ক্যাপ্টেন মারুফ জিজ্ঞেস করল, কোথায় কোয়ারেন্টাইন করা হবে?
মাইলখানেক দূরে একটা স্কুল রয়েছে। সেটাকে কোয়ারেন্টাইন হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে।
স্যার, আপনারা কি সত্যিই এটাকে ভাইরাসের সংক্রমণ বলে সন্দেহ করছেন?
হ্যাঁ। অবশ্যই।
ক্যাপ্টেন মারুফ আপত্তি করে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল–সেনাবাহিনীতে নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়, সব সময় নিজের কথা বলার পরিবেশ থাকে না। কমান্ডিং অফিসার বলল, আমি একে নিয়ে যাচ্ছি।
ঠিক আছে স্যার।
আর কয়েক ঘণ্টার মাঝে বিশাল টুপ নামানো হবে। এখানে প্রায় দশ স্কয়ার কিলোমিটার এলাকা পুরোপুরি ঘিরে ফেলা হবে, ভিতরে কেউ যেতে পারবে না।
কীভাবে ঘিরে ফেলা হবে?
কাঁটাতার, ইলেকট্রিক লাইন এবং লেজার সারভেলেন্স।
ক্যাপ্টেন মারুফ হতবাক হয়ে কমান্ডিং অফিসারের দিকে তাকিয়ে রইল, লেজার সারভেলেন্স?
হ্যাঁ। কমান্ডিং অফিসার দাঁত বের করে হেসে বলল, আমেরিকান গভর্নমেন্ট সাহায্য করছে। আজ রাতের মাঝে কমপ্লিট হয়ে যাবে।
আর এই এলাকার মানুষগুলো?
ট্রাকে করে সরিয়ে নেওয়া হবে। ঐ দেখ ট্রাক আসছে।
ক্যাপ্টেন মারুফ তাকিয়ে দেখল সত্যি সত্যি দৈত্যের মতো বড় বড় অনেকগুলো ট্রাক আসছে। মানুষজনের ভয়ার্ত কথাবার্তা, ছোট শিশু এবং মেয়েদের কান্না শোনা যাচ্ছে। মানুষজন ছোটাছুটি করছে, একজন আরেকজনকে ডাকাডাকি করছে। এত অল্প সময়ের নোটিশে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। সবকিছু নিয়ে একটা ভয়াবহ আতঙ্ক।
ঠিক কী কারণ জানা নেই কিন্তু ক্যাপ্টেন মারুফের হঠাৎ মনে হল পুরো ব্যাপারটি একটি বড় ধরনের ষড়যন্ত্র। এর মাঝে অন্য কিছু রয়েছে–ভাইরাস নয়, রোগশোক নয়, অন্য কিছু। ব্যাপারটি কী সে জানে না কিন্তু সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাপ্টেন মারুফ কেমন করে জানি বুঝতে পারে একটা ভয়ঙ্কর বিপদ এগিয়েছে।
০৬. সকালবেলা খবরের কাগজ হাতে
সকালবেলা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে নিশীতা একেবারে থ হয়ে গেল, পত্রিকায় বড় বড় হেডলাইন, ঢাকার উপকণ্ঠে ভয়াল ভাইরাস ভিতরে ভাইরাস সংক্রমণের বর্ণনা। ভাইরাসে আক্রান্ত হলে কী ধরনের উপসর্গ হতে পারে লেখা রয়েছে, শরীরের প্রতিটি অংশ। দিয়ে রক্তক্ষরণ একটি প্রধান উপসর্গ–সেটাকে তাই এবোলা ভাইরাসের কাছাকাছি কোনো প্রজাতি বলে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে।
ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সাধারণ মানুষকে উদ্ধার করার জন্য সেই এলাকা থেকে কয়েক হাজার মানুষকে রাতের মাঝে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পুরো এলাকাকে কাটাতার দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে, সেখানে সামরিক প্রহরা বসানো হয়েছে। ভাইরাস দিয়ে সংক্রমণ হয়েছে এ রকম কিছু মানুষকে এর মাঝে কোয়ারেন্টাইন করা হবে।
নিশীতা পুরো খবরটা পড়ার আগেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। নিশীতার আম্মা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হল? কোথায় যাচ্ছিস?
