জায়গাটি আমি কি দেখেছি না দেখিনি যখন এই অর্থহীন ভাবনাটি আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ঠিক তখন আমি অনুভব করলাম আমার কজিতে বাঁধা ছোট কমিউনিকেশান্স মডিউলটাতে কেউ একজন আমার তথ্যগুলি যাচাই করে দেখছে। আমার মৌখিক অনুমতি ছাড়া সেটি করার কথা নয়, কাজটি ঘোরতর অন্যায়। আমি হাত দিয়ে স্পর্শ করে কমিউনিকেশান্স মডিউলটি বন্ধ করতে গিয়ে থেমে গেলাম। এই মহাকাশযানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে থাকলে সবচেয়ে প্রথমে এই কাজটি করার কথা–অন্য মানুষকে যাচাই করে দেখা। কেউ একজন আমাকে যাচাই করে দেখছে। সেটি বন্ধ করে দিলে তার কৌতূহল বা সন্দেহ বেড়ে যাবে যার ফল আমার জন্যে ভাল নাও হতে পারে। আমি দাঁড়িয়ে গিয়ে কৌতূহলী চোখে চারিদিকে তাকাতে থাকি। আমার সামনে বেশ কিছু চতুষ্কোণ পাথর সাজানো আছে, ডানদিকে একটা দালানের মতো উঠে গেছে। পেছনে বড় করিডোর। বাম দিকে বেশ খানিকটা উন্মুক্ত জায়গা। আশে পাশে কোথাও কোনো মানুষ রবোট বা অন্যকোন ধরনের যানবাহন নেই। যেই আমাকে যাচাই করে দেখছে সে কাজটি করছে গোপনে। আমি মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, মানুষ কী বিচিত্র একটি প্রজাতি, কত সহজে তাদেরকে সাময়িকভাবে কলুষিত করে দেয়া যায়। আমি যখন যোগাযোগ মডিউলে কথা বলব না কী পুরো ব্যাপারটা উপেক্ষা করে এগিয়ে যাব ঠিক করতে পারছিলাম না, তখন দেখতে পেলাম চতুষ্কোণে পাথরের আড়াল থেকে দুজন মানুষ দ্রুত পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। মানুষ দুজনের হাতে কালচে বিদঘুটে জিনিসগুলি যে কোনো ধরনের অস্ত্র সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
মানুষ দুজন আমার দুপাশে দাঁড়িয়ে শক্ত হাতে আমার দুই হাত ধরে ফেলল। আমি ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম তাদের গায়ে যন্ত্রের মতো জোর–সম্ভবত তারা মানুষ নয়, রবোট। আমি নিজেকে যেটুকু সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললাম, আমাকে ছেড়ে দাও।
নিনীষ স্কেলে যার বুদ্ধিমত্তা আটের উপরে তাকে আমরা এমনি ছেড়ে দেব? আমাদের দেখে কি এত বড় নির্বোধ মনে হয়?
আমি মানুষগুলির চেহারা খুব ভাল করে দেখি নি, কিন্তু যেটুকু দেখেছি তাদের বেশ নিবোধই মনে হচ্ছিল যদিও সেটা এখন জোর গলায় বলার সাহস হল না। মানুষ দুজন আমাকে টেনে-হিচড়ে নিয়ে যেতে থাকে, আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে-করতে বললাম, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? কী করবে আমাকে দিয়ে?
বিক্রি করব।
বিক্রি করবে? কার কাছে?
যে ভাল দাম দেবে।
আমি মানুষ দুজনকে মুখের দিকে তাকালাম, তারা সত্যি কথা বলছে নাকি আমার সাথে রসিকতা করছে বোঝার চেষ্টা করলাম, ভাবলেশহীন মুখে কোনো ধরনের অনুভূতি নেই, সম্ভবত সত্যি কথাই বলছে। এই মহাকাশযানে এর মাঝে বুদ্ধিমান মানুষ কোননাবেচা শুরু হয়ে গেছে আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে তোমরা কিসের বিনিময়ে বিক্রি করবে?
মানুষ দুজনই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। একজন বলল, সত্যি তুমি জান না?
না। আমি আজকেই শীতল ঘর থেকে বের হয়েছি। নিনীষ স্কেলে আট-এর মানুষ এখন বারো পয়েন্টে বিক্রি হচ্ছে। ছয় পয়েন্টে এক স্তর উপরে উঠা যায়। প্রতি স্তরে রয়েছে–
লোকটি তার কথা শেষ করার আগেই আমার কানের কাছে দিয়ে শিসের মতো শব্দ করে কী একটা ছুটে গেল, পর মুহূর্তে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হল। মানুষ দুজন আমাকে নিয়ে সাথে সাথে বড় একটা পাথরের পাশে হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। আমি পাথরের আড়ালে নিজেকে ঢেকে রাখলাম। দেখতে পেলাম মানুষ দুজন তাদের অস্ত্র উপরে তুলে প্রচণ্ড কর্কশ শব্দে গুলি করতে শুরু করেছে। তীব্র আলোর ঝলকানিতে চারিদিকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বিস্ফোরণের শব্দ ধোয়া এবং ধুলোবালিতে চারিদিকে অন্ধকার হয়ে আসে। আমি এরকম পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়ি নি এবং এরকম পরিস্থিতিতে কী করতে হয় সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। প্রচণ্ড আতংকে হতচকিত হয়ে উঠে দৌড়ানোর একটা অদম্য ইচ্ছাকে অনেক চেষ্টা করে চেপে রেখে আমি মাথা নিচু করে শুয়ে রইলাম।
আমার কানের কাছে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হল এবং আমি মাথা তুলে দেখতে পেলাম আমার পাশে উবু হয়ে শুয়ে থাকা একজন মানুষের শরীরের অর্ধেক প্রচণ্ড বিস্ফোরণে উড়ে গেছে এবং শরীরের ছিন্ন-ভিন্ন অংশ থেকে কিছু পোড়া তার, ধাতব যন্ত্রপাতি আর ঝলসে যাওয়া পলিমার বের হয়ে আছে এবং সেখান থেকে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। আমি যাদেরকে মানুষ ভেবেছিলাম সেগুলি নিচু স্তরের রবোট ছাড়া আর কিছু নয়। রবোটটি সেই অবস্থাতে তার অস্ত্র দিয়ে কর্কশ শব্দ করে গুলি করে যেতে থাকে।
কিছুক্ষণের মাঝে বেশ কয়েকজন এসে আমাদের ঘিরে ফেলল, দেখে তাদের মানুষ মনে হলেও খণ্ডযুদ্ধে উড়ে যাওয়া অংশ থেকে ধাতব যন্ত্রপাতি বের হয়ে রয়েছে বলে সেগুলি যে রবোট সে সম্পর্কে আমার কোনো সন্দেহ রইল না। দুজন নিচু হয়ে আমাকে টেনে তুলে নিল, তৃতীয়টি তার হাতের অস্ত্র দিয়ে পড়ে থাকা বাকি রবোটটিকে প্রায় পুরোপুরি ভাস্মীভূত করে ফেলল। আমি নিশ্চিতভাবে জানি এরা দেখতে মানুষের মতো হলেও কেউই আসলে মানুষ নয় এবং একজন আরেকজনকে যেরকম সহজে ধ্বংস করে ফেলছে সেটি সত্যিকার অর্থে নৃশংসতা নয় কিন্তু তবু আমার সারা শরীর গুলিয়ে আসতে থাকে।