লেন এক মুহূর্তের জন্যে চুপ করল, মহামতি গ্রাউল স্থির হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে, লেন সেই দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, অসীম মহাকাশের ব্যাপারটি আমার ছোট মস্তিষ্ক সহ্য করতে পারল না। আমি ব্যাপারটি চিন্তা করতে পারলাম না। আমার মাথা ঘুরে উঠল, আমি চিৎকার করে আমার মায়ের কাছে ছুটে গেলাম। আমার মা আমাকে বুকে জড়িয়ে বলল, ভয় কি মা আমার! এই তো আমি।
গ্রাউলকে হঠাৎ কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখায়। ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, তুমি প্রশ্ন কর–
করছি। প্রশ্ন করছি। লেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গ্রাউলের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ছোট মস্তিষ্কটি যখন বিশাল একটি ব্যাপার সহ্য করতে পারছিল না আমি সেখান থেকে বের হয়ে এসেছিলাম আমার মায়ের বুকের মাঝে আশ্রয় নিয়ে। আমি তার কথা শুনেছি, তার মুখের কোমল চেহারা দেখেছি, তার দেহের ঘ্রাণ, তার স্পর্শ অনুভব করেছি। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়–আমার মস্তিষ্ককে সেই ভয়ংকর চিন্তা থেকে মুক্ত করে নিয়ে গেছে–
গ্রাউল হঠাৎ ভয়ংকর চিৎকার করে বলল, তুমি কী বলতে চাও?
লেনের চোখ হঠাৎ শ্বাপদের মতো জ্বলতে থাকে। সে হিংস্র স্বরে বলল, তোমার চোখ নেই কান নেই। তোমার ঘ্রাণ নেয়ার নাক নেই, স্পর্শের অনুভূতি নেই। তোমার রয়েছে শুধু এক ভয়ংকর মস্তিষ্ক। মানুষের মস্তিষ্ক থেকে সেই মস্তিষ্কের ক্ষমতা সহস্রগুণ বেশি দুর্বলতাগুলিও সহস্র গুণ বেশি। নিশ্চয়ই বেশি। সেই মস্তিষ্কে যদি হঠাৎ লাগামছাড়া ভয়ংকর একটা ভাবনা এসে হাজির হয় তুমি কী করবে? কী করবে? কোন ইন্দ্রিয় তোমাকে রক্ষা করবে? কোন ইন্দ্রিয়?
গ্রাউলের চেহারা হঠাৎ ভয়ংকর হয়ে ওঠে। তার সবুজ মুখাবয়ব বিকৃত হয়ে যায়, মুখ গহ্বর থেকে ধারালো দাত, লকলকে জিব বের হয়ে আসে। জড়ানো গলার স্বরে সে চিৎকার করে বলল, আসবে না–কোন ভয়ংকর ভাবনা আসবে না, আসবে না–
আসবে। নিশ্চয়ই আসবে। তাই তুমি মহাকাশযানের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষকে তোমার পাশে এনে হাজির করেছ। যদি কখনো সেই ভয়ংকর ভাবনা এসে হাজির হয় তুমি তোমার আশে পাশে আটকে রাখা মস্তিষ্কের সাহায্যে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। তারা হবে তোমার মায়ের চেহারা? ঘ্রাণ? তার গলার স্বরে? তার স্পর্শ!
