তথ্যগুলি সরবরাহ করে একটি অত্যন্ত বিচিত্র জিনিস আবিষ্কার করা হয়েছে।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি ইচ্ছে করে এক মুহূর্তের জন্যে থামল এবং বেশ কয়েকজন এক সাথে জিজ্ঞেস করল, কী জিনিস?
দেখা গেছে সমস্ত পৃথিবী একটা ভয়াবহ গোলযোগের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর মানুষেরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। একে অন্যকে কীভাবে ধ্বংস করবে সেটাই হচ্ছে সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য।
পিছনের দিকে বসে থাকা বুড়ো মতো একজন মানুষ বলল, আমি তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না–নিরীহ কিছু সংবাদ থেকে সেটা কেমন করে বোঝা সম্ভব?
আমার পাশে বসে থাকা মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, সম্ভব হতে পারে। যদি দেখা যায় একটি ঘটনা ঘটছে অন্য আরেকটি ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে আর সেই ঘটনাগুলি একটি আরেকটাকে সাহায্য না করে ক্ষতি করছে–
মধ্য বয়স্ক মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। যেমন ধরা যাক ফসল কাটার ব্যাপারটি। ঠিক ফসল কাটার সময় যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় আর সেই দুর্যোগটি যদি হয় ইচ্ছাকৃত–তাহলে আমাদের সন্দেহ করার কারণ রয়েছে। এমনিতে আমাদের কাছে সেই তথ্যগুলি অর্থহীন কিন্তু যদি সেগুলি বিশ্লেষণ করা যায় তখন সেগুলি হঠাৎ করে খুব অর্থবহ হয়ে ওঠে।
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়েছিলাম। হঠাৎ করে আমার মনে হল আমি একটু একটু বুঝতে পারছি সে কী বলতে চাইছে। একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত গলা উচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই মহাকাশযান যারা নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের ধারণা আমরা এই পৃথিবীতে বাস করার অনুপযুক্ত?
মধ্যবয়স্ক মানুষটি আমার প্রশ্ন শুনে খুব অবাক হয়ে গেল, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কী ধারণা পৃথিবীতে মানুষেরা যেরকম হানাহানি করেছ আমাদের এই মহাকাশযানে ঠিক সেরকম হানাহানি শুরু করতে হবে, যেন আমরা যখন পৃথিবীতে পৌঁছাব তখন কী করতে হবে আমাদেরকে বলে দিতে হবে না?
মধ্যবয়স্ক মানুষটি আমতা আমতা করে বলল, তুমি কথাগুলি বলেছ খুব রুঢ় ভাবে কিন্তু কথাটি সত্যি। আমি একটু অন্যভাবে বলতে যাচ্ছিলাম।
আমার পাশে যে মেয়েটি বসেছিল সে আমার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়েছিল, এবারে মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কীভাবে বলতে যাচ্ছিলে?
আমি বলতে চাইছিলাম যে আমরা যে গ্রহ থেকে এসেছি সেই গ্রহে একটা নূতন ধরনের সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যে কারণেই হোক আমাদের গ্রহে একজন মানুষ অন্য মানুষকে অনেক বেশি বিশ্বাস করে, আমরা একে অন্যের উপরে অনেক বেশি নির্ভরশীল। আমরা যখন পৃথিবীতে পৌঁছাব পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থায় নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারব না। অপরিচিত অবস্থার সাথে যুদ্ধ করে আমাদের সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত হয়ে যাবে–
আমি মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়ে নিজের ভিতরে এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করতে থাকি। এই মানুষটি যে কথাগুলি বলছে সেগুলি অর্থহীন কথা, কখনো কাউকে বিভ্রান্ত করতে হলে এই ধরনের কথা বলতে হয়। কেন সে আমাদের বিভ্রান্ত করতে চাইছে? আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম, সে সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, আমরা যে সমাজ-ব্যবস্থা থেকে এসেছি সেখানে কোনো নেতৃত্ব নেই। আমাদের কার কী দায়িত্ব নিখুতভাবে ