- বইয়ের নামঃ নয় নয় শূন্য তিন
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. রিশান পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে
রিশান পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে নিচে তাকাল, যতদূর চোখ যায় ততদূর বিস্তৃত এক বিশাল অরণ্য, সবুজ দেবদারু গাছ ঝোঁপঝাড় লতাগুল্ম জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। উপর থেকে এই বিশাল অরণ্যরাজিকে মনে হচ্ছে একটি সবুজ কার্পেট, কেউ যেন নিচে গভীর উপত্যকায় খুব যত্ন করে বিছিয়ে রেখেছে। দূরে পর্বতমালার সারি, প্রথমে গাঢ় নীল, তার পিছনে হালকা নীল, আরো দূরে ধূসর রং হয়ে দিগন্তে মিশে গেছে। কাছাকাছি উঁচু একটা পাহাড়ের চূড়ায় সাদা খানিকটা মেঘ আটকা পড়ে আছে, এ ছাড়া আকাশে কোথাও কোনো মেঘের চিহ্ন নেই, স্বচ্ছ নীল রঙের আকাশ যেন পৃথিবীকে স্পর্শ করার চেষ্টা করছে। পাহাড়ের পাদদেশে যে বুনো নদীটি পাথর থেকে পাথরে ভয়ঙ্কর গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল, এই চুড়ো থেকে সেই নদীটিকেই মনে হচ্ছে একটি শান্ত স্রোতধারা। চারদিকে এক ধরনের আশ্চর্য নীরবতা, কান পাতলে গাছের পাতার মৃদু শব্দ, ঝরনার ক্ষীণ গুঞ্জন বা বন্য পাখির অস্পষ্ট কলরব শোনা যায়। কিন্তু সেসব পাহাড়ের চূড়ায় এই আশ্চর্য নীরবতাকে স্পর্শ করে না। রিশান প্রকৃতির প্রায় এই নির্লজ্জ সৌন্দর্যের দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। সে গ্রহ থেকে গ্রহে, উপগ্রহ থেকে উপগ্রহে ঘুরে বেড়িয়েছে, মহাকাশের গভীরে হানা দিয়েছে, সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে পার হয়ে গেছে; কিন্তু নিজের পৃথিবীর এই বিস্ময়কর সৌন্দর্যের দিকে কখনো চোখ মেলে তাকায় নি। মাটির পৃথিবীতে যে এত রহস্য লুকিয়ে আছে কে জানত?
রিশান ঘাড় থেকে তার ছোট ঝোলাটি নামিয়ে রেখে একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে। যে প্রচণ্ড প্রাণশক্তি নিয়ে সে জীবনের বড় অংশ পাড়ি দিয়ে এসেছে সেই প্রাণশক্তি কি এখন অকুলান হতে শুরু করেছে? বুকের ভিতরে কোথায় যেন এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করে, এক ধরনের অপূর্ণতা এক ধরনের চাপা অভিমান কোথায় জানি যন্ত্রণার মতো জেগে উঠতে শুরু করে। মনে হতে থাকে জীবনের সব চাওয়া পাওয়া সব সাফল্য ব্যর্থতা আসলে অর্থহীন। এই নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় প্রাচীন একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে–থেকেই বুঝি জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে হয়
রিশান একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে তার পা দুটি ছড়িয়ে দিল, আর ঠিক তখন তার হাতের কব্জিতে বাঁধা যোগাযোগ মডিউলটিতে একটা মৃদু কম্পন আর সাথে সাথে উচ্চ কম্পনের একটা তীক্ষ্ণ কিন্তু নিচু শব্দ শোনা যায়। রিশান মডিউলটির দিকে তাকাল। একটি লাল আলো নিয়মিত বিরতি দিয়ে জ্বলছে এবং নিভছে, কেউ একজন তার সাথে কথা বলতে চায়। উপরের লাল বোতামটি স্পর্শ করে সে ইচ্ছে করলেই কথা বলার অনুমতিটি প্রত্যাখ্যান করতে পারে; কিন্তু তার দীর্ঘদিনের সুশৃঙ্খল জীবনের অভ্যাস তাকে লাল বোতামটি স্পর্শ করতে দিল না, সে নিচু গলায় অনুমতি দিল। সাথে সাথে তার চোখের সামনে ত্রিমাত্রিক একটি ছবি ভেসে আসে, সুসজ্জিত অফিসঘরে সুদৃশ্য ডেস্কের সামনে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ উবু হয়ে বসে আছে। মানুষটির মুখ ভাবলেশহীন, শুধুমাত্র হাতের উপর লাল তারাটি বুঝিয়ে দিচ্ছে সে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। নির্জন পাহাড়ের চুড়োয় হলোগ্রাফিক এই দৃশ্যটি এত বেমানান দেখাতে থাকে যে রিশান প্রায় নিজের অজান্তেই মাথা নাড়তে শুরু করে। সরকারি কর্মচারীটি মাথা ঘুরিয়ে রিশানকে দেখতে পেল এবং সাথে সাথে তার ভাবলেশহীন মুখে বিস্ময়ের একটা সূক্ষ্ম ছাপ পড়ে। মানুষটি অভিবাদন করে যখন কথা বলল তার কণ্ঠস্বরে কিন্তু বিস্ময়টুকু প্রকাশ পেল না। খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, রিশান, আমি মহাজাগতিক কেন্দ্রের মূল দফতর থেকে বলছি, একটা বিশেষ প্রয়োজনে তোমার সাথে আমার কথা বলা প্রয়োজন। তোমার হাতে কি সময় আছে?
এটি একটি সৌজন্যমূলক কথা, রিশান খুব ভালো করে জানে তার সময় না থাকলেও এখন কথা বলতে হবে। সে মানুষটির চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, কী কথা?
কয়েকদিনের মাঝে কিছু মহাকাশচারী একটি তথ্যানুসন্ধানী মিশনে যাচ্ছে। গুরুত্ব মাত্রায় পঞ্চম স্তরের অভিযান। বিশেষ কারণে মহাকাশচারীদের মাঝে একটু রদবদল করা হয়েছে। সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে যার যাবার কথা ছিল তাকে অপসারণ করে সেখানে তোমাকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
আমাকে?
হ্যাঁ।
আমি পঞ্চম মাত্রার অভিযানের উপযুক্ত মহাকাশচারী নই।
তুমি যদি রাজি থাক সদর দফতর থেকে তোমাকে প্রয়োজনীয় যোগ্যতার সনদ দেয়া হবে।
রিশান উচ্চপদস্থ এই সরকারি কর্মচারীটির দিকে তাকাল। মানুষটি সম্ভবত সুদর্শন, কিন্তু হলোগ্রাফিক ছবিতে কিছু একটা অবাস্তব ব্যাপার রয়েছে যার কারণে মানুষের চেহারার সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো কখনো ঠিক করে ধরা পড়ে না। মানুষটি উত্তরের অপেক্ষায় তার দিকে তাকিয়ে আছে, যদিও সম্ভবত সে খুব ভালো করেই জানে সে কী বলবে। পঞ্চম স্তরের অভিযানে যাওয়ার সৌভাগ্য খুব কম মহাকাশচারীর জীবনেই এসেছে, স্বেচ্ছায় কেউ কখনো সেই সুযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে বলে মনে হয় না। রিশানের হঠাৎ ইচ্ছে হল সে মাথা নেড়ে বলবে, না আমি যেতে চাই না। হাতে লাল তারা লাগানো এই মানুষটি তখন নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে তাকাবে তারপর ইতস্তত করে বলবে, কেন তুমি যেতে চাও না? রিশান তখন খুব সরল মুখ করে বলবে, আমি গ্রহ থেকে গ্রহে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেছি, আমার এখন বিশ্রাম দরকার। আমি এই নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় একা একা বসে বহুদূরে দেবদারু গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে চাই। বাতাসের শব্দ শুনতে শুনতে ঝরনার পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে চাই। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের খেলা দেখতে চাই। যখন অন্ধকার নেমে আসবে তখন তাপনিরোধক পোশাকে নিজেকে মুড়ে ফেলে আকাশের নক্ষত্র গুনতে চাই।
কিন্তু রিশান সেসব কিছু বলল না। তার সুদীর্ঘ সুশৃঙ্খল জীবনে সে নিয়মের বাইরে কিছু করে নি, এবারেও করল না। নরম গলায় বলল, পঞ্চম মাত্রার অভিযানে যাওয়া আমার জন্যে একটা অভাবনীয় সুযোগ। আমাকে সেই সুযোগ দেয়ার জন্যে আমি মহাকাশ কেন্দ্রের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
আমি কি তোমাকে নিয়ে যাবার জন্যে এখানে একটা ছোট বাই ভার্বাল পাঠাব?
রিশান পাহাড়ি নদীটির দিকে তাকিয়ে বলল, না এখানে নয়। আমি ঘণ্টা দুয়েকের মাঝে এই পাহাড় থেকে নেমে যাব। নিচে একটি ছোট লোকালয় আছে, আমাকে তার কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে তুলে নিলেই হবে।
উচ্চপদস্থ মানুষটি হলোগ্রাফিক স্ক্রিন থেকে বিস্মিত হয়ে রিশানের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না। রিশান প্রায় কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলল, এখানে একটি বাই ভার্বালকে অত্যন্ত বিসদৃশ দেখাবে।
নিয়ম অনুযায়ী এই মানুষটির নিজে থেকে বিদায় নেবার কথা, কিন্তু রিশান সেজন্যে অপেক্ষা করল না। তাকে বিদায় জানিয়ে কব্জিতে বাধা যোগাযোগ মডিউলটি স্পর্শ করে তাকে অদৃশ্য করে দিল। রিশান একটি নিশ্বাস ফেলে হাত দিয়ে একবার মাটিকে স্পর্শ করল। আবার তাকে এই মাটির পৃথিবীকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। মহাকাশে ছুটে ছুটে সে। তার জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। মহাকাশচারীর জীবন বড় নিঃসঙ্গ, এক একটি অভিযান শেষ করে যখন তারা পৃথিবীতে ফিরে আসে, তারা অবাক হয়ে দেখে পৃথিবীতে শতাব্দী পার হয়ে গেছে। পরিচিতেরা কেউ নেই, প্রিয়জনেরা শীতলঘরে, ভালবাসার মেয়েটির দেহ জরাগ্রস্ত, মুখে বার্ধক্যের বলিরেখা। শহর নগর পাল্টে গিয়েছে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়, মানুষের মুখের ভাষায় দুর্বোধ্য জটিলতা। শুধু যে জিনিসটি পাল্টে নি সেটি হচ্ছে পর্বতমালা বিশাল অরণ্য আর নীল আকাশ। রিশান আজকাল তাই ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে এই পর্বতমালার খোঁজে, নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় বসে খুঁজে পেতে চেষ্টা করে তাঁর হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীকে। শৈশব কৈশোর আর যৌবনে যেই প্রকৃতিকে অবহেলায় দূরে সরিয়ে রেখেছে এখন তার জন্যে বুকের ভিতর জন্ম নিচ্ছে গভীর ভালবাসা।
রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে একমুঠো মাটি তুলে এনে তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সিলিকনের এই যৌগ কী বিচিত্র রহস্যের জন্ম দিয়েছে পৃথিবীতে! প্রাণ নামে এই অবিশ্বাস্য রহস্য কি আছে আর কোথাও?
০২. হলঘরটি বিশাল
হলঘরটি বিশাল, রিশান উপরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়, ছাদ প্রায় দেখা যায় না! বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভিতরে এত বড় একটা ঘর রয়ে গেছে। ঘরের মাঝখানে কালো গ্রানাইটের একটা টেবিল। টেবিলের চারপাশে সুদৃশ্য চেয়ার, চেয়ারের হাতলে যোগাযোগ মডিউলের জটিল মনিটর। ঘরের মাঝে এক ধরনের নরম আলো, সতেজ বাতাস। চোখ বন্ধ করলে মনে হয় বদ্ধ ঘরে নয়, বুঝি সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। রিশান হেঁটে তার জন্যে আলাদা করে রাখা চেয়ারটিতে বসল। সাথে সাথে কানের কাছে কিছু একটা ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করে, মহামান্য রিশান, আমার নাম কিটি, আপনাকে আমি আজকের এই সভাকক্ষ থেকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। সবার আগে আমি আপনাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। আপনার বাম পাশে বসেছেন নিডিয়া। নিডিয়ার পাশে যিনি বসেছেন তার নাম। হান। টেবিলের অন্য পাশে বসেছেন বিটি এবং ষুন। যিনি এখনো আসেন নি তিনি হচ্ছেন দলপতি লি–রয়। মহাকাশ অভিযানে তার অভিজ্ঞতা অভূতপূর্ব। লি–রয় তিন তারকার অধিকারী হয়েছেন অত্যন্ত অল্প বয়সে। তিনি যেরকম দুঃসাহসী ঠিক সেরকম তার ধীশক্তি। অত্যন্ত প্রখর তার বুদ্ধিমত্তা…
রিশান চেয়ারের হাতল খুঁজে যোগাযোগ মডিউলের লাল বোতামটি চেপে ধরতেই কথা বন্ধ হয়ে গেল। যন্ত্রপাতির কথা শুনতে তার ভালো লাগে না। বিশেষ করে সেই কথাবার্তায় যদি মানুষের আবেগের ভান করা হয় সেটা সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না।
রিশান ভিসুয়াল মনিটরটির দিকে এক নজর তাকিয়ে এই টেবিলের মানুষগুলোর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিয়ে মাথা তুলে তাকাল। সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে সে ঠিক কাউকে উদ্দেশ্য না করে বলল, আমি রিশান, তোমরা নিশ্চয়ই এতদিনে খবর পেয়েছ আমি তোমাদের সাথে যাচ্ছি। টেবিলের অন্য পাশে বসে থাকা বিটি নামের সোনালি চুলের মেয়েটি হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, আমরা সেটা জানি। আমরা সবাই আগ্রহ নিয়ে তোমার সাথে পরিচিত হবার জন্যে অপেক্ষা করছি।
রিশান মাথা নেড়ে বলল, সেটা সত্যি হবার কথা নয়, তোমরা নিশ্চয়ই এতদিনে আমার ফাইলটি পড়ার সুযোগ পেয়েছ এবং ইতিমধ্যে জেনে গেছ আমি নেহাত সাদাসিধে কাটখোট্টা মানুষ।
টেবিলে বসে থাকা লাল চুলের ককেশীয় চেহারার মানুষটি মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ি অন্যমনস্কভাবে চুলকাতে চুলকাতে বলল, আমার নাম হান, কাটখোট্টা মানুষদের যদি প্রতিযোগিতা হয় আমি মোটামুটি নিশ্চিত তোমাকে দশ পয়েন্টে হারিয়ে দেব।
বিটি নামের সোনালি চুলের মেয়েটি শব্দ করে হেসে বলল, রিশান, হান একটুও বাড়িয়ে বলছে না। বিনয় জাতীয় মানবিক গুণাবলি খুব যত্ন করে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
হান বিটির দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আমরা একটা মহাকাশ অভিযানে যাচ্ছি, ধর্ম প্রচারে তো যাচ্ছি না, মানবিক গুণাবলির বিকাশ যদি না ঘটে তোমার খুব আপত্তি আছে?
বিটি দুই হাত সামনে তুলে বলল, কিছু আপত্তি নেই।
রিশান হান এবং বিটির কথাপকথন খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল এবং দুজন একটু থামতেই গলার স্বরে একটু গুরুত্ব ফুটিয়ে বলল, তোমরা কী বলবে জানি না, আমি কিন্তু এই অভিযানটিতে এর মাঝে একটা বিশেষত্ব লক্ষ করতে শুরু করেছি।
টেবিলে বসে থাকা চার জনই রিশানের দিকে ঘুরে তাকাল। পাশে বসে থাকা কোমল চেহারার মেয়েটি বলল, তুমি কী বিশেষত্ব খুঁজে পেয়েছ?
আমি আগে যেসব মহাকাশ অভিযানে গিয়েছি সেখানে সবসময় ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মানুষকে একসাথে পাঠানো হত। কেউ পদার্থবিজ্ঞানী কেউ জীববিজ্ঞানী কেউ ইঞ্জিনিয়ার
নিডিয়া নামের কোমল চেহারার মেয়েটি রিশানকে বাধা দিয়ে বলল, কিন্তু তথ্য তো আজকাল আর মানুষের মস্তিষ্কে পাঠানো হয় না; সে জন্যে শক্তিশালী কপোট্রন, কম্পিউটার, রবোট, ডাটাবেস এসব রয়েছে। এখন মানুষকে পাঠানো হয় তার মানবিক দায়িত্বের। জন্যে
তুমি সেটা ঠিকই বলেছ নিডিয়া। রিশান মাথা নেড়ে বলল, আমিও ঠিক একই কথা বলছি। মহাকাশ অভিযানে মানুষের দায়িত্ব হয় মানবিক। দলটি এমনভাবে তৈরি করা হয়। যেন কেউ খুব কঠোর, কেউ অবিশ্বাস্য সুশৃঙ্খল, কেউ আশ্চর্যরকম কোমল, কেউ বা খেয়ালি। দেখা গেছে দীর্ঘকাল একসাথে কাজ করার জন্যে এ রকম ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মানুষের একটি দল খুব চমৎকারভাবে কাজ করে। আমি নিজে একাধিকবার এ রকম অভিযানে গিয়েছি, অসম্ভব দুঃসহ সব অভিযান কিন্তু আমরা কখনো ভেঙে পড়ি নি, তার একটি মাত্র কারণ–আমরা ছিলাম ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মানুষ। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কী জান?
কী?
আমাদের এই দলটিতে আমরা সবাই মোটামুটি একই ধরনের মানুষ।
নিডিয়া ভুরু কুঁচকে বলল, সেটি কী ধরনের?
আমরা সবাই মোটামুটি কঠোর প্রকৃতির মানুষ আমি তোমাদের সবার ফাইল দেখেছি, তোমরা সবাই কোনো–না–কোনো অভিযানে অত্যন্ত কঠোর পরিবেশে পড়েছ এবং সবচেয়ে বড় কথা সেইসব পরিবেশে খুব কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছ।
কেউ কোনো কথা বলল না কিন্তু সবাই স্থির দৃষ্টিতে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল। রিশান খানিকক্ষণ তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, সেইসব কঠোর সিদ্ধান্ত সময় সময় ছিল নিষ্ঠুর, অমানবিক। আমি নিশ্চিত তোমরা সেইসব কথা ভুলে থাকতে চাও।
হান মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, তুমি কী বলতে চাও রিশান?
তুমি জান আমি কী বলতে চাই।
তবু তোমার মুখে শুনি।
আমার ধারণা মহাকাশ অভিযানের কেন্দ্রীয় দফতর ইচ্ছে করে এ রকম একটি দল তৈরি করেছে। আমাদের ব্যবহার করে তারা খুব একটি নিষ্ঠুর কাজ করাবে।
ষুন এতক্ষণ সবার কথা শুনে যাচ্ছিল, এই প্রথম মুখ খুলল, শান্ত চোখে রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার মনে হয় তোমার সন্দেহ অমূলক। আমাদের অভিযানটি পঞ্চম মাত্রার অভিযান। মানুষের ব্যবহার উপযোগী একটা আবাসস্থল খুঁজে বের করা যার প্রধান উদ্দেশ্য। এর ভিতরে নিষ্ঠুরতার কোনো ব্যাপার নেই।
রিশান খানিকক্ষণ ষুনের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, আমি সন্দেহপ্রবণ কুটিল প্রকৃতির মানুষ, আমি তোমার সাথে একমত নই। আমার ধারণা আমাদের পঞ্চম মাত্রার অভিযানের কথা বলে পাঠানো হচ্ছে, কিন্তু গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দেখব একটি দ্বিতীয় মাত্রার নৃশংসতা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।
ষুনের পূর্বপুরুষ সম্ভবত দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার কাছাকাছি কোনো অঞ্চল থেকে এসেছে, তার মাথার চুল কুচকুচে কালো, মঙ্গোলীয় চাপা নাক এবং সরু চোখ। সে স্থির দৃষ্টিতে রিশানের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কঠিন মুখে বলল, তুমি যে কাজটি করছ সেটি মহাকাশ নীতিমালায় একটি আইনবহির্ভূত কাজ–একটি অভিযানের আগে মহাকাশচারীদের সেই অভিযান সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা দেয়া।
রিশান ষুনের দিকে তাকিয়ে রইল, মানুষটি কোনো কারণে তাকে অপছন্দ করেছে, না হয় মহাকাশ নীতিমালার কথা টেনে আনত না। রিশান কী একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই হান কাঠ–কাঠ গলায় হেসে উঠে বলল, ষুন, মহাকাশ নীতিমালার কথা বলে ভয় দেখানোও নীতিমালাবহির্ভূত কাজ–
আলোচনাটি অন্য একদিকে মোড় নিতে যাচ্ছিল ঠিক তখন দরজা খুলে দীর্ঘকায় একজন মানুষ প্রবেশ করে। মানুষটি অত্যন্ত সুদর্শন কিন্তু চেহারায় নিষ্ঠুরতার কাছাকাছি এক ধরনের কাঠিন্য রয়েছে। শরীরে হালকা হলুদ রঙের ঢিলেঢালা একটি পোশাক, হাতের কাছে তিনটি লাল রঙের তারা জ্বলজ্বল করছে। মানুষটি তার জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখা চেয়ারে বসে রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি লি–রয়। এই অভিযানের আনুষ্ঠানিক দলপতি!
নিডিয়া লি–রয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যিকারের দলপতিটি তাহলে কে?
সেটা এখনো ঠিক হয় নি। এই ধরনের দীর্ঘ অভিযানের নেতৃত্ব খুব ধীরে ধীরে যে মানুষটি সবচেয়ে কর্মক্ষম তার কাছে চলে আসে।
ষুন বলল, কিন্তু মহাকাশ নীতিমালা
লি–রয় হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, মহাকাশ নীতিমালা একটি মানসিক আবর্জনা ছাড়া আর কিছু নয়। তোমরা জান মহাকাশ নীতিমালা অনুযায়ী আমি ইচ্ছে করলে তোমাদের প্রাণদণ্ড দিতে পারি।
প্রাণদণ্ড?
তাঁ। আগে প্রমাণ করতে হবে যে তোমরা মানবসভ্যতাবিরোধী কাজ করছ। যখন পাঁচ–ছয় জন মানুষ ছোট একটা মহাকাশযানে করে কয়েক শতাব্দীর জন্যে কোনো অজানা গ্রহের দিকে যেতে থাকে তখন মানবসভ্যতা জাতীয় বড় বড় কথাগুলোর কোনো অর্থ থাকে না। ওই মানুষগুলো তখন একটা পরিবারের সদস্য হয়ে যায়। তাদের ভিতরে তখন কোনো আনুষ্ঠানিক নিয়মকানুন থাকে না, থাকা উচিত না।
রিশান সুদর্শন এই মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকে, মানুষটিকে তার পছন্দ হয়েছে। মনে হয় চমৎকার নেতৃত্ব দিতে পারবে। লি–রয় আবার রিশানের দিকে ঘুরে তাকাল, মুখে একটা হাসি টেনে এনে বলল, তোমার সাথে এখনো আমার পরিচয় হয় নি। তবে তোমার গোপন ফাইলটি আমি দেখেছি, আগে দেখলে সম্ভবত তোমাকে আমি এই অভিযানে আমার সাথে নিতাম না।
বিটি অবাক হয়ে বলল, কেন কী হয়েছে রিশানে।
অসম্ভব কাটগোয়ার মানুষ। এর মাথায় কিছু একটা ঢুকে গেলে সেটা বের করা অসম্ভব ব্যাপার! বৃহস্পতির একটা অভিযানে দলপতিকে একটা ঘরে বন্ধ করে মহাকাশযানের নেতৃত্ব নিয়ে নিয়েছিল। মহাকাশযান আর তার বার জন ক্রুয়ের জীবন বেঁচে গিয়েছিল কিন্তু সেই দলপতি এখনো মহা খাপ্পা হয়ে আছে। এজন্যে কখনো কোনো লাল তারা পায় নি।
ষুন বিড়বিড় করে বলল, কিন্তু কিছুতেই একটা নিয়ম থাকতে হয়।
অবশ্যই। লি–রয় মাথা নেড়ে বলল, অবশ্যই সবকিছুতেই নিয়ম থাকতে হয়; কিন্তু সেই নিয়মটি কী কেউ জানে না। পৃথিবীতে সদর দফতরের আরামদায়ক চেয়ারে বসে যে। নিয়মটি খুব চমৎকার মনে হয়, একটা গ্রহের আকর্ষণে একটা গ্রহকণার দিকে ছুটে ধ্বংস হয়ে যাবার আগের মুহূর্তে সেই নিয়মের কোনো মূল্য নেই। তখন নিয়ম হচ্ছে বেঁচে থাকা। দলপতিকে ঘরে বন্ধ করে মহাকাশযানের নেতৃত্ব নেয়া তখন চমৎকার একটি নিয়ম
রিশান লি–রয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে লি–রয়!
অন্য কেউ বললে আমি খুশিই হতাম, কিন্তু তোমার মুখে শুনে একটু দুশ্চিন্তা অনুভব করছি। যাই হোক আমার একটু দেরি হল আসতে। সদর দফতর থেকে কোড নম্বরটি দিতে একটু দেরি হল। আমাদের এই অভিযানটি মূল কেন্দ্রে রেজিস্ট্রি হয়েছে। আনুষ্ঠানিক নাম, মনুষ্যের বসবাসযোগ্য গ্রহ–উপগ্রহ সম্পর্কিত জরিপ। অভিযানের আনুষ্ঠানিক কোড নম্বর নয়। নয় শূন্য তিন।
নয় নয় শূন্য তিন?
হ্যাঁ, এই মুহূর্তে এটা অর্থহীন চারটি সংখ্যা কিন্তু আমি একেবারে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি কিছুদিনের মাঝেই আমাদের জীবনে এর থেকে অর্থবহ ব্যাপার আর কিছু থাকবে না।
ঠিকই বলেছ। হান মৃদু স্বরে বলে, আমার আগের অভিযানের কোড সংখ্যা ছিল আট আট তিন দুই। এত ভয়ঙ্কর একটা অভিযান ছিল যে আট সংখ্যাটিই এখন আমি সহ্য করতে পারি না।
লি–রয় হেসে বলল, আশা করছি আমাদের বেলায় সেরকম কিছু ঘটবে না। ফিরে আসার পর নয় শূন্য কিংবা তিন এই সংখ্যাগুলোর সাথে তোমাদের ভালবাসা হয়ে যাবে! যাই হোক কাজ শুরু করার আগে বল তোমাদের কোনো প্রশ্ন আছে কি না।
নিডিয়া টেবিলে একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, রিশান একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছে। সেটা সম্পর্কে তোমার মতামত জানতে চাই।
লি–রয় রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, কী প্রশ্ন?
রিশান ইতস্তত করে বলল, ঠিক প্রশ্ন নয় একটা সন্দেহ। আমাদের এই দলটির সব কয়জন সদস্য অত্যন্ত কঠোর স্বভাবের, আমাকে এখানে টেনে আনার সেটাও একটা কারণ। মহাকাশ অভিযানে এ রকম একটি দল পাঠানোর পিছনে সত্যিকার উদ্দেশ্যটা কী? মনুষ্য বসবাসের উপযোগী গ্রহ–উপগ্রহ সম্পর্কিত জরিপ কথাটি এক ধরনের ভাওতাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। আমার ধারণা, আমাদের এমন একটি পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়া হবে যেটি হবে ভয়ঙ্কর এবং নৃশংস। আমাদের সেই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না–
লি–রয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত সে কোনো কথা বলল না, তারপর মৃদু গলায় বলল, তুমি মহাকাশ কেন্দ্রের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছ রিশান। এটি খুব বড় অভিযোগ, কোনরকম প্রমাণ ছাড়া এ রকম অভিযোগ করা ঠিক না।
আমার কাছে একটা ছোট প্রমাণ আছে, লি–রয়
কী প্রমাণ?
এই ঘরটি একটি বিশাল ঘর। ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখ সেটা এত উঁচুতে যে ভালো করে দেখা যায় না। বিশাল এই ঘরে বসলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। আমাদেরকে এই ঘরে এনে বসানো হয়েছে।
সবাই অবাক হয়ে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল, সে ঠিক কী বলতে চাইছে কেউ বুঝতে পারছে না। রিশান ছাদের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু আমি বাজি ধরে বলতে পারি এটা ছোট একটা ঘুপচি ঘর, এই ছাদটা একটা কৌশলী দৃষ্টিভ্রম। আমি টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে ছাদটা স্পর্শ করতে পারব–
তাতে কী প্রমাণ হয় রিশান?
তাতে প্রমাণ হয় আমাদেরকে প্রতিনিয়ত ছলনা করা হয়। আমাদেরকে অনুভূতি দেয়া হয় বিশাল একটা ঘরে বসে থাকার কিন্তু আসলে আমরা বসে থাকি ছোট একটা ঘুপচি ঘরে। আমাদের অনুভূতি দেয়া হয় মহান একটি অভিযানের আসলে আমরা যাই নীচ কোনো একটি সংঘর্ষে অংশ নিতে
দুটি এক ব্যাপার নয় রিশান।
আমার কাছে এক।
ষুন বাধা দিয়ে বলল, কিন্তু কিন্তু রিশানের কথা সত্যি কি না সেটা এখনো প্রমাণিত হয় নি। এই ঘরটি হয়তো আসলে বিশাল
হান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, লি–রয় তুমি অনুমতি দিলে আমি টেবিলে উঠে দাঁড়িয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারি।
অনুমতি দিচ্ছি।
হান লাফিয়ে টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে হাত উপরে তুলে ধরতেই সেটি একটি ঝকঝকে আয়নাকে স্পর্শ করল, অত্যন্ত সুচারুভাবে বসানো রয়েছে, দুই পাশে থেকে প্রতিফলিত হয়ে সেটি একটি অত বিশাল ঘরের অনুভূতি দিচ্ছে। হান বিড়বিড় করে বলল, দেখ কত বড় ধুরন্ধর!
