গলায় বসে থাকা পুরুষ্ট আরো একটা মশাকে থাবা দিয়ে চটকে দিতেই হান্নানের মনে হল সে কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেল। হান্নান সিগারেটটা হাতে আড়াল করে রেখে উঠে দাঁড়াল, ডান হাতে কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবারটা বের করে নেয়। রমিজ মাস্টার কি না সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি, ভুলে অন্য কাউকে খুন করে ফেলা মানে অহেতুক কয়টা গুলি খরচ। আজকাল গুলির অনেক দাম।
একজন মানুষ লম্বা পা ফেলে হেঁটে আসছে, হান্নান রমিজ মাস্টারকে কয়েকদিন থেকে লক্ষ করে আসছে, সে প্রায় নিঃসন্দেহ হয়ে গেল যে এটাই রমিজ মাস্টার। কাছাকাছি এলে একবার জিজ্ঞেস করে নেওয়া যাবে। হান্নান সিগারেটটা ফেলে দিল। গুলি করার সময় রিভলবারটা দুই হাতে ধরলে নিশানা ভালো হয়।
রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে থাকা হান্নানকে দেখে রমিজ মাস্টার যেরকম অবাক হবে ভেবেছিল সে কিন্তু সেরকম অবাক হল না। বেশ সহজ গলাতে বলল, কে? মাকসুদ আলী নাকি?
না। আমার নাম হান্নান।
ও।
আপনি কি রমিজ মাস্টার?
জি। আমি রমিজ মাস্টার। কেন?
হান্নান তখন দুই হাতে রিভলবারটা ধরে উঁচু করল। এ রকম সময় মানুষ ভয় পেয়ে দৌড় দেয়, তখন নিশানা ঠিক করে গুলি করতে হয়। যারা এই লাইনে নতুন তারা শরীরে গুলি করে, শরীর বড় তাই গুলি করা সোজা। কিন্তু শরীরে গুলি করলে মৃত্যুর কোনো গ্যারান্টি নেই, মাথায় গুলি লাগাতে পারলে এক শ ভাগ গ্যারান্টি। মানুষের শরীরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে মাথা।
রমিজ মাস্টার কিন্তু দৌড় দিল না, অবাক হয়ে হান্নানের দিকে তাকাল। হান্নান ট্রিগার টানতে গিয়ে থেমে গেল কারণ রমিজ মাস্টার আসলে হান্নানের দিকে তাকায় নি, হান্নানের। পিছন দিকে তাকিয়েছে। সেখানে কিছু একটা দেখে সে খুব অবাক হয়েছে। হান্নান খসখস করে কিছু একটা শব্দ শুনল, শব্দটা ভালো না। এই প্রথমবার তার বুকের মাঝে ধক করে। উঠল–এতদিন ধরে সে এই লাইনে কাজ করে আসছে কখনো এ রকম কিছু হয় নাই। রিভলবারটা দুই হাতে ধরে রেখে সে পিছনে ফিরে তাকাল এবং হঠাৎ করে তার সমস্ত শরীর পাথরের মতো জমে গেল।
তার থেকে চার–পাঁচ হাত দূরে বিচিত্র একটা মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, মূর্তিটি মানুষের না দানবের বোঝা যায় না। মূর্তিটির হাত পা মাথা নাক চোখ মুখ সবকিছুই আছে, কাজেই নিশ্চয়ই মানুষই হবে, কিন্তু দেখে মানুষ মনে হয় না। শরীরটি ধাতব, চোখ দুটি থেকে লাল আলো বের হচ্ছে। মাথাটুকু কেমন যেন ফুলে গিয়েছে, তার ভিতর থেকে কিলবিলে এক ধরনের অনেকগুলো ঔড় বের হয়ে এসেছে; সেগুলো আস্তে আস্তে নড়ছে। একটা হাত কাটা, সেখান থেকে এক ধরনের যন্ত্রপাতি বের হয়ে এসেছে। হান্নান আতঙ্কে চিৎকার করে বলল, কে? কে এটা?
