নিশীতা উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, দেখেছেন?
রিয়াজ হাত নেড়ে বলল, দেখেছি, কিন্তু আগেই এত উত্তেজিত হয়ো না। আমি যেটা বলছি সেটা হচ্ছে হার্ডওয়্যার ব্যবহার করে কিছু একটা করার সম্ভব-অসম্ভবের কথা। সত্যি সত্যি সেটা করার মতো বুদ্ধিমত্তা এপসিলনের নেই, আমার কোনো কম্পিউটারেরও নেই।
কিন্তু আপনি দেখতে পাচ্ছেন সেটা ঘটেছে।
সেটা ঘটে নি। রিয়াজ একটু অধৈর্য হয়ে বলল, তুমি যেটা বলছ সেটা অসম্ভব। অনেকটা যেন আমি একটা কাগজের প্লেন ছুঁড়েছি–সেটা তিন শ প্যাসেঞ্জার নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে নিউইয়র্কে ল্যান্ড করে গেছে।
নিশীতা হাত দিয়ে তার চুলকে পিছনে সরিয়ে বলল, আপনি এপসিলনকে জিজ্ঞেস করে দেখেন।
রিয়াজ হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, তোমার যদি জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে করে তুমি করে দেখো–আমি করছি না। এপসিলনকে প্রশ্ন করা আর আমার মাইক্রোওয়েভ ওভেনকে জিজ্ঞেস করা একই কথা!
নিশীতা মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায়? এপসিলন কোথায়?
রিয়াজ হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, ঐ যে ওদিকে।
নিশীতা এগিয়ে যেতে শুরু করতেই রিয়াজ বলল, নিশীতা তুমি ছেলেমানুষি কাজটা শুরু করার আগে তোমার পত্রিকা অফিসে ফোন করে বল। তারা তোমার লিড নিউজের জন্য বসে আছে।
নিশীতা হেসে বলল, না, বসে নেই।
কেন বসে নেই? তুমি যে ফাইনাল পেস্টিং বন্ধ করে রাখতে বললে?
নিশীতা খিলখিল করে হেসে বলল, কেমন করে বলব, আমার টেলিফোনের ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে। আমি ওদের সাথে কথা বলি নি, কথা বলার ভান করছিলাম।
রিয়াজ হাসান চোখ কপালে তুলে বলল, কী বললে? ভান করছিলে? আসলে কারো সাথে কথা বল নি?
না। আমাদের সাংবাদিকদের এ রকম আরো অনেক ট্রিকস্ আছে, সময় হলেই দেখবেন!
রিয়াজ হাসান খানিকক্ষণ নিশীতার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হাসতে শুরু করল নিশীতা ততক্ষণে মনিটরটির সামনে পৌঁছে গেছে, এপসিলনের চেহারা ফুটে উঠেছে, সেটি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কে, কে হাসে?
তুমি জান না কে হাসছে?
এপসিলন খানিকক্ষণ নিশীতার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, জানি।
রিয়াজ হাসান হঠাৎ হাসি থামিয়ে অবাক হয়ে নিশীতার দিকে তাকাল। নিশীতা বলল, কী হয়েছে?
রিয়াজ নিশীতার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রায় ছুটে এসে মনিটরটির সামনে দাঁড়াল, বিস্ফারিত চোখে এপসিলনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বললে এপসিলন?
এপসিলন কোনো কথা না বলে চোখ ঘুরিয়ে রিয়াজের দিকে তাকাল। নিশীতা একটু অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে ড. হাসান?
রিয়াজ হতচকিতের মতো নিশীতার দিকে তাকিয়ে বলল, এটি এপসিলন নয়।
কেন?
কারণ এপসিলন সব সময় প্রশ্নের উত্তর দেয় প্রশ্ন দিয়ে। এটি দেয় নি।
তা হলে এটি কে? রিয়াজ ঘুরে এপসিলনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি জানি না।
» ০৫. হান্নান গালে বসে থাকা
হান্নান গালে বসে থাকা একটা মশাকে থাবা দিয়ে মেরে চটকে ফেলল, জায়গাটা অন্ধকার বলে দেখতে পেল না মশাটা তার রক্ত খেয়ে পুরুষ্ট হয়েছিল, গালে সেই রক্তের দাগ লেগেছে। হান্নানের শরীরে অনুভূতি সেরকম তীক্ষ্ণ নয়, মশা কামড়ালে প্রায় সময়েই টের পায় না; গালের চামড়া নরম বলে মাঝে মাঝে বুঝতে পারে। হান্নান একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে আছে গত আধঘণ্টা থেকে, আরো কতক্ষণ বসে থাকতে হবে জানে না। তাকে সাড়ে তিন হাজার টাকার চুক্তিতে ঠিক করা হয়েছে রমিজ মাস্টারকে খুন করার জন্য। রমিজ মাস্টার রাত্রিবেলা বাজারে চায়ের দোকানে চা খেতে যায়, সেখানে একটা ছোট টেলিভিশন আছে, টেলিভিশনে বাংলা খবর শুনে বাড়িতে ফিরে আসে। মোটামুটি রুটিনমাফিক–কাজেই হান্নানের সুবিধে হল। একজন মানুষকে নিরিবিলি পাওয়াটাই কঠিন, খুন করাটা পানির মতো সোজা। আজকাল হান্নানের একটা গুলিতেই কাজ হয়ে যায়। সে অবশ্য তবু আরো দুইটা গুলি খরচ করে। গুলির দাম আছে বাজে খরচ করা ঠিক না। রিভলবারটা অবশ্য তার নিজের, অনেক কষ্ট করে যোগাড় করেছে। হান্নান এক ধরনের স্নেহ নিয়ে কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবারটার গায়ে হাত বুলিয়ে দেখল, চাইনিজ রিভলবার খুব বিশ্বস্ত জিনিস, তার রুজি–রোজগারের এক নম্বর অবলম্বন। এই লাইনে কাজ অনেক বেড়েছে কিন্তু উপার্জন সেরকম বাড়ে নি। আগে হলে এই রকম একটা খুন করার জন্য সে চোখ বুজে দশ হাজার টাকা চাইতে পারত, এখন পুঁচকে পুঁচকে মস্তানে দেশ ভরে গেছে। দুই শ টাকাতেই কাজ সেরে ফেলতে চায়–অভিজ্ঞতা নাই, লোভ বেশি। তবে নূতন মস্তানরা কাজকর্ম গুছিয়ে করতে পারে না বলে লোকজন এখনো তার কাছে আসে। আগে। বেশিরভাগ কেস ছিল জমি নিয়ে শত্রুতা, আজকাল সেটা হয়েছে রাজনীতি। রমিজ মাস্টারও রাজনীতির কেস–মনে হয় ইউনিয়ন ইলেকশনের ব্যাপার, হান্নান অবশ্য মাথা ঘামায় না, তার টাকা পেলেই হল!
হান্নান পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে এদিক–সেদিক তাকিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। হাত দিয়ে সিগারেটের আগুন ঢেকে সে একটা লম্বা টান দিল, সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছে, রমিজ মাস্টার দশ–পনের মিনিটের মাঝেই এসে যাবে। হান্নান নিজের ভিতরে কোনো উত্তেজনা অনুভব করে না। মানুষ তো আর সারা জীবন বেঁচে থাকে না, আগে হোক পরে হোক মারা যাবেই। গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়, রোগশোকে মারা যায় না হয় তার হাতেই মারা গেল। হান্নান আজকাল আর ঠিক করে হিসাব রাখে না– তার হাতে কত জন মারা গেল। হিসাব রেখে কী হবে?