ক্যাপ্টেন মারুফ অন্যমনস্কভাবে হেঁটে একটু সামনে এগিয়ে যায়, ঠিক তখন দেখতে পায় একজন মানুষ পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে আসছে। দুই জন জওয়ান মানুষটিকে থামানোর জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল, ক্যাপ্টেন মারুফ হাত তুলে তাদের থামাল।
রমিজ মাস্টার ছুটতে ছুটতে ক্যাপ্টেন মারুফের কাছে এসে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে কিন্তু সে এত ভয় পেয়েছে এবং ছুটে এসে এমনভাবে হাঁপিয়ে উঠেছে যে তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হয় না। ক্যাপ্টেন মারুফ ভুরু কুঁচকে বলল, কী হয়েছে আপনার?
রমিজ মাস্টার একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, স্যার, ঐখানে একটা দানব। একটা রাক্ষস।
রাক্ষস?
জি স্যার। শরীরের ভিতর থেকে একটা জন্তু বের হয়ে এসে একজন মানুষের শরীরে ঢুকে গেছে। মানুষটাকে মেরে ফেলছে স্যার আপনারা তাড়াতাড়ি যান।
মেরে ফেলছে?
জি স্যার। আপনি চিন্তা করতে পারবেন না কী ভয়ানক। রমিজ মাষ্টার প্রচণ্ড আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে থাকে। ক্যাপ্টেন মারুফ রমিজ মাস্টারের দিকে খানিকটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে, তাকে উপর থেকে বলা হয়েছে ভাইরাসটি মস্তিষ্ককে আক্রান্ত করে, যারা আক্রান্ত হয় তারা অমানুষিক ভয় পেয়ে বিচিত্র কথা বলতে শুরু করে, এই মানুষটির ঠিক তাই হচ্ছে, নিশ্চয়ই সেই বিচিত্র ভাইরাসের কারণে। ক্যাপ্টেন মারুফ মানুষটির দিকে তাকিয়ে তবু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারে না, তার কেন জানি মনে হতে থাকে মানুষের এই ভয়টি মস্তিষ্কের রোগ নয়। মনে হয় এটি সত্যি।
রমিজ মাস্টার ক্যাপ্টেন মারুফের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার আপনারা যাবেন না? দেখতে যাবেন না? লোকটাকে বাঁচাতে যাবেন না?
ক্যাপ্টেন মারুফ প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়ে বলল, বাপ্যারটা আগে আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে। আপনি এখন আমাদের ঐ ভ্যানটার পিছনে গিয়ে বসেন।
জি না। আমি বসব না। আমার বাড়ি যেতে হবে।
আপনি এখন বাড়ি যেতে পারবেন না।
রমিজ মাস্টার অবাক হয়ে বলল কেন?
এই পুরো এলাকার সব মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
কেন?
একটা খুব খারাপ অসুখ ছড়িয়ে পড়ছে। একটা খারাপ ভাইরাস।
অসুখ? রমিজ মাস্টার মাথা নাড়ল, বলল, জি না স্যার। আমি এই এলাকার সব খবর জানি। এইখানে কোনো অসুখ নাই। কয়দিন থেকে আজব সব ব্যাপার হচ্ছে, কিন্তু কোনো অসুখ নাই।
ক্যাপ্টেন মারুফ ভুরু কুঁচকে বলল, আজব ব্যাপার?
জি। আজব ব্যাপার। একদিন এলাকার সব জন্তু–জানোয়ার খেপে গেল। একদিন কয়েকটা গাছের সব পাতা ঝরে গেল। এলাকার কিছু মানুষজন একেবারে নিখোঁজ হয়ে গেল। বিলের কাছে কী যেন হয় কেউ বুঝতে পারে না। রাত্রিবেলা চিকন একরকম শব্দ শোনা যায়। মানুষজন ভয় পায়–আজকে আমি দেখলাম ভয় পাওয়ার কারণটা কী।
ক্যাপ্টেন মারুফ মানুষটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, এবারে তার কথাবার্তাকে সত্যিই অসংলগ্ন মনে হচ্ছে। সে মোটামুটি শীতল গলায় বলল, আপনি ভ্যানটার পিছনে বসুন। এখন আপনি কোথাও যেতে পারবেন না।
কেন যেতে পারব না?