ষুন একটু অবাক হয়ে হানের দিকে তাকিয়েছিল। এবারে আস্তে বলল, প্রমাণিত হল ঘরটি ছোট কিন্তু তার মানে নয় আমরা নৃশংসতা করতে যাচ্ছি।
লি–রয় মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। ষুন ঠিকই বলেছে। রিশান, তোমার সন্দেহের কোনো ভিত্তি নেই
রিশান একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, আমি স্বীকার করছি আমার সন্দেহের কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু আমি এটাও বলছি অতীতে অনেকবার আমার অনেক কিছু নিয়ে সন্দেহ হয়েছিল–ভিত্তিহীন সন্দেহ। যুক্তি নিয়ে তো আর সন্দেহ হতে পারে না, তাহলে তো সেটা সন্দেহ নয় সেটা সত্যি। আমার সেইসব ভিত্তিহীন সন্দেহ বেশিরভাগ সময়ে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু–
কিন্তু কী?
কখনো কখনো সেইসব ভিত্তিহীন সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হয়েছে, অন্তত একবার সেটি বার জন মহাকাশচারীর প্রাণ রক্ষা করেছিল।
লি–রয় হাসার ভঙ্গি করে বলল, আমরা সেটা মনে রাখব রিশান। এখন সেটা নিয়ে আর কিছু করার নেই, কাজেই সেটা মুলতুবি থাক।
থাক।
তাহলে এস মহাকাশ অভিযান নয় নয় শূন্য তিন–এর সদস্যরা, আমাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক সভা শুরু করি।
সবাই নিজের চেয়ারটি টেবিলের কাছাকাছি টেনে নিয়ে এসে ভিসুয়াল মনিটরটির উপর ঝুঁকে পড়ে।
০৩. রিশান প্রায় নগ্ন দেহে
রিশান প্রায় নগ্ন দেহে স্টেনলেস স্টিলের একটি টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে কয়েকটি স্বাস্থ্য–সহায়ক রবোট এবং দুজন টেকনিশিয়ান। শরীরের নানা জায়গায় নানা ধরনের মনিটর লাগাতে লাগাতে টেকনিশিয়ান দুজন বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছিল। রিশান তার এক পা থেকে অন্য পায়ে ভর সরিয়ে বলল, আর কতক্ষণ?
মোটামুটি শেষ। তুমি যখন শীতলঘর থেকে বের হবে তখন শরীরকে আবার ব্যবহারের উপযোগী করার জন্যে এই নূতন মাইক্রো ক্যাপসুলগুলো খুব চমৎকার।
কী করে এগুলো?
শরীরের ভিতরে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। ঠিক সময়ে এক ধরনের এনজাইম বের করতে থাকে।
আমি এর আগে যখন মহাকাশ অভিযানে গিয়েছিলাম তখন এগুলো ছিল না। কেন্দ্রীয় কম্পিউটার ধীরে ধীরে শরীরে মাংসপেশিকে জাগিয়ে তুলত।
সেটি প্রাগৈতিহাসিক প্রযুক্তি।
তাই হবে নিশ্চয়ই।
টেকনিশিয়ান দুজন এবারে ধীরে ধীরে রিশানের শরীরে এক ধরনের নিও পলিমারের পোশাক পরাতে শুরু করে। ভিতরে এক ধরনের কোমল উষ্ণতা, রিশান দুই হাত উপরে তুলে পোশাকটির উষ্ণতা অনুভব করে দেখে। টেকনিশিয়ান দুজনের একজন–যার চেহারায় এক ধরনের ছেলেমানুষি ভাব রয়েছে, জিজ্ঞেস করল, রিশান, এত বড় অভিযানে যাওয়ার আগে তোমার কি ভয় করছে?
না। আমাকে তোমরা নানা ধরনের ওষুধপত্রে বোঝাই করে রেখেছ। এই মুহূর্তে আমার ভিতরে ভয় ক্রোধ দুঃখ কষ্ট কিছু নেই। এক ধরনের ফুরফুরে আনন্দ।
যদি তোমাকে আনন্দের অনুভূতি না দেয়া হত, তাহলে কি তোমার ভয় করত?
মনে হয় করত। আমি ভীতু মানুষ।
তুমি যখন ফিরে আসবে তখন পৃথিবীতে আরো অনেকগুলো বছর কেটে যাবে, সেটা ভেবে তোমার ভিতরে কি একটু দুঃখের অনুভূতি হচ্ছে?
না। আমি এতবার মহাকাশ অভিযানে গিয়েছি যে পৃথিবীতে আমার পরিচিত কোনো মানুষ নেই। যারা ছিল তারা কয়েক শ বছর আগে মরে শেষ হয়ে গেছে।
সত্যি?
হ্যাঁ।
তোমার বয়স কত ছেলে? চব্বিশ?
আমার বিয়াল্লিশ। কিন্তু আমার কত বছর আগে জন্ম হয়েছে জান?
কত বছর আগে?
প্রায় ছয় শ বছর আগে। তোমার সামনে একজন খুব প্রাচীন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে
ছেলেমানুষি চেহারার টেকনিশিয়ানটি এক ধরনের বিস্ময়াভিভূত হয়ে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল, তোমার কি পরিবার আছে, রিশান?।
নেই। মহাকাশচারীদের পরিবার থাকতে হয় না। তাদের নিঃসঙ্গতা শেখানো হয়।
তোমার কোনো প্রিয়জন আছে?
না। আমার কোনো প্রিয়জনও নেই। মহাকাশচারীদের কোনো প্রিয়জন থাকতে হয় না। ছেলেমানুষি চেহারার টেকনিশিয়ানটি রিশানের হাতে একটি ফিতা লাগাতে লাগাতে হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, তোমাকে যদি আবার নূতন করে জীবন শুরু করতে দেয়া হয় তাহলে তুমি কি মহাকাশচারী হবে?
মনে হয় না।
তুমি কী হবে রিশান?
মনে হয় শিশুদের স্কুলের শিক্ষক।
এরপর টেকনিশিয়ান এবং রিশান দুজনেই দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল। রিশানকে মহাকাশ অভিযানের পোশাক পরিয়ে কালো ক্যাপসুলের মাঝে শুইয়ে দেবার পর রিশান নরম গলায় বলল, যাই ছেলে, ভালো থেকো তোমরা।
টেকনিশিয়ান দুজন হাত নেড়ে বলল, বিদায় রিশান। তোমার অভিযান সফল হোক। তুমি আরো সুন্দর পৃথিবীতে ফিরে এসো।
ক্যাপসুলের ঢাকনাটা লাগিয়ে দেবার আগের মুহূর্তে রিশান বলল, তোমাদের একটা কথা জিজ্ঞেস করি।
কর।
আমাদের যে মহাকাশযানে পাঠাচ্ছ সেটি কুরু ৪৩ জাতীয়।
হ্যাঁ। এর মাঝে যে পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র আছে দু–চারটে গ্রহ–উপগ্রহ উড়িয়ে দেয়া যায়, তোমরা সেটা জান?
শুনেছি।
আমরা যাচ্ছি পৃথিবীর মানুষের জন্যে নূতন বসতি খুঁজে বের করতে, আমাদের এত অস্ত্র দিয়ে পাঠাচ্ছে কেন জান?
টেকনিশিয়ান দুজন অবাক হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। ছেলেমানুষি চেহারার টেকনিশিয়ানটি ইতস্তত করে বলল, সেটা তো আমাদের জানার কথা নয়। আমরা হচ্ছি টেকনিশিয়ান–তোমাদের পোশাক পরিয়ে ক্যাপসুলে শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া আমাদের কাজ।
তা ঠিক। কিন্তু আমার কী মনে হয় জান?
কী?
আমাদের পাঠাচ্ছে কারো সাথে যুদ্ধ করতে। কিছুতেই ধরতে পারছি না সেটা কে হতে পারে!
ক্যাপসুলের ঢাকনাটা নামিয়ে দেবার সাথে সাথে একটা বাতাস বইতে শুরু করে, তার মাঝে নিষিদ্ধ ফুলের গন্ধ। কিছুক্ষণের মাঝেই বিশানের চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। সে ফিসফিস করে নিজেকে বলল, ঘুমাও রিশান, ঘুমাও।
সত্যি সত্যি সে ঘুমিয়ে পড়ল সুদীর্ঘকালের জন্য।
০৪. চোখ খুলে তাকাল রিশান
খুব ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল রিশান। কোথাও কিছু নেই, মাথার কাছে একটা সবুজ বাতি থাকার কথা সেটিও নেই। সে যেন এক অলৌকিক শূন্যতায় ভেসে রয়েছে। সত্যিই কি তার চেতনা ফিরে আসছে নাকি এটিও একটি স্বপ্ন? রিশান প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করতে লাগল সে কোথায় এবং কেন তার মাথার কাছে একটা সবুজ বাতি থাকার কথা, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারল না।
ঘুম এবং জাগরণের মাঝামাঝি তরল অবস্থায় দীর্ঘ সময় কেটে গেল এবং খুব ধীরে ধীরে আবার তার চেতনা ফিরে আসতে থাকে। এক সময় সে চোখ খুলে তাকায় এবং দেখতে পায় মাথার কাছে সত্যি একটি সবুজ বাতি জ্বলছে। কুরু ইঞ্জিনের কম্পন অনুভব করে রিশান, কান পেতে থেকে গুমগুম একটা চাপা আওয়াজ শুনতে পায় সে।
রিশান চোখ বুজে শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। ঘুম থেকে ওঠা নিস্তেজ ভাবটা কেটে গিয়ে খুব ধীরে ধীরে শরীরের ভিতরে সজীব একটা ভাব ফিরে আসতে শুরু করেছে। ক্যাপসুলের ভিতরে আলো জ্বলে উঠছে ধীরে ধীরে। শীতল একটা বাতাস বইছে ভিতরে, অচেনা কী একটা ফুলের গন্ধ সেই বাতাসে। রিশান ধীরে ধীরে উঠে বসে, সাথে সাথে মাথার উপর থেকে ঢাকনাটা সরে যায়। দেয়ালে নানা ধরনের প্যানেল জ্বলজ্বল করছে, উপরে বামদিকে একটা সৌরঘড়ি সময় জানিয়ে দিচ্ছে। রিশান অবাক হয়ে দেখল সে ঘুমিয়েছিল এক বছরেরও কম সময় নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না সে, এটা কী করে সম্ভব?
রিশান ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে আসে। এক মুহূর্ত সময় নেয় নিজের তাল সামলে নিতে, তারপর দেয়াল ধরে এগিয়ে যায়, লি–রয়কে খুঁজে বের করতে হবে এখনই। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে নিশ্চয়ই, তাদের কয়েক যুগ ঘুমিয়ে থাকার কথা ছিল।
নিয়ন্ত্রণঘরে বড় স্ক্রিনের সামনে লি–রয় দাঁড়িয়েছিল। রিশানকে দেখে বলল, তোমাকেও ঘুম থেকে তুলেছে?
হ্যাঁ। কী ব্যাপার?
জানি না। মনে হয় তোমার সন্দেহই সত্যি। আমাদের মূল অভিযানের পাশাপাশি আরো কোনো অভিযান শেষ করতে হবে।
তথ্যকেন্দ্র কী বলে?
বিশেষ কিছু বলে না। কাছাকাছি কোনো অঞ্চল থেকে একটা বিপদ সঙ্কেত পেয়ে আমাদের ডেকে তুলেছে।
আমরা পৃথিবী থেকে এক আলোকবর্ষ দূরেও যাই নি–পৃথিবী এই বিপদ সঙ্কেতের কথা জানত।
লি–রয় মাথা নাড়ল, মনে হয় জানত।
আমাদেরকে বলে নি।
না।
আমরা কি এই বিপদ সঙ্কেত অগ্রাহ্য করে আমাদের মূল অভিযানে যেতে পারি না?
ইচ্ছে করলে পারি। কিন্তু
কিন্তু কী?
বিপদ সঙ্কেত অগ্রাহ্য করা যায় না।
রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ। ঠিকইঅলেছ। অন্যেরা কি এখনো ঘুমাচ্ছে?
না। সবাইকে জাগানো শুরু করা হয়েছে। তারা উঠে আসতে আসতে চল তুমি আর আমি যাবতীয় তথ্যগুলো সংগ্রহ করে ফেলি।
ঘণ্টাখানেক পরে মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণঘরে যখন ছয় জন ক্রু একত্র হয়েছে তখন সবাই কমবেশি বিচলিত। লি–রয়, সবাইকে শান্ত করে দ্রুত কাজ ক্ষ করে দেয়। বড় টেবিলের একপাশে বসে মনিটরে সবুজ রঙের একটা গ্রহের ছবি স্পষ্ট করতে করতে বলল, আমাদের যাবতীয় সমস্যার মূল হচ্ছে এই গ্রহটি। গাছের পাতায় সবুজ খুব সুন্দর দেখায়। কিন্তু গ্রহ হিসেবে সবুজ রং ভালো নয়, কেমন জানি পচে যাওয়ার একটা ভাব রয়েছে। এই গ্রহটির বেলায় কথাটি আরো বেশি সত্যি।
হান অধৈর্য হয়ে বলল, কী বলতে চাইছ তুমি। গ্রহ আবার পচে যায় কেমন করে?
বলছি। তোমরা সবাই জান, পৃথিবী থেকে এক আলোকবর্ষ যাবার আগেই আমাদের একটা বিপদ সঙ্কেত দিয়ে ঘুম থেকে তোলা হয়েছে। বিপদ সঙ্কেতটি এসেছে এই গ্রহ। থেকে।
নিডিয়া অবাক হয়ে বলল, এই গ্রহে মানুষের বসতি রয়েছে?
হ্যাঁ। প্রায় চল্লিশ বছর আগে এখানে মানুষ বসতি করেছিল। মানুষ থাকার উপযোগী গ্রহ এটি নয় তবু মানুষ বসতি করেছিল। তোমরা যখন জেগে উঠছিলে তখন আমি আর রিশান মিলে গ্রহটা সম্পর্কে মোটামুটি খোঁজখবর নিয়েছি, তথ্যকেন্দ্র থেকে সরাসরি সেসব জানতে পারবে কিন্তু তবু তোমাদের বলে দিই। লি–রয় এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, রিশান, তুমিই বল।
রিশান অন্যমনস্কভাবে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, গ্রহ বলতে আমাদের যেরকম একটি জিনিসের কথা মনে হয়, এটি সেরকম কিছু নয়। পৃথিবীর তরের চার ভাগের
এক ভাগ কিছু জিনিস কোনোভাবে আটকে আছে। নিয়মিত কোনো কক্ষপথ নেই, আশপাশের অন্যান্য মহাজাগতিক আকর্ষণে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। সৌরজগতে গ্রহগুলোতে আলোর উৎস হচ্ছে সূর্য, এখানে সেরকম কিছু নেই। গ্রহটিতে লৌহ জাতীয় আকরিক থাকায় শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে, খুব বিচিত্র একটি বায়ুমণ্ডল রয়েছে, সেখানে আয়োনিত গ্যাসে ইলেকট্রনের ঘূর্ণন থেকে বিচিত্র এক ধরনের আলো তৈরি হয়। এই আলো নিয়মিত নয়, কখনো বেশি কখনো কম, কখনো উজ্জ্বল কখনো নিষ্প্রত–শব্দটা হওয়া উচিত ভূতুড়ে।
গ্রহটি অসম্ভব শীতল; কিন্তু মাটির নিচে প্রচণ্ড চাপে আটকে থাকা কিছু গলিত আকরিক থাকার কারণে স্থানে স্থানে তাপমাত্রা সহ্য করার পর্যায়ে রয়েছে। চল্লিশ বছর আগে মানুষ যখন এখানে বসতি করেছিল এ রকম একটা উষ্ণ জায়গা বেছে নিয়েছিল।
গ্রহটি সম্পর্কে আরো নানারকম ঘুঁটিনাটি তথ্য রয়েছে, তোমরা ইচ্ছে করলে তথ্যকেন্দ্র থেকে পেতে পার, আমি আর সেগুলো জোর করে শোনাতে চাই না।
রিশানের কথা শেষ হতেই হান বলল, কিন্তু আমি এখনো বুঝতে পারছি না তোমরা গ্রহটা পচে গেছে কেন বলছ?
লি–রয় হাসার মতো এক ধরনের ভঙ্গি করে বলল, পচে যাওয়া মানে কী হান?
হান মাথা চুলকে বলল, রূপক অর্থে বোঝানো হয় নষ্ট হয়ে যাওয়া, ধ্বংস হয়ে যাওয়া। তুমি কি বলতে চাইছ–এখানকার মানুষের যে বসতি রয়েছে তারা নিজেদের সাথে নিজেরা ঝগড়াঝাটি করছে? যুদ্ধ–বিগ্রহ করছে? ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
না, সেরকম কিছু না। পচে যাওয়ার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণুর ভোজসভা। এই গ্রহটিতে সেরকম কিছু ঘটেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
উপস্থিত যারা ছিল তারা সবাই চমকে উঠে বলল, এই গ্রহে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে?
হা। খুব নিম্নস্তরের এককোষী প্রাণ। কিন্তু প্রাণ। মানুষের বসতি হয়েছিল সে কারণেই। পৃথিবীর বাইরে যে প্রাণের বিকাশ হয়েছে সেটা সম্পর্কে তথ্য সগ্রহ করা।
নিডিয়া ইতস্তত করে বলল, আমি জীববিজ্ঞানী নই, প্রাণের রহস্য আমার জানা নেই, কিন্তু এককোষী প্রাণ সম্পর্কে তথ্য সগ্রহ করতে মানুষের চল্লিশ বছর লেগে গেছে?
সেটাই সমস্যা। লি–রয় চিন্তিত মুখে বলল, এই এককোষী প্রাণীদের নিয়ে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে এই গ্রহে। মানুষ সেটা ধরতে পারছে না। অনেক চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে, এখন যে কয়জন মানুষ বেঁচে আছে তারা ফিরে যেতে চাইছে। আমাদের কাছে। বিপদ সঙ্কেত পাঠিয়েছে তাদের উদ্ধার করে ফেরত পাঠানোর জন্যে।
ষুন ঘুরে তাকাল লি–রয়ের দিকে, ব্যস? আর কিছু নয়?
না, আর কিছু নয়।
তাহলে রিশান যেটা ভেবেছিল, আমাদের পাঠানো হচ্ছে ভয়ানক একটা নৃশংস কাজ করার জন্যে সেটা সত্যি নয়?
না, সেরকম কিছু নয়।
রিশানের দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। রিশান মাথা নেড়ে বলল, ষুন, তুমি কি ভাবছ আমার খুব মন খারাপ হয়েছে যে আমার সন্দেহটি মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে?
ষুন তার মঙ্গোলীয় সরু চোখকে আরো সরু করে বলল, না, আমি তা বলছি না।
তাছাড়া এখনো সময় শেষ হয়ে যায় নি। ব্যাপারটা যেরকম সহজ মনে হচ্ছে হয়তো তত সহজ নয়। এককোষী কিছু জীবাণু নিয়ে গবেষণা করতে মানুষের চল্লিশ বছর সময় লাগার কথা নয়। এর মাঝে অন্য কোনো ব্যাপার থাকা এতটুকু বিচিত্র নয়।
ষুন ঘুরে তাকাল রিশানের দিকে। তুমি তাই মনে কর?
রিশানের কী হল কে জানে, শক্ত মুখ করে বলল, হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি। আমি দুঃখিত, কিন্তু সত্যি আমি তাই মনে করি।
০৫. ছোট একটা স্কাউটশিপ
ছোট একটা স্কাউটশিপে করে মহাকাশযান থেকে চার জন গ্রহটিতে নেমে আসছিল। স্কাউটশিপটা একটু বেশি ছোট, একসাথে দুজনের বেশি বসার কথা নয়। তার মাঝে চার জন চাপাচাপি করে বসেছে। দীর্ঘ সময় বায়ুশূন্য মহাকাশে ভেসে ভেসে এসেছে, বিশাল মহাকাশযানের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রিত ভ্রমণে তারা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ করে ছোট একটা স্কাউটশিপে করে গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করামাত্র প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে তাদের পৃথিবীর কথা মনে পড়ে যায়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সাথে এর অবিশ্যি একটি বড় পার্থক্য রয়েছে–এই বায়ুমণ্ডলটি বিষাক্ত। স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণে বসেছে লি–রয়, যদিও পুরো কাজটি করা হচ্ছিল মহাকাশযানের মূল কম্পিউটার থেকে।
স্কাউটশিপটা নিচে নেমে আসতে আসতে হলুদ রঙের একটি মেঘের ভিতর একটি বড় ঝাঁকুনি খেয়ে খুব সাবধানে দিক পরিবর্তন করল। নিডিয়া দুই হাতে শক্ত করে দেয়াল ধরে রেখে বলল, এ রকম ঝাঁকুনি হবে জানলে আমি মহাকাশযানেই থাকতাম। রিশান ঘোট গোল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে ধাকতে বলল, ঝাঁকুনিতে আমার বিশেষ আপত্তি নেই কিন্তু কোনোভাবে বিষাক্ত গ্যাস খানিকটা ভিতরে না ঢুকে যায়।
লি-রয় সামনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, আরেকটা বড় ঝাঁকুনি কোনভাবে সামলে নিয়ে বলল, এই শেষ, যদি এ রকম হতে থাকে, আমি ফিরে গিয়ে অন্য ব্যবস্থা করছি।
অন্য কী ব্যবস্থা করবে?
পুরো মহাকাশযানটা নামিয়ে আনব–এইসব ছোটখাটো স্কাউটশিপ যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছু নয়।
ষুন লি–রয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, সেটা হয়তো আরো বড় যন্ত্রণা হবে। বাইরে অসম্ভব ঠাণ্ডা, বড় একটি ইঞ্জিন যদি কোনোভাবে জমে যায়, মহাকাশযানকে চালু করতে গিয়ে তোমার জীবন শেষ হয়ে যাবে।
তা ঠিক।
বাইরে আবার গাঢ় হলুদ রঙের এক ধরনের মেঘ ভেসে এল এবং তার মাঝে ঝাঁকুনি খেতে খেতে স্কাউটশিপটা নিচে নামতে থাকে। চার জন যাত্রী কোনোভাবে নিশ্বাস বন্ধ করে। বসে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত স্কাউটশিপটা মাটির কাছাকাছি এসে গ্রহটাকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে। মানুষের বসতিটা কিছুক্ষণের মাঝেই খুঁজে পাওয়া যায়, স্বচ্ছ অর্ধগোলাকৃতি কিছু ডোম, কিছু চতুষ্কোণণা টাওয়ার এবং নানা আকারের এন্টেনা। এর মাঝে কোনো একটি চতুর্থ মাত্রার বিপদ সঙ্কেত পাঠিয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
স্কাউটশিপের অবলাল সংবেদী চোখ খুঁজে খুঁজে অবতরণক্ষেত্রটি খুঁজে বের করে। দীর্ঘদিন অব্যবহারে সেটি প্রায় ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে আছে। স্কাউটশিপটা খুব সাবধানে সেখানে নেমে এল। স্কাউটশিপ থেকে নামার আগে তারা ভেতরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল কিন্তু কোনো লাভ হল না। বসতির মাঝে যে মানুষগুলো আছে তারা যে কারণেই হোক কারো সাথে যোগাযোগ করতে রাজি নয়।
স্কাউটশিপ থেকে মূল মহাকাশযানে যোগাযোগ করে লি–রয় পুরো অবস্থাটি আরেকবার পর্যালোচনা করে নেয়। তারপর সবাইকে বিশেষ পোশাক পরে নিতে আদেশ করে।
বিষাক্ত পরিবেশে অনির্দিষ্ট সময় থাকার জন্যে বিশেষ ধরনের পোশাকটি পরতে দীর্ঘ সময় নেয়। একজনের আরেকজনকে সাহায্য করতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত প্রস্তুত হয়ে যখন সবাই স্কাউটশিপ থেকে বের হয়ে এল তখন বাইরে বিচিত্র এক ধরনের ঝড় ব্রু হয়েছে। আকাশে ঘোলাটে এক ধরনের আলো বিদ্যুৎ চমকানোর মতো করে ঝলসে উঠেছে। বাতাসে হলুদ ধুলো উড়ছে এবং সবকিছু ছাপিয়ে চাপা এক ধরনের গোঙানোর মতো শব্দ। পুরো পরিবেশটিতে এক ধরনের অশরীরী আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে। চার জনের ছোট দলটি মানুষের বসতির দিকে হাঁটতে শুরু করে। সবার সামনে রিশান, তার হাতে একটি শক্তিশালী এটমিক ব্লাস্টার। সবার পিছনে লি–রয়, তার হাতে মাঝারি আকারের লেজারগান। মাঝখানে নিডিয়া এবং ষুন, তারা ছোট দুটি ভাসমান বাক্সে কিছু রসদ টেনে নিচ্ছে।
স্কাউটশিপের অবতরণক্ষেত্র থেকে মানুষের বসতির মূল গেটটি খুব কাছাকাছি কিন্তু তবু এই ছোট দলটির সেখানে পৌঁছতে অনেকক্ষণ লেগে খেল। গেটটি বন্ধ এবং রিশান সেখানে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শব্দ করতে থাকে। দীর্ঘ সময় কেটে যায় এবং শেষ পর্যন্ত মাথার উপরে একটি মনিটরে একজন মানুষের ভয়ার্ত দেখা যায়। মানুষটি আতঙ্কিত গলায় বলল, কে?
আমরা একটি মহাকাশ অভিযানের দল। তোমাদের বিপদ সঙ্কেত পেয়ে দেখতে এসেছি।
মানুষটি আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তার মুখ দেখে মনে হয় সে তাদের কথা বিশ্বাস করছে না।
লি–রয় আবার বলল, আমাদের ভিতরে আসতে দাও।
মানুষটি তবু কোনো কথা বলল না, একদৃষ্টে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।
লি–রয় একটু অধৈর্য হয়ে বলল, আমরা তোমাদের সাহায্য করতে এসেছি, আমাদের ভিতরে আসতে দাও।
ও আচ্ছা দিচ্ছি। তোমরা একটু অপেক্ষা কর।
উপরের মনিটর থেকে মানুষটি অদৃশ্য হয়ে গেল।
ষুন নিচু গলায় বলল, এরা বাইরের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
হা। নিডিয়া যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমি ভিতরে কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
রিশান বলল, প্রাচীনকালে মানুষ যেরকম দুর্গ তৈরি করত এই বসতিটাকে দেখে আমার সেরকম মনে হচ্ছে।
নিডিয়া বলল, কিছু একটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু আমি ঠিক ধরতে পারছি না কী।
ধরতে না পারার কী আছে, যেটা পছন্দ হচ্ছে না সেটা হচ্ছে এই গ্রহটা। তাকিয়ে দেখ একবার।
লি–রয়ের কথা শুনে সবাই তাকিয়ে দেখল এবং সাথে সাথে সত্যিই সবার গা কাটা দিয়ে ওঠে। আকাশে ঘোলাটে এক ধরনের আলো সেটি কখনো একটু বেড়ে যায় কখনো একটু কমে যায়। আলোটি আসছে ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে এবং ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করছে। গ্রহটির বায়ুমণ্ডল স্বচ্ছ নয়–গাঢ় হলুদ রঙের। উপরে তাকালে মনে হয় যেন ঘোলা পানির নিচে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রহটির বায়ুমণ্ডলও স্থির নয়, সবসময় ঝড়ো বাতাস বইছে। শুরু হলুদ রঙের এক ধরনের ধুলো উড়ছে, ঘুরে ঘুরে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে। আবছা আলোতে খুব বেশি দেখা যায় না কিন্তু যতদূর চোখ যায় ততদূর রুক্ষ পাথর এবং খানাখন্দ। চারদিকে এক ধরনের বিভীষিকা ছড়িয়ে আছে।
নিডিয়া একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে সরে পড়তে পারলে বাচি।
লি–রয় অধৈর্য হয়ে আরেকবার বন্ধ–দরজার দিকে তাকাল, তারপর গলার স্বর ট্রান্সমিটারের আর. এফ, ব্যান্ডে সব ফ্রিকোয়েন্সিতে ছড়িয়ে দিয়ে বলল, তোমরা ভিতরে যারা আছ তারা আমাদের ঢুকতে দাও। যদি সেটি না কর আমরা জোর করে ঢুকতে বাধ্য হব। আমরা তোমাদের সাহায্য করতে এসেছি।
লি–রয়ের হুমকিতে কাজ হল মনে হয়, প্রথমে খুট করে একটা শব্দ হল এবং সাথে সাথে বড় দরজাটি হাট করে খুলে যায়। প্রথম ঘরটি বায়ুচাপ নিরোধক ঘর। বাইরের দরজাটি বন্ধ হয়ে যাবার সাথে সাথে ভিতরে চাত্রা স্বাভাবিক হতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মাঝেই তারা কোয়ারেন্টাইন ঘরে এসে প্রবেশ করল এবং তাদেরকে জীবাণুমুক্ত করার জটিল এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপারটি শুরু হয় গেল।
শেষ পর্যন্ত যখন তারা মানুষের মূল বসতিতে প্রবেশ করতে পারল তখন কারো আর দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তি নেই।
মানুষের মূল বসতিটি যেখানে শুরু হয়েছে সেখানে মহাকাশচারীর এই দলটিকে অভ্যর্থনা করার জন্যে চার জন মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। মানুষগুলো নির্জীব, তাদের গায়ের চামড়া বিবর্ণ চোখে অসুস্থ হলুদাভ এক ধরনের রং। তারা কোনো ধরনের উচ্ছ্বাস না দেখিয়ে শীতল গলায় তাদের অভ্যর্থনা জানাল। লি–রয় একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, আমি লি–রয়, মহাকাশ অভিযান নয় নয় শূন্য তিনের দলপতি
মানুষগুলো কৌতূহলহীন চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। শেষ পর্যন্ত একজন, যার গায়ের কাপড় ধূসর এবং অপরিষ্কার, একটু এগিয়ে এসে ঠাণ্ডা গলায় বলল, তোমাকে অভিবাদন।
তোমাদের পাঠানো চার মাত্রার বিপদ সঙ্কেত পেয়েছি। আমাদের তথ্যকেন্দ্রে তোমাদের সব খবর রয়েছে।
ও।
হ্যাঁ, আমরা তোমাদের উদ্ধার করে পৃথিবীতে পাঠানোর ব্যবস্থা করব।
মানুষগুলো কোনো উচ্ছ্বাস না দেখিয়ে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে রইল। লি–রয় আবার কথোপকথন শুরু করার চেষ্টা করল, তোমাদের অনেক বড় বিপদ বলে জানিয়েছ। বিপদটা কী ধরনের বলবে?