সেই বিচিত্র মূর্তি কোনো শব্দ করল না, হান্নানের দিকে এক পা এগিয়ে এল। হান্নান তখন লক্ষ করল মূর্তিটির শরীরের ভিতরে কিছু একটা নড়ছে এবং গলার কাছাকাছি এসে হঠাৎ করে চামড়া ফুটো করে জীবন্ত কিছু বের হয়ে এল। প্রাণীটি একটা সরীসৃপের আকারের, কিন্তু পৃথিবীর কোনো পরিচিত প্রাণীর সাথে তার মিল নেই।
রাতজাগা পাখির মতো কর্কশ শব্দ করে সেই জীবন্ত প্রাণীটি ক্ষিপ্র পশুর মতো হান্নানের ওপর লাফিয়ে পড়ল। হান্নান তার রিভলবার দিয়ে প্রাণীটাকে গুলি করে, বুলেটের আঘাতে সেটি থমকে দাঁড়ায় কিন্তু থেমে যায় না। প্রাণীটি হান্নানের বুকের ওপর চেপে বসে এবং কিছু বোঝার আগেই তার শরীর ফুটো করে ভিতরে ঢুকে যেতে শুরু করে। প্রচণ্ড আতঙ্কে হান্নান চিৎকার করতে থাকে কিন্তু কেউ তার চিৎকার শুনে এগিয়ে আসে না।
রমিজ মাস্টার হঠাৎ করে সংবিৎ ফিরে পেল। সে ভয় পেয়ে পিছনে দুই পা সরে আসে তারপর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে। হান্নানের চিৎকার ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হতে থাকে, কিন্তু রমিজ মাস্টার তবুও থামার সাহস পায় না।
.
ক্যাপ্টেন মারুফ জিপ থেকে নেমে তার সাথে আসা মিলিটারি জওয়ানদের রাস্তাটি ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলল। একটু আগে তার কাছে নির্দেশ এসেছে এই এলাকাটা ঘিরে ফেলতে। এখানে একটা খুব খারাপ ভাইরাসের আউটব্রেক হয়েছে, সব মানুষকে সরিয়ে নিতে হবে। তার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, যতক্ষণ পুরোপুরি কাজ শুরু করা না হয় তাকে এই এলাকাটি চোখে চোখে রাখতে বলা হয়েছে। ভাইরাসটি এবোলা ভাইরাসের মতো, তবে সংক্রমণ শুরু হয় মস্তিষ্ক থেকে। যাদের সংক্রমণ হয় তারা এক ধরনের আতঙ্কে অস্থির হয়ে যায়, ভূত দানব দেখেছে বলে দাবি করতে থাকে। ক্যাপ্টেন মারুফকে বিশেষ করে বলে দেওয়া হয়েছে সেরকম মানুষ দেখলে তাকে যেন আলাদা করে আটকে রাখা হয়।
ক্যাপ্টেন মারুফ তার নির্দেশমতো রাতের অন্ধকারে রাস্তাটি ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু সে কিছু হিসাব মিলাতে পারছে না। সে বইপত্র পড়ে, এবোলা ভাইরাস নিয়েও পড়াশোনা করেছে–এই ভাইরাসের সংক্রমণ হলে মানুষের মস্তিষ্ক থেকে সংক্রমণ হয় না। পুরো শরীরে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যায়। এবোলা ভাইরাস আফ্রিকায় শুরু হয়েছে, বাংলাদেশে নয়। তা ছাড়া ভাইরাসের সংক্রমণ হলে খবরের কাগজে তার খবর ছাপা হত, এখানকার। হাসপাতালে রোগী যেত, ডাক্তারেরা বলত কিন্তু সেরকম কিছু হয় নি। সামরিক বাহিনী হিসেবে তারা আলাদা থাকে কিন্তু এখন হঠাৎ মনে হচ্ছে কিছু বিদেশী এই পুরো ব্যাপারটি নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমেরিকার বড় বড় কিছু হারকিউলেস পরিবহন বিমান এসেছে ভিতর থেকে বিদঘুঁটে হেলিকপ্টার নামানো হচ্ছে। বিচিত্র যন্ত্রপাতি নিয়ে আসা হচ্ছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য আমেরিকার মানুষের এত দরদ কেন? আগে তো কখনো হয় নি।