আপনাকে ভাইরাসে ধরেছে কি না আমাদের দেখতে হবে।
রমিজ মাস্টার ক্রুদ্ধ চোখে ক্যাপ্টেন মারুফের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি বসব না।
ক্যাপ্টেন মারুফ কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা দুই জন জওয়ানকে ইঙ্গিত করতেই তারা রমিজ মাস্টারকে ধরে জোর করে টেনে নিয়ে গেল। রমিজ মাস্টার চিৎকার করে বলল, আমি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, পাকিস্তান মিলিটারি পর্যন্ত আমার গায়ে হাত দিতে সাহস পায় নাই, আর আপনাদের এতবড় সাহস
ক্যাপ্টেন মারুফ রমিজ মাস্টারের কথা শুনে কেমন জানি লজ্জিত বোধ করল–সত্যিই তো তার কী অধিকার আছে একজন মানুষকে এভাবে হেনস্থা করার? সে লম্বা পায়ে এগিয়ে গেল, কাছাকাছি একটা সেন্ট্রাল কমান্ড বসানো হয়েছে, সেখানে যোগাযোগ করে উপরের লোকজনের সাথে একটু কথা বলা যেতে পারে।
ওয়াকিটকি দিয়ে ক্যাপ্টেন মারুফ যোগাযোগ করল, কমান্ডিং অফিসার রমিজ মাস্টারের কথা শুনেই শিস দেওয়ার মতো একটা শব্দ করে বলল, মানুষটাকে আটকে রাখ, আমরা আসছি।
ক্যাপ্টেন মারুফ একটু ইতস্তত করে বলল, স্যার, ইনি থাকতে চাইছেন না।
জোর করে আটকে রাখ। এটা খুব জরুরি।
সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের মাঝে একটা জিপের হেডলাইট দেখা গেল এবং জিপ থামার আগেই সেখান থেকে কমান্ডিং অফিসার লাফিয়ে নেমে এলেন। পিছন থেকে একজন বিদেশী মানুষ নেমে এল, ক্যাপ্টেন মারুফ মানুষটিকে আগে দেখে নি, সে ফ্রেড লিস্টার।
ক্যাপ্টেন মারুফের পিছু পিছু ফ্রেড লিস্টার এবং কমান্ডিং অফিসার ভ্যানের পিছনে রমিজ মাস্টারের কাছে হাজির হল। রমিজ মাস্টার চুপচাপ বসে আছে, তার মুখে এক ধরনের হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি। কমান্ডিং অফিসারকে দেখে কিছু একটা বলতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত থেমে গেল হঠাৎ করে বুঝতে পারল এখানে এদের সাথে কথা বলে কোনো লাভ নেই।
ফ্রেন্ড লিস্টার নিচু গলায় ইংরেজিতে কমান্ডিং অফিসারকে বলল, জিজ্ঞেস কর সে যে মূর্তিটা দেখেছে সেটি দেখতে কী রকম।
ক্যাপ্টেন মারুফ অবাক হয়ে ফ্রেন্ড লিস্টারের দিকে তাকাল, এটা যদি ভাইরাসের আক্রমণ হয়ে থাকে তা হলে কেন সে মূর্তির বর্ণনা জানতে চাইছে? রমিজ মাস্টারকে বাংলায় প্রশ্নটা করা হলে এক ধরনের অনিচ্ছা নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। কমান্ডিং অফিসারকে প্রত্যেকটা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিতে হল এবং ফ্রেড লিস্টার খুব গম্ভীর মুখে পুরোটা শুনে গেল। মৃর্তির শরীর থেকে একটা বিচিত্র জন্তু লাফিয়ে বের হওয়ার কথা বলতেই ফ্রেড লিস্টার হাত তুলে বলল, আর শোনার প্রয়োজন নেই একে এক্ষুনি কোয়ারেন্টাইন করতে হবে।