রবোটগুলি হাতের অস্ত্রগুলি তাক করে আমাকে ঘিরে এগিয়ে যেতে থাকে। আমি কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে এনে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
একটি রবোট ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে যান্ত্রিক ভাষায় কিছু শব্দ উচ্চারণ করল, আমি তার কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি মাথা নেড়ে বললাম, তুমি কী বলছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
রবোর্টটি কোনো কথা না বলে আমার দিকে তার হাতটা বাড়িয়ে দেয়, তার দুই আঙুল থেকে সুচালো দুটি ইলেকট্রন্ড বের হয়ে আসে, আমি কিছু বোঝার আগেই সেগুলি আমার কপাল স্পর্শ করল, আমি ভয়ংকর একটা ইলেকট্রিক শক অনুভব করলাম এবং সাথে সাথে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল।
আমার যখন জ্ঞান ফিরে এল আমি আবিষ্কার করলাম আমি উপুড় হয়ে শীতল একটা পাথরের মেঝেতে শুয়ে আছি। মাথায় চিনচিনে একটা ব্যথা। আমি সাবধানে মাথা তুলে তাকালাম–অন্ধকার একটা ঘর, মনে হল সেখানে আরো কিছু মানুষ আছে। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকানোর চেষ্টা করতেই ঘরের কোণা থেকে একজন মানুষ আমার দিকে এগিয়ে এসে নরম গলায় বলল, তুমি এখনো বেঁচে আছ? আমি ভেবেছিলাম মরে গেছ।
আমি উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে বললাম, না, এখনো মরি নি। আমরা কোথায়?
মহাকাশযানের সবচেয়ে বড় দস্যুদলের হাতে বন্দী।
বন্দী?
হ্যাঁ।
কেন?
মানুষটি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল, যদি বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে ছয়ের বেশি হয় তোমাকে স্থানীয় কোনো নেতার কাছে বিক্রি করে দেবে।
যদি না হয়?
তাহলে কপাল খারাপ। শুনেছি শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ কেটে কেটে বিক্রি করে। শক্তিশালী হৃদপিণ্ড নাকি খুব ভাল দামে বিক্রি হচ্ছে। নিনীষ স্কেলে তোমার বুদ্ধিমত্তা কত?
আট।
আট! মানুষটা শিস দেওয়ার মতো একটা শব্দ করে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, এত যদি তোমার বুদ্ধি তাহলে এই গাড়ায় এসে হাজির হলে কেমন করে?
আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, যন্ত্রপাতি কাউকে বুদ্ধিমান বললেই সে বুদ্ধিমান হয়ে যায় না। আমি বেশির ভাগ ব্যাপারে একেবারে নিবোধ।
সে ব্যাপারে আমর কোনো সন্দেহ নেই! মানুষটা নির্মমভাবে তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, আমার বুদ্ধিমত্তা যদি নিনীষ স্কেলে ছয়ও হতো আমি অর্ধেক মহাকাশযান দখল করে ফেলতাম।
আমি মানুষটার চোখের দিকে তাকালাম, সে চোখ সরিয়ে হেঁটে ঘরের অন্যপাশে চলে গেল। একটু পরে শুনতে পেলাম সে গুন গুন করে বিষণ একটা সুরে গান গাইছে–অকারণেই আমার মন খারাপ হয়ে গেল।
আমি দীর্ঘ সময় একা একা ঘরের কোণায় বসে রইলাম। শীতল ঘর থেকে বের হবার পর দীর্ঘ সময় খাবার খেতে হয় না, যদি তা না হতো তাহলে এতক্ষণে আমি নিশ্চয়ই ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে যেতাম। কিছু একটা ঘটার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে আমি যখন হাল ছেড়ে দিচ্ছিলাম তখন হঠাৎ দরজা খুলে গেল। রাগী চেহারার কম বয়স্ক একজন মানুষ দুই পাশে দুইজন সশস্ত্র রবোট নিয়ে ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের মাঝে কিহা কে?
