাযোগ হয় নি। ফ্রেন্ড লিস্টারের দলবল আর কোনো উৎপাত করেছে কি না সেটারও একটা খোঁজ নেওয়া দরকার।
রিয়াজ হাসানের বাসার গেট হাট করে খোলা, দরজায় কলিংবেল অনেকবার টিপেও কেউ উত্তর দিল না। রিয়াজ হাসান বাসায় নেই ভেবে নিশীতা খানিকটা আশাহত হয়ে চলে আসছিল তখন কী ভেবে সে দরজার হ্যাঁন্ডেল ঘুরিয়ে অবাক হয়ে আবিষ্কার করল দরজাটি খোলা। সে ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে উচ্চৈঃস্বরে ডাকল, ড. হাসান।
কেউ উত্তর দিল না। নিশীতা তখন সাবধানে ভিতরে ঢুকে চমকে উঠল, মনে হচ্ছে এই বাসার ভিতরে প্রলয়কাণ্ড ঘটে গেছে। ঘরের সবকিছু ওলটপালট হয়ে আছে, ঘরময় যন্ত্রপাতি এবং কাগজপত্র ছড়ানো–ছিটানো। নিশীতার বুকটি হঠাৎ ধক করে ওঠে, সে সাবধানে। ভিতরে উঁকি দেয়। মনে হচ্ছে ঘরের ভিতর একটা টর্নেডা হয়ে গেছে। নিশীতা ভিতরের ঘরগুলো ঘুরে আবার বাইরের ঘরে এসে দাঁড়াল, মনে হচ্ছে এই ঘরটির উপর দিয়ে সবচেয়ে বেশি ঝড় গেছে। নিশীতা নিচু হয়ে একটি–দুইটি কাগজ তুলে আনল। ছোটখাটো যন্ত্রপাতি ইতস্তত ছড়িয়ে আছে, একটা স্পর্শ করতেই কে যেন তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে উঠল, কে? কে ওখানে?
নিশীতা থমকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারল এটি এপসিলনের কণ্ঠস্বর। কাত হয়ে পড়ে থাকা মনিটরটির ভিতর থেকে এপসিলন নিশীতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, নিশীতা? তুমি কি নিশীতা?
হ্যাঁ। আমি নিশীতা। নিশীতা এগিয়ে গিয়ে মনিটরটিকে সোজা করে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, এখানে কী হয়েছে?
দেখতে পাচ্ছ না কী হয়েছে?
হ্যাঁ। দেখতে পাচ্ছি। ড. রিয়াজ হাসান কোথায়?
নাই।
নিশীতা ভুরু কুঁচকে এপসিলনের দিকে তাকাল, সে আবার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে প্রশ্ন। করে, রিয়াজ হাসানের মতে এটি অসম্ভব। নিশীতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এপসিলনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় গিয়েছেন রিয়াজ হাসান?
তাকে ধরে নিয়ে গেছে।
নিশীতা প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, কে ধরে নিয়ে গেছে?
ফ্রেড লিস্টারের লোকজন।
তুমি কেমন করে জান?
আমি দেখেছি।
তুমি কেমন করে দেখবে? তোমার চোখ নেই, আছে একটা সস্তা ভিডিও ক্যামেরা।
এপসিলন কোনো কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে নিশীতার দিকে তাকিয়ে রইল। নিশীতা অধৈর্য হয়ে বলল, কী হল? কথা বলছ না কেন?
ভাবছি।
কী ভাবছ?
তোমাকে কেমন করে বলব।
নিশীতা অবাক হয়ে এপসিলনের দিকে তাকিয়ে রইল, তার ভিতরে হঠাৎ একটা বিচিত্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়, মনে হয় এই ঘরে সে একা নয়, এখানে অন্য একজন আছে, সে যেরকম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এপসিলনের দিকে তাকিয়ে আছে ঠিক সেইভাবে অন্য কেউ তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল, কোথাও কেউ নেই কিন্তু তবু কী বিচিত্র এবং বাস্তব সেই অনুভূতি। নিশীতা জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, কী হল, কিছু বলবে না?