ফোন করতে।
কাকে ফোন করবি?
মোজাম্মেল ভাইকে। আমাদের এডিটর।
কেন? কী হয়েছে?
দেখছ না কী ছাপা হয়েছে?
আম্মা তখনো পত্রিকা দেখেন নি, বললেন, কী ছাপা হয়েছে?
তুমি সেটা বুঝবে না আম্মা–
আম্মা এবারে সত্যি সত্যি রেগে উঠলেন, গলা উচিয়ে বললেন, তুই এসব কী শুরু করেছিস? পৃথিবীতে তুই ছাড়া আর কোনো সাংবাদিক নেই? সকাল সাতটার সময় ঘর থেকে বের হয়ে যাস ফিরে আসিস রাত বারোটায়? দেশের কী অবস্থা জানিস না? একটা মোটর সাইকেলে টো টো করে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা ঘুরে বেড়াচ্ছিস? এখন সকালে নাশতা খাওয়ার সময় নাই তার আগেই টেলিফোন করতে হবে?
আম্মা, তুমি বুঝতে পারছ না
আমি খুব ভালো বুঝতে পারছি যে আমার কপালে অনেক দুঃখ আছে। আমার মরণ না হওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই–
এরপর আম্মা নিশীতার আব্বা কেমন করে তার ঘাড়ে সবকিছু চাপিয়ে দিয়ে মারা গেলে সেটা নিয়ে অভিযোগ করতে শুরু করলেন, আর মারা যখন গেলেনই কেন মেয়েটাকে এ রকম একটা আধা ছেলে আধা মেয়ে–ডানপিটে একরোখা উচ্ছল একটা চরিত্র তৈরি করে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলেন সেটা নিয়ে আক্ষেপ করতে লাগলেন। সবার মেয়েরা বিয়েশাদি করে ঘর–সংসার করছে আর তার মেয়েটি কেন এ রকম বাউণ্ডেলেপনা করে বেড়াচ্ছে সেটা নিয়ে খোদার কাছে নালিশ করতে শুরু করলেন। কাজেই। নিশীতাকে আবার খাবার টেবিলে এসে বসতে হল, পাউরুটিতে মাখন লাগিয়ে খেতে হল, চা শেষ করতে হল এবং তারপর টেলিফোন করতে যেতে পারল।
বাংলাদেশ পরিক্রমার সম্পাদক মোজাম্মেল হককে তার বাসায় পাওয়া গেল। ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে বলে তিনি প্রতিদিন সকালে হাঁটতে বের হন, নিশীতা যখন ফোন করেছে তখন তিনি মাত্র হেঁটে ফিরে এসেছেন। মোজাম্মেল হক জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার নিশীতা? এই ভোরে?
আজকের সকালে খবরের কাগজ দেখেছেন?
দেখেছি, কী হয়েছে?
কী হয়েছে বুঝতে পারছেন না?
না।
ভাইরাসের খবরটা দেখেছেন?
দেখেছি। অনেক রাতে খবর এসেছে সবাই লিড নিউজ দিয়েছে।
আপনি বুঝতে পারছেন না এটা মিথ্যা?
মোজ্জামেল হক হাসার মতো শব্দ করে বললেন, মিথ্যা?
হ্যাঁ। এই এলাকায় একটা মহাজাগতিক প্রাণী নেমেছে বলে পুরো এলাকাটা ঘিরে ফেলে সব মানুষকে বের করে দিয়েছে।
হ্যাঁ, তুমি আগেও বলেছ।
নিশীতা একটু অধৈর্য হয়ে বলল, হ্যাঁ, যারা যারা সেই মহাজাগতিক প্রাণীকে দেখেছে কোয়ারেন্টাইন করার নামে তাদের সবাইকে আলাদা করে রেখেছে যেন কারো সাথে কথা বলতে না পারে!