গ্রুনি।
গ্রুনি?
হ্যাঁ। রুনি একজন একজন করে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলেছে।
গ্রুনিটা কে?
রিশান লি–রয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, এই গ্রহের যে এককোষী প্রাণের বিকাশ হয়েছে– একটা জীবাণু ছাড়া আর কিছু নয়, সেটাকে এখানকার মানুষেরা গ্রনি বলে ডাকে।
মানুষগুলো সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ল।
তোমরা এখানে সব মিলিয়ে কতজন মানুষ ছিলে?
প্রথমে এসেছিল চার জন, চল্লিশ বছর আগে। দশ বছর পরে এসেছিল আরো চার জন। তারপরের বার তিন জন। শেষ বার এসেছে পাঁচ জন।
তার মাঝে মারা গেছে কয়জন?
সবাই।
সবাই তো হতে পারে না, তোমরা তো বেঁচে আছ।
হ্যাঁ আমরা ছাড়া। চার জন মানুষ মাথা নেড়ে বলল, আমরা চার জন ছাড়া।
আর কেউ বেঁচে নেই?
মানুষগুলো কোনো উত্তর দিল না। অন্যমনস্কভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।
লি–রয় আবার জিজ্ঞেস করল, আর কেউ বেঁচে নেই?
অপরিষ্কার কাপড় পরা নির্জীব ধরনের মানুষটি চোখ তুলে বলল, না।
নিডিয়া একটু এগিয়ে লি–রয়ের হাত স্পর্শ করে বলে, আমার মনে হয় এদের ধাতস্থ হওয়ার জন্যে খানিকটা সময় দেয়া দরকার। আমরা একটু পর তাদের সাথে কথা বলি।
রিশান মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ, সেটাই ভালো। ততক্ষণ আমরা জায়গাটা পরীক্ষা করে দেখি।
০৬. রিশান নিডিয়াকে নিয়ে
রিশান নিডিয়াকে নিয়ে যখন মানুষের এই বসতিটি পরীক্ষা করে দেখছিল তখন লি–রয় আর ফুন বসতির মূল তথ্যকেন্দ্রে এই গ্রহ সম্পর্কে কী কী তথ্য রয়েছে সেগুলোতে চোখ বুলাতে শুরু করল। তথ্যগুলো সুবিন্যস্ত নয়, এই বসতির মানুষেরা সত্যিকার মানুষের জীবন যাপন করে নি–গ্রহান্তরে মানুষের বসতিতে যে ধরনের নিয়মকানুন মানার কথা সে ধরনের নিয়ম। এখানে মানা হয় নি। কাজেই গ্রহ এবং প্রহের নিম্নস্তরের প্রাণ গ্রুনি সম্পর্কে তথ্যগুলো ছিল ছড়ানো ছিটানো। তথ্যগুলো সগ্রহের ব্যাপারে চার জন মানুষ খুব বেশি সাহায্য করতে পারল না। দীর্ঘদিন থেকে এক ধরনের আতঙ্কিত জীবন যাপন করে তারা খানিকটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেছে।
রিশান এবং নিডিয়াও বসতিটি পরীক্ষা করতে গিয়ে আবিষ্কার করল এটি দীর্ঘদিন থেকে মনুষ্য বাসের অনুপযোগী। মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে দৈনন্দিন যেসব বিষয়ের প্রয়োজন এখানে সেগুলোও নেই। সমস্ত বসতিটি অগোছালো এবং নোরা। রসদপত্র ছড়ানো ছিটানো নিরাপত্তার ব্যাপারগুলো অনিয়মিত। বসতিটিতে ঘোলাটে এক ধরনের আলো এবং সেই আলোতে সবকিছুকে কেমন জানি ভূতুড়ে দেখায়। তাপমাত্রা নিয়মিত নয় এবং থেকে–থেকেই তারা শীতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। পুরো বসতিটিতে এক ধরনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যে, কোনো স্বাভাবিক মানুষ এখানে থাকলে কিছুদিনের মাঝে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাবার কথা। রিশান এবং নিডিয়া মানুষের বসতিটি পরীক্ষা করতে করতে তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করল, এখানে বড় বড় শীতলঘরে নানা ধরনের রসদ মজুদ থাকার কথা। রসদগুলো পরীক্ষা। করতে করতে তারা একটি ঘরে হাজির হল। ভন্টের গোপন সংখ্যা প্রবেশ করাতেই দরজাটি ঘরঘর শব্দে খুলে যায় এবং সাথে সাথে দুজনে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। ঘরের দেয়ালে সারি সারি মানুষের মৃতদেহ। মৃতদেহগুলো সংরক্ষণের জন্যে কোনো এক বিচিত্র কারণে দেয়ালের সাথে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে এবং সেগুলো এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পুরো ব্যাপারটিতে এক ধরনের বিচিত্র অস্বাভাবিকতা যেটি সহ্য করার মতো নয়। নিডিয়া রিশানের হাত জাপটে ধরে বলল, দরজাটা বন্ধ করে দাও।
দিচ্ছি, এক সেকেন্ড। আমাকে একটি জিনিস দেখে নিতে দাও।
কী দেখবে?
মানুষগুলোকে
তোমার পর্যবেক্ষণ যন্ত্রে ছবি উঠে গেছে, তুমি সেখানে দেখতে পারবে। চল যাই।
হ্যাঁ যাচ্ছি।
রিশান যাবার আগে আবার তাকাল, একসাথে সে আগে কখনো এতগুলো মৃতদেহ দেখেছে কি না মনে করতে পারে না। আর মৃতদেহগুলো রেখেছে কী বিচিত্রভাবে, দেখে মনে হয় হঠাৎ সবাই হেঁটে বের হয়ে আসবে। কিছু পুরুষ এবং কিছু মেয়ে, সেই কোন সুদূর পৃথিবী থেকে এসে এই কদর্য গ্রহটিতে জীবন দিয়েছে।
নিডিয়া তখনো রিশানের হাত ধরে রেখেছিল, কাঁপা গলায় বলল, আমার ভালো লাগছে না, চল ফিরে যাই।
ফিরে যাবে? বেশ। তুমি যাও আমি বাকিটুকু দেখে আসি।
না। নিডিয়া মাথা নেড়ে বলল, আমার একা যেতে ভয় করছে। তুমিও আস।
রিশান অবাক হয়ে নিডিয়ার দিকে তাকাল, ভয় করছে? কিসের ভয়?
জানি না। আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না, হঠাৎ করে এতগুলো মৃতদেহ দেখে কেমন জানি সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছে। নিডিয়া আবার শিউরে ওঠে।
রিশান আর নিডিয়া ফিরে এসে দেখে তথ্যকেন্দ্রের বড় মনিটরের সামনে লি–রয় আর ষুন বসে আছে এহের চার জন অপ্রকৃতিস্থ মানুষ জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাছে। লি রয় মানুষগুলোকে জিজ্ঞেস করল, তথ্যকেন্দ্রের অনেক তথ্য দেখি নষ্ট করা হয়েছে। কেন নষ্ট করলে?
চার জন মানুষের মাঝে যে মানুষটি তুলনামূলকভাবে বয়স্ক একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কিছু করার নেই, তাই—
তাই মূল্যবান তথ্য নষ্ট করবে?
মূল্যবান নয়। সব তথ্য পৃথিবীতে পাঠানো হয়ে গেছে—
লি–রয় চিন্তিত মুখে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে রইল।
রিশান জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার লি–রয়?
এখানে সবকিছু কেমন জানি খাপছাড়া। তথ্যকেন্দ্রে নানা ধরনের গোলমাল রয়েছে। অনেক রকম মূল্যবান তথ্য নষ্ট করা হয়েছে।
কেন?
জানি না। তবে পৃথিবীর একটা নির্দেশ আছে এখানে।
কী নির্দেশ?
এই দেখ, আমি শোনাচ্ছি তোমাদের।
নিডিয়া আর রিশান কাছে এগিয়ে গেল। পৃথিবীর যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা, গোপনীয়তার মাত্রা, প্রয়োজনীয় কোড নাম্বার সবকিছু শেষ করে নির্দেশটি শুরু হল। ছয় লাল তারার একজন বয়স্ক মানুষ হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে জীবন্ত হয়ে আসে। একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে মানুষটি কথা বলতে শুরু করে, আমি মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান এম সাতর। আমি আমার পদাধিকার বলে এবং আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব এবং ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্দেশ দিচ্ছি। সৌরজগৎ থেকে প্রায় এক আলোকবর্ষ দূরে এই গ্রহটি, যার অবস্থান নিষাদ স্কেলে চার চার শূন্য চার তিন এবং পাঁচ পাঁচ আট চার ছয় এবং যেখানে মানুষের অভিযান তিন তিন দুই চার সুসম্পন্ন হয়েছে, আমি সেই গ্রহের মানুষদের কিংবা যারা তাদের সাথে যোগাযোগ করতে এসেছে সেই মানুষদের এই নির্দেশ দিচ্ছি।
এই গ্রহটিতে একটি নিম্নস্তরের প্রাণ আবিষ্কৃত হয়েছে। দীর্ঘ সময় এই প্রাণীটির ওপর গবেষণা করা হয়েছে এবং দেখা গেছে এটি একটি এককোষী প্রাণী। এই প্রাণীটি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য আমাদের সগ্রহ করা হয়েছে এবং এই মুহূর্তে সেটি সম্পর্কে আমাদের কোনো কৌতূহল নেই। কিন্তু এই গ্রহটি সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল রয়েছে। সৌরজগৎ থেকে বের হয়ে ছায়াপথের দিকে যাত্রা শুরু করার সময় এই গ্রহটি পৃথিবীর মানুষের জন্যে একটি সাময়িক আবাসস্থল হতে পারে। এর অবস্থান নানা কারণে আমাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের ধারণা হয়েছে এই গ্রহের এককোষী প্রাণীটি–যেটি একটি জীবাণু ছাড়া আর কিছু নয়, মানুষের নিরাপত্তার জন্যে একটি হুমকিস্বরূপ।
পুরো ব্যাপারটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করে পৃথিবীর মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে এই গ্রহটিকে জীবাণুমুক্ত করা হবে। কাজেই এই মর্মে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই গ্রহের এককোষী প্রাণীগুলোকে ধ্বংস করার জন্যে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। দীর্ঘদিনের গবেষণার কারণে আমরা নিশ্চিতভাবে জানি কীভাবে এই জীবাণুগুলোকে ধ্বংস করা সম্ভব। তার জন্যে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্যাদি প্রস্তুত করার জন্যে কিংবা নিয়ে আসার জন্যে অনুমতি দেয়া হচ্ছে। এ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য রয়েছে মহাকাশ নির্দেশমালা তিন তিন চার নয় অনুচ্ছেদের সাত সাত আট চার অংশে।
লি–রয় মনিটর স্পর্শ করে হলোগ্রাফিক ছবিটি অদৃশ্য করে দিয়ে বলল, নির্দেশটা এখানেই শেষ, এরপরে রয়েছে নানারকম ঘুঁটিনাটি।
রিশান অন্যমনস্কভাবে নিজের চুলে আঙুল প্রবেশ করিয়ে বলল, কিছু একটা গোলমাল আছে এখানে।
সবাই ঘুরে তাকাল রিশানের দিকে। ষুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিশানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কী গোলমাল?
আমি জানি না কী, কিন্তু কিছু একটা গোলমাল আছে। একটা জীবন্ত প্রাণীকে এত সহজে ধ্বংস করার কথা নয়।
ষুন বলল, এটা কোনো জীবন্ত প্রাণী নয়। এটা জীবাণু। মানুষ অতীতে অনেক জীবাণু। ধ্বংস করেছে। আমি যতদূর জানি বসন্ত নামে একটা ভয়াবহ রোগ ছিল পৃথিবীতে, সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে সেটি পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
লি–রয় বলল, এই জীবাণুটি তো পুরোপুরি ধ্বংস করা হচ্ছে না। তার নমুনা নিশ্চয়ই রাখা আছে কোথাও। যদিও আমি জানি না এই নমুনাটি কী কাজে লাগবে!
রিশান চিন্তিত মুখে বসতির চার জন অপ্রকৃতিস্থ মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকে, ঠিক বুঝতে পারছে না কী, কিন্তু কিছু একটা গোলমাল আছে কোথাও সেটা কী ধরতে পারছে না।
ষুন লি–রয়কে বলল, আমাদের কাজ তাহলে খুব সহজ হয়ে গেল। এই চার জন মানুষকে পৃথিবীতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা, গ্রহটিকে জীবাণুমুক্ত করা, তারপর আবার আগের কাজে ফিরে যাওয়া।
কিছু একটা গোলমাল আছে এখানে। রিশান মাথা নেড়ে বলল, কিছু একটা গোলমাল আছে।
ষুন রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যদি না জান গোলমালটা কোথায়, তাহলে সেটা নিয়ে চেঁচামেচি করে তো কোনো লাভ নেই।
রিশান ষুনের কথা শুনল বলে মনে হল না। সে হঠাৎ ঘুরে অপ্রকৃতিস্থ চার জন মানুষের দিকে তাকাল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ কঠোর স্বরে জিজ্ঞেস করল, এখানে সবাই মারা গিয়েছে, তোমরা চার জন কেন মারা যাও নি?
চার জন মানুষ এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। রিশান চোখের দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ করে বলল, তোমরা পৃথিবীতে ফিরে না গিয়ে এই নির্জন গ্রহে রয়ে গেলে কেন?
আমাদের মহাকাশযান নষ্ট হয়ে গেছে।
কেমন করে নষ্ট হল?
আমরা জানি না।
পৃথিবীতে খবর পাঠালে না কেন?
পাঠিয়েছি।
রিশান কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারা আরো কিছু বলবে ভেবে কিন্তু মানুষগুলো কিছু বলল না। রিশান আবার তীব্র গলায় বলল, এখানে সব মানুষ মারা গিয়েছে কিন্তু তোমরা কেন মারা যাও নি? বল
নিডিয়া রিশানের হাত স্পর্শ করে বলল, তুমি শুধু শুধু উত্তেজিত হচ্ছ রিশান, তারা মারা যায় নি সেটা তাদের অপরাধ হতে পারে না।
ষুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিশানের দিকে তাকিয়েছিল। এবারে ঘুরে লি–রয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, লি–রয়, আমাদের কি বিশানের উত্তেজিত কথাবার্তা শোনার প্রয়োজন আছে? আমরা কি আমাদের কাজ শুরু করতে পারি? আরো দুটি স্কাউটশিপ, প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্যাদি, যন্ত্রপাতি নামাতে পারি?
পার। তুমি কাজ শুরু করে দাও ষুন।
ষুন যোগাযোগ মডিউলটা কাছে টেনে নিয়ে কথা বলতে শুরু করছিল, হঠাৎ রিশান চিৎকার করে বলল, দাঁড়াও।
কী হয়েছে?
ওই দেখ। রিশান আঙুল দিয়ে দেয়ালের দিকে দেখায়।
কী? লি–রয় অবাক হয়ে বলল, কী?
রিশান এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে বসে দেয়ালের দিকে তাকায়। সেখানে কাঁচা হাতে লেখা, আমি রবোটকে ঘৃণা করি।
রিশান ঘুরে তাকাল মানুষ চার জনের দিকে, বিস্ফারিত চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, আমি জানি তোমরা চার জন কেন মারা যাও নি। তোমরা আসলে মানুষ নও।
মানুষ চার জন কোনো কথা বলল না। কেমন জানি বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল
রিশান এটমিক ব্লাস্টারটি টেনে নিয়ে চিৎকার করে বলল, তোমরা রবোট।
মানুষ চার জন কোনো কথা বলল না
নিডিয়া আর্তচিৎকার করে বলল, হায় ঈশ্বর!
রিশান এটমিক ব্লাস্টারটা টেনে গুলি করার জন্যে লক ইন করে হুঙ্কার দিয়ে বলল, কথা বল আবর্জনার দল, না হয় গুলি করে তোমাদের ফাপা কপোট্রন গুঁড়ো করে দেব। তোমরা রবোট?
হ্যাঁ।
আগে বল নি কেন?
তোমরা জিজ্ঞেস কর নি।
রিশান অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে জিজ্ঞেস করল, দেয়ালে এই লেখাটা কার?
সানির।
সানি?
হ্যাঁ।
কে সে?
একটা ছেলে। দশ বছর বয়স।
কোথায় সে?
রবোট চারটি কোনো কথা বলল না
রিশান চিৎকার করে বলল, কথা বল
জানি না।
জান না?
না। বসতি থেকে বের হয়ে গেছে।
দশ বছরের একটা বাচ্চা ছেলে একা একা এই বসতি থেকে বের হয়ে গেছে?
রবোট চারটি কোনো কথা বলল না। রিশান এটমিক ব্লাস্টারটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, আবর্জনার বাটি, নোংরা প্লাস্টিক, সত্যি কথা বল, না হয় এক সেকেন্ডে তোমাদের কপোট্রন আমি ধুলো করে উড়িয়ে দেব! তোমাদের মহাকাশযান কেমন করে নষ্ট হয়েছে?
রবোট চারটি কোনো কথা বলল না।
কথা বল।
গ্রুনিরা ইঞ্জিন ক্যাপের সেফটি বালব খুলে নিয়ে গেছে। কন্ট্রোল প্যানেলের মূল প্রসেসর নষ্ট করেছে। ভ্যাকুয়াম সিল কেটে দিয়েছে। জ্বালানি ট্যাংক ফুটো করে–
গ্রুনিরা নিম্নশ্রেণীর প্রাণী নয়। তারা বুদ্ধিমান প্রাণী?
রবোট চারটি কোনো কথা বলল না
রিশান চিৎকার করে বলল, কথা বল। গ্রুনিরা বুদ্ধিমান প্রাণী?
আমরা জানি না।
পৃথিবীর মহাকাশকেন্দ্র জানে?
রবোটদের এক জন মাথা নাড়ল। বলল, জানে।
রিশান এটমিক ব্লাস্টারটা হাতবদল করে লি–রয়ের দিকে তাকাল, এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, পৃথিবীর মহাকাশকেন্দ্র একটি বুদ্ধিমান প্রজাতিকে ধ্বংস করার জন্যে আমাদেরকে পাঠিয়েছে।
লি–রয় কোনো কথা বলল না। রিশান আরো এক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, অনুমতি দাও আমি এই জঞ্জালগুলোর কপোট্রন গুঁড়ো করে দিই।
তার অনেক সময় পাবে রিশান। লি–রয় একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, এখন তোমরা তোমাদের পোশাক পরে নাও। আমরা খুব বিপদের মাঝে আছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের মহাকাশযানে ফিরে যেতে হবে।
রিশান তার এটমিক ব্লাস্টারটি কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে লি–রয়ের দিকে ঘুরে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তোমরা যাও লি–রয়। আমি পরে আসছি।
তুমি কী করবে?
ছেলেটাকে খুঁজে বের করব। এ রকম একটা গ্রহে দশ বছরের একটা বাচ্চা ছেলে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তুমি চিন্তা করতে পার?
০৭. অবলাল সংবেদী চশমা
রিশান চোখে অবলাল সংবেদী চশমাটা লাগিয়ে সামনে তাকাল। যতদূর চোখ যায় শুকনো পাথর ছড়িয়ে আছে। ঝড়ো বাতাসে ধুলো উড়ছে, তার সাথে এক ধরনের চাপা গর্জন। অত্যন্ত প্রতিকূল আবহাওয়া, এই গ্রহটি মানুষের বসবাসের জন্যে উপযোগী নয়। এই বিশাল গ্রহে দশ বছরের একটি ছেলে কোথাও হারিয়ে গেছে, তাকে খুঁজে বের করা খুব সহজ ব্যাপার নয়।
রিশান এটমিক ব্লাস্টারটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চারটি বিকন ছেড়ে দেয়া হয়েছে, সেগুলো এই এলাকাটি স্ক্যান করা শুরু করেছে, দশ বছরের বাচ্চাটির পোশাকে যে বিপারটি লাগানো আছে সেটা খুঁজে পাওয়া মাত্র সেখানে লক্ষ্যবদ্ধ হয়ে যাবে। তারপর বিকনের সঙ্কেত অনুসরণ করে বাচ্চাটিকে খুঁজে বের করতে হবে। বাচ্চাটি এই বসতি থেকে কতদূরে সরে গিয়েছে তার ওপর নির্ভর করছে তাকে খুঁজে বের করতে কত সময় লাগবে। গ্রহটির বায়ুমণ্ডল যদি এত অস্বচ্ছ এবং এত আয়োনিত না হত তাহলে মহাকাশযানের অনুসন্ধানী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যেত, কিন্তু এই গ্রহটিতে তার কোনো আশা নেই।
রিশান ঝড়ো হাওয়ার মাঝে দাঁড়িয়ে তার যোগাযোগ মডিউলটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মানুষের বসতিতে অন্যেরা তার জন্যে অপেক্ষা করছে, বাচ্চাটিকে নিয়ে ফিরে গেলে সবাই মহাকাশযানে ফিরে যাবে। যদি সে বাচ্চাটাকে খুঁজে না পায়? যদি কোনো কারণে বাচ্চাটি তার বিপারটি বন্ধ করে দিয়ে থাকে? রিশান জোর করে চিন্তাটি মাথা থেকে সরিয়ে দিল।
ঝড়ো হাওয়ার একটা বড় ঝাঁপটা হঠাৎ রিশানকে প্রায় উড়িয়ে নিতে চায়, সে সাবধানে একটা পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিল। হলুদ ধুলো পাক খেয়ে খেয়ে উঠতে থাকে, অন্ধকার হয়ে আসে চারদিক। রিশান দাতে দাঁত চেপে এটমিক ব্লাস্টারটি শক্ত করে ধরে রাখে। এই গ্রহের প্রাণীগুলো কি এখন তাকে লক্ষ করছে? গ্রুনি নামের এককোষী প্রাণী তো বুদ্ধিমান প্রাণী হতে পারে না, বুদ্ধিমান প্রাণীটা তাহলে কী রকম? তাদের জৈবিক ব্যবহার কী রকম? জৈৱিক কথাটি কি ব্যবহার করা যাবে এই প্রাণীটির জন্যে? তারা কি সত্যিই বুদ্ধিমান? মানুষের মতো চিন্তা করতে পারে? মানুষের মতো কি বুদ্ধিমান? যদি সত্যিই মানুষের মতো বুদ্ধিমান হয়ে থাকে তাহলে প্রাণীগুলো মানুষকে মেরে ফেলেছে কেন? আর সত্যিই যদি সবাইকে মেরে ফেলে থাকে তাহলে এই বাচ্চাটিকে কেন বাচিয়ে রেখেছে? রিশান জোর করে চিন্তাটুকু ঠেলে সরিয়ে দেয়, তার কাছে এখন যথেষ্ট তথ্য নেই যে ভেবে সে একটা কূলকিনারা পাবে।
রিশান এটমিক ব্লাস্টারটি হাতবদল করে তার অবলাল চশমা দিয়ে দূরে তাকাল। কী ভয়ঙ্কর অশরীরী একটি দৃশ্য, সৃষ্টিজগতে কি এর থেকে কুশ্রী, এর থেকে নিরানন্দ কোনো এলাকা আছে? একটি দশ বছরের বাচ্চা কি তার জীবনে এর থেকে ভালো কিছু পেতে পারে না?
ক্ষীণ একটা শব্দ শুনে রিশান তার যোগাযোগ মডিউলটির দিকে তাকাল, একটা লাল আলো জ্বলছে এবং নিভছে–যার অর্থ বিকন চারটি এই বাচ্চা ছেলেটিকে খুঁজে পেয়েছে। রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে বসতিতে যোগাযোগ করল, নরম গলায় বলল, লি–রয়, বাচ্চাটিকে মনে হয় খুঁজে পাওয়া গেছে।
কোথায়?
এখান থেকে অনেক দূরে। এত ছোট একটি বাচ্চা একা এত দূরে কেমন করে গেল সেটা একটা রহস্য। আমি যাচ্ছি তাকে আনতে।
বেশ। আমরা তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। এদিকে আরো কিছু বিচিত্র জিনিস ঘটেছে–
কী?
তুমি ফিরে এস তখন বলব। তোমার কিছু সাহায্য লাগলে বল
বলব।
রিশান যোগাযোগ কেটে দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। দীর্ঘ পথ, হেঁটে যেতে অনেকক্ষণ লাগবে। একটু আগে যেটা ঝড়ো হাওয়া ছিল, মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে সেটা পুরোপুরি একটা ঝড়ে পরিণত হতে যাচ্ছে।
বিকনের সঙ্কেত অনুসরণ করে রিশান হাঁটছে। খালি চোখে গ্রহটিকে যেরকম দুর্গম মনে হচ্ছিল হাঁটতে গিয়ে অনুভব করে সেটি তার থেকে অনেক বেশি দুর্গম। ছোট একটা বাই ভার্বাল নিয়ে আসার দরকার ছিল, কিন্তু কিছু আনা হয় নি। সেটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সে এখন হাঁটার দিকে মনোযোগ দেয়। পুরো গ্রহটি পাথুরে মাঝে মাঝে বিশাল গহ্বর। সমস্ত পথ উঁচু–নিচু, তার মাঝে হলুদ এক ধরনের ধুলো উড়ছে। মাধ্যাকর্ষণ বল কম বলে প্রতি পদক্ষেপেই সে একটু করে ভেসে উপরে উঠে যাচ্ছে। ঝড়ের গতি আস্তে আস্তে বাড়ছে, তার সাথে সাথে গ্রহের ঘোলাটে আলোটাও মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে তীব্রতর হচ্ছে। তবে আলোটি স্থির নয়, ক্রমাগত নড়ছে, যার ফলে চোখের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ছে।
বিকনের সঙ্কেত অনুসরণ করে হেঁটে হেঁটে রিশান যত কাছে যেতে থাকে যোগাযোগ মডিউলে লাল আলোটি তত স্পষ্ট হতে থাকে। আলোটি কিছুক্ষণ আগেও নড়ছিল, এখন স্থির হয়েছে। মনে হচ্ছে ছেলেটি হাটা থামিয়ে কোথাও বিশ্রাম নিচ্ছে। কাছাকাছি পৌঁছানোর ফলে রিশান যোগাযোগ মডিউলে আরো নানা ধরনের তথ্য পেতে থাকে, ইচ্ছে করলে সে এখন ছেলেটির সাথে কথা বলতে পারে, এমনকি হলোগ্রাফিক ছবিও পাঠাতে পারে, কিন্তু সে কিছুই করল না। দশ বছরের একটি বাচ্চা নেহাতই শিশু, তার সাথে একটু সতর্ক হয়ে যোগাযোগ করা দরকার। বিশেষ করে সে যখন এ ধরনের কিছুই আশা করছে না।
শেষ অংশটি হল সবচেয়ে কঠিন। খাড়া একটি পাহাড় বেয়ে উঠে আবার নিচে নেমে যেতে হল। এখানকার পাথরগুলোও দুর্বল, পায়ের চাপে হয় খুলে আসছিল নাহয় ভেঙে যাচ্ছিল। রিশান প্রচণ্ড পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। একটি বাই ভার্বাল না নিয়ে আসা নেহাতই বোকামি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আর না পেরে শক্ত একটা পাথর খুঁজে বের করে সেখানে হেলান দিয়ে বসে বড় বড় নিশ্বাস নিতে থাকে। চারদিকে কিছুক্ষণের জন্যে অন্ধকার নেমে এসেছে, হঠাৎ কোথায় জানি আলো ঝলসে উঠল, আর রিশান চমকে উঠে দেখে তার সামনে একটি মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। অবিকল মানুষের মতো, একটি নারীমূর্তি।
রিশান চিৎকার করতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ বন্ধ করল, বিড়বিড় করে নিজেকে বলল, দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছে আমার। অতিরিক্ত পরিশ্রমে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গিয়ে নানা ধরনের দৃশ্য দেখছি; যখন খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চোখ খুলব, দেখব কিছু নেই। রিশান বড় বড় কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে আবার চোখ খুলল, সত্যিই কোথাও কিছু নেই।
রিশান বুঝতে পারে এখনো তার বুক ধকধক করছে। নারীমূর্তিটি এত বাস্তব ছিল যে সত্যি সত্যি মনে হচ্ছিল তার সামনে বুঝি একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে মেয়ে কোথা থেকে আসবে? যে বুদ্ধিমান প্রাণীটি রয়েছে সেটি দেখতে পৃথিবীর মেয়েদের মতো হবে। বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। সৃষ্টিকর্তা বলে সত্যিই যদি কেউ থাকে তার কল্পনাশক্তি নিশ্চয়ই এত কম নয় যে, সব বুদ্ধিমান প্রাণীকে মানুষের রূপ দিয়ে তৈরি করবে। রিশান মাথা থেকে চিন্তাটি দূর করে দিল। সে নিজের কাছেও স্বীকার করতে চাইছে না যে সে ভয় পেয়েছে।
বিকনের সঙ্কেত অনুসরণ করে কিছুক্ষণের মাঝেই সে পাহাড়ের একটা গুহার কাছাকাছি হাজির হল–ভিতর থেকে একটা ক্ষীণ আলোকরশ্মি বের হয়ে আসছে। রিশান বাইরে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে ভিতরে ঢুকল। গুহাটি বেশ বড়, মাঝামাঝি একটা বড় পাথরের উপরে একটা ছোট জিনন ল্যাম্প জ্বলছে, তার কাছাকাছি একটা ছোট ছেলে মহাকাশচারীর পোশাক পরে শুয়ে আছে। রিশানকে ঢুকতে দেখে ছেলেটি বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়ায়, নিচে থেকে কী একটা তুলে নিয়ে লাফিয়ে পিছনে সরে গিয়ে সেটা বিশানের দিকে তাক করে দাঁড়ায়, রিশান জিনিসটি চিনতে পারল, একটা প্রাচীন কিন্তু কার্যকরী অস্ত্র।
রিশান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই সে ছেলেটার রিনরিনে গলার স্বর শুনতে পেল, হাতের অস্ত্র ফেলে দাও না হয় গুলি করে তোমার কপোট্রন ফুটো করে দেব।
রিশান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ছেলেটা আবার ধমক দিয়ে ওঠে, এক্ষুনি
রিশান এটমিক ব্লাস্টারটি ছুঁড়ে ফেলে দিল।
এবার দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াও।
রিশান দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াল।
এবারে ডান হাত নামিয়ে সাবধানে তোমার কপোট্রনের সুইচ অফ করে দাও, একটু ভুল করেছ কি গুলি করে তোমার কপোট্রন উড়িয়ে দেব।
আমার কপোট্রনের সুইচ নেই, আমি একজন মানুষ।
আমি বিশ্বাস করি না। ছেলেটা তীব্র স্বরে বলল, এখানে কোনো মানুষ নেই, সব রবোট।
আমি এখানে থাকি না। আমি পৃথিবী থেকে এসেছি। তোমাকে উদ্ধার করে নিতে এসেছি।
বিশ্বাস করি না। ছেলেটা তার রিনরিনে গলার স্বরে চিৎকার করে অস্ত্রটা বিপজ্জনকভাবে ঝাঁকিয়ে বলল, বিশ্বাস করি না। তুমি কাছে আসবে না।
ঠিক আছে, আমি কাছে আসব না।
কী চাও তুমি?