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমি। কেন কী হয়েছে?
রাগী চেহারার মানুষটি আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল, হাতে কমিউনিকেশান্স রিডারে আমার তথ্যগুলি ভাল করে মিলিয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমার সাথে চল।
কোথায়?
তোমাকে আমরা মিয়ারার কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। তার কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
মিয়ারা? সেটা কে?
রাগী চেহারার মানুষটা শুষ্ক স্বরে হেসে উঠে বলল, বলতেই হবে তুমি খুব সৌভাগ্যবান মানুষ যে মিয়ারার নাম শুন নি! দশ বছরের মাঝে এই মেয়ে মানুষটি যদি পুরো মহাকাশযানটা দখল করে না নেয় তাহলে আমার মাথা কেটে সেখানে একটা কপোট্রন বসিয়ে দিও!
আমি কোনো কথা না বলে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে তার কাপড়ের মাঝে হাত ঢুকিয়ে চোখ-ঢাকা একটা হেলমেট বের করে এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা মাথায় পরে নাও, তোমাকে কোথায় নিচ্ছি দেখতে দিতে চাই না।
আমি অত্যন্ত খেলো ধরনের হাস্যকর এই হেলমেটটি পরে নিতেই আমার চোখের সামনে সবকছুি পাল্টে গেল, আমি মানুষটি এবং রবোট দুটিকে এখনও দেখতে পাচ্ছিলাম কিন্তু বাকি সব কিছু পাল্টে গিয়ে সেখানে অতিপ্রাকৃত বিচিত্র সব দৃশ্য খেলা করতে থাকে। আমার সামনে বিচিত্র ধরনের রাস্তাঘাট, দেয়াল এবং ধুধু প্রান্তর আসা-যাওয়া করতে থাকে, আমি জানি তার সবই কাল্পনিক এবং এই পথ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে খারাপ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমি তাই সাবধানে মানুষটির পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকি। দীর্ঘ পথ পায়ে হেটে আমি এক ধরনের গাড়িতে উঠে বসলাম, সেটি খুব নিচু দিয়ে উড়ে গেল এবং সব শেষে বিশাল একটা দালানের সামনে আমাদের নামিয়ে দিল। সেখানে খানিকক্ষণ কথা বার্তা হল যার কিছুই আমি বুঝতে পারলাম না। একসময় গোলাকার একটা দরজা খুলে গেল এবং আমি আরেকজন মানুষের পিছু পিছু হেঁটে এবং ভাসমান আসনে করে একটা ঘরে এসে প্রবেশ করলাম। ঘরটিতে আরো একজন মানুষ বসেছিল, হেলমেটে বসানো চোখের আবরণের কারণে মানুষটিকে অত্যন্ত বিচিত্র দেখাতে থাকে কিন্তু তাকে ভাল করে দেখার জন্যে আমি নিজে থেকে হেলমেটটি খোলার সাহস পাচ্ছিলাম না।
কিহা, তুমি তোমার হাস্যকর হেলমেটটি খুলে ফেলতে পার। আমি একজন মেয়ের গলার আওয়াজ শুনে চমকে উঠি–এই কি তাহলে মিয়ারা? সাবধানে হেলমেটটি খুলতেই চোখের সামনে একটা আলোকোজ্জল ঘর বের হয়ে এল। ঘরটি প্রাচীনকালের একটি অফিসঘরের মতো করে সাজানো এবং বিশাল একটা কালো টেবিলের পিছনে ধাতব রঙের রুপালি চুলের একটি মেয়ে বসে আছে। সুন্দরী বলতে যা বোঝায় এই মেয়েটি তা নয় কিন্তু তার ভেতরে এক ধরনের আদিম সৌন্দৰ্য্য লুকিয়ে আছে। মেয়েটি তার ঝকঝকে ধারালো চোখে আমার। দিকে তাকিয়ে বলল, কিহা, তুমি বসতে পার।