মধ্যবয়স্ক মানুষটি হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল, সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না যে কেউ এভাবে তার সাথে কথা বলতে পারে। বার কয়েক চেষ্টা করে সে আবার কিছু একটা বলতে শুরু করল কিন্তু আমার আর শোনার ইচ্ছে হল না, লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।
বাইরে দাঁড়িয়ে আমি কয়েকবার জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলাম। শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ানো গেলে নাকী রাগ কমে আসে। এত তাড়াতাড়ি এভাবে রেগে গেলাম কেন কে জানে। মানুষটি মিথ্যে কথা বলছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু তার জন্যে সে নিশ্চয়ই দায়ী নয়। আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে বাইরে তাকালাম, যতদূর চোখ যায় একটা ধু ধু প্রান্তরের মতো, এর পুরোটা মানুষের তৈরী এখনো আমার বিশ্বাস হয় না।
আমি সামনে নেমে যাচ্ছিলাম ঠিক তখন পিছন থেকে একজন আমাকে ডাকল, কিহা!
আমি ঘুরে তাকালাম, আমার পাশে বসে থাকা ঝকঝকে চেহারার মেয়েটি আমার দিকে ছুটে আসছে। কাছে এস আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, আমার নাম লেন। তুমি সত্যি শীতল ঘরে ঘুমাতে যাচ্ছ?
আমি মেয়েটা দিকে তাকালাম, কী চমৎকার চেহারা মেয়েটির, যে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ার মেয়েটার চেহারা ডিজাইন করেছে তার রুচিবোধের তুলনা হয় না।
আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি সত্যিই শীতল ঘরে ঘুমাতে যাচ্ছি।
তুমি ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে চাও না?
না।
কেন?
কারণ আমি জানি এই মহাকাশযান বিশাল একটা প্রজেক্ট। যে কোনো মূল্যে এটাকে সমাপ্ত করা হবে–আমি সাহায্য করি আর নাই করি। এই মুহূর্তে পুরো ব্যাপারটির মাঝে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র রয়েছে। বড় ধরনের নোংরামি। আমার নোংরামি ভাল লাগেনা। আমার ধারণা ছিল কয়েক হাজার বছর আগে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়াররা আমাদের ভেতর থেকে সব নোংরামো সরিয়ে নিয়েছে।
লেন খিলখিল করে হেসে ফেলল, বলল, তুমি একেবারে ছেলেমানুষ! তুমি সত্যিই বিশ্বাস কর জিনেটিক ইঞ্জিনিয়াররা ভাল মানুষ তৈরি করছে?
আমি লেনের দিকে তাকিয়ে বললাম, তারা যে ভাল চেহারার মানুষ তৈরি করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই!
চেহারা তৈরি করা সহজ! আমি আমার জিনেটিক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখেছি। তাদের হিসেব অনুযায়ী আমি খুব উন্নত ধরনের মানুষ। কিন্তু তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে আমার মাঝে মাঝে কী জঘন্য ধরনের কাজ করার ইচ্ছে করে!
যেরকম?
মেয়েটি মাথা নাড়ল, সেগুলি তোমাকে বলা যাবে না! তুমি শুনলে আমাকে নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে ধরিয়ে দেবে।
অন্যায় কাজ করার ইচ্ছে করা আর অন্যায় করা এক জিনিস নয়। ফ্যান্টাসি গ্রহণযোগ্য জিনিস।
লেন হাত নেড়ে বলল, সেটা নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করতে পারব, এখন কাজের কথা বলা যাক। তুমি সত্যিই শীতল ঘরে যেতে চাইছ?
তুমি দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা করলে। ব্যাপার কী?
আমি তোমার সাথে একমত যে আমাদের সাহায্য ছাড়াই এই মহাকাশযান পৃথিবীতে পৌঁছে যাবে। যারা এটা নিয়ন্ত্রণ করছে এটা তাদের দায়িত্ব। কিন্তু এই যে নেতৃত্বের ব্যাপারটা–
আমি অবাক হয়ে লেনের দিকে তাকালাম, নেতৃত্বের কোনো ব্যাপারটা?