আমি তোমাকে বলেছি, আমি একজন মানুষ। এই গ্রহ থেকে একটা বিপদ সঙ্কেত পেয়ে নেমে এসেছি। এসে শুনেছি তুমি এখানে আছ। আমি তাই তোমাকে নিতে এসেছি।
আমি যেতে চাই না, কোথাও যেতে চাই না, তুমি যাও।
রিশানের বুক হঠাৎ এই বাচ্চাটির জন্যে গভীর মমতায় ভরে আসে, সে নরম গলায় বলল, তুমি যদি যেতে না চাও আমি তোমাকে জোর করে নেব না সানি। কিন্তু যদি তুমি আমার সাথে কথা বল তাহলে আমি বাজি ধরে বলতে পারি, তুমি আমার সাথে পৃথিবীতে যাবে।
কেন?
সেটা আমি তোমাকে এখন বলব না। আমি কি এখন একটু কাছে আসতে পারি?
না। তুমি কাছে আসবে না।
ঠিক আছে, তুমি যদি না চাও আমি তোমার কাছে আসব না। এই দেখ আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি
না, তুমি চলে যাও
বিশান মাথা নাড়ল, না আমি যাব না।
যদি না যাও, তাহলে আমি তোমাকে গুলি করব।
রিশান আবার মাথা নাড়ল, না তুমি গুলি করবে না। তুমি একজন মানুষ, আমি আরেকজন মানুষ। একজন মানুষ কখনো আরেকজন মানুষকে গুলি করে না।
ছেলেটি খানিকক্ষণ রিশানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি সত্যি মানুষ?
আমি সত্যি মানুষ।
তুমি হাসতে পার?
আমি হাসতে পারি।
ছেলেটি একটু ইতস্তত করে বলল, তাহলে তুমি একবার হাস।
রিশান হাসিমুখে বলল, মানুষ এমনি এমনি তো হাসতে পারে না, তুমি একটা হাসির গল্প বল, আমি হাসব।
আমি হাসির গল্প জানি না। ছেলেটি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি জান?
রিশান আরো একটু এগিয়ে যায়, আমিও খুব বেশি জানি না কিন্তু কয়েকটা জানি। তুমি যদি শুনতে চাও, তোমাকে আমি বলব।
ছেলেটি কোনো কথা বলল না। রিশান আরো একটু এগিয়ে যায়, ছেলেটি তখনো তার দিকে প্রাচীন অস্ত্রটি তাক করে ধরে রেখেছে। রিশান বলল, তুমি যেভাবে নিজেকে রক্ষা করছ আমি দেখে মুগ্ধ হয়েছি! তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে আমার অস্ত্রটি দেখাতে পারি। দেখবে?
ছেলেটি মাথা নাড়ল। রিশান সাবধানে এটমিক ব্লাস্টারটি হাতে তুলে নিয়ে গুহার বাইরে দূরে একটা বড় পাথরের দিকে তাক করে ট্রিগার টেনে ধরে, একটা নীল আলো ঝলসে উঠে সাথে সাথে পুরো পাথরটি চূর্ণ হয়ে উড়ে যায়। ছেলেটি অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল। রিশান এটমিক ব্লাস্টারটি সানির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, তুমি নেবে?
ছেলেটি সাগ্রহে সেটা টেনে নিল। রিশান বলল, এখন তুমি আমাকে কাছে বসতে দেবে?
ছেলেটি মাথা নাড়ল, বলল, বস।
রিশান ছেলেটার কাছে বসে তার দিকে তাকাল, মহাকাশচারীর পোশাকের স্বচ্ছ হেলমেটের ভিতরে একটি কমবয়সী শিশু–চোখে এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে রিশানের দিকে তাকিয়ে আছে। রিশানের খুব ইচ্ছে করল তার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে কোমল স্নেহের একটা কথা বলে। কিন্তু সেটি সম্ভব নয়, বিষাক্ত গ্যাসের গ্রহটিতে মহাকাশচারীর পোশাকের আড়ালে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে, তাছাড়া দশ বছরের এই ছেলেটিকে কেউ কখনো স্নেহের কথা বলে নি। অনভ্যস্ত হাতে যে অস্ত্র ধরে রাখে, তাকে স্নেহের কথা বললে সে কি সেটি বুঝতে পারবে?
রিশান একটি নিশ্বাস ফেলে নরম গলায় বলল, সানি, চল আমরা তাহলে যাই।
কোথায়?
প্রথমে বসতিতে, সেখানে অন্য সবাইকে নিয়ে মহাকাশযানে। ছেলেটা একটু অবাক হয়ে রিশানের দিকে তাকাল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, এখন তো যেতে পারব না।
কেন?
দেখছ না ঝড় উঠেছে। এই ঝড় বেড়ে যাবে তারপর আকাশ থেকে আগুন পড়তে থাকবে–
আগুন?
হ্যাঁ, দেখা যায় না কিন্তু আগুন। যেখানে পড়বে সেটা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে! দেখছ না আমি এই গুহায় বসে আছি।
রিশান বাইরে তাকাল, সত্যি বাইরে ঝড়ের গতি অনেক বেড়েছে আর স্থানে স্থানে সত্যি নীলাভ এক ধরনের আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলছে।
০৮. পাথরে হেলান দিয়ে
পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছে রিশান, তার ডান পাশে সানি গুটিসুটি মেরে বসেছে। তার হাতে এখন কোনো অস্ত্র নেই, সে শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করেছে যে রিশান সত্যিই একজন মানুষ এবং সে সম্ভবত সানিকে সত্যি সাহায্য করতে চায়। তাদের সামনে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় দুটি হলোগ্রাফিক ছবিএকটিতে মহাকাশযান থেকে হান এবং বিটি; অন্যটিতে এই গ্রহে মানুষের এককালীন বসতি থেকে লি–রয়, নিডিয়া এবং স্কুন।
বাইরে ঝড়ের বেগ খুব বেড়েছে এবং মাঝে মাঝেই ছোটখাটো বিস্ফোরণের শব্দ হচ্ছে, তার মাঝে সবাই কোনোভাবে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে। লি–রয় বলল, রিশান তুমি সত্যিই কোনোরকম সাহায্য চাও না? ইচ্ছে করলে আমরা মহাকাশযান থেকে একটা বিশেষ স্কাউটশিপের ব্যবস্থা করতে পারি–
কোনো প্রয়োজন নেই। রিশান মাথা নেড়ে বলল, আমার এখানকার গাইড সানি বলেছে এই ঝড় এক সময়ে থেমে যাবে তখন হেঁটে চলে যেতে পারব। তাছাড়া এখন বৃষ্টির মতো এসিড পড়ছে, কোনো স্কাউটশিপ পাঠানো মনে হয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
মহাকাশযান থেকে বিটি বলল, কখন যে তোমরা ভালোয় ভালোয় ফিরে আসবে এবং কখন যে আমরা এই পোড় গ্রহ থেকে বের হতে পারব কে জানে!
লি–রয় হেসে বলল, অধৈর্য হোয়ো না বিটি! প্রথমে আমরা এই গ্রহটাকে যেটুকু বিপজ্জনক ভেবেছিলাম এখন আর সেরকম বিপজ্জনক মনে হচ্ছে না।
কারণটা কী?
গত কয়েক ঘণ্টা নিডিয়া এই গ্রহের প্রাণী সম্পর্কে সত্যিকারের খানিকটা গবেষণা করেছে। সেটা করার পর মনে হচ্ছে অবস্থা খুব খারাপ নয়। লি–রয় নিডিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, নিডিয়া তুমি বলবে?
বলছি। নিডিয়া হাতের ছোট ক্রিস্টাল ডিস্কটাতে চোখ বুলিয়ে বলল, মানুষ এই গ্রহের হিসেবে প্রায় চল্লিশ বছর আগে এই গ্রহে বসতি করেছে। গ্রহটি বসতি স্থাপনের উপযোগী নয় তবু মানুষ এখানে বসতি করেছিল। কারণ এই গ্রহে এক ধরনের প্রাণের বিকাশ হয়েছিল। পৃথিবীর তুলনায় এই প্রাণ অত্যন্ত তুচ্ছ–এককোষী নিম্নস্তরের প্রাণ, বড়জোর এক ধরনের জীবাণুর মতো, কিন্তু একটি প্রাণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন এই নিম্নস্তরের প্রাণ নিয়ে গবেষণা করেছে, তার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করেছে এবং এক সময়ে আবিষ্কার করেছে এটি সম্পর্কে আর জানার কিছু বাকি নেই। তখন তারা পৃথিবীতে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিল, কিন্তু তাদের খুব দুর্ভাগ্য–ঠিক তখন তাদের একটা দুর্ঘটনা ঘটে, একজন বিজ্ঞানী এই এককোষী জীবাণুতে আক্রান্ত হয়ে কিছু করার আগেই মারা গেল।
এই গ্রহের এই মন খারাপ করা পরিবেশে সেটা তাদের জন্যে খুব বড় এটা আঘাতের মতো ছিল এবং কয়েকজন বিজ্ঞানী দাবি করেছে তারা মাঝে মাঝে তাদের মৃত সহকর্মীকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে
রিশান বাধা দিয়ে বলল, কী বললে তুমি? তাদের মৃত সহকর্মীকে দেখেছে?
হ্যাঁ, কিন্তু সেটা মানসিক চাপ থেকে সৃষ্টি এক ধরনের দৃষ্টিবিভ্রম, নানা ধরনের অভিযানে এ রকম ব্যাপার ঘটেছে বলে শোনা গেছে। যাই হোক, বিজ্ঞানীরা যখন পৃথিবীতে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন
রিশান আবার বাধা দিয়ে বলল, কী রকম ছিল তাদের সহকর্মী? স্পষ্ট না অস্পষ্ট?
নিডিয়া একটু অবাক হয়ে রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, সেটা পরিষ্কারভাবে লিপিবদ্ধ নেই–যেটুকু আছে তাতে মনে হয় অস্পষ্ট ছায়ার মতো–
কতক্ষণ দেখেছে তারা?
খুব অল্প সময়। নিডিয়া ঘুরে রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এই ব্যাপারটি নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছ কেন?
না, এমনি। বলে যাও যা বলছিলে।
হ্যাঁ, বিজ্ঞানীরা যখন ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন তারা আবিষ্কার করে তাদের মহাকাশযানটি কারা যেন নষ্ট করে গেছে। সেটি এমনভাবে নষ্ট করা হয়েছে যেটি শুধুমাত্র আরেকজন মানুষ করতে পারে প্রথমে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিল তাদের মাঝে কেউ একজন করেছে কিন্তু সেটি কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য একটা ব্যাপার নয়।
বিজ্ঞানীরা সেটা নিয়ে অনেক মাথা ঘামিয়েছে, শেষ পর্যন্ত তারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে যে এই গ্রহে নিশ্চয়ই কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী আছে। সেই প্রাণীকে তারা খুঁজে বের
করার অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পায় নি। এদিকে একজন একজন করে সবাই সেই জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
রিশান বাধা দিয়ে বলল, না সবাই না। সানি বেঁচে আছে।
হ্যাঁ, সানি ছাড়া সবাই মারা গেছে। সানির ভিতরে নিশ্চয়ই সেই জীবাণুর প্রতিষেধক কিছু একটা রয়ে গেছে যেটা আর কারো নেই। বিজ্ঞানীরা সেটা জানত না–আমরা জানি।
লি–রয় বলল, এর মাঝে কিছু দুর্বোধ্য ব্যাপার রয়েছে। যেমন–এটা মোটামুটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে এখানে কোনো এক ধরনের বুদ্ধিমান প্রাণী রয়েছে কিন্তু কিছুতেই সেই প্রাণীকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। এই প্রাণী মানুষের মহাকাশযানকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে কিন্তু কখনো সোজাসুজি কোনো মানুষের ক্ষতি করে নি। এই গ্রহের মানুষেরা মারা গেছে এই জীবাণু দ্বারা–যেটার নাম নি। কাজেই বলা যায় আমাদের সেই বুদ্ধিমান প্রাণী থেকে নিজেদের রক্ষা করার কোনো প্রয়োজন নেই, আমাদের নিজেদের রক্ষা করতে হবে গ্রুনি থেকে। এই জীবাণু থেকে!
নিডিয়া বলল, সেটা খুব সহজ। আমরা যতক্ষণ এই গ্রহে থাকব, মহাকাশচারীর পোশাক পরে থাকতে হবে। এর ভিতরের পরিবেশ পুরোপুরি পরিশুদ্ধ। বাইরে থেকে কোনো জীবাণু এর ভিতরে আসতে পারবে না।
মহাকাশযান থেকে বিটি বলল, শুনে খুশি হলাম কিন্তু তবুও তোমাদের বেশিক্ষণ এই গ্রহে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। ঝড়টা কমে যাওয়ামাত্র এখানে চলে আস।
হ্যাঁ চলে আসব।
লি–রয় বলল, এই গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীগুলোর কাজকর্মগুলো যদি খুব ভালোভাবে লক্ষ করা যায় তাহলে একটা বিচিত্র জিনিস চোখে পড়ে।
রিশান জিজ্ঞেস করল, কী?
বুদ্ধিমান প্রাণীটির বুদ্ধিমত্তা ধীরে ধীরে বেড়েছে। প্রথমে সে ছোটখাটো কৌশল করেছে, যতই দিন যাচ্ছে তার কৌশল বেড়েছে। দেখে মনে হয় প্রায় মানুষের মতো–যেন আস্তে আস্তে শিখছে।
নিডিয়া বলল, এই গ্রহে দ্বিতীয় আরেকটা ব্যাপার রয়েছে। কোনো বিচিত্র গ্রহে যখন মহাকাশচারীরা নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করে সবসময় তারা কিছু কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। অবাস্তব জিনিসপত্র দেখে–অপ্রাকৃতিক অভিজ্ঞতা হয়–এর সবই এক ধরনের বিভ্রম। কিন্তু এই গ্রহে যারা ছিল তাদের অপ্রাকৃতিক অভিজ্ঞতা তুলনামূলকভাবে বেশি। সত্যি কথা সেই অপ্রাকৃতিক ঘটনাগুলো পড়লে মনে হয় সত্যি সত্যি বুঝি সেগুলো ঘটেছে।
রিশান স্থির চোখে বলল, কী রকম ঘটনা?
নিডিয়া ইতস্তত করে বলল, আমি এখন ঠিক সেগুলো বর্ণনা করতে চাই না, মনের মাঝে এক ধরনের চাপের সৃষ্টি করতে পারে।
তবুও শুনি।
যেমন একজন বিজ্ঞানীর অভিজ্ঞতা লেখা আছে, সে এই গ্রহে একা একা হাঁটছিল। হঠাৎ–নিডিয়া কথা বলতে গিয়ে থেমে যায়।
হঠাৎ কী?
হঠাৎ সে ঘুটঘুটে অন্ধকারে আবছা আবছা দেখতে পায় তার দিকে কী যেন এগিয়ে আসছে, কাছাকাছি এলে দেখতে পেল একটা হাত
হাত?
হ্যাঁ, কনুই পর্যন্ত একটা হাত–তাকে নাকি জাপটে ধরার চেষ্টা করছিল, সেই বিজ্ঞানী ভয়ঙ্কর ভয় পেয়ে ছুটে কোনোভাবে পালিয়ে এসেছে। কয়েকদিন পর সে মারা গেল। নিডিয়া নিশ্বাস ফেলে বলল, খুব মন খারাপ করা গল্প।
হা। রিশান মাথা নেড়ে বলল, ঠিকই বলেছ
খানিকক্ষণ সবাই চুপ করে থাকে। নিডিয়া আবার কী একটা বলার চেষ্টা করছিল, ঠিক তখন ষুন বলল, এতক্ষণ নিডিয়া যেটা বলেছে তার সাথে পৃথিবীর নির্দেশের কিন্তু কোনো মতবিরোধ নেই।
বিশান সোজা হয়ে বলল, কী বলতে চাইছ তুমি?
আমি বলছি যে পৃথিবী থেকে আমাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে গ্রহটিকে জীবাণুমুক্ত করতে। এই জীবাণু বুদ্ধিমান প্রাণী নয়, কাজেই একে ধ্বংস করতে আমাদের কোনো দ্বিধা থাকা উচিত নয়
রিশান বাধা দিয়ে বলল, কিন্তু যে–কোনো জীবিত প্রাণী অন্য জীবিত প্রাণীর ওপর নির্ভর করে। পৃথিবীতে গাছপালার কোনো বুদ্ধি নেই, এখন আমরা যদি সব গাছ ধ্বংস করে দিই তাহলে পৃথিবীতে কি অন্যান্য বুদ্ধিমান প্রাণী বেঁচে থাকতে পারবে?
ষুন একটু রেগে উঠে বলল, গাছ আর জীবাণু এক ব্যাপার নয়। তাছাড়া এই ব্যাপারে আমাদের মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন নেই। এখানকার সমস্ত তথ্য পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমাদের সেই সিদ্ধান্ত মানতে হবে। যদি আমাদের ভালো নাও লাগে মানতে হবে। তারা হয়তো কিছু একটা জানে যেটা আমরা জানি না।
সেটা কী?
ষুন মাথা নাড়ল, আমি জানি না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি তাদের সিদ্ধান্ত মানুষের মঙ্গলের জন্যে আমাদের সেটা মানতেই হবে। এই গ্রহ ছেড়ে যাবার আগে আমাদের গ্রুনি জীবাণুকে ধ্বংস করে যেতে হবে।
রিশান লি–রয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বল লি–রয়?
লি–রয় একটু ইতস্তত করে বলল, ফুন সত্যি কথাই বলেছে রিশান। ব্যাপারটা আমরা আরো ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখব, কিন্তু মনে হয় ফিরে যাবার আগে আমাদের গ্রুনি জীবাণুকে ধ্বংস করে যেতে হবে। তুমি যদি কোনোভাবে প্রমাণ করতে পার এখানকার অদৃশ্য ভূতুড়ে বুদ্ধিমান প্রাণী কোনোভাবে গুনির ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে তাহলে অবিশ্যি ভিন্ন কথা।
মহাকাশযান থেকে বিটি বাধা দিয়ে বলল, আমার মনে হয় এটা নিয়ে এখন তর্ক বিতর্ক করে লাভ নেই। সবাই নিরাপদে মহাকাশযানে ফিরে আস, তারপর দেখা যাবে। তাছাড়া রিশানকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে, তার মনে হয় বিশ্রাম নেয়া দরকার।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। লি–রয় গলা উঁচিয়ে বলল, সবাই এখন বিশ্রাম নাও। ঝড়টা কমে আসা মাত্র মহাকাশযানে ফিরে আসতে হবে। শুভরাত্রি।
টুক করে একটা শব্দ হয়ে হলোগ্রাফিক দৃশ্য দুটি অদৃশ্য হয়ে গেল। রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে সানির দিকে তাকাল। সানি জ্বলজ্বলে চোখে রিশানের দিকে তাকিয়ে আছে। রিশান নরম গলায় বলল, ঘুমাও সানি, একটু বিশ্রাম নাও।
সানি খানিকক্ষণ তীব্র চোখে রিশানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমরা এই গ্রহের কিছু জান না।
রিশান অবাক হয়ে বলল, কী জানি না?
কিছু জান না
কেন এই কথা বলছ?
সানি কোনো কথা না বলে মুখ ঘুরিয়ে নিল। রিশান খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার জিজ্ঞেস করল, সানি, তুমি কেন এই কথা বলছ?
সানি কোনো কথা বলল না। রিশান আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাকে বলতে চাও?
সানি মাথা নাড়ল। রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে তাহলে এখন তুমি ঘুমাও
রিশান সানির পাশে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকে।
মহাকাশচারীর পোশাকে ঘুমানো খুব সহজ নয়, শুয়ে থেকে খানিকটা বিশ্রাম নেয়া হয়, তার বেশি কিছু নয়। দীর্ঘ সময় শুয়ে থেকে যখন রিশানের চোখে ঘুম নেমে আসে, হঠাৎ সে অবাক হয়ে দেখতে পায় গুহার মাঝামাঝি একটা নারীমূর্তি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে– তার দিকে তাকিয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে।
আতঙ্কে চিৎকার করতে গিয়ে অনেক কষ্টে সে নিজেকে সামলে নিল, সে কি সত্যি দেখছে নাকি এটি তার দৃষ্টিবিভ্রম? চোখ বন্ধ করার আগে সে বুকের কাছে তার স্বয়ংক্রিয় ছবি তোলার যন্ত্রটি স্পর্শ করে, তারপর শক্ত করে দুই চোখ বন্ধ করে ফেলল।
দীর্ঘ সময় পর সে যখন চোখ খুলে তাকাল তখন গুহায় কিছু নেই। রিশান ঘুরে সানির দিকে তাকাল–একটা পাথরে হেলান দিয়ে সে ঘুমোচ্ছ। তার মুখে এক ধরনের বিস্ময়কর প্রশান্তি, একটি শিশু এ রকম একটি গ্রহে একা একা বেঁচে থাকার পরও তার মুখে কেমন করে এ রকম একটি প্রশান্তির চিহ্ন ফুটে উঠতে পারে কে জানে। রিশান আবার ভালো করে তাকাল, শিশুটির মুখে শুধু প্রশান্তি নয় আরো একটা কিছু আছে যেটা সে প্রথমে ঠিক ধরতে পারে না। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝতে পারল, শুধু প্রশান্তি নয় শিশুটির চেহারায় এক ধরনের নিষ্পাপ সারল্য আছে যেটা সে বহুকাল দেখে নি। রিশান এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
রিশান দীর্ঘ সময় চুপচাপ শুয়ে রইল, ঘুরেফিরে তার শুধু নারীমূর্তিটির কথা মনে হতে থাকে। কেন সে বার বার একটি নারীমূর্তি দেখছে? এটি কি দৃষ্টিবিভ্রম নাকি সত্যি?
০৯. সানি একটা উঁচু বেঞ্চে শুয়ে আছে
সানি একটা উঁচু বেঞ্চে শুয়ে আছে, তার উপর উবু হয়ে ঝুঁকে পরীক্ষা করছে ষুন। ষুনের মাথার উপর নানা ধরনের যন্ত্রপাতি, পাশে বড় বড় মনিটর। একটা দশ বছরের শিশুর যেটুকু শান্ত হওয়ার কথা, সানি তার থেকে অনেক বেশি শান্ত। যুনের কথামতো সে দীর্ঘ সময় বেঞ্চে চুপচাপ শুয়ে রয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, তার হাবভাব চালচলনে একজন বয়স্ক মানুষের ছাপ খুব স্পষ্ট।
রিশান আর নিডিয়া বেশ খানিকটা দূর থেকে সানি এবং সুনকে লক্ষ করছিল। ষুন তৃতীয়বারের মতো সানির রক্ত পরীক্ষা করে অস্পষ্টভাবে মাথা নাড়ল, কিছু একটা হিসাব সে মিলাতে পারছে না। রিশান নিচু গলায় নিডিয়াকে জিজ্ঞেস করল, কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে?
হা। নিডিয়া মাথা নাড়ে। সানির শরীরে গ্রুনির বিরুদ্ধে একটা প্রতিষেধক থাকার কথা, সেটা পাচ্ছে না।
ও! রিশান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি কি সানি সম্পর্কে কিছু জান? কোথা থেকে এসেছে, কী বৃত্তান্ত?
হ্যাঁ। কাল রাতে পড়ছিলাম। এই বসতিতে নারা নামে একটা মেয়ে থাকত, খুব সাহসী মেয়ে। যখন বুঝতে পারল দীর্ঘ সময় এই বসতিতে থাকতে হবে তখন সে খুব একটা সাহসের কাজ করল।
ভ্রূণ ব্যাংক থেকে একটা বাচ্চা নিয়ে নিল?
না, সেটা তো খুব সাহসের কাজ হল না। সে ঠিক করল নিজের শরীরে একটা বাচ্চা করবে। আগে যেরকম করে করা হত।
সত্যি?
হ্যাঁ। তারপর সে নিজের শরীরে একটা ক্ৰণ বসিয়ে সেই শিশুটির জন্ম দিল। সেই শিশুটি হচ্ছে সানি।
কী আশ্চর্য! রিশান অবাক হয়ে মাথা নাড়ে–এও কি সম্ভব? পৃথিবীতেও তো মানুষ আজকাল সন্তান গর্ভধারণ করে না।
হ্যাঁ, কিন্তু নারা নামের এই মেয়েটি করেছিল। বাচ্চাটি জন্ম হবার পর মেয়েটির জীবন পাল্টে গেল–কী যে আনন্দে ছিল পরের তিন বছর! নিডিয়া বিষণ্ণ চোখে মাথা নেড়ে বলল, তিন বছর পর মেয়েটি মারা গেল, বাচ্চাটি একা একা বড় হয়েছে তারপর। একজন একজন করে সব মানুষ মারা গেল, তারপর বাচ্চাটি আরো একা হয়ে গেল। চারটি অপ্রকৃতিস্থ রবোট আর এই বাচ্চাটি! কী ভয়াবহ ব্যাপার–
রিশান আবার তাকাল, বেঞ্চে সানি চুপচাপ শুয়ে আছে, তার উপর ষুন খুব চিন্তিত মুখে উবু হয়ে ঝুঁকে আছে। গ্রুনির বিরুদ্ধে যে প্রতিষেধকটি তার শরীরে পাওয়া যাবে বলে সবাই ভেবেছিল সেটি তার শরীরে নেই। ষুন হতচকিতভাবে খানিকক্ষণ একটা মনিটরের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার আরো কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে সানির দিকে এগিয়ে যায়।
রিশান নিডিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, সানির মায়ের নাম ছিল নারা?
হ্যাঁ।
তার কি কোনো ছবি আছে?
হ্যাঁ, মূল তথ্যকেন্দ্রে তার ছবি আছে। কেন?
আমি, আমি একটু দেখতে চাই।
নিডিয়া উঠে দাঁড়াল, বলল, এস আমার সাথে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে রিশান হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল, নিডিয়া অবাক হয়ে বলল, কী হল থামলে কেন?
আমার একটা কথা মনে পড়েছে।
কী কথা?
মনে আছে প্রথম যখন আমরা এসেছিলাম তখন আমরা শীতলঘরে গিয়ে দেখেছিলাম সবগুলো মৃতদেহ পাশাপাশি দাঁড় করানো আছে?
হ্যাঁ। তার মাঝে একটা নিশ্চয়ই নারা।
হ্যাঁ
রিশান কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমি সেই ঘরটিতে আরেকবার যেতে চাই।
কেন?
মৃতদেহগুলো আরেকবার দেখতে চাই
নিডিয়া খানিকক্ষণ রিশানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, চল।
শীতলঘরটিতে যাওয়া পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বলল না। ঘরটির সামনে দাঁড়িয়ে দুজনেই একটু দ্বিধা করতে থাকে, শেষ পর্যন্ত রিশান একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, এস নিডিয়া, আমি একা ভিতরে যেতে চাই না।
ভারি দরজাটা ঠেলে দুজনে ভিতরে ঢোকে, ভিতরে তাপমাত্রা অনেক কম; কিন্তু মহাকাশচারীর পোশাক পরে থাকায় দুজনের কেউ সেটা বুঝতে পারে না। মৃতদেহগুলো। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে, দেখে মনে হয় হঠাৎ বুঝি সবগুলো একসাথে জেগে উঠে এগিয়ে আসবে। রিশান কয়েক পা এগিয়ে যায়। চোখের সামনে কাঁচে জমে থাকা জলীয় বাষ্পটুকু পরিষ্কার করে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মৃতদেহগুলো ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে দেখতে থাকে। প্রথম দুজন পুরুষ, তারপর একটি মেয়ে, তারপর আরো একজন পুরুষ। তারপর দুটি মেয়ে এবং তারপর আরেকজন পুরুষ। এই পুরুষটির পাশে দাঁড়ানো একটি মেয়ে এবং রিশান মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে পাথরের মতো জমে গেল।
নিডিয়া একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে রিশান?
রিশান হাত তুলে কাঁপা গলায় বলল এই কি নারা?
নিডিয়া অবাক হয়ে বলল, কিন্তু তুমি কেমন করে বুঝতে পারলে?
আমি যখন সানির খোঁজে বের হয়েছিলাম তখন একে দেখেছি।
নিডিয়া চমকে উঠে বলল, কী বললে? একে দেখেছ?
হ্যাঁ। স্পষ্ট দেখেছি, দুবার
তোমার চোখের ভুল কিংবা দৃষ্টিবিভ্রম।
হতে পারে, কিন্তু দৃষ্টিবিভ্রম হয়ে এই মেয়েটিকে কেন দেখব?
জানি না। আমি জানি না। নিডিয়া মাথা নেড়ে বলল, চল এই ঘর থেকে বের হয়ে যাই। এই ঘরের ভিতরে আমার ভালো লাগে না।
চল যাই।
দুজনে কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে হাঁটতে থাকে। সিঁড়ির কাছাকাছি এসে রিশান বলল, আমি যখন দ্বিতীয়বার এই মেয়েটিকে দেখেছি তখন তার ছবি তুলে রেখেছি।
কোথায় সেই ছবি?