লেন হঠাৎ হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত হাসতে শুরু করে। তার অপ্রকৃতস্থ হাসি সুড়ঙের মতো সেই ঘরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে। মহামতি গ্রাউলের চেহারা আরো ভয়ংকর হয়ে উঠে তার মুখাবয়ব বিস্তৃত হতে হতে ঘরের ছাদ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেই ভয়ংকর চেহারা থেকে এক অবিশ্বাস্য আক্রোশ ফুটে বের হতে শুরু করে। লেন সেই ভয়ংকর চেহারার দিকে ছুটে গিয়ে চিৎকার করে বলল, তুমি। ভেবেছ আমি তোমাকে ভয় পাব? তোমার দানবের চেহারা দেখে আমি আতংকে শিউরে উঠব? না। আমি তোমাকে ভয় পাই না। এতটুকু ভয় পাই না। কারণ আমি জানি তুমি তোমার নিজের ভেতরের সেই ভয়ংকর ভাবনার ভয়ে থরথর করে কাপতে থাক। তুমি ভীতু কাপুরুষ–তুমি অসহায় দুর্বল–তুমি তুচ্ছ! ইচ্ছে করলে আমি তোমাকে ধ্বংস করে দিতে পারি। ধ্বংস করে দিতে পারি
না! গ্রাউল হঠাৎ আর্তনাদ করে বলল, না!
হ্যাঁ। লেন হিংস্র গলায় বলল, হ্যাঁ। হ্যাঁ। হ্যাঁ। আমি তোমাকে এখন সেই প্রশ্নটি করব। যে প্রশ্নটির ভয়ে তুমি থর থর করে কাপছ। যে প্রশ্নটি করলে তুমি আমার চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাবে আমি তোমাকে সেই প্রশ্নটি করব। লেন এক মূহুর্ত থেমে বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে তীব্র স্বরে বলল, তুমি আমাকে বল, তোমার সেই ভয়ংকর ভাবনাটি কী? বল।
গ্রাউলের মুখাবয়ব হঠাৎ এক অবর্ণনীয় আতংকে বিকৃত হয়ে যায়। চোখের মণি ঘোলাটে হয়ে আসে, মুখের মাংশপেশী থরথর করে কাঁপতে থাকে, তার লকলকে জিভ মুখ থেকে বের হয়ে আসে, মুখের কষ থেকে লোল গড়িয়ে পড়ে। সেই বিকৃত কাতর চেহারায় ভাঙা গলায় বলল, না–না–না–আমি সেটা ভাবতে চাই না–ভাবতে চাই না
তোমাকে ভাবতে হবে! লেন চিৎকার করে বলল, ভাবতে হবে। ভাবতে হবে। ভেবে ভেবে আমাকে বলতে হবে। বলতে হবে।
না। হ্যাঁ। হ্যাঁ। হ্যাঁ। আমাকে বল। লেন হিংস্র গলায় চিৎকার করে বলল, বল।
গ্রাউল হঠাৎ পুরোপুরি ভেঙে পড়ল। অবর্ণনীয় আতংকে থর থর করে কাপতে কাঁপতে বলল, একটা শিশু হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। সামনে একটা রাস্তা। সেই রাস্তা দূর দিগন্তে গিয়ে এক বিন্দুতে মিলে গেছে। শিশুর হাতে একটা ফুলের ঝাপি। সেই ঝাঁপিতে সে রাস্তার পাশে থেকে বুনোফুল তুলছে। সেই ফুল নিয়ে সে ছুটে গিয়েছে সামনে আর দিগন্ত তখন আরো দূরে সরে গিয়েছে। শিশুটি আবার ফুল তুলেছে ঝাপিতে। আবার ছুটে গিয়েছে সামনে দিগন্ত আরো দূরে সরে গিয়েছে। গ্রাউল হঠাৎ ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, শিশুটির বুনোফুলের ঝাপি থেকে হঠাৎ সব ফুল ঝড়ে গেছে নিচে, শিশুটি ফুল তুলতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আবার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আবার চেষ্টা করছে। তারপর আবার ছুটে গেছে সামনে। তখন সেই দিগন্ত আবার সরে গেছে দূরে। শিশুটি ছুটে যেতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আবার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। পারছে না। হঠাৎ ফুলের ঝাপি থেকে সব ফুল ঝড়ে গেল নিচে। শিশুটি সেই ফুল কুড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। চেষ্টা করছে–চেষ্টা করছে–চেষ্টা করছে! পারছে কিন্তু পারছে না। ছুটে যাচ্ছে কিন্তু যেতে পারছে না। পারছে না–পারছে না