আমি সাবধানে একটা আরামদায়ক চেয়ারে বসতেই আমার শরীরের ভিতর দিয়ে স্বল্প কম্পনের একটি তরঙ্গ আসা যাওয়া করতে থাকে এবং এক ধরণের আরামে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায়। মেয়েটি হাসি হাসি মুখে বলল, ব্যাপারটি প্রায় অবিশ্বাস্য কিন্তু সত্যি তুমি আমাকে চেনো না। আমি মিয়ারা–
আমি মাথা নেড়ে বললাম, তোমার সাথে পরিচিত হয়ে সুখী হলাম মিয়ারা।
মিয়ারা শব্দ করে হেসে বলল, তুমি আসলে সুখী হও নি কিহা। ভদ্রতার জন্যে অবশ্যি এই ধরনের একটি দুটি কথা আমি শুনতে রাজি আছি। তবে এমনিতে আমি স্পষ্ট কথা বলতে এবং শুনতে ভালবাসি।
চমৎকার। আমি গলার স্বর এতটুকু উঁচু না করে বললাম, আমি তোমাকে স্পষ্ট করেই বলে দিই। আমি বিশ্বাস করি প্রতিটি মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। আমি পৃথিবীতে না পৌঁছানো পর্যন্ত শীতলঘরে গিয়ে ঘুমাতে চাই।
মিয়ারার মুখ হঠাৎ কঠিন হয়ে আসে এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি হঠাৎ আমি বুকের ভিতরে ভয়ের এক ধরনের কাঁপুনি অনুভব করি। মিয়ারা জিভ দিয়ে তার রঙ করা টকটকে লাল ঠোটকে ভিজিয়ে বলল, কার কোথায় কতটুকু অধিকার সেটা একেক সময় একেকভাবে ঠিক করা হয়। এখন আমার আওতার মাঝে যারা আছে তাদের জন্যে আমি ঠিক করছি। তোমার বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে আট–আমার থেকে এক মাত্রা বেশি, কাজেই আমি অহেতুক সময় নষ্ট না করে সোজাসুজি কাজের কথায় চলে আসি। মিয়ারা আমার উপর থেকে চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, তোমাকে আমি একটি সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দিতে চাই। আমি আশা করছি তুমি স্বেচ্ছায় সেটা সমাধান করবে।
যদি না করি?
মিয়ারা আমার দিকে তাকিয়ে সহৃদয় ভাবে হেসে বলল, অবশ্যি করবে। কারণ যদি না কর তাহলে তোমার খুলি থেকে মস্তিষ্কটি বের করে সেটাকে একটা সাইবার কন্ট্রোলে ব্যবহার করা হবে। কিছুক্ষণ হল সেই কাজে দক্ষ একটা রবোটকে আমি অনেক দাম দিয়ে কিনেছি–তার নাকি এই ধরনের একটা অস্ত্রোপাচার করার জন্যে হাত নিশপিশ করছে!
আমি স্থির দৃষ্টিতে মিয়ারার দিকে তাকালাম, মিয়ারা চোখ ফিরিয়ে না নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে ক্লান্ত গলায় বললাম, কেন তোমরা এসব করছ মিয়ারা?
মিয়ারা কোনো কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি নিচু গলায় বললাম, তুমি নিশ্চয়ই বলবে যে তুমি যদি না কর সেটা অন্য একজন করবে। তুমি যদি একজনকে ক্রীতদাস হিসেবে কিনে না আন তাহলে অন্য কেউ তোমাকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেবে
মিয়ারা আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল–আমি মাথা নেড়ে বললাম, না। তুমি কেন দেখতে পাচ্ছ না যে এটা একটা খেলা। কেউ একজন তোমাদের নিয়ে খেলছে।
মিয়ারা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ। আমি জানি। কিন্তু এই খেলার কোনো দর্শক নেই কিহা। সবাই খেলোয়াড়। তোমাকেও খেলতে হবে। তুমি পাশের ঘরে যাও। তোমাকে বায়ো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে কিছু উত্তেজক সিরাম দেয়া হবে, তোমাকে দেখে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে, এখানে ক্লান্তির কোনো সময় নেই কিহা। ক্লান্ত হলেই পিছিয়ে পড়তে হয়–পিছিয়ে পড়লেই শেষ।
আমি মিয়ারার দিকে তাকালাম, তার পাথরের মতো চোখে কোনো রকম ভাবালুতা নেই। পরিবেশ কী দ্রুতই না মানুষকে পাল্টে দিতে পারে!
আমি দরজার সামনে দাড়াতেই দরজাটা খুলে গেল। ভিতরে আবছা অন্ধকার, আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই একজন আমার দিকে ছুটে এল। এলোমেলো চুলের একটি ভয়ার্ত মেয়ে। মেয়েটি কাঁপা গলায় বলল, কি তোমাকেও এনেছে?
আমি আবছা অন্ধকারে মেয়েটিকে ভাল করে দেখার চেষ্টা করতে করতে বললাম, কে?
আমি লেন।
লেন, তুমি? আমার আরো কিছু একটা বলার ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু কী বলব কিছুতেই ভেবে বের করতে পারলাম না।
৩. চতুর্থ প্রজাতির একটি রবোট
চতুর্থ প্রজাতির একটি রবোট আমার এবং লেনের কাছে এসে মাথা নুইয়ে সম্মান প্রদর্শন করে বলল, আমার নাম ত্রিনি। আপনাদের দুজনের দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করার জন্যে আমাকে পাঠানো হয়েছে।
আমি ত্রিনির দিকে এক নজর তাকিয়ে বললাম, আমাকে আর লেনকে এই মাত্র রিটালিন-৪০০ দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ সময়ের জন্যে আমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকবে না। ঘুম পাবে না–এমন কী বাথরুমেও যেতে হবে না। দৈনন্দিন কাজের বাকি থাকল কী?
ত্রিনি আবার মাথা নুইয়ে বলল, আপনাদের দুজনকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেটা পালন করার জন্যে আপনাদের নানা ধরনের তথ্য প্রয়োজন হতে পারে–
তোমাদের মূল তথ্যকেন্দ্রে আমাকে নিয়ে গেলেই আমি নেটওয়ার্ক দিয়ে সব তথ্য পেয়ে যাব। তোমাকে আমাদের প্রয়োজন হবে না। তুমি যেতে পার তিনি। একটি রবোট আমার কাছে ঘুর ঘুর করলে আমার ভাল লাগে না।
মহামান্য কিহা, রবোটের সাহচর্য আপনার ভাল লাগে না শুনে আমি দুঃখিত। কিন্তু
তুমি মোটেও দুঃখিত নও তিনি। চতুর্থ প্রজাতি রবোট দুঃখ অনুভব করতে পারে না। তুমি সোজাসুজি সত্যি কথাটি বলে ফেল।
ত্রিনি এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, আমাকে আপনাদের নিরাপত্তার জন্যে রাখা হয়েছে। এখান থেকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে আপনারা যেন কোনোভাবে নিজেদের বিপদগ্রস্ত না করেন–
লেন শব্দ করে হেসে বলল, তুমি আমাদের চোখে চোখে রাখবে যেন আমরা পালিয়ে না যাই?
আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন মহামান্যা লেন। মহামান্যা মিয়ারার এই আবাসস্থলটি অদৃশ্য লেজার রশ্মি এবং শক্তি-বলয় দিয়ে প্রতিরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এখানে প্রবেশ করতে চাইলে কিংবা বের হতে চাইলে আপনাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।