নিশ্চয়ই আমার তথ্যকেন্দ্রে আছে
আমাকে দেখাও, আমি দেখতে চাই।
রিশান বুকের কাছাকাছি একটা সুইচ স্পর্শ করতে গিয়ে থেমে গিয়ে বলল, আমার একটু ভয় করছে। যদি দেখতে পাই কিছু নেই?
নিডিয়া একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ভয় পাওয়ার সময় পার হয়ে গেছে রিশান। তুমি ছবিটা বের কর
রিশান ছবিটা বের করল এবং রিশানের সাথে সাথে নিডিয়াও সবিস্ময়ে দেখল ছবিতে। সাদা একটি ছায়ামূর্তি স্থির চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ছবিটি কিংবা ছায়ামূর্তিটি খুব স্পষ্ট নয়; কিন্তু সেটি যে নারার ছায়ামূর্তি সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। দুজন কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলল না, রিশান অনুভব করল আতঙ্কের একটা বিচিত্র অনুভূতি তার মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। নিডিয়া রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার মনে হয় ব্যাপারটি সবাইকে জানানোর প্রয়োজন আছে।
হ্যাঁ, চল নিচে যাই।
নিচে বড় হলঘরটিতে চারটি রবোট পাশাপাশি বসেছিল। সানিকে নিয়ে পরীক্ষা শেষ হয়েছে, সে একটা গোল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ষুন চিন্তিত মুখে হাতে একটা ছোট ক্রিস্টাল ডিস্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। রিশান এবং নিডিয়াকে দেখে একটু এগিয়ে এসে বলল, আমি সানিকে খুব ভালো করে পরীক্ষা করে দেখেছি–অস্বাভাবিক কিছু পেলাম না। সে ঠিক অন্য সব মানুষের মতো
তাকে ইচ্ছে করলেই গ্রুনি আক্রমণ করতে পারে?
হ্যাঁ। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে তাকে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত করছে না?
না। রিশান সানির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, আমরা এখন পর্যন্ত যেসব ব্যাপার ঘটতে দেখেছি তার থেকে একটা জিনিস পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, গ্রুনি অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর একটা জীবাণুবিশেষ; কিন্তু একটা খুব বুদ্ধিমান প্রাণী তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। সানি যে এই জীবাণু দিয়ে আক্রান্ত হচ্ছে না তার কারণ সেই বিশেষ বুদ্ধিমান প্রাণী তাকে আক্রান্ত করতে চায় না।
ষুন ভুরু কুঁচকে বলল, আমি জানি না তুমি কেন এই কথা বলছ। অসংখ্যবার এই গ্রহকে তন্ন তন্ন করে খোজা হয়েছে, গ্রুনি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় নি। এই গ্রহের একমাত্র জীবন্ত প্রাণী হচ্ছে গ্রুনি। গ্রুনি একটা জীবাণু ছাড়া কিছু নয়, তার বুদ্ধিমত্তা থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না।
আমি সেটা নিয়ে এখন কিছু বলতে চাই না ষুন। কিন্তু আমি যখন সানিকে খুঁজতে গিয়েছিলাম তখন কী দেখেছি তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে। আমি তার ছবি তুলে এনেছি, নিডিয়া সেই ছবি দেখেছে।
কিসের ছবি?
রিশান সানির দিকে তাকাল, সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রিশান একটু ইতস্তত করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন ঘরঘর করে কোয়ারেন্টাইন ঘরের দরজা খুলে লি–রয় বড় হলঘরটিতে ঢুকল। মহাকাশচারীর পোশাকের মাঝে তার চেহারাতে এক ধরনের বিচলিত ভাব।
রিশান লি–রয়ের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, কী খবর লি–রয়?
আমি স্কাউটশিপটা দেখতে গিয়েছিলাম। তোমরা বিশ্বাস করবে না সেখানে কী হয়েছে।
কী?
খুব যত্ন করে কেউ একজন নিয়ন্ত্রণ মডিউলের মূল ভরকেন্দ্রটি নষ্ট করেছে। মহাকাশযান থেকে আরেকটা না আনা পর্যন্ত স্কাউটশিপটা চালানোর কোনো উপায় নেই।
কেউ কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না। হঠাৎ সানি একটু এগিয়ে এসে বলল, তোমার কি মাথা ব্যথা করছে?
লি–রয় অবাক হয়ে সানির দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ। তুমি কেমন করে বুঝতে পারলে।
সানি লি–রয়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, তোমার কি মাথার বাম পাশে বেশি ব্যথা করছে।
লি–রয় একটু অস্বস্তির সাথে ডান হাতটা উপরে তুলে বলল, হ্যাঁ মাথার বাম পাশে চিনচিন করে ব্যথা করছে?
ডান হাতটা কি তোমার অবশ লাগছে?
লি–রয় অবাক হয়ে নিজের ডান হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ। সত্যিই ডান হাতটা কেমন জানি অবশ অবশ লাগছে। তুমি কেমন করে জান?
সানি কোনো কথা না বলে লি–রয়ের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর ঘুরে রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, এই মানুষটিকে গ্রুনি আক্রমণ করেছে। একটু পরেই এই মানুষটি মারা যাবে। তাকে তোমরা শুইয়ে রাখ।
ঘরে কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই স্থির দৃষ্টিতে সানির দিকে তাকিয়ে থাকে, রিশান খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, কিন্তু কিন্তু লি–রয় মহাকাশচারীর পোশাক পরে আছে, তার ভিতরে কোনো কিছু ঢুকতে পারবে না।
লি–রয় হাত তুলে বলল, আমার মনে হয় সানি ঠিকই বলেছে, বাইরে আমার পোশাকের মাঝে হঠাৎ একটা সূক্ষ্ম ফুটো হয়েছে, অত্যন্ত সূক্ষ্ম, আমার পোশাকের মূল মডিউল সেটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে আমাকে রক্ষা করেছে। কিন্তু আমি জানি বাইরে কিছুক্ষণের জন্যে আমার পোশাকটি নিশ্ছিদ্র ছিল না।
কেউ কোনো কথা বলল না। লি–রয় খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘরের এককোনায় হেঁটে গিয়ে তার মহাকাশচারীর পোশাকটা খুলে ফেলতে ফেলতে বলল, এখন শুধুশুধু এটা পরে থাকার কোনো অর্থ হয় না–যা হবার তা হয়ে গেছে।
ষুন এগিয়ে গিয়ে বলল, কিন্তু একটা বাচ্চা ছেলের কথায় বিশ্বাস না করে–
লি–রয় হাত তুলে সুনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সে হয়তো বাচ্চা ছেলে কিন্তু এই গ্রহের ব্যাপারে সে সম্ভবত একমাত্র অভিজ্ঞ মানুষ। তাছাড়া আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার শরীরের মাঝে কিছু একটা ঘটছে। আমি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার আগে তোমাদের। সাথে ব্যাপারটা আলোচনা করতে চাই। তোমরা কাছাকাছি আস।
লি–রয় মহাকাশচারীর পোশাক থেকে বের হয়ে লম্বা একটা বেঞ্চে বসে ক্লান্ত গলায় বলল, মহাকাশযান থেকে হান আর বিটিকে ডাক, আমি শেষবার তোমাদের সাথে কথা বলে নিই। লিরয় সানির দিকে ঘুরে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, সানি–
সানি লি–রয়ের দিকে ঘুরে তাকাল।
আমার কতক্ষণ সময় আছে সানি?
বেশি সময় নাই। ঘণ্টাখানেক পরে তোমার ব্যথাটা কমে যাবে, তখন তোমার খুব ঘুম পেতে থাকবে। এক সময় তুমি ঘুমিয়ে যাবে তখন আর ঘুম থেকে উঠবে না
ঘণ্টাখানেক তো খারাপ সময় নয়। এর মাঝে অনেক কিছু করে ফেলা যায়। সময় নষ্ট করে লাভ নেই, এস তোমাদের আমি কয়েকটা নির্দেশ দিয়ে যাই।
ষুন এগিয়ে এসে বলল, আমি তবু তোমাকে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে চাই লি–রয়। তুমি এখানে শুয়ে পড়।
লি–বয় বাধ্য ছেলের মতো বেঞ্চে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। ষুন তার মাথায় একটা চতুষ্কোণ প্রোব লাগিয়ে একটা মনিটরের দিকে তাকিয়ে একটা ছোট নিশ্বাস ফেলল। লি–রয় মাথা ঘুরিয়ে ষুনের দিকে তাকিয়ে বলল, নিশ্চিত হতে পেরেছ ষুন?
ষুন কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল।
লি–রয় জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, কথাটা খুব খারাপ শোনাবে তবু আমি একটা কথা বলে যাই। আমার ধারণা তোমরা যারা এখানে আছ তোমরা কেউ বেঁচে ফিরে যেতে পারবে না। কাজেই হান আর বিটি যেন কোনো অবস্থায় এই গ্রহে নেমে না আসে।
ষুন মাথা নেড়ে বলল, আমাদের পৃথিবীর নির্দেশমতো গ্রহটিকে জীবাণুমুক্ত করা উচিত ছিল।
লি–রয় উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন সানি এগিয়ে এসে বলল, আমি তোমাকে একটা কথা বলতে পারি?
কী কথা?
তুমি কি আমার মাকে একটা কথা বলবে?
তোমার মাকে?
হ্যাঁ। বলবে আমি এখানে এভাবে থাকতে চাই না। আমার ভালো লাগে না। আমি তার কাছে যেতে চাই।
লি–রয় খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে বলব।
আর বোলো স্কাউটশিপে মূল ভরকেন্দ্র যেন ফিরিয়ে দেয়–যদি তারা রাজি না হয় তুমি নিজে ফিরিয়ে এনো।
লি–রয় অবাক হয়ে সানির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কী বলছ আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
সানি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি যদি না বোঝ কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু তবু তুমি শুনে রাখ। ঠিক আছে?
লি–রয় মাথা নাড়ল।
চারটি রবোট এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল, হঠাৎ তারা চার জন একসাথে উঠে দাঁড়ায়। একজন গলা নামিয়ে বলল, শীতলঘরে জায়গা করতে হবে।
হ্যাঁ সতের নম্বর মৃতদেহটা ডানদিকে সরিয়ে দিয়ে নয় নম্বরটা সামনে নিয়ে এলেই হবে।
অন্য দুইজন কলের পুতুলের মতো মাথা নেড়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। নিডিয়া একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি খুবই দুঃখিত লি–রয়। আমি খুবই দুঃখিত।
লি–রয় খানিকক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, এখানে দুঃখ পাবার কিছু নেই। আমি এখন যা বলি তোমরা মন দিয়ে শোন। আমাদের হাতে একেবারে সময় নেই।
সবাই একটু এগিয়ে আসে।
১০. ষুন দেয়ালে হেলান দিয়ে
ষুন দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে পা ছড়িয়ে বসেছে রিশান আর নিডিয়া। ঘরের মাঝামাঝি হলোগ্রাফিক একটা দৃশ্যে হান এবং বিটি বিষণ্ণ মুখে বসে আছে। সুন সবার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, তোমরা নিশ্চয়ই জান সব মহাকাশচারীর ভিতরেই একটা স্বপ্ন থাকে যে সে একবার পঞ্চম মাত্রার মহাকাশ অভিযানের নেতৃত্ব দেয়। লি–রয় মারা যাবার পর অভিজ্ঞতার দিক থেকে বিচার করে পঞ্চম মাত্রার অভিযান নয় নয় শূন্য তিনের নেতৃত্ব আমাকে দেয়া হয়েছে; কিন্তু এর নেতৃত্বের জন্যে আমার বিন্দুমাত্র মোহ নেই। আমি কখনো এভাবে নেতৃত্ব পেতে চাই নি। কিন্তু যেহেতু এভাবে এটা আমার হাতে এসেছে আমাকে এর দায়িত্ব নিতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে কী করতে হবে সেটা আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে না, সেই সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে নেয়া হয়ে গেছে। আমাকে শুধুমাত্র সেটা কার্যকর করতে হবে। আমি তোমাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি আমি সেই কাজটি খুব সুচারুভাবে করব।
রিশান ষুনকে থামিয়ে বলল, তুমি এই গ্রহটিকে জীবাণুমুক্ত করার কথা বলছ?
হ্যাঁ, তোমরা সেটা নিয়ে যত ইচ্ছে তর্ক–বিতর্ক করতে পার তাতে আর কিছু আসে যায় না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।
ঠিক এ রকম সময়ে চারটি রবোট ঘরে এসে ঢুকল। সবার সামনে যে দাঁড়িয়েছিল সে নিচু গলায় বলল, মহাকাশকেন্দ্রের মহাপরিচালকের কাছে থেকে তোমাদের জন্যে একটি নির্দেশ এসেছে।
ষুন অবাক হয়ে বলল, আমাদের জন্যে? নির্দেশ?
হ্যাঁ।
সেটি কী করে সম্ভব?
রবোটটি কোনো কথা বলল না, সামনে হেঁটে কোথায় জানি স্পর্শ করতেই দেয়ালের বড় স্ক্রিনে মহাকাশকেন্দ্রের সদর দফতরের মহাপরিচালকের ক্রুদ্ধ একটা ছবি ভেসে আসে। কোনোরকম ভূমিকা ছাড়া সে কঠোর গলায় প্রায় চিৎকার করে বলে, আমি তোমাদের নির্দেশ দিয়েছিলাম এই গ্রহটিকে জীবাণুমুক্ত করতে—তোমরা কর নি এবং শুধুমাত্র সেই কারণে তোমরা তোমাদের একজন সহকর্মীকে হারিয়েছ। তোমাদের হাতে সময় নেই, যদি আর কোনো সহকর্মী এই গ্রহে প্রাণ হারায় সেটি হবে সপ্তম মাত্রার অপরাধ এবং সেজন্যে তোমাদের প্রচলিত নিয়মে বিচার করা হবে।
মহাপরিচালক যেভাবে হঠাৎ করে কথা বলতে শুরু করেছিল ঠিক সেভাবে হঠাৎ করে কথা শেষ করে দেয় এবং স্ক্রিন থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। রিশান রবোটগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাদের কাছে এ রকম কয়টি নির্দেশ আছে?
পাঁচটা।
আমাদের একজন করে মারা গেলে একটি করে দেখানোর কথা?
রবোটগুলো মাথা নাড়ল।
অন্যগুলোতে কী আছে দেখতে পারি?
না। দেখানোর নিয়ম নেই।
রিশান অন্যমনস্কভাবে তার এটমিক ব্লাস্টারটি হাতে তুলে নিতে গিয়ে থেমে গেল, সে অস্ত্রটি সানির কাছে দিয়েছিল এবং সেটি এখনো ফিরিয়ে নেয়া হয় নি।
ষুন গলা উঁচিয়ে বলল, মহাপরিচালকের কথা তোমরা শুনেছ। কাজেই আমাদের কী করতে হবে তোমরা সবাই জান। আমি এখন নিজেদের মাঝে দায়িত্ব ভাগ করে দিতে চাই। কেউ কিছু বলতে চাও?
রিশান মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। আমার একটা প্রশ্ন আছে।
বল।
তুমি জান এখানে একটা বুদ্ধিমান প্রাণী রয়েছে। তারা খুব কৌশলে স্কাউটশিপকে অকেজো করে দিতে পারে। তারা মানুষের রূপ নিয়ে দেখা দিতে পারে। আমি নিজের চোখে দেখেছি, তোমাদেরকেও তার ছবি দেখিয়েছি। আমরা জানি এই বুদ্ধিমান প্রাণীর সাথে নির একটা সম্পর্ক আছে। গুনি জীবাণু, তাই সম্ভবত এই প্রাণীর নির্দেশে সানিকে স্পর্শ করে নি। এখন আমরা যদি গ্রুনিকে ধ্বংস করে দিই, সম্ভবত এই বুদ্ধিমান প্রাণীর সাথে আমাদের একমাত্র যোগসূত্রটি কেটে দেব–আমরা সম্ভবত এই বুদ্ধিমান প্রাণীরও একটি বড় ক্ষতি করব–হয়তো তাদেরও ধ্বংস করে দেব। তুমি কি মনে কর একটা বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে আমরা আরেকটা বুদ্ধিমান প্রাণীকে এভাবে ধ্বংস করতে পারি?
ষুন গম্ভীর গলায় বলল, তুমি কী করতে চাও?
এই পুরো রহস্যটির সমাধান লুকিয়ে আছে সানির মাঝে। সে কিছু ব্যাপার জানে যেটা আমরা কেউ জানি না। সে আমাদের এমন কিছু বলতে পারে যেটা থেকে পুরো রহস্যের সমাধান বের হতে পারে। আমি নিদের ধ্বংস করার আগে সানির সাথে কথা বলতে চাই।
আমি তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি।
সে কী বলেছে?
কিছু বলতে রাজি হয় নি।
আমি জানি সে এত সহজে কিছু বলবে না। সে মাত্র দশ বছরের বাচ্চা কিন্তু একা এ রকম একটা ভয়ঙ্কর পরিবেশে থেকে থেকে কিছু কিছু ব্যাপারে সে অসম্ভব কঠিন। তাকে কথা বলানোর আগে আমাদের নিজেদের তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে।
আমি লক্ষ করেছি তুমি তার চেষ্টা করছ–তোমার নিজের এটমিক ব্লাস্টারটি তার হাতে তুলে দিয়েছ!
রিশান এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমি তোমার কথায় এক ধরনের শ্লেষ শুনতে পাচ্ছি।
তুমি ভুল শুনছ না।
তাহলে আমি ধরে নেব তুমি আমার কথাকে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছ না?
না, সেটি সত্যি না। আমি তোমার কথায় যেটুকু গুরুত্ব দেবার কথা ঠিক ততটুকু গুরুত্ব দিচ্ছি। সানি কী জানে সেটা আমিও জানতে চাই। তবে আমি তার জন্যে অনির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করে থাকব না। আমাদের সময় নেই। আমি গ্রুনিকে ধ্বংস করার যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে চাই, একই সাথে সানির থেকে সবকিছু জানতে চাই
সেটা তুমি কীভাবে করবে?
ষুন রিশানের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে গোল জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। রিশান হঠাৎ চমকে উঠে ষুনের দিকে তাকাল, চিৎকার করে বলল, তুমি সানির মস্তিষ্ক স্ক্যান করবে?
আমার আর কোনো উপায় নেই।
কী বলছ তুমি? মস্তিষ্ক স্ক্যান করলে সমস্ত স্মৃতি নষ্ট হয়ে যায়। একজন মানুষের নিজস্ব সত্তা হচ্ছে তার স্মৃতি। তার স্মৃতি নষ্ট করা হচ্ছে মানুষকে ধ্বংস করা–
আমি জানি। বড় প্রয়োজনে বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয়—
তোমার এই সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো অধিকার নেই।
আমি অভিযান নয় নয় শূন্য তিনের দলপতি। আমার কী কী করার অধিকার আছে শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে।
রিশান উঠে দাঁড়াল। ষুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, রিশান তুমি কি আমার সিদ্ধান্তের সাথে একমত?
না।
তুমি জান আমার সিদ্ধান্তের সাথে একমত না হলে কী হবে?
রিশান কোনো কথা বলল না। ষুন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমার মনে আছে রিশান আমরা এই অভিযানে আসার আগে তুমি কী বলেছিলে?
রিশান কোনো কথা বলল না। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, তুমি বলেছিলে আমাদের এই দলটির প্রত্যেকে খুব কঠোর প্রকৃতির। তুমি ঠিকই বলেছিলে। আমরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত কঠোর। একজন খুব কঠোর মানুষ যদি তার দলের একজন অবাধ্য মহাকাশচারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় সে কী করবে বলে তোমার মনে হয়?
আমি জানি সে কী করতে চাইবে। কিন্তু কেমন করে করবে সেটা আমি জানি না।
ষুন প্রায় কোমল গলায় বলল, তুমি জান তোমার কাছে এটমিক ব্লাস্টারটি নেই। তুমি জান তোমার চারপাশে চারটি রবোট দাঁড়িয়ে আছে। মহাকাশ অভিযানের দলপতি হিসাবে এই চারটি রবোট সোজাসুজি আমার নিয়ন্ত্রণে
তুমি–তুমি আমাকে বন্দি করছ?
হ্যাঁ। তোমাকে আপাতত বন্দি করছি। তোমার কাছে কোনো সহযোগিতা আশা করছি, কাজেই তোমাকে অচেতন করে শীতলকক্ষে ভরে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেব। পৃথিবীর কর্তৃপক্ষ তোমাকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
রিশান মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল। সবাই স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ষুনও মাথা ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকাল, তোমরা আমার সিদ্ধান্তকে অপছন্দ করতে পার, তার কারণ আছে এবং তোমাদের তার অধিকারও আছে। কিন্তু আশা করছি কেউ এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবে না।
কেউ কোনো কথা বলল না। ষুন একটা নিশ্বাস ফেলে রবোটগুলোকে বলল, রিশানকে নিয়ে যাও তোমরা।
রিশান একবার ভাবল সে রবোটগুলোকে বাধা দেবে, কিন্তু অপ্রকৃতিস্থদর্শন এই রবোটগুলোকে যতই নির্জীব এবং দুর্বল মনে হোক না কেন, তাদের ধাতব শরীরে নিশ্চয়ই অমানুষিক জোর। তাদের বাধা দেয়া সম্ভবত খুব বড় ধরনের নির্বুদ্ধিতা। রিশান ষুনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সত্যি এটা করছ?
ষুন মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। তুমি আমার জায়গায় হলে তুমিও করতে।
নিডিয়া ক্লান্ত গলায় বলল, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমার সামনে এটা ঘটছে।
ষুন নিডিয়ার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু এটা সত্যি ঘটছে। বিশ্বাস কর।
১১. রিশান ছোট ঘরটিতে চুপচাপ
রিশান ছোট ঘরটিতে চুপচাপ বসে আছে। ঘরটি বাইরে থেকে বন্ধ, সম্ভবত একটা রবোটকে বাইরে পাহারা হিসেবেও রাখা আছে। তার এখান থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই, সে বের হতে চাইছেও না। বের হয়ে তার কিছু করার নেই। ষুন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করে প্রত্যেকটা কাজ করছে, কোথাও কোনো ফাঁকি নেই। সে এই ঘরে বসে যোগাযোগ চ্যানেলে কান পেতে নানা ধরনের সংবাদের আদান প্রদান থেকে সব খবরাখবর পেয়েছে। মহাকাশযানের মূল সরবরাহ থেকে আটত্রিশটা নিক্সিরল গ্যাসের ট্যাংক এই গ্রহটিতে পাঠানো হয়েছে। ট্যাংকগুলো গ্রহটির বিভিন্ন জায়গায় ভাসমান অবস্থায় আছে। নির্দিষ্ট সময়ে ট্যাংকগুলো ফেটে নিক্সিরল গ্যাস বের হয়ে গ্রহটিতে ছড়িয়ে পড়বে। মানুষের জন্যে গ্যাসটি ক্ষতিকর নয়। এক ধরনের ঝাঁজালো গন্ধ রয়েছে এবং দীর্ঘ সময় নিশ্বাসের সাথে শরীরে প্রবেশ করে এক ধরনের সাময়িক অবসাদ ঘটাতে পারে, কিন্তু গ্রুনি জীবাণুর জন্যে এই গ্যাসটি ভয়ঙ্কর। গুনি জীবাণুটির বেশ অনেকগুলো শুড়ের মতো অংশ রয়েছে, এই গ্যাসটির স্পর্শে সেগুলো সাথে সাথে অকেজো হয়ে যায়, তার ত্বকের ভিতর দিয়ে গ্যাসটি ভিতরে প্রবেশ করে। জীবাণুটির মূল অংশটি তখন মিলি সেকেন্ডের মাঝে ফেটে যায়। ভিতর থেকে যে সমস্ত জৈব অণু বের হয়ে আসে সেগুলো তখন অন্য গ্রুনিকে আক্রমণ করে এবং কিছুক্ষণের মাঝে বিশাল গ্রুনির কলোনি ধ্বংস হয়ে যায়। অত্যন্ত কার্যকরী একটি পদ্ধতি, মানুষ দীর্ঘকাল গবেষণা করে এটি বের করেছে। গ্রহটি বেশি বড় নয়, তার বায়ুমণ্ডলে নির্দিষ্ট পরিমাণ নিক্সিরল গ্যাস সৃষ্টি করার জন্যে আটত্রিশটা ট্যাংকই যথেষ্ট। নিক্সিরল গ্যাস অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলে সহজে অক্সিডাইজ হয়ে অকেজো হয়ে যায়। এই গ্রহে অক্সিজেন খুব কম, বলতে গেলে নেই। যেটুকু আছে সেটাই নিক্সিরলকে ধীরে ধীরে অক্সিডাইজ করে প্রায় ছয় ঘণ্টা পরে নিষ্ক্রিয় করে দেবে। ছয় ঘণ্টা অনেক সময় এর পর এই গ্রহটিতে গ্রুনির কোনো চিহ্ন থাকার কথা নয়।
পুরো ব্যাপারটি চিন্তা করে রিশান ভিতরে এক ধরনের অসহ্য ক্ষোভ অনুভব করে। পৃথিবীর বাইরে একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী অথচ তার একমাত্র যোগসূত্রটিকে কী সহজে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। মানুষের কাছে কি এর থেকে বেশি কিছু আশা করা যেত না?
রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে পুরো ব্যাপারটি ভুলে যাবার চেষ্টা করে। তার পক্ষে যেটুকু চেষ্টা করা সম্ভব সে করেছে। পৃথিবীতেও এর আগে নানা ধরনের অমানবিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, এই গ্রহে কেন নেয়া হবে না? সিদ্ধান্তটি তো হঠাৎ করে নেয়া হচ্ছে না, অনেক চিন্তাভাবনা করে নেয়া হয়েছে। এই গ্রহের প্রত্যেকটা তথ্যকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে, সেই তথ্য দীর্ঘদিন থেকে পর্যালোচনা করা হয়েছে, তারপর সেখান থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের পাঠানো হয়েছে। বিশাল মহাকাশযানে আটত্রিশ ট্যাংক নিক্সিরল থাকা কি একটা দুর্ঘটনা? কিছুতেই নয়।
রিশান সবকিছু ভুলে যেতে চেষ্টা করে, কিন্তু সেটা সহজ নয়। মানুষের মস্তিষ্ক অত্যন্ত বিচিত্র একটি জিনিস, সেটি কখন কীভাবে কাজ করবে সেটি বোঝা খুব মুশকিল। পুরো ব্যাপারটি মাথা থেকে সরিয়ে রাখার একটি মাত্র উপায়, অন্য কিছুতে মনোযোগ দেয়া। ষুন তাকে এই ছোট ঘরটিতে বন্দি করে রেখেছে সত্যি কিন্তু তার যোগাযোগ মডিউলটি অকেজো করে দেয় নি। সে ইচ্ছে করলে মূল তথ্যকেন্দ্র থেকে খবরাখবর নিতে পারে, কোনো একটা কিছু নিয়ে পড়াশোনা করতে পারে। যে জীবাণুটি কিছুক্ষণ পর এই গ্রহ থেকে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে সে সেই গ্রুনি জীবাণু নিয়েই সময় কাটাবার সিদ্ধান্ত নিল।
গ্রুনি জীবাণুটি অত্যন্ত নিম্নস্তরের জীবাণু। এককোষী একটা প্রাণী, কোষের মাঝখানে একটি সাধারণ নিউক্লিয়াস এবং তার চারপাশ দিয়ে শুড়ের মতো কিছু একটা বের হয়ে আছে। এমনিতে দীর্ঘ সময় সেটি সম্পূর্ণ জড় পদার্থের মতো বেঁচে থাকে, নির্দিষ্ট তাপ এবং রাসায়নিক পরিস্থিতিতে সেটা ভাগ হয়ে নিজের সংখ্যা বাড়াতে শুরু করে।
রিশান দীর্ঘ সময় নিয়ে এই জীবাণুটির বংশ বিস্তার পদ্ধতি নিয়ে পড়াশোনা করল, পৃথিবীর জৈবিক প্রাণী থেকে পদ্ধতিটি ভিন্ন কিন্তু সেরকম বৈচিত্র্যময় কিছু নয়, কিছুক্ষণের মাঝেই সে সেটা নিয়ে সময় ব্যয় করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে যোগাযোগটি বন্ধ করার আগে নি জীবাণুর কিছু ছবি দেখে খানিকক্ষণ সময় কাটাবে বলে ঠিক করল। এককোষী প্রাণীর ছবি খুব বেশি চিত্তাকর্ষক হতে পারে না, সে মিনিট পাঁচেক এই জীবাণুটির নানা ভঙ্গিমায় কিছু ছবি দেখে পুরো ফাইলটুকু বন্ধ করার আগে হঠাৎ একটি ছবি দেখে থমকে গেল। দুটি গ্রুনি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে, তারা একে অন্যের শুড় স্পর্শ করে আছে। ছবিটি খুব সাধারণ একটা ছবি কিন্তু এর মাঝে কী একটা জিনিস তার খুব পরিচিত মনে হয় যেটা সে আগে কোথাও দেখেছে। সেটা কী হতে পারে?
রিশান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারে না। রিশান সাবধানে আরো কয়েকটি ছবি দেখে, একসাথে বেশ কয়েকটি গ্রুনি জীবাণু একে অন্যের শুড় স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে আছে। এই ছবিটি তার আরো বেশি পরিচিত মনে হচ্ছে, কোথায় সে দেখেছে এই ছবি?
রিশান ছবিগুলোর নিচে লেখা তথ্যগুলো পড়তে থাকে। মাঝে মাঝে গ্রুনি জীবাণু একে অন্যের গঁড় স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন এই শুড়ের মাঝে দিয়ে এক ধরনের সঙ্কেত আদান প্রদান হয় বলে মনে করা হয়–
হঠাৎ রিশান বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল, নিউরন সেল! এই গুনি জীবাণু দেখতে হুবহু মানুষের মস্তিষ্কের নিউরন সেলের মতো! লম্বা শুড়গুলো হচ্ছে নিউরন সেলের এক্সন আর ডেন্ড্রাইটস। মানুষের মস্তিষ্কে অসংখ্য নিউরন সেলের ডেণ্ড্রাইটস একটি অন্য একটির সাথে সিনাপস দিয়ে জুড়ে থাকে, সেখান থেকে আসে মানুষের বুদ্ধিমত্তা–মানুষের সৃজনশীল ক্ষমতা, চিন্তা করার অনুভূতি! একটি নিউরন সেল পুরোপুরি অর্থহীন কিন্তু মানুষের মস্তিষ্কে যখন এক শ বিলিয়ন নিউরন সেল পাশাপাশি সজ্জিত হয়ে থাকে, ডেন্ড্রাইটস দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় তখন সেটা হয়ে যায় এক বিস্ময়কর রহস্য! এই গ্রুনি জীবাণুও নিশ্চয়ই সেরকম। একটি বা অসংখ্য জীবাণু আলাদাভাবে পুরোপুরি বুদ্ধিহীন নিম্ন–শ্রেণীর একটা প্রাণী, কিন্তু যখন এগুলো কোথাও মানুষের মস্তিষ্কের মতো সাজানো হয়ে যায় সেটা হয়ে যায় ঠিক মানুষের মতো বুদ্ধিমান একটা প্রাণী।
রিশান লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, নিশ্চয়ই তাই হচ্ছে এখানে। তাই মানুষ কখনো বুদ্ধিমান। প্রাণীগুলোকে খুঁজে পায় নি, যখনই জোর চেষ্টা করেছে শুধু গ্রুনিকে পেয়েছে। গ্রুনিই হচ্ছে বুদ্ধিমান প্রাণী। গ্রুনিকে ধ্বংস করে দেয়ার অর্থ হচ্ছে এই বুদ্ধিমান প্রাণীকে ধ্বংস করে দেয়া। শুধু তাই নয়, হঠাৎ করে রিশানের আরেকটা জিনিস মনে হল, গ্রুনি যখন কোনো মানুষকে আক্রমণ করে সেটা সোজাসুজি মানুষের মস্তিষ্ককে আক্রমণ করে–একটা করে গ্রুনি জীবাণু একটা করে নিউরনকে ধ্বংস করে। সেই নিগুলো তখন গিয়ে সেই মস্তিষ্ককে অনুকরণ করে কিছু একটা তৈরি করে। সেটা হয়তো সেই মানুষের মস্তিষ্কের মতো হয়, হয়তো সেই মানুষের বুদ্ধিমত্তা জন্ম নেয়, সেই মানুষের স্মৃতি।
রিশান উত্তেজিত হয়ে মাথা নাড়ল, নিশ্চয়ই তাই হয়–তাই সানির মা মারা যাবার পরও সানির জন্যে তার ভালবাসা এখনো গ্রুনিদের মাঝে বেঁচে আছে। তাই ঘুরেফিরে তার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, তাই অন্য সবাই মারা গেলেও নিরা সানিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। স্কাউটশিপ অকেজো করার কৌশলগুলো তাই মানুষের আশ্চর্য বুদ্ধিপ্রসূত! সানি নিশ্চয়ই এসব জানে। তাই লি–রয়কে দিয়ে অন্যদের কাছে খবর পাঠিয়েছিল! রিশান তাড়াতাড়ি তার কমিউনিকেশান মডিউল স্পর্শ করে ষুনের সাথে যোগাযোগ করল ষুন ব্যস্তভাবে করিডোর ধরে হেঁটে যাচ্ছিল, রিশানের আহ্বানে খুব অবাক হয়ে বলল, তুমি কিছু বলবে?
হ্যাঁ, ষুন। আমার মনে হয় আমি এখানকার বুদ্ধিমান প্রাণীদের রহস্য ভেদ করেছি।
তুমি রহস্য ভেদ করেছ?
হ্যাঁ।
আমি জানি কেন এখানে বুদ্ধিমান প্রাণী আছে আর কেন আমরা সেই প্রাণীদের খুঁজে পাই না। আমি এখন জানি কেন গ্রুনিদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
ষুন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, রিশান, আমি জানি তুমি অসম্ভব বুদ্ধিমান, আমি জানি তুমি সত্যিই রহস্য ভেদ করেছ। কিন্তু ধরে নাও তার জন্যে দেরি হয়ে গেছে।
দেরি হয়ে গেছে?
হ্যাঁ, আমি আমার পরিকল্পনার কোনো পরিবর্তন করব না। এর মাঝে নিক্সিরল গ্যাস এই গ্রহে পৌঁছে গেছে, গ্যাসের ট্যাংকগুলোর তাপমাত্রা আস্তে আস্তে বাড়ানো হচ্ছে, আর ঘণ্টাখানেকের মাঝে সেগুলো এই গ্রহে ছড়িয়ে দেয়া হবে। আমি আমার পরিকল্পনামতো এগিয়ে যাব।
কিন্তু ষুন–
আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। ষুন মাথা নেড়ে বলল, তোমাকে শারীরিকভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে। আমি এখন তোমাকে মানসিকভাবে বন্দি করব। তুমি এখন আর। কারো সাথে কথা বলতে পারবে না।
ষুন তার হাতে কী একটা সুইচ স্পর্শ করতেই রিশানের চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ করে এক ধরনের ভয়ঙ্কর নীরবতা নেমে এল রিশানকে ঘিরে। রিশান মাথা ঘুরে তাকাল এবং যেন প্রথমবারের মতো আবিষ্কার করল সে একটা ছোট ঘরে বন্দি হয়ে আছে। বাইরে বের হওয়া দূরে থাকুক, সে কারো সাথে মুখের কথা পর্যন্ত বলতে পারবে না।
অসহ্য ক্রোধে হঠাৎ তার সবকিছু ভেঙেচুরে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে।
১২. রিশান দীর্ঘ সময় ঘরে পায়চারি
রিশান দীর্ঘ সময় ঘরে পায়চারি করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে, তাকে দেখায় খাঁচায় আটকে থাকা একটা বুনো প্রাণীর মতো যেটি কিছুতেই নিজের পরিস্থিতিকে মেনে নিতে পারছে না। রিশান সমস্ত ঘরটি আরেকবার ঘুরে এসে বুঝতে পারল তার কিছু করার নেই; কিন্তু তবুও সে কিছুতেই পুরো ব্যাপারটি মেনে নিতে পারবে না। সব মানুষের ভিতরেই নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ যুক্তিহীন এক ধরনের বিশ্বাস কাজ করে যে কারণে একটি অবাস্তব অসম্ভব পরিবেশেও সে একেবারে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যেতে থাকে। রিশান এ রকম একটা পরিবেশে এসে পড়েছে। তার কিছু করার নেই তবু তাকে চেষ্টা করে যেতে হবে।
সে প্রথমে ঘরটিকে ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে পরীক্ষা করে। দেখে বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু নিশ্চিতভাবে এখানে কোনো ধরনের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে যেটি তার ওপর দৃষ্টি রাখছে এবং কোনো একটা তথ্যকেন্দ্রে খবর পাঠিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু ঘরটি মানুষের আবাসস্থলে, কাজেই সেটি নিশ্চয়ই এখানে অক্সিজেন সরবরাহ করে যাচ্ছে, বাতাস পরিশোধন করে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় রাখছে। রিশান খুঁজে খুঁজে বাতাস, তাপ এবং আলোর উৎসগুলো বের করে, তারপর নিজের মহাকাশচারীর পোশাক থেকে যন্ত্রপাতির ছোট বাক্সটি বের করে সেগুলো নষ্ট করে দেয়। সাথে সাথে ঘরের মাঝে এক ধরনের ভূতুড়ে অন্ধকার নেমে আসে। ঘরটিতে এখন অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাবার কথা এবং সেটি কোথাও একটি বিপদ সঙ্কেত পাঠিয়ে তাকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করার কথা। তাকে কীভাবে উদ্ধার করা হবে সে জানে না কিন্তু তার জন্যে প্রথমেই দরজাটি খুলতে হবে। একবার দরজা খোলা হলে বাইরে। বের হবার কিছু একটা ব্যবস্থা করা হয়তো অসম্ভব হবে না।
ঘরটিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে আসছে, সে নিজে মহাকাশচারীর পোশাকের মাঝে রয়েছে বলে তার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। তাপমাত্রাও কমে আসছে, কিছুক্ষণের মাঝেই সেটা বিপদসীমা অতিক্রম করে যাবে। তার মহাকাশচারীর পোশাকের যোগাযোগ কেটে দেয়া হয়েছে কিন্তু তবুও নিশ্চয়ই সেটা তার শারীরিক অবস্থার নানারকম তথ্য পাঠিয়ে যাচ্ছে। সে হাতড়ে হাতড়ে সেই যোগাযোগটাও কেটে দিল, এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি কাজ, যার অর্থ সে এই আবাসস্থলের মূল কেন্দ্র থেকে আর কোনো ধরনের সাহায্য পেতে পারবে না। সাথে সাথে রিশান একটি ক্ষীণ শব্দ শুনতে পায়–শেষ পর্যন্ত সে নিশ্চয়ই একটা বিপদ সঙ্কেত তৈরি করতে পেরেছে।
এই আবাসস্থলে কোনো মানুষ নেই, তাকে উদ্ধার করার জন্যে কোনো এক ধরনের রবোট হাজির হবে, তাদের বুদ্ধিমত্তা বা যুক্তিতর্ক সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। সে কী করবে এখনো জানে না; কিন্তু সেটা নিয়ে ভাবার সময় নেই। রিশান হঠাৎ ঘরের বাইরে একটা শব্দ শুনতে পায়–কিছু একটা তাকে উদ্ধার করতে এসেছে বলে মনে হয়।
খুট করে একটা শব্দ হল এবং সাথে সাথে দরজা খুলে একটা প্রাচীন রবোট এসে ঢোকে, তার মাথার উপরে দুটি ফটোসেলের চোখ, পায়ের নিচে ধাতব চাকা। শক্তিশালী যান্ত্রিক দেহে সেটি প্রায় রিশানের দিকে ছুটে আসতে শুরু করে। রিশানের কাছাকাছি এসে সেটি তাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করল, যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট করে রেখেছে বলে কিছু শুনতে পেল না। রবোটটি তার উপর ঝুঁকে পড়ার চেষ্টা করছে, শারীরিক তথ্যগুলো পৌঁছাচ্ছে না বলে সেটি এখনো কিছু বুঝতে পারছে না। রিশান মুখে যন্ত্রণার মতো একটা ভঙ্গি করে মেঝেতে শুয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিল, রবোটটিকে তখন আরো অনেক ঝুঁকে পড়তে হবে। প্রাচীন এই রবোটগুলো এ রকম ভঙ্গিতে কাজ করার উপযোগী নয়, সেটিকে তখন কোনোভাবে বিভ্রান্ত করার সুযোগ পাওয়া যেতে পারে।
রিশান প্রথমে দুই হাতে তার মাথা স্পর্শ করে, তারপর তাল সামলাতে না পারার ভঙ্গি করে ঘুরে নিচে পড়ে যায়। রবোটটি দ্রুত কিছু বিপদ সঙ্কেত তৈরি করে মূল কেন্দ্রে তথ্য। পাঠাতে শুরু করে রিশানের উপর ঝুঁকে পড়ে। তার সমস্যাটি কোথায় রবোটটি এখনো বুঝে উঠতে পারে নি।
রবোটটি বিপজ্জনক ভঙ্গিতে তার উপর ঝুঁকে পড়েছে। সে যদি হঠাৎ করে খুব জোরে ভরকেন্দ্রে একটা ধাক্কা দিতে পারে সেটা তাল হারিয়ে পড়ে যেতে পারে, তখন কপোট্রনের পিছনে পারমাণবিক ব্যাটারিটা অচল করে দেয়ার সময় পাওয়া অসম্ভব নয়। রিশান চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে মুখে যন্ত্রণার একটা ভাব ফুটিয়ে কথা বলার ভঙ্গি করতে থাকে। যোগাযোগ মডিউল বন্ধ করে রাখা আছে, রবোটটির পক্ষে কথা শোনার কোনো উপায় নেই। মাইক্রোফোনে শব্দতরঙ্গ অনুভব করার একটা চেষ্টা করার জন্যে রবোটটি আরো ঝুঁকে পড়ল এবং রিশান তখন তার বুকের কাছাকাছি অংশ স্পর্শ করে জোরে একটা ধাক্কা দিল, রবোটটি তাল হারিয়ে হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে যায় এবং সেটিকে খুব বিচিত্র এবং হাস্যকর দেখাতে থাকে।
রিশান দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে রবোটটির পিছনে ছুটে গিয়ে কপোট্রনের নিচে হাত দিয়ে ঢাকনাটি খুলে দেখে পাশাপাশি দুটি পারমাণবিক ব্যাটারি লাগানো রয়েছে। হ্যাঁচকা টান দিতেই দুটি ব্যাটারিই খুলে গেল এবং সাথে সাথে রবোটটি সম্পূর্ণ অকেজো জঞ্জালের মতো উবু হয়ে পড়ে রইল। রিশান কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কোথাও অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে না। সে ঘর থেকে বের হয়ে এল। তার হাতে কোনো অস্ত্র নেই, থাকলে ভালো। হত।
রিশান সাবধানে করিডোর ধরে হেঁটে যেতে থাকে। ষুন তার যোগাযোগ মডিউলটি অকেজো করে রেখেছে, যদি সেটা চালু থাকত তাহলে এখন কে কোথায় আছে বুঝতে পারত। আশপাশের শব্দ শোনার জন্যে সে তার পোশাকের সবগুলো ইউনিট চালু করে দেয়। করিডোরের শেষে একটি দরজা, তার অন্য পাশে একটা বড় হলঘরের মতো। হলঘরটি থেকে সে বের হয়ে আরেকটি করিডোরে হাজির হল, তার শেষ মাথায় একটা ঘরে একটা আলো জ্বলছে। রিশান সাবধানে সেদিকে হেঁটে যেতে থাকে এবং ঠিক তখন সে প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেল। বিস্ফোরণটি এসেছে তার এটমিক ব্লাস্টারটি থেকে, যেটি সে সানির হাতে দিয়ে এসেছিল। ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটছে এই আবাসস্থলে– ভেবেচিন্তে কাজ করার সময় পার হয়ে গেছে এখন। রিশান বিস্ফোরণের শব্দের দিকে ছুটে যেতে থাকে।
অনেক দূর থেকে সে হইচই চেঁচামেচি এবং চিৎকার শুনতে পায়, কাছে গিয়ে তার চক্ষুস্থির হয়ে যায়। দেয়ালে পিঠ দিয়ে সানি ড়িয়ে আছে, তার হাতে রিশানের এটমিক ব্লাস্টারটি। ঘরে ষুন এবং নিডিয়া পাথরেঞ্জর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। কাছাকাছি একটি রবোটের ধ্বংসাবশেষ, হাঁটুর উপর থেকে পুরো অংশটি এটমিক ব্লাস্টারের বিস্ফোরণে পুরোপুরি বাষ্পীভূত হয়ে গেছে। ঘরে দেয়ালে একটা বড় গর্ত এবং সমস্ত ঘরে এক ধরনের ধোঁয়া। সানি এটমিক ব্লাস্টারটি আরেকটু উপরে তুলে বলল, আমার কাছে যদি কেউ আসে আমি ঠিক এইভাবে শেষ করে দেব। খবরদার কেউ আছে আসবে না।
রিশান দরজার কাছাকাছি থেমে গিয়ে বলল, আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি সানি। তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পার।
আমি কাউকে বিশ্বাস করি না
এটমিক ব্লাস্টারটি অসম্ভব শক্তিশালী সানি, যদি কোনোভাবে আবাসস্থলের মূল দেয়ালে ফুটো হয়ে যায়, পুরো আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাবে।
ধ্বংস হলে হবে, কিছু আসে যায় না আমার
রিশান এক পা এগিয়ে এসে বলল, সানি সত্যি তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না? বেঁচে থাকতে হলে কাউকে–না–কাউকে বিশ্বাস করতে হয়।
আমি কাউকে বিশ্বাস করি না
কর। তুমি তোমার মাকে বিশ্বাস কর। কর না?
সানি চমকে উঠে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিশানের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না। রিশান আরো এক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, কর না?
তুমি আমার মায়ের কথা জান?
জানি।
সানি হঠাৎ করে এটমিক ব্লাস্টারটা বিপজ্জনকভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে চিৎকার করে বলল, তাহলে সবাইকে মেরে ফেলছ কেন?
আমি মারছি না সানি। বিশ্বাস কর আমি বাঁচাতে চাইছি। তুমি আমাকে এটমিক ব্লাস্টারটি দাও, হয়তো কিছু একটা করা যাবে
না।
দাও সানি। তুমি আমাকে বিশ্বাস কর– মানুষ হলে কাউকে–না–কাউকে বিশ্বাস করতে হয়। আমাকে তোমার বিশ্বাস করতেই হবে।
তুমি আমার মাকে বাঁচাবে?
আমি জানি না সম্ভব হবে কি না; কিন্তু আমি চেষ্টা করব। আমাদের হাতে সময় খুব কম সানি। তুমি আমাকে এটমিক ব্লাস্টারটা দাও।
সানি কিছুক্ষণ রিশানের দিকে তাকিয়ে থেকে তার দিকে এটমিক ব্লাস্টারটা এগিয়ে দেয়।
রিশান এগিয়ে গিয়ে সানির হাত থেকে সেটা নেয়া মাত্র ষুন রিশানের দিকে ঘুরে বলল, তুমি কেমন করে বের হয়ে এসেছ?
সেটা নিয়ে এখন কথা বলার প্রয়োজন বা সময় কোনোটাই নেই ষুন। তোমাকে সবার আগে নিক্সিরল গ্যাসের ট্যাংকগুলো বিকল করতে হবে।
ষুন খানিকক্ষণ কোনো কথা না বলে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর শীতল গলায় বলে, আমি এই অভিযানের দলপতি, এখানে আমি আদেশ দেব–
রিশান অধৈর্য হয়ে বলল, দলপতিগিরি দেখানোর অনেক সময় পাবে ষুন, এখন কাজের কথায় আস–এই মুহূর্তে আমাদের নিক্সিরল গ্যাস থামাতে হবে, যেভাবে হোক। এই পৃথিবীর সব বুদ্ধিমান প্রাণী ধ্বংস হয়ে যাবে না হয়। তারা গ্রুন দিয়ে তৈরী–এই গ্রহের যারা মারা গেছে তাদের সবার মস্তিষ্কের কপি তৈরি করেছে, সানির মা আছে সেখানে, আমি নিশ্চিত লি–রয়ও এখন আছে!
কী বলছ তুমি?
আমি সত্যি বলছি। সানিকে জিজ্ঞেস করে দেখ।
ষুন ঘুরে সানির দিকে তাকাল, সানি মাথা নাড়ল সাথে সাথে। ষুন খানিকক্ষণ হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে থেকে বলল, তার মানে এখানে বুদ্ধিমান প্রাণী আসলে এখানকার মৃত মানুষেরা?
অনেকটা তাই—
তাহলে তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করে না কেন?
আমরা কি তার সুযোগ দিয়েছি? কিন্তু এখন কথা বাড়িয়ে লাভ নেই ষুন, নিক্সিরল গ্যাসকে যেভাবে হোক বন্ধ করতে হবে ষুন। যেভাবে হোক–
ষুন কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। রিশান অধৈর্য হয়ে বলল, কথা বলছ না কেন ষুন?
ষুন ইতস্তত করে বলল, আমি দুঃখিত রিশান, নিক্সিরল গ্যাসের ট্যাংকগুলো চার্জ করা হয়ে গেছে।
তার অর্থ কী?
তার অর্থ সেগুলোর নিয়ন্ত্রণের জন্যে যে ইউনিটগুলো ছিল সেগুলো কাজ করতে শুরু করেছে। এখন থেকে কিছুক্ষণের মাঝে সেগুলো বিস্ফোরিত হয়ে সারা গ্রহে নিক্সিরল ছড়িয়ে দেবে।
এটা বন্ধ করার কোনো উপায় নেই?
না।
রিশান হতবুদ্ধির মতো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সানির দিকে ঘুরে তাকাল, তার সারা মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে বিড়বিড় করে বলল, তোমরা আমার মাকে আবার মেরে ফেলবে?
রিশান কোনো কথা বলল না
সানি হঠাৎ ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। রিশান পিছনে পিছনে ছুটে গিয়ে তাকে কোনোমতে ধরে ফেলে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাও সানি।
একটা ঝটকা মেরে হাত ছুটিয়ে নিয়ে সানি চিৎকার করে বলল, ছাড় আমাকে
কিন্তু, তুমি কোথায় যাও
মায়ের কাছে।
মায়ের কাছে?
হ্যাঁ।
তুমি জান তারা কোথায়?
জানি
আমিও যাব তোমার সাথে।
কেন?
হয়তো সেখানে কিছু একটা করা যাবে, হয়তো কোনোভাবে তাদের বাঁচানো যাবে।
সত্যি? সানি বড় বড় চোখ করে বলল, সত্যি?
রিশান সানির ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল আমি জানি না সেটা সত্যি কি না, কিন্তু চেষ্টা তো করতে হবে। যাও তুমি পোশাক পরে আস, আমাদের হাতে কোনো সময় নেই।
সানি ছুটতে ছুটতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। রিশান ঘরের ভিতরে ঢুকে ষুনের কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে বলল, ষুন, আমি আর সানি বাইরে যাচ্ছি, শেষ চেষ্টা করে দেখতে চাই
কিন্তু
কিন্তু কী?
ষুন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি পুরো ব্যাপারটা আবার ভেবে দেখেছি। আমরা এখন যেটা জেনেছি, পৃথিবীর মানুষেরা সেটা নিশ্চয়ই জানে। তারপরও তারা যদি চায় আমরা এই গ্ৰহটাকে জীবাণুমুক্ত করি তার নিশ্চয়ই কোনো একটা কারণ আছে–
তুমি আমাকে সাহায্য করবে না?
না। তোমাকে আমি একটা ঘরে বন্দি করে রেখেছিলাম। আবার তোমাকে আমার বন্দি করে রাখতে হবে রিশান। মহাকাশ অভিযানের বিধিমালায় খুব পরিষ্কার বলা আছে–
মহাকাশ অভিযানের বিধিমালায় কি বিদ্রোহ সম্পর্কে কিছু লেখা আছে?
বিদ্রোহ?
হ্যাঁ। যেখানে সাধারণ একজন সদস্য জোর করে দলের নেতৃত্ব নিয়ে নেয়?
ষুন ফ্যাকাশে মুখে বলল, হ্যাঁ রিশান। লেখা আছে। তার জন্যে খুব কঠোর শাস্তির কথা লেখা আছে–
রিশান জোর করে মুখে এক ধরনের হাসি টেনে এনে বলল, শাস্তি অনেক পরের ব্যাপার, সেটা নিয়ে এখন চিন্তা করে লাভ নেই। আমি অভিযান নয় নয় শূন্য তিনের নেতৃত্ব তোমার কাছ থেকে নিয়ে নিচ্ছি। এখন থেকে সবাই আমার আদেশে কাজ করবে।
কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে সেটি সম্ভব নয়।
হ্যাঁ। রিশান পাথরের মতো মুখ করে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ, তুমি বেঁচে থাকতে সেটি সম্ভব নয়।
ষুন হঠাৎ চমকে উঠে রিশানের দিকে তাকাল—-সরু চোখে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?।
রিশান তার এটমিক ব্লাস্টারটি উপরে তুলে সোজাসুজি ষুনের মাথার কাছে ধরে বলল, তুমি স্বেচ্ছায় আমাকে নেতৃত্বটি দিতে পার ষুন– মানুষের মস্তিষ্ক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে দেখতে আমার একেবারে ভালো লাগে না।
ষুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল, সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। যে সত্যি সত্যি রিশান তার মাথায় একটা এটমিক ব্লাস্টার ধরে রেখেছে।
রিশান শীতল গলায় বলল, যোগাযোগ মডিউলে তোমার কোডটি বলে আমাকে নেতৃত্বটি দিয়ে দাও ষুন। তোমার মাথায় গুলি করলে নেতৃত্বটি এমনিতেই চলে আসবে– আমার ধৈর্য খুব কম, তুমি খুব ভালো করে জান।
ষুন বিড়বিড় করে নেতৃত্ব কোডটি উচ্চারণ করা মাত্র হঠাৎ করে তার যোগাযোগ মডিউলটিতে নীল আলো ঝলসে ওঠে। ষুনের কাছ থেকে মূল নেতৃত্ব রিশানের কাছে হস্তান্তরিত হয়ে গেছে। মহাকাশ অভিযানের দলপতির প্রয়োজনীয় তথ্যাদি মূল তথ্যকেন্দ্র থেকে আনা নেয়া শুরু হতে থাকে। রিশান এটমিক ব্লাস্টারটি নিচে নামিয়ে রেখে নিডিয়ার দিকে ঘুরে তাকাল, বলল, নিডিয়া
বল রিশান।
তুমি মূল তথ্যকেন্দ্রে খোঁজ নাও নিক্সিরল গ্যাসকে নিষ্ক্রিয় করতে হলে কী করতে হয়। যদি তার জন্যে বিশেষ কোনো রাসায়নিক থাকে সেটি খুঁজে বের কর–
আমি যতদূর জানি অক্সিজেন খুব সহজে এটাকে অক্সিডাইজ করে দেয়। আমি আরেকটু দেখতে পারি
বেশ তাহলে যতগুলো সম্ভব অক্সিজেন সিলিন্ডার তুমি একটা বাই ভার্বালে তোলার ব্যবস্থা কর।
করছি।
রিশান যোগাযোগ মডিউলে স্পর্শ করতেই ঘরের মাঝখানে মহাকাশযানের একটা অংশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেখানে হান এবং বিটিকে উদ্বিগ্ন মুখে বসে থাকতে দেখা যায়। রিশান মুখে জোর করে একটা হাসি টেনে এনে বলল, তোমাদের নূতন দলপতিকে অভিনন্দন জানানোর কোনো প্রয়োজন নেই
হান মাথা নেড়ে বলল, আমি তার কোনো চেষ্টা করছিলাম না রিশান।
বেশ– এখন আমি যেটা বলছি খুব ভালো করে শোন। মহাকাশযান থেকে তোমরা চেষ্টা কর আটত্রিশটা নিক্সিরলের ট্যাংককে খুঁজে বের করতে
সেটা খুব সহজ নয় রিশান। তুমি জান এই গ্রহের গ্যাস মোটামুটিভাবে অস্বচ্ছ।
তবুও তুমি চেষ্টা কর– অন্য কোনো কিছু যদি কাজ না করে চেষ্টা কর আলট্রাসনিক কিছু ব্যবহার করতে। পুরোপুরি নিখুঁতভাবে যদি না পার চেষ্টা কর মোটামুটিভাবে সেগুলোর অবস্থান বের করার জন্য–
চেষ্টা করব। তারপর কী করব?
চেষ্টা কর সেগুলো উড়িয়ে দিতে।
তুমি জান তবু সেগুলো থেকে নিক্সিরল বের হবে–
হ্যাঁ। কিন্তু তুমি যদি ছোটখাটো পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাও, প্রচণ্ড উত্তাপে নিক্সিরল তার মৌলগুলোতে ভাগ হয়ে যাবার কথা–
তোমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে রিশান, তুমি নিশ্চয়ই পুরো গ্ৰহটাকে পারমাণবিক বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিতে চাও না?
না তা চাই না। কিন্তু যেটুকু সম্ভব নিক্সিরলকে নষ্ট করতে চাই। যেভাবে সম্ভব।
ঠিক আছে।
রিশান ঘুরে ষুনের দিকে তাকাল। বলল, ষুন—
বল।
তুমি আমাকে ছোট একটা ঘরে সবরকম যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আটকে রেখেছিলে–
ষুন একটু অস্বস্তি নিয়ে রিশানের দিকে তাকাল। রিশান শীতল গলায় বলল, একজন মানুষকে এর থেকে বড় কোনো যন্ত্রণা দেয়া যায় বলে আমার জানা নেই।
আমি–আমি দুঃখিত। কিন্তু আমার কোনো উপায় ছিল না।
সেটা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু আমি তোমাকে এই ব্যাপারটা দেখাতে চাই যতক্ষণ আমি ফিরে না আসছি আমার ইচ্ছে তুমি একটা ছোট বদ্ধঘরে সমস্ত যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বসে থাক।
তার কি কোনো প্রয়োজন আছে, রিশান?
না নেই। তবু আমার তাই ইচ্ছে। আমি এই অভিযানের দলপতি, রবোটগুলো আমার আদেশ চোখ বন্ধ করে পালন করবে। সানি একটা রবোটের সর্বনাশ করে ফেলেছে কিন্তু তোমাকে ধরে নেয়ার জন্যে আমার মনে হয় তিনটা রবোটই যথেষ্ট।
ষুন কোনো কথা না বলে স্থির চোখে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল।
১৩. বাই ভার্বালটি মাটির খুব কাছাকাছি
বাই ভার্বালটি মাটির খুব কাছাকাছি দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। নিচে গাঢ় ধূসর রঙের পাথর, বাতাসের ঝাঁপটায় তার উপর দিয়ে বাদামি রঙের ধুলো উড়ছে। আকাশে অশরীরী এক ধরনের আলো চারদিকে এক অতিপ্রাকৃতিক পরিবেশের জন্ম দিয়েছে। বাই ভার্বালের ঘোট কন্ট্রোলঘরে নিয়ন্ত্রণ সুইচটি হালকা হাতে রিশান স্পর্শ করে আছে, তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে সানি।
একটা বিপজ্জনক বাঁক নিয়ে রিশান কাত হয়ে যাওয়া বাই ভার্বালটি সোজা করে নিয়ে সানির দিকে তাকাল, শিশুটির মুখে কোনো ধরনের অনুভূতি নেই। একটা ছোট শিশু কেমন করে এত নিস্পৃহ হতে পারে রিশান ঠিক বুঝতে পারে না। সে নিচু গলায় সানিকে ডাকল, সানি
সানি তার দিকে না তাকিয়ে বলল, বল।
তুমি কী ভাবছ?
আমি?
হ্যাঁ।
সানি এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, তোমার কি মনে হয় আমার মাকে তুমি বাঁচাতে পারবে?