লেন মনে হল একটু লজ্জা পেয়ে গেল। একটু ইতস্তত করে বলল, এই যে নেতৃত্বের কথা বলছে সেটা নিয়ে আমার খুব কৌতূহল। আমার খুব জানার ইচ্ছে যে মানুষ যদি খুব উচ্চাকাক্ষী হয় তাহলে সত্যিই কি স্বার্থপর হয়ে যায়? নিজের সিদ্ধান্ত সেটা ভাল হোক আর খারাপ হোক অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়? অন্যেরাও
সেটা মুখ বুজে মেনে নেয়?
আমি মাথা নাড়ালাম, নিশ্চয়ই তাই হয় লেন।
এখানেও কি তাই হচ্ছে?
আমার মনে হয় হচ্ছে। গত দশ বছর থেকে এখানে মানুষকে শীতল ঘর থেকে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে। তাদেরকে বলা হচ্ছে নেতৃত্ব দিতে। কাজেই আমি নিশ্চিত এই মহাকাশযানটা এখন ছোট ছোট অংশে ভাগ হয়ে গেছে। প্রত্যেকটা অংশে একজন করে নেতা রয়েছে। তারা সবাই আরো বড় অংশের নেতৃত্বের জন্যে যুদ্ধ করছে।
যুদ্ধ?
হ্যাঁ। হয়তো সত্যিকার অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ নয়। কৌশল দিয়ে যুদ্ধ। ছল চাতুরী দিয়ে যুদ্ধ। কিন্তু যুদ্ধ নিশ্চয়ই হচ্ছে।
লেনের চোখ চকচক করতে থাকে। সে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আমি ব্যাপারটা দেখতে চাই।
আমার মনে হয় ব্যাপারটা কুৎসিত। প্রাচীন কালে মানুষের নেতৃত্বের প্রয়োজন। ছিল। মানুষ যত উন্নত হয়েছে নেতৃত্বের প্রয়োজন তত কমে এসেছে। এখন আসলে নেতৃত্বের কোনো প্রয়োজন নেই।
কিন্তু এই মহাকাশযানে তো নেতৃত্বের প্রয়োজন তৈরি করা হয়েছে।
এটা কৃত্রিম। আমার ধারণা কেউ একজন আমাদের নিয়ে একটা পরীক্ষা করছে। ভয়ংকর একটা পরীক্ষা।
লেন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি দেখতে চাই পরীক্ষা কেমন ভাবে করা হয়। কেমন জানি একটা কৌতূহল। হয়তো দূষিত কৌতূহল, কিন্তু কৌতূহল।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, কৌতূহল কখনো দূষিত হয় না লেন। কৌতূহল অনাবশ্যক হতে পারে, কিন্তু দূষিত নয়।
লেন আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার কোনো কৌতূহল নেই?
আমি মাথা নাড়লাম, না। নেই। আমি শীতল ঘরে গিয়ে আবার ঘুমিয়ে যেতে চাই। শান্ত নিরুপদ্রব ঘুম। আমি জেগে উঠতে চাই পৃথিবীতে। আমার জীবনীশক্তি আমি এই মহাকাশযানে অপচয় করতে চাই না। আমি সেটা পৃথিবীর জন্যে বাঁচিয়ে রাখতে চাই।
লেন কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি প্রথমবার লক্ষ করলাম তার চোখ দুটি আশ্চর্য রকম নীল–ঠিক পৃথিবীর মতো।
২. মহাকাশযানের এই অংশটুকু
মহাকাশযানের এই অংশটুকু আমার কেমন জানি চেনা-চেনা মনে হল। মাঝে মাঝে হঠাৎ করে কোনো অচেনা জায়গাকে চেনা-চেনা মনে হয় এর কারণ কী কে জানে। বিশাল এই মহাকাশযানটি আক্ষরিক অর্থে একটি বিরাট উপগ্রহের মতো, এর অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি ভগ্নাংশ আমি দেখেছি, আমার স্মৃতি ভাল নয় যেটুকু দেখেছি সেটুকুও ভাল মনে নেই, কাজেই আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে এই জায়গাটি আমি আসলে আগে কখনো দেখি নি।