আমি জানি না সানি– তোমাকে আমি মিছিমিছি আশা দিতে চাই না। তোমার মাকে বাচানোর সম্ভাবনা খুব বেশি নয়। নিক্সিরল গ্যাসটি তৈরিই করা হয়েছে গ্রুনি ধ্বংস করার জন্যে, কাজেই ব্যাপারটি খুব কঠিন।
সানি কোনো কথা না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই শিশুটির ভাবভঙ্গিতে কোনো শিশুসুলভ ব্যাপার নেই। একটি শিশু মনে হয় শুধুমাত্র আরেকটা শিশুর কাছ থেকে শিশুসুলভ ভাবভঙ্গিগুলো শেখে।
রিশান আবার নিচু গলায় ডাকল, সানি
বল।
তোমাকে মনে হয় একটা জিনিস বলা দরকার।
কী জিনিস?
তুমি যাকে তোমার মা বলে সম্বোধন করছ, সে কিন্তু সত্যিকার অর্থে তোমার মা নয়।
সানি ঝট করে ঘুরে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বলছ?
রিশান সাবধানে বাই ভার্বালের নিয়ন্ত্রণটি আয়ত্তের মাঝে রেখে নরম গলায় বলল, তুমি রাগ হোয়ো না সানি, আমার কথা আগে শোন।
না, আমি শুনতে চাই না।
তোমাকে শুনতে হবে সানি। তুমি এই গ্রহে একা একা বেঁচে আছ কেন জান?
কেন?
কারণ তোমার মা কখনো চায়নি তুমিও তার মতো হয়ে যাও। তোমার মা চেয়েছে তুমি মানুষের মতো থেকে একদি নমানুষের পৃথিবীতে ফিরে যাও।
সানি স্থির চোখে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল; কিন্তু কোনো কথা বলল না। রিশান নরম গলায় বলল, আমি কি ভুল বলেছি সানি?
সানি রিশানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল।
সানি, তোমার একটা জিনিস জানতে হবে।
কী জিনিস?
তোমার মা মারা গিয়েছে। এখন যাকে তুমি তোমার মা বলছ সে তোমার মা নয়।
সে তাহলে কে?
সে তোমার মায়ের মস্তিষ্কের অনুকরণে তৈরী একটি প্রাণী।
না– সানি হঠাৎ চিৎকার করে বলল, সে আমার মা!
তুমি যত ইচ্ছে হয় চিৎকার করতে পার; কিন্তু সেটা সত্যিকে পাল্টে দেবে না। তোমার মা মারা গেছে সানি। তার মৃতদেহ মানুষের আবাসস্থলের শীতলঘরে রাখা আছে
থাকুক
রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে সানি আমরা সেটা নিয়ে পরে কথা বলব। এখন আমাকে বল আমরা কি গ্রুনি কলোনির কাছাকাছি এসে গেছি?
হ্যাঁ। ওই বড় পাথরটা পার হয়ে তুমি ডান দিকে থেমে যাও।
ঠিক আছে সানি, তুমি শক্ত করে হ্যান্ডেলটা ধরে রাখ।
বাই ভার্বালটা সাবধানে থামিয়ে রিশান সামনে তাকাল, যেখানে থেমেছে তার সামনে খাড়া দেয়ালের মতো একটা পাহাড় উঁচু হয়ে উঠে গেছে। রিশান তার অবলাল সংবেদী চশমাটি চোখে লাগিয়ে উপরে তাকায়, পাথরের এই খাড়া দেয়ালটি কোনো একটি বিচিত্র কারণে আশপাশের সব পাথর থেকে উষ্ণ। রিশান মাথা ঘুরিয়ে সানির দিকে তাকিয়ে তাকে ডাকল, সানি–
বল।
গ্রুনি কলোনিটা কোথায়?
এই পাথরের পিছনে।
কিন্তু সেখানে তুমি কেমন করে যাও?
সানি হাত দিয়ে উপরে দেখিয়ে বলল, ওই যে উপরে একটা ছোট ফুটো আছে, আমি হামাগুড়ি দিয়ে ভিতরে ঢুকে যাই।
ভিতরে কী আছে সানি।
সানি একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, দেয়ালের মাঝে লেগে আছে ভিজে ভিজে এক রকম জিনিস, প্যাচিয়ে প্যাচিয়ে ভিতরে চলে গেছে। আমি যখন ভিতরে যাই তখন সেগুলো থরথর করে কাঁপে, হলুদ এক রকম ধোঁয়া বের হয়।
তোমার–তোমার ভয় করে না?
সানি কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল।
তখন তুমি কী কর?
আমি তখন আমার মাকে ডাকি।
তোমার মা আসে তোমার কাছে?
মাঝে মাঝে আসে। সাদা ধোঁয়ার মতো দেখা যায়।
তুমি কখনো কথা বলেছ তোমার মায়ের সাথে?
হ্যাঁ। বলেছি।
তোমার মা তোমার কথা বুঝতে পারে?
মনে হয় পারে।
তুমি সত্যি জান?
হ্যাঁ। আমি জানি।
চমৎকার। রিশান একটু ইতস্তত করে বলল, তাহলে তুমি ভিতরে যাও। এই অক্সিজেন সিলিন্ডারটা নিয়ে যাও সাথে। ভিতরে গিয়ে বলবে এই গ্রহে নিক্সিরল ছড়িয়ে দিচ্ছে–মনে থাকবে নামটি?
নিক্সিরল।
হ্যাঁ। বলবে সেটা থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা মাত্র উপায়–পুরোটা অক্সিজেন দিয়ে ভাসিয়ে দেয়া। এই যে লিভারটা আছে টেনে ধরতেই অক্সিজেন বের হতে শুরু করবে। ঠিক আছে?
সানি মাথা নাড়ল, ঠিক আছে।
খুব সাবধান–অক্সিজেন দিয়ে কিন্তু অনেক বড় বিস্ফোরণ হতে পারে। ভিতরে কী আছে আমি জানি না–তাই কোনো স্পার্ক যেন তৈরি না হয়।
হবে না। আমি সাবধান থাকব।
যাও তাহলে। দেরি কোরো না।
তুমি আসবে না?
আমি আসছি। চারদিকে অক্সিজেনের ছোট ছোট উৎস তৈরি করে আসি। কিছু বিস্ফোরকও ফেলে আসতে হবে।
বিস্ফোরক? কেন?
তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্যে। তাপমাত্রা যত বেশি হবে নিক্সিরল তত তাড়াতাড়ি অক্সিডাইজ হবে
ও।
যাও তুমি ভিতরে। আমি আসছি।
সানি ভারি অক্সিজেন সিলিন্ডারটা টেনে টেনে উপরে উঠতে থাকে। রিশান সেদিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় ডাকল, সানি
কী হল।
তোমার কি মনে হয় গ্রুনি কলোনি আমাকে ভিতরে ঢুকতে দেবে?
কেন দেবে না?
আমি যে মানুষ! যে মানুষেরা নিক্সিরল নিয়ে এসেছে
কিন্তু তুমি তো সেরকম মানুষ নও।
তোমার তাই মনে হয়?
হ্যাঁ, রিশান।
ঠিক আছে তাহলে, তুমি যাও। সানি উপরে উঠতে শুরু করতেই রিশান আবার ডাকল, সানি
কী হল?
তোমার কি মনে হয় আমি যখন ভিতরে যাব, তখন
তখন কী?
তখন কি আমি ভয় পাব?
সানি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ রিশান তুমি ভয় পাবে।
তুমি–তুমি ভয় পাও না?
পাই। কিন্তু আমি জানি আমার মা আছে সেখানে। তোমার তো মা নেই।
ও আচ্ছা।
রিশান নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল সানি ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে ভারি অক্সিজেন সিলিন্ডারটি নিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। একটু পরে তাকেও ওই বড় পাথরের আড়ালে অন্ধকার একটা গুহায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হবে। ভিতরে তার জন্যে কী অপেক্ষা করে আছে চিন্তা করে হঠাৎ কেন জানি তার পেটের মাঝে পাক দিয়ে ওঠে।
রিশান মাথা থেকে পুরো ব্যাপারটি প্রায় ঠেলে সরিয়ে দেয়, এখন তার অনেক কাজ বাকি। অক্সিজেনের সিলিন্ডার আর বিস্ফোরকগুলো চারদিকে ছড়িয়ে দেবার আগে মনে হয় একবার মহাকাশযানের সাথে কথা বলে নেয়া দরকার। নিডিয়াকেও মূল তথ্যকেন্দ্রে খোঁজ। নেয়ার কথা বলা হয়েছে, নূতন কিছু জানতে পেরেছে কি না সেটাও এখন জিজ্ঞেস করে নেয়ার সময় হয়েছে। রিশান একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসে উপরে তাকাল, সানি অক্সিজেন সিলিন্ডারটি নিয়ে প্রায় উপরে উঠে গিয়েছে। সেদিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে থাকতে। থাকতে সে তার যোগাযোগ মডিউলটি স্পর্শ করল। প্রায় সাথে সাথেই তাকে ঘিরে দুটি হলোগ্রাফিক দৃশ্য ফুটে ওঠে, একটিতে হান এবং বিটি, অন্যটিতে নিডিয়া।
রিশান হানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমাদের হাতে আর কত সময় রয়েছে হান?
খুব বেশি নয়। সবচেয়ে প্রথম ট্যাংকটির বিস্ফোরণ হবে এখন থেকে এগার মিনিট পরে।
মাত্র এগার মিনিট?
হ্যাঁ।
তুমি কি কোনো ট্যাংকের অবস্থান বের করতে পেরেছ?
কয়েকটা পেরেছি। কিন্তু খারাপ ধরনের একটা ঝড় হচ্ছে নিচে, কাজটি খুব সহজ নয়।
ট্যাংকটির বিস্ফোরণ হবার কতক্ষণ পর নিক্সিরল এখানে পৌঁছাবে বলে মনে হয়?
সাত মিনিটের মাঝে লক্ষ শতাংশ হয়ে যাবে। বিপদসীমার অনেক উপরে।
রিশান ঘুরে নিডিয়ার দিকে তাকাল, নিডিয়া তুমি কিছু বলবে?
বলার বেশি কিছু নেই। আমি মূল তথ্যকেন্দ্রে খোঁজ নিয়েছি সেখানেও নূতন কোনো তথ্য নেই। শুধু একটা ব্যাপার তুমি বিবেচনা করে দেখতে পার।
কী?
নিক্সিরল উঁচু তাপমাত্রায় খুব সহজে অক্সিডাইজ হয়। কাজেই তুমি যদি ওই এলাকার তাপমাত্রা বাড়াতে পার হয়তো খানিকটা সময় বাঁচাতে পারবে।
আমি সেজন্যে বিস্ফোরক নিয়ে এসেছি–
কিন্তু সেটা খুব বেশি নয়। নিডিয়া মাথা নেড়ে বলল, তাপমাত্রা খুব বেশি বাড়বে না। তুমি এখন যেখানে আছ তার কাছাকাছি একটা আগ্নেয়গিরি রয়েছে।
আগ্নেয়গিরি?
হ্যাঁ, কোনোভাবে সেটাতে যদি অগ্ন্যুৎপাত করানো যেত, তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে যেত।
রিশান হানের দিকে তাকাল, হান
বল।
তুমি কি আগ্নেয়গিরিটা খুঁজে বের করতে পারবে?
বিটি একটা বড় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ আমি মনিটরে মনে হয় দেখতে পাচ্ছি।
চমৎকার। একটা মাঝারি ধরনের নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণে আগ্নেয়গিরির মাথাটা উড়িয়ে দাও, হয়তো অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়ে যাবে!
তুমি সত্যি বলছ, না ঠাট্টা করছ?
সত্যি বলছি।
তুমি জান এটা কতটুকু বিপজ্জনক?
না, জানি না। জানতে চাইও না। কিন্তু আমি এই সৃষ্টিজগতের মানুষ ছাড়া একমাত্র অন্য বুদ্ধিমান প্রাণীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। বিপদকে এখন ভয় পাওয়ার সময় নেই।
তোমাদের সবার প্রাণের ওপর ঝুঁকি হবে। প্রচণ্ড রেডিয়েশন
কিছু করার নেই হান। তুমি দেরি কোরো না। এখানে পৌঁছাতে সময় লাগবে, শুরু করে দাও।
আমি করতে চাই না রিশান।
আমি দলপতি হিসেবে তোমাকে আদেশ দিচ্ছি হান।
.
কিছুক্ষণ পর রিশানকে দেখা গেল একটি ছোট জেট ইঞ্জিন ব্যবহার করে বিশাল প্রস্তর খণ্ডটির চারপাশে সময়নির্ভর অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং বিস্ফোরক বসিয়ে দিচ্ছে। সেগুলো চার্জ করে সে আবার আগের জায়গায় ফিরে এল। তার মনিটরে এর মাঝে বাতাসের মাঝে অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে যাবার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। সানি নিশ্চয়ই ভিতরে অক্সিজেন সিলিন্ডারটি খুলে দিয়েছে।
রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে যোগাযোগ মডিউল স্পর্শ করে নিচু গলায় ডাকল, সানি।
এক মুহূর্ত পর সানির শিশুকণ্ঠের উত্তর শোনা গেল, আমাকে ডাকছ?
হ্যাঁ। তুমি কি–তুমি কি তোমার মায়ের সাথে কথা বলেছ?
সানি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।
কী হল সানি? কথা বলেছ?
আমি জানি না। এখানে এখানে—
এখানে কী?
আমার ভয় করছে রিশান। তুমি আসবে?
রিশানের হঠাৎ বুক কেঁপে ওঠে। সে কাঁপা গলুম বলল, আমি আসছি সানি। আমি এক্ষুনি আসছি।
ঠিক তখন দূরে একটা চাপা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। নিক্সিরলের প্রথম ট্যাংকটি বিস্ফোরিত হয়েছে খুব কাছাকাছি কোথাও
১৪. খাড়া দেয়ালের মাঝে
খাড়া দেয়ালের মাঝে ছোট একটা ফুটো, ভিতরে খুব কষ্ট করে ঢুকতে হয়। রিশান প্রথমে ঢুকতে গিয়ে আবিষ্কার করল পিঠে ঝুলে থাকা যন্ত্রপাতি পাথরে আটকে যাচ্ছে। সে সেগুলো খুলে হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে এগোতে থাকে। ভিতরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। তার মাথায় লাগানো ছোট একটা আলো কাছাকাছি খানিকটা আলোকিত করে রেখেছে, সেটা দূরের সবকিছুকে আরো গাঢ় অন্ধকারে আড়াল করে রেখেছে। দূরে কী আছে রিশান দেখার চেষ্টা না করে হামাগুড়ি দিয়ে বুকের উপর ভরে করে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে।
খানিকক্ষণ যাওয়ার পর হঠাৎ খানিকটা খোলা জায়গা পাওয়া গেল। রিশান সাবধানে এক হাতে তার যন্ত্রপাতির ব্যাগ এবং অন্য হাতে এটমিক ব্লাস্টারটি নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মাথায় লাগানো আলোটি তার আশপাশে খানিকটা জায়গা আলোকিত করে রেখেছে, রিশান সেই আলোতে সামনে তাকায়। চারপাশে পাথরের দেয়াল এবং সেখানে বিচিত্র থলথলে এক ধরনের জিনিস ঝুলছে। জিনিসটি জীবন্ত এবং সেটি ক্রমাগত নড়ছে, এক জায়গা থেকে ধীরে ধীরে অন্য জায়গায় সরসর করে সরে যাচ্ছে। রিশান নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল। তার কেন জানি মনে হতে থাকে সেখান থেকে হঠাৎ কিছু একটা তার দিকে ছুটে আসবে, অক্টোপাসের মতো তাকে জড়িয়ে ধরে তার সমস্ত শরীরকে থলথলে শুড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরবে। কিন্তু সেরকম কিছু হল না, থলথলে জিনিসগুলো তার আশপাশে নড়তে থাকে, সরসর শব্দ করতে থাকে এবং ভিজে এক ধরনের তরল পদার্থ সেখান থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে।
রিশান চাপা গলায় ডাকল, সানি তুমি কোথায়?
এই যে এখানে।
আমি এখানে দেখতে পাচ্ছি না।
তুমি কোথায়?
আমি এইমাত্র ঢুকেছি, সুড়ঙ্গটার কাছে।
তুমি দাঁড়াও আমি আসছি।
হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি আস। এই সুড়ঙ্গের মুখটা আমাদের বন্ধ করে দিতে হবে।
সানি সাবধানে তার যন্ত্রপাতির ব্যাগটা নামিয়ে সেখান থেকে কিছু পলিমার বের করতে থাকে। সুড়ঙ্গটা খুব বড় নয়, সেটাকে বন্ধ করে দেয়া খুব কঠিন হবে না।
রিশান পলিমারের আস্তরণটা দাঁড় করাতে করাতেই দূরে ছোট একটা আলো দেখা। গেল, সানি আসছে।
সানির সমস্ত পোশাকে চটচটে এক ধরনের তরল—
রিশান অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে সানি? পড়ে গিয়েছিলে?
না।
তাহলে? আমাকে আমাকে ধরে ফেলেছিল।
ধরে ফেলেছিল?
হ্যাঁ। সানি ভয়ার্ত মুখে বলল, আমার মাকে আমি খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় গেছে আমার মা?
রিশান হাত বাড়িয়ে সানিকে স্পর্শ করে বলল, আছে নিশ্চয়ই আছে। তুমি ভয় পেয়ো না সানি, আগে আমার সাথে হাত লাগাও। এই যে আস্তরণটা তৈরি করেছি, শক্ত হয়ে যাবার আগে সুড়ঙ্গের মুখটা বন্ধ করে দিতে হবে। তুমি এই পাশে ধর–
সানি কাঁপা হাতে রিশানের সাথে হাত লাগায়, কিছুক্ষণের মাঝেই সুড়ঙ্গের মুখটা বন্ধ হয়ে গেল। রিশান তার মনিটরে লক্ষ করে ভিতরে বাতাসের চাপ বেড়ে যাচ্ছে, সম্ভবত এই গুহাটায় আর বড় কোনো ফুটো নেই।
রিশান আবার সানির দিকে তাকাল, তার মুখে চাপা ভয়, সে মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে। রিশানও আবার চারদিকে তাকাল। হঠাৎ তার বুকটা ধক করে ওঠে, মনে হয় চারপাশের থলথলে জীবন্ত জিনিসগুলো ধীরে ধীরে তাদের ঘিরে ফেলছে। সত্যিই কি এখন তাদের চেপে প্রবে? রিশান জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটা সরিয়ে দিয়ে সানির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, সানি, তুমি তোমার মায়ের সাথে কেমন করে কথা বল?
তোমার সাথে যেভাবে বলি সেভাবে।
রিশান একটু অবাক হয়ে বলল, সত্যি? এমনি বললেই শুনতে পায়?
সবসময় পায় না। তখন আমি আমার মাথাটা পাথরের দেয়ালের সাথে চেপে ধরে কথা বলি, চিৎকার করে কথা বলি–
তার মানে তোমার কথাটা শব্দতরঙ্গ হিসেবে যায়। রিশান তার যন্ত্রপাতির ব্যাগ থেকে ছোট একটা এমপ্লিফায়ার বের করে সানির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও তুমি এর মাঝে কথা বল, কথাটা শব্দতরঙ্গ হিসেবে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া যাবে। তোমাকে তাহলে আর চিৎকার করে কথা বলতে হবে না
সানি এমপ্লিফায়ারটা হাতে নিয়ে বলল, আমি কী কথা বলব?
তোমার মায়ের সাথে কিছু একটা বল। তাকে বল নিক্সিরল গ্যাস ছড়িয়ে পড়ছে, তাই আমরা এভাবে এসে অক্সিজেন ছড়িয়ে দিচ্ছি। বল, বাইরে আমরা বিস্ফোরক বসিয়েছি, সুড়ঙ্গটা বন্ধ করে দিচ্ছি–যা তোমার মনে হয় বল। আমি জানতে চাই উত্তরে তোমার মা কী বলে।
সানি এমপ্লিফায়ারটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল, মা আমি সানি।
সানির কণ্ঠস্বর বহুগুণ বেড়ে গিয়ে সমস্ত গুহার মাঝে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল। রিশান অবাক হয়ে দেখল, থলথলে জিনিসগুলো হঠাৎ কেমন জানি কিলবিল করে নড়ে ওঠে। সানি এমপ্লিফায়ারটা সরিয়ে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করল। তারপর আবার বলল, মা, আমি সানি। তুমি কথা বল। আমার ভয় করছে।
রিশান হঠাৎ চমকে উঠে শুনল–কোথা থেকে জানি কণ্ঠস্বর ভেসে এল, চলে যাও– চলে যাও সানি।
কণ্ঠস্বরটি ঠিক মানুষের কণ্ঠস্বর নয়, শুনে মনে হয় কেউ যেন শব্দ না করে শুধু নিশ্বাস ফেলে কথা বলছে। একসাথে যেন শত সহস্র মানুষ হাহাকার করে নিশ্বাস ফেলছে।
সানি হতচকিত হয়ে রিশানের দিকে তাকাল, তারপর ভয় পাওয়া গলায় বলল, কেন মা? আমি কেন চলে যাব?
রিশান অবাক হয়ে দেখল চারদিকে ঘিরে থাকা থলথলে জীবন্ত জিনিসগুলো আবার সরসর করে নড়তে থাকে, বাতাসে আবার মানুষের হাহাকারের মতো শব্দ হতে থাকে। সানি আবার জিজ্ঞেস করল, কেন আমি চলে যাব মা?
বিপদ… অনেক বড় বিপদ…
রিশান ঠিক শুনতে পেয়েছে কিনা বুঝতে পারল না, সানির দিকে তাকাল। সানিও তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। রিশান এমপ্লিফায়ারটা টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিসের বিপদ?
রিশানের কণ্ঠস্বর শক্তিশালী এমপ্লিফায়ারে করে গুহার মাঝে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে এবং তখন হঠাৎ একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটতে শুরু করে। চারপাশের থলথলে জিনিসগুলো কাঁপতে শুরু করে। কিলবিল করে নড়তে শুরু করে। ক্রুদ্ধ গর্জনের মতো হিসহিস শব্দ হতে থাকে এবং হঠাৎ পাথরের দেয়াল থেকে গলিত স্রোতধারার মতো কিছু একটা ছুটে আসে। কিছু বোঝার আগে কিছু একটা রিশানকে পেঁচিয়ে ধরে তাকে আছড়ে নিচে ফেলে দেয়। রিশান শক্ত হাতে এটমিক ব্লাস্টারটি চেপে ধরে চিৎকার করে বলল, ছেড়ে দাও, না হয় গুলি করে শেষ করে দেব—
রিশানের কথার জন্যেই হোক আর অন্য যে কারণেই হোক, দেয়াল থেকে ছুটে আসা আধা তরল, আঠালো লকলকে জিনিসটা তাকে ছেড়ে দিয়ে আবার গড়িয়ে গড়িয়ে দেয়ালের দিকে ফিরে গেল। রিশান সাবধানে উঠে বসতে চেষ্টা করে, সমস্ত শরীর প্যাঁচপ্যাঁচে আঠালো তরলে ঢেকে গেছে, কোনোমতে নিজেকে টেনেহিঁচড়ে সে সোজা করে দাঁড়া করায়। সানি গুহার এককোনা থেকে তার দিকে ছুটে এসে বলল, ওরা অনেক রেগে আছে। অনেক রেগে আছে।
কেন?
তুমি কথা বলেছ তাই। তোমার কথা ওরা শুনতে চায় না।
কেন আমার কথা শুনতে চায় না?
আমি জানি না।
কিন্তু ওদের আমার কথা শুনতে হবে, আমি ওদের বাঁচাতে এসেছি। রিশান এমপ্লিফায়ারটা হাতে নিয়ে চিৎকার করে বলল, আমি তোমাদের বাঁচাতে এসেছি
রিশানের কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ অন্ধকার গুহাটিতে যেন প্রলয় কাও শুরু হয়ে গেল। পাথরের দেয়ালে ঝুলে থাকা থলথলে জিনিসগুলো ফুলে ফেঁপে ওঠে, লকলকে জিভের মতো লম্বা লম্বা ঔড় বের হয়ে আসে, হিসহিস হিংস্র শব্দে সমস্ত গুহা প্রতিধ্বনিত হতে থাকে–
রিশান এটমিক ব্লাস্টারটি চেপে ধরে রেখে বলল, খবরদার কেউ আমার কাছে আসবে, আমি গুলি করে শেষ করে দেব–
সাথে সাথে আবার ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা যেতে থাকে, সমস্ত গুহা যেন থরথর করে কেঁপে ওঠে। রিশান নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, আমি তোমাদের বাঁচাতে এসেছি। আমি ছাড়া আর কেউ তোমাদের বাঁচাতে পারবে না। বিশ্বাস কর আমার কথা
রিশান নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সমস্ত গুহাটি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে, হিংস্র শব্দেও থরথর করে কাঁপতে থাকে। কিছু একটা যেন অসহ্য ক্রোধে ফেটে পড়তে চায়। রিশান মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকিয়ে এটমিক ব্লাস্টারটি শক্ত করে ধরে রেখে বলল, পৃথিবী থেকে নিক্সিরল পাঠিয়েছে, সেখান থেকে বাচার একত্র উপায় অক্সিজেন। আমি তাই অক্সিজেনে ভাসিয়ে দিচ্ছি তোমাদের–
রিশান ভীত চোখে চারদিকে তাকাল, তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয় কিন্তু হঠাৎ তার মনে হতে থাকে কেউ একজন তার কথা শুনছে আগ্রহ নিয়ে। সে বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, আমি বাইরেও অসংখ্য অক্সিজেনের উৎস ছড়িয়ে এসেছি। তারা অক্সিজেন বের করছে এখন। তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্যে বিস্ফোরক রেখেছি। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হবে কিছুক্ষণের মাঝেই, তোমরা ভয় পেয়ো না।
সানি খুব ধীরে ধীরে রিশানের কাছে এগিয়ে এসে তার হাত স্পর্শ করে। রিশান ঘুরে তার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, তুমি কিছু বলবে সানি?
তোমার কথা শুনছে!
হ্যাঁ।
আর রাগ করছে না, দেখেছ?
হ্যাঁ সানি। আর রাগ করছে না–
রিশানের কথা শেষ হবার আগেই বাইরে থেকে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে, ভিতরে থলথলে জিনিসগুলো আবার হিসহিস করতে শুরু করে, সরসর করে নড়তে থাকে, স্থানে স্থানে প্যাঁচপ্যাঁচে আঠালো তরল ফিনকি দিয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। রিশান গলা উচিয়ে বলল, তোমরা ভয় পেয়ো না, আমি এই বিস্ফোরকগুলো দিয়েছি। একটু পরে আরো বড় একটা বিস্ফোরণ হবে, একটা আগ্নেয়গিরির মাথা উড়িয়ে দেয়া হবে অগ্ন্যুৎপাত শুরু করার জন্যে–আশপাশে তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্যে আমি ইচ্ছে করে করেছি।
খুব ধীরে ধীরে ভিতরের পরিবেশ একটু শান্ত হয়ে আসে এবং ঠিক তখন প্রচণ্ড বিস্ফোরণটি এসে তাদের আঘাত করে–
হান নিশ্চয়ই পারমাণবিক বিস্ফোরণে আগ্নেয়গিরির চূড়োটি পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছে। সমস্ত গুহাটি ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে উঠল, উপর থেকে পাথরের টুকরো ভেঙে ভেঙে পড়ছে, ধুলো উড়ছে, দেয়ালে থলথলে প্রাণীগুলো থরথর করে কাঁপছে, এক ধরনের জান্তব চিৎকার। দেয়াল থেকে ভয়ঙ্কর আক্রোশে কিছু একটা তাদের দিকে ছুটে আসতে শুরু করেছে, রিশান লাফিয়ে সরে গিয়ে সানিকে জাপটে ধরে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। কিছু একটা আঘাত করল তখন এবং কিছু বোঝার আগেই রিশান জ্ঞান হারাল।
১৫. রিশানের মনে হল
রিশানের মনে হল সে একটা পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। যতদূর চোখ যায় নিচে একটা বিস্তৃত অরণ্য। সবুজ দেবদারু গাছ ঝোঁপঝাড় লতাগুল্ম জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। একটা ছোট নদী কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে। নদীর পানিতে রোদ পড়ে ঝিকমিক করছে। নদীর পানি থেকে হঠাৎ হুস করে ভেসে উঠল একটি মেয়ে দুই হাত উপরে তুলে চিৎকার করে উঠল, বাচাও বাঁচাও আমাকে বাঁচাও
রিশান ছুটে যেতে চাইল নিচে কিন্তু হঠাৎ গাছের লতাগুল্ম তাকে পেঁচিয়ে ধরল সাপের মতো, সে ছুটে যেতে চাইছে কিন্তু যেতে পারছে না। পা বেঁধে পড়ে যাচ্ছে নিচে। মেয়েটি ভেসে যাচ্ছে পানিতে, চিৎকার করে ডাকছে তাকে রিশান–রিশান–রিশান–
রিশান চোখ খুলে তাকাল। চারদিকে চাপা অন্ধকার, তার মাঝে সত্যি সত্যি কেউ ডাকছে তাকে। রিশান তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল, তার উপর ঝুঁকে আছে সানি, ভয়ার্ত গলায় ডাকছে, রিশান রিশান
রিশান শুকনো গলায় বলল, কী হয়েছে সানি?
তুমি বেঁচে আছ? আমি ভেবেছিলাম মরে গেছ।
আমি মরি নি। রিশান উঠে বসার চেষ্টা করে। চোখ তুলে চারদিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছিল আমার?
পড়ে গিয়েছিলে। পুরো পাহাড়টা ভেঙে পড়ে গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম সবাই মরে যাব আমরা।
রিশান হাতড়ে হাতড়ে যন্ত্রপাতির বাক্সটা বের করে একটা সবুজ মনিটরের দিকে তাকাল, বাইরে তাপমাত্রা কম করে হলেও বিশ ডিগ্রি বেড়ে গেছে। বাইরে নিক্সিরলের পরিমাণ হঠাৎ করে দ্রুত কমতে শুরু করেছে, এভাবে আরো কিছুক্ষণ চলতে থাকলে মনে হয় বিপদ কেটে যাবে। রিশান সানির দিকে তাকিয়ে বলল, সানি, মনে হয় আমরা গ্রুনি কলোনিকে বাঁচিয়ে ফেলেছি।
সত্যি?
হ্যাঁ, এই দেখ নিক্সিরল কত তাড়াতাড়ি কমে আসছে। আর ঘণ্টাখানেকের মাঝে এত কমে যাবে যে কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
রিশান সানিকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, বাইরে কী অবস্থা অবিশ্যি আমি জানি। আগ্নেয়গিরি থেকে হয়তো গলগল করে লাভা বের হয়ে আমাদের ঢেকে ফেলেছে!
সানি ভয় পাওয়া চোখে রিশানের দিকে তাকাল, সত্যি?
রিশান হাসিমুখে বলল, না সানি। আমি ঠাট্টা করছিলাম।
সানি একটু অবাক হয়ে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল। ঠাট্টা ব্যাপারটি কী সে জানে না। তার সাথে কেউ কখনো ঠাট্টা করে নি।
রিশান আর সানি চুপচাপ দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইল। বাইরে নিশ্চয়ই খুব গরম, তাদের মহাকাশচারীর পোশাকের ভিতরে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। দেয়ালের সাথে লেগে থাকা কিলবিলে জিনিসগুলো ক্রমাগত নড়ছে, হিসহিস এক ধরনের শব্দ হচ্ছে, হঠাৎ হঠাৎ সেটাকে এক ধরনের যন্ত্রণায় কাতর ধ্বনির মতো মনে হয়। ভিতরে এক ধরনের হলুদ রঙের বাষ্পও জমা হচ্ছে, সেটা কী এবং কেন তৈরি হচ্ছে সে সম্পর্কে রিশানের কোনো ধারণা নেই।
রিশান তার যোগাযোগ মডিউলের দিকে তাকাল, মহাকাশযান থেকে হান এবং বিটি, অবাসস্থল থেকে নিডিয়া তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে, সে ইচ্ছে করে চ্যানেলটা বন্ধ করে রেখেছে। এখানে গুহার মাঝে বসে তার চ্যানেলটি ভোলার ইচ্ছে করল না। সবকিছু ভালোয় ভালোয় মিটে গেলে বাইরে গিয়ে সে তাদের সাথে কথা বলবে।
রিশান চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ সময় বসে রইল। সানি সারাদিনের উত্তেজনায় নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে, রিশানের কোলে মাথা রেখে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। রিশান তার মাথায় লাগানো অনুজ্জ্বল আলোটিতে সানির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কৈশোরে সে মহাকাশচারীর কঠোর জীবন বেছে নিয়েছিল, কোনোদিন তাই তার স্ত্রী পুত্র পরিজন হয় নি। সন্তানকে বুকে চেপে ধরে রাখতে কেমন লাগে সে কখনো জানতে পারে নি। কিন্তু নির্বান্ধব জনমানবশূন্য বিষাক্ত একটি গ্রহের বদ্ধ একটি গুহায় বিচিত্র এক ধরনের জীবিত প্রাণীর। কাছাকাছি বসে থেকে দশ বছরের এই শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ তার বুকের ভিতরে এক ধরনের আশ্চর্য অনুভূতির জন্ম হয়
তার ইচ্ছে করতে থাকে গভীর ভালবাসায় শিশুটিকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু সে সেটা করতে পারল না, মহাকাশচারীর পোশাক এত কাছাকাছি এনেও তাদের দুজনকে ধরাছোঁয়ার বাইরে আলাদা করে রেখেছে।
রিশান কতক্ষণ সানির দিকে তাকিয়েছিল সে জানে না, হঠাৎ সামনে তাকিয়ে সে পাথরের মতো জমে গেল। তার কাছাকাছি একটি নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, এত কাছে যে প্রায় হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়। রিশান ভালো করে তাকাল, মূর্তিটি অর্ধস্বচ্ছ এবং বর্ণহীন। এই মূর্তিটিকে সে আগে দেখেছে, ছায়ামূর্তিটি সানির মা নারার। রিশান কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, তুমি কি নারা?
ছায়ামূর্তিটি মাথা নাড়ে।
তুমি–তুমি কি কিছু বলতে চাও?
হ্যাঁ, ছায়ামূর্তিটি মাথা নাড়ে।
বল।
তোমাকে ধন্যবাদ পৃথিবীর মানুষ। আমাদের বাঁচানোর জন্যে অনেক ধন্যবাদ।
রিশান কী বলবে ঠিক বুঝতে পারল না, হাত নেড়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমি শুধু আমার দায়িত্বটুকু করেছি, তার বেশি কিছু নয়।
ছায়ামূর্তিটি আবার কী একটা বলতে চেষ্টা করে কিন্তু বলতে পারে না। রিশান ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে রইল, ছায়ামূর্তিটি আবার চেষ্টা করল, তবু বলতে পারল না
রিশান নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমার কি কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে?
ছায়ামূর্তিটি মাথা নাড়ল।
তুমি কি সানিকে কিছু বলতে চাও?
ছায়ামূর্তিটি মাথা নাড়ল। তারপর খুব কষ্ট করে বলল, হ্যাঁ।
আমি সানিকে ডেকে তুলছি।
রিশান নিজের কোলের উপর শুয়ে থাকা সানির দিকে তাকিয়ে নরম গলায় ডাকল, সানি, দেখ কে এসেছে।
সানি প্রায় সাথে সাথে চোখ খুলে তাকাল, রিশানের দিকে তাকিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বলল, কে এসেছে?
রিশান যত্ন করে সানিকে তুলে বসিয়ে দিয়ে বলল, তোমার মা।
মা! মুহূর্তে সানি পুরোপুরি জেগে উঠে, লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় ছুটে যাচ্ছিল, রিশান তাকে ধরে রাখল। সানি চিৎকার করে বলল, তুমি বেঁচে আছ!
নারার ছায়ামূর্তিটি মাথা নাড়ল। তারপর ফিসফিস করে বলল, সানি, কথা বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে, আমি তোমাকে শেষ কথাটি বলে যাই।
কী শেষ কথা?
তুমি যখন পৃথিবীতে যাবে তখন
আমি যাব না। আমি এখানে থাকব।
না সানি। এই গ্রহ মানুষের জন্যে না। তুমি পৃথিবীতে যাবে এবং এই গ্রহের কথা ভুলে যাবে।
না–সানি ক্রুদ্ধ গলায় বলল, আমি যাব না।
তুমি যাবে সানি, রিশান তাকে শক্ত করে ধরে রেখে বলল, তুমি অবিশ্যি যাবে।
পৃথিবীতে আমার মা নেই।
এখানেও তোমার মা নেই।
সানি চিৎকার করে ছায়ামূর্তিটিকে দেখিয়ে বলল, এই যে আমার মা।
না, রিশান মাথা নেড়ে বলল, এটা তোমার মা নয়। এটা তোমার মায়ের একটা ছায়ামূর্তি।
ছায়ামূর্তিটি মাথা নেড়ে বলল, সানি। এটা সত্যি কথা। এটা তোমার মায়ের স্মৃতি থেকে তৈরি করা একটা ছায়ামূর্তি। এর মাঝে কোনো প্রাণ নেই
তবু আমি যাব না। সানি ঠোঁট কামড়ে চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করতে থাকে।
রিশান সানির হাত ধরে রেখে নরম গলায় বলল, সানি তুমি মানুষ। মানুষকে পৃথিবীতে যেতে হয়, না হয় তার জন্ম অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তুমি যখন যাবে তখন দেখবে পৃথিবীটা কী অপূর্ব। সেখানকার মানুষ কত বিচিত্র আর কী গভীর তাদের ভালবাসা। তুমি মায়ের ভালবাসা হারিয়েছ তাই এখনো গ্রুনি কলোনিতে সেই ভালবাসা খুঁজে বেড়াও। যখন পৃথিবীতে যাবে তখন দেখবে ভালবাসা তোমাকে খুঁজে বেড়াবে–
চাই না চাই না আমি
তুমি চাও সানি। তোমার মাও তাই চায়।
ছায়ামূর্তিটি মাথা নেড়ে ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ সানি, আমিও তাই চাই।
সানি কোনো কথা না বলে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তার চোখ আবার পানিতে ভরে আসছে, সবকিছু ঝাঁপসা হয়ে আসছে চোখের পানিতে। তার বুকের ভিতরে এক গভীর শূন্যতা এসে ভর করছে, মনে হচ্ছে কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। কিছু না।
.
রিশান সানিকে নিয়ে সুড়ঙ্গ দিয়ে বের হবার ঠিক আগের মুহূর্তে থমকে দাঁড়াল। গুহাটির মাঝামাঝি এখনো সেই ছায়ামূর্তিটি দাঁড়িয়ে আছে। রিশান একটু ইতস্তত করে বলল, নারা, তোমাদের মাঝে কি লি–রয় আছে?
ছায়ামূর্তিটি মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ রিশান। এই তো আমি।
তুমি? রিশান চমকে উঠে বলল, তুমি তো নারা—
আমি নারা আমি লি–রয় আমি কিশি আমি রন আমি আরো অনেকে
রিশান হতচকিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল, বলল তোমরা সবাই এক?
হ্যাঁ। আমরা সবাই এক। আমরা বিশাল একটা মস্তিষ্ক যেখানে সবার নিউরন কাছাকাছি
তোমরা আলাদা আলাদা নও?
না। আমরা এক
তার মানে তার মানে—
তার মানে আমরা মানুষের চাইতেও বুদ্ধিমান হবার ক্ষমতা রাখি রিশান
রিশান হতচকিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। গুহার ভিতরের থলথলে জিনিসটাকে সে চিনতে পেরেছে–এটি দেখতে মানুষের মস্তিষ্কের মতো। বিশাল একটা মস্তিষ্ক মানুষের করোটির মাঝে যেভাবে সাজানো থাকে।
কেন জানি না রিশান হঠাৎ একবার শিউরে ওঠে।
» ১৬. রিশান আর সানি ছোট একটা ঘরে
রিশান আর সানি ছোট একটা ঘরে বসে আছে। ঘরটিতে একটা বৈচিত্র্যহীন বেঞ্চ এবং উপর থেকে আসা কর্কশ এক ধরনের তীব্র আলো ছাড়া আর কিছু নেই। সানি চারদিকে একবার তাকিয়ে বলল, আমাদেরকে এখনো কেন এখানে আটকে রেখেছে?
আমাদেরকে এখানে আটকে রাখে নি, এখানে আমাদের জীবাণুমুক্ত করছে।
কিন্তু অন্য দুজন তো চলে গেল।
হ্যাঁ তারা তো আমাদের মতো গ্রুনি কলোনিতে যায় নি। তাদের জীবাণুমুক্ত করা সহজ। আমাদের দুজনের অনেক সময় নেবে।
ও। সানি খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলল, কিন্তু চুপচাপ বসে থাকতে তো ভালো লাগে না। কিছু তো দেখতেও পারি না
এই তো আর কিছুক্ষণ, তারপর আমরা মূল মহাকাশযানে চলে যাব, সেখানে অনেক কিছু দেখতে পাবে। এই যে গ্ৰহটাতে এতদিন তুমি ছিলে সেটা কেমন তাও দেখবে!
সানি একটা ছোট নিশ্বাস ফেলল, কিছু বলল না। রিশান তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, মন খারাপ লাগছে সানি?
সানি কোনো কথা বলল না। রিশান তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, এই তো আর কয়েকদিনের মাঝে আমরা পৃথিবীতে রওনা দেব–সেখানে পৌঁছে দেখবে তোমার কত ভালো লাগবে। সেখানে তোমার আর কোনোদিন মহাকাশচারীর পোশাক পরে বের হতে হবে না। বাতাস ঝকঝকে পরিষ্কার, তুমি বুক ভরে নিশ্বাস নেবে। আকাশ হবে গাঢ় নীল, মাঝে মাঝে সেখানে থাকবে সাদা মেঘ। কখনো কখনো সেখানে বিদ্যুৎ চমকে চমকে উঠবে, তারপর বৃষ্টি প্রু হবে!
বৃষ্টি?
হ্যাঁ বৃষ্টি! আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি নেমে আসবে।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
তখন তুমি ইচ্ছে করলে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পার, দেখবে বৃষ্টির পানি এসে তোমাকে ভিজিয়ে দেবে!
সত্যি?
হ্যা সত্যি। এই গ্রহে যেরকম কোনো পানি নেই, তুমি প্রত্যেক ফোঁটা পানি বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রাখ–পৃথিবী সেরকম নয়। পৃথিবীর প্রায় বেশিরভাগই পানি!
কী মজা!
হ্যাঁ–খুব মজা। রিশান হেসে বলল, তারপর তুমি যখন তোমাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যাবে, দেখবে তোমার বয়সী ছেলেমেয়ে! তাদের মাঝে কেউ কেউ তোমার প্রাণের বন্ধু হয়ে যাবে–তোমার মনে হবে তোমার সেই বন্ধুদের ছাড়া তুমি কেমন করে একা একা ছিলে এতদিন!
কিন্তু, কিন্তু
কিন্তু কী?
আমি তো কখনো পৃথিবীতে থাকি নি–আমি তো জানি না কী করতে হয়, কী বলতে হয়—
সেটা নিয়ে তুমি কিছু ভেবো না! তারা যখন জানবে তুমি ভিন্ন গ্রহ থেকে এসেছ দেখবে কেমন অবাক হয়ে যাবে!
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
রিশান এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে এই শিশুটির দিকে তাকিয়ে রইল। রহস্যের খোঁজে সে গ্রহ থেকে গ্রহে, মহাকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভয়ঙ্কর সব অভিযানে জীবনের বড় অংশ কাটিয়ে এসেছে; ছোট একটা শিশুর অর্থহীন কৌতূহলের মাঝে যে এত বড় বিষয়, এত অপূর্ব রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে সে কল্পনাও করে নি।
রিশান আর সানি যখন ছোট আলোকিত ঘরটিতে বসে থেকে–থেকে ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেল তখন হঠাৎ একটা সবুজ আলো জ্বলে ওঠে এবং প্রায় সাথে সাথেই ঘরঘর শব্দ করে দরজা খুলে যায়। দরজার অন্য পাশে হান এবং বিটি দাঁড়িয়ে আছে। হান একটু এগিয়ে এসে সানির সামনে দাঁড়িয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, সম্মানিত সানি! আমাদের মহাকাশযানে তোমাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
সানি একটু অবাক হয়ে হানের দিকে তাকাল, ঠিক কী বলবে বুঝতে পারল না। বিটি একটু এগিয়ে এসে সানির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এস আমার সাথে। তোমাকে আমাদের মহাকাশযানটি দেখাই।
সানি একটু ইতস্তত করে বলল, কী আছে মহাকাশযানে?
কত কী আছে, তুমি কোনটা দেখতে চাও সেটা তোমার ইচ্ছে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কুৰু ইঞ্জিন আছে। কৃত্রিম মহাকর্ষ নিয়ন্ত্রণকক্ষ আছে, তুমি ইচ্ছে করলে সেখানে গিয়ে মহাকর্ষ বল অদৃশ্য করে দিতে পারবে, তখন তুমি শূন্যে ভেসে বেড়াবে!
সত্যি?
হ্যাঁ। আমাদের কাছে ইরিত্রা লেজার আছে, সেটা দিয়ে তুমি ইচ্ছে করলে তোমার গ্রহের বায়ুমণ্ডলটিতে একটা আলোর খেলা শুরু করে দিতে পার। আমাদের মূল তথ্যকেন্দ্রে অসংখ্য তথ্য আছে, চোখ বুলিয়ে দেখতে পার! কৃত্রিম অনুভূতি–ঘরে কৃত্রিম অনুভূতি অনুভব করতে পার! আরো এতসব জিনিস আছে যে বলে শেষ করতে পারব না। চল আমার সাথে
সানির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে বিটির হাত ধরে বলল, চল।
রিশান এবং হান বিটির হাত ধরে সানির ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে, তাদের পিছনে দরজাটি ঘরঘর করে বন্ধ হয়ে যাবার সাথে সাথে দুজনেরই মুখ শক্ত হয়ে যায়। হান কঠোর মুখে রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন কী করবে তুমি?
কী করব?
হ্যাঁ। তুমি নিজে নিজে খুব বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছ রিশান। তার বেশিরভাগই নীতিমালার বাইরে। শুধু নীতিমালার বাইরে নয়, নীতিমালার বিরুদ্ধে।
বিশান একটা নিশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, আমার কিছু করার ছিল না। একটা বুদ্ধিমান প্রাণীকে আমি ধ্বংস হতে দিতে পারি না।
সেটা নিয়ে দীর্ঘদিন আলোচনা করা যাবে রিশান, এখন সেটা থাক। এখন বল তুমি কী করতে চাও।
আমি পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাই।
পৃথিবীতে ফিরে গেলে মহাকাশ কাউন্সিলে তোমার বিচার হবে রিশান। সে বিচারের রায় কী হবে আমি তোমাকে এখনই বলে দিতে পারি, শুনতে চাও?
না। আমি নিজেও জানি সেই রায়। কিন্তু আমি পৃথিবীতেই ফিরে যেতে চাই।
হান রিশানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি জান রিশান আমাদের এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ফিরে যাবার প্রয়োজন নেই। আসল উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন, আমাদের পাঠানো হয়েছে পৃথিবীর মানুষের বাসোপযোগী একটা গ্রহ খুঁজে বের করার জন্যে। আমরা সে জন্যে আরো এক–দুই শতাব্দী ঘুরে বেড়াতে পারি। তারপর যখন পৃথিবীতে ফিরে যাব, পৃথিবীর সবকিছু পাল্টে যাবে, হয়তো তোমাকে মহাকাশ কাউন্সিলের সামনে দাঁড়াতে হবে না, হয়তো
না। রিশান মাথা নাড়ল, আমি পৃথিবীতেই ফিরে যেতে চাই। পৃথিবী পাল্টে যাবার আগে আমি যেতে চাই।
কেন?
রিশান একটু ইতস্তত করে বলল, সানিকে আমি আমার পরিচিত পৃথিবীতে নিতে চাই হান। যে পৃথিবীতে গাছ আছে, নদী আছে, নীল আকাশে মেঘ আছে, মানুষের ভিতরে ভালবাসা আছে। দুশ বছর পর পৃথিবীতে কী হবে আমি জানি না আমি আমি সেই ঝুঁকি নিতে পারি না।
হান রিশানের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, আমি বুঝতে পারছি রিশান। আমরা পৃথিবীতেই ফিরে যাব!
রিশান নিচু গলায় বলল, বেঁচে থাকাটাই বড় কথা নয়। কিন্তু যতদিন বেঁচে থাকব সেই বেঁচে থাকাটার যেন একটা অর্থ থাকে।
হান হেসে বলল, অর্থ থাকবে রিশান। নিশ্চয়ই অর্থ থাকবে।
পৃথিবীতে ফিরে যাবার আগে প্রস্তুতি নিতে কয়েকদিন কেটে গেল। এই সময়টাতে সানি নিডিয়ার সাথে ইরিত্রা লেজার দিয়ে গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে আলোর খেলা করে কাটাল। ঘুমোতে যাবার আগে বিটির সাথে কৃত্রিম মহাকাশ নিয়ন্ত্রণকক্ষে ভেসে বেড়ানোটি মোটামুটিভাবে একটি নিয়মিত খেলা হয়ে দাঁড়াল। হান তাকে নিয়ে বসত কুরু ইঞ্জিনের সামনে। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ইঞ্জিনটি সম্পূর্ণ বিনা কারণে তার সমস্ত শক্তি ব্যয় করে গর্জন করানোর ঘোরতর বেআইনি কাজটি সবাই উপভোগ করতে শুরু করল শুধুমাত্র সানির বিস্ময়াভিভূত মুখটি দেখে! রিশান তাকে নিয়ে বসত তথ্যকেন্দ্রে, মানুষের বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার তার সামনে সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে বিকশিত করে দিয়ে সে সানির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকত। স্বল্পভাষী ষুনকেও সবাই আবিষ্কার করল কৃত্রিম অনুভূতি–ঘরে, দীর্ঘ সময় সানিকে নিয়ে সে সেখানে বসে তার সাথে মানুষের বিচিত্র অনুভূতিকে নিয়ে খেলা করত।
যেদিন দীর্ঘ যাত্রার জন্যে সবাইকে শীতলঘরে গিয়ে ঘুমোতে হল, কোনো একটি বিচিত্র কারণে সবার ভিতরে এক ধরনের বিষণ্ণতা নেমে এল। ঠিক কী কারণ কারো জানা নেই কিন্তু সবার মনে হতে লাগল চমৎকার একটি স্বপ্ন শেষ হয়ে আসছে।
১৭. একটি কালো টেবিলের সামনে
একটি কালো টেবিলের সামনে বসে আছে একজন বয়স্ক মানুষ। মানুষটির হাতে পাঁচটি উজ্জ্বল লাল তারা। রিশান এত উচ্চপদস্থ মানুষকে আগে কখনো সামনাসামনি দেখেছে কি না মনে করতে পারল না। মানুষটির দুপাশে বসেছে আরো দুজন, একজন পুরুষ অন্যজন মহিলা। তাদের হাতে চারটি করে লাল তারা। বয়স্ক মানুষটির মুখে কেমন জানি এক ধরনের যন্ত্রণার চিহ্ন, অন্য দুজন সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন। হাতে লাল তারাগুলো না থাকলে এই মানুষগুলোকে নিশ্চিতভাবে রবোট হিসেবে চালিয়ে দেয়া যেত।
রিশান টেবিলের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়াল। বয়স্ক মানুষটির মুখে যন্ত্রণার চিহ্নটি হঠাৎ আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সে খানিকক্ষণ রিশানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বস রিশান।
রিশান শক্ত লোহার চেয়ারটিতে সোজা হয়ে বসল। বৃদ্ধ মানুষটি এক ধরনের দুঃখী গলায় বলল, আমার নাম কিহি। আমি মহাকাশ কাউন্সিলের সভাপতি।
রিশান ভদ্রভাবে বলল, তোমার সাথে পরিচিত হতে পেরে আনন্দিত হলাম।
বৃদ্ধ মানুষটি খানিকক্ষণ রিশানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমাকে এখানে ডেকে আনার কোনো প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু আমার খুব কৌতূহল হয়েছে তোমাকে নিজের চোখে দেখার।
কথাটি প্রশংসাও হতে পারে এক ধরনের শ্লেষও হতে পারে তাই রিশান কোনো কথা বলে চুপ করে রইল। কিহি আবার একটি বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি জান তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
রিশান মাথা নাড়ল, জানি মহামান্য কিহি।
তুমি জান তোমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে খুব শিগগিরই।
জানি
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার আগে তোমার কিছু চাইবার আছে?
রিশান মাথা নাড়ল, না নেই। তবে—
তবে কী?
রিশান একটু ইতস্তত করে বলল, মহাকাশ অভিযান নয় নয় শূন্য তিনে আমরা সানি নামে একটা বাচ্চা ছেলেকে উদ্ধার করে এনেছিলাম। যদি তার সাথে একবার কথা বলা যেত তবে চমৎকার হত।
কিহি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার মনে হয় আমি তার ব্যবস্থা করতে পারব।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
কিহি আবার চুপ করে বসে রইল, তারপর একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, রিশান, তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি?
কর
আমি তোমার সমস্ত রিপোর্টটি দেখেছি, তুমি কী বলবে আমি জানি। তবু আমি তোমার নিজের মুখ থেকে শুনতে চাই।
ঠিক আছে।
তুমি কেন গ্রুনি কলোনিকে ধ্বংস করতে দিলে না?
তারা বুদ্ধিমান প্রাণী। বুদ্ধিমান প্রাণীকে ধ্বংস করা যায় না। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমাদের যেটুকু অধিকার তাদের ঠিক সমান অধিকার
তুমি জান এরা মানুষের মস্তিষ্কের অবিকল প্রতিরূপ তৈরি করে।
জানি।
তুমি জান এরা শুধু মানুষের মস্তিষ্কের প্রতিরূপ নয় এরা একে অন্যের সাথে জুড়ে থাকে?
জানি।
যার অর্থ তারা একজন মানুষের মস্তিষ্ক নয়, তারা একসাথে অসংখ্য মানুষের মস্তিষ্ক?
জানি।
যার অর্থ তারা মানুষ থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান হবার ক্ষমতা রাখে।
জানি
যার অর্থ তারা ইচ্ছে করলে মানুষকে পরাভূত করতে পারে? যার অর্থ তারা মানুষকে ধ্বংস করে মানুষের পৃথিবী দখল করে নিতে পারে?
রিশান মাথা তুলে স্থির দৃষ্টিতে কিহির দিকে তাকাল, তারপর বলল, অভিযান নয় নয় শূন্য তিনে পৃথিবীর মানুষ ইচ্ছে করলে রুনিকে ধ্বংস করে দিতে পারত। তারা কি ধ্বংস করেছে?
কিহি কোনো কথা বলল না, তারপর নিচু গলায় বলল, তোমার কি মনে হয় গ্রুনিদের মাঝে তোমার মতো মানুষ থাকবে?
নিশ্চয় থাকবে।
যদি না থাকে? যদি শুধু আমার মতো মানুষ থাকে?
তাহলে পৃথিবীর মানুষ তাদের থেকে বুদ্ধিমান একটি প্রাণীর কাছে পরাজিত হবে। পৃথিবীর মানুষ তিন মিলিয়ন বছর বুদ্ধিমত্তায় সবার ওপরে থেকে সমস্ত প্রাণীদের ওপর প্রভুত্ব করেছে। এখন সে বুদ্ধিমত্তায় নিচের সারিতে গিয়ে তাদের নির্ধারিত স্থান নেবে। ধরে নিতে হবে সেটাই প্রকৃতির নিয়ম।
কিহি কোনো কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মাথা ঘুরিয়ে তার দুই পাশে বসে থাকা দুজনের দিকে তাকাল, তাদের মুখে বিন্দুমাত্র ভাবান্তর হল না। রিশান মুখে একটা হাসির ভঙ্গি করে বলল, প্রায় এক আলোকবর্ষ দূরের একটা গ্রহ থেকে যদি সেই প্রাণী পৃথিবীতে হানা দিতে পারে তাদের সম্ভবত পৃথিবীতে খানিকটা স্থান করে দেয়াই উচিত।
কিহি শক্ত গলায় বলল, তাদের এক আলোকবর্ষ দূর থেকে আসতে হবে না, তারা সম্ভবত তোমাদের মহাকাশযানে করে তোমাদের সাথেই এসেছে।
গ্রুনি যেন আসতে না পারে সেজন্যে আমাদের দীর্ঘ কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে মহামান্য কিহি। পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানবিজ্ঞান–প্রযুক্তি তার পিছনে ব্যয় করা হয়েছে।
হ্যাঁ। কিহি মাথা নেড়ে বলল, পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানবিজ্ঞান–প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে সত্যি, কিন্তু সেই জ্ঞানবিজ্ঞান–প্রযুক্তি গড়ে তোলা হয়েছে বুদ্ধিহীন নিম্নস্তরের প্রাণী থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্যে, মানুষ থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী থেকে রক্ষা করার জন্যে নয়।
কিহির পাশে বসে থাকা মহিলাটি নিচু গলায় বলল, আমি বলেছিলাম এই মহাকাশযানটিকে সৌরজগতের বাইরে বিস্ফোরণ করে উড়িয়ে দিতে। আমি এখন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি সেটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হত।
কিহি মাথা ঘুরে মহিলাটির দিকে তাকাল তারপর ঘুরে রিশানের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল, রিশান, তুমি এখন যেতে পার।
রিশান উঠে দাঁড়াল, প্রায় সাথে সাথেই দুপাশ থেকে দুটি নিচু স্তরের রবোট তার দিকে এগিয়ে এল। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মানুষকে কখনো একা একা যেতে দেয়া হয় না। বিশেষ করে রিশানের মতো একজন মানুষকে।
কিহি তার নরম চেয়ারটি থেকে উঠে হেঁটে হেঁটে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল, বাইরে ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এসেছে, দিনের এই সময়টিতে কেন জানি অকারণে মন বিন্ন হয়ে যায়। কিহি বিষণ্ণভাবে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইল।
.
আজকে রিশান নামের মানুষটির মৃত্যুদণ্ডাদেশ পালন করার কথা। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাবার পর একজন মানুষের যেটুকু বিচলিত হবার কথা এই মানুষটি মনে হয় ততটুকু বিচলিত নয়। আজ ভোরে সানি নামের বাচ্চা ছেলেটি এসেছিল রিশানের কাছে, দুজনকে দেখে কে বলবে এটি তার জীবনের শেষ কয়টি মুহূর্ত! তার কথা বলার উৎফুল্ল ভঙ্গি, উচ্চৈঃস্বরের হাসি আর আনন্দোজ্জল চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল খুব বুঝি একটা আনন্দের ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে। সানি নামের ছেলেটি যখন চলে যাচ্ছিল তখন ঘুরে এসে হঠাৎ রিশানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, কিছুতেই ছেড়ে যেতে চায় না, এক রকম জোর করে তাকে সরিয়ে নিতে হল–তখন হঠাৎ মনে হচ্ছিল মানুষটি বুঝি ভেঙে পড়বে, কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ে নি। কিছু কিছু মানুষ ইস্পাতের মতো শক্ত নার্ভ নিয়ে জন্মায়।
কিহি হেঁটে হেঁটে নিজের চেয়ারের কাছে ফিরে এল, কিছুক্ষণ থেকে মাথাটি কেমন জানি ভার ভার লাগছে। ভোতা এক ধরনের ব্যথার অনুভূতি, বিশেষ করে বাম পাশে কেমন জানি চিনচিনে এক ধরনের তীক্ষ্ণ ব্যথা।
কিহি মাথা স্পর্শ করার জন্যে ডান হাতটা উপরে তুলতে গিয়ে থেমে গেল, হাতটি কেমন জানি অবশ অবশ লাগছে, মনে হচ্ছে কোনো অনুভূতি নেই।
কিহি অন্যমনস্কভাবে বাইরে তাকাল, কোথায় জানি এ রকম একটা উপসর্গের কথা শুনেছে কিন্তু সে ঠিক মনে করতে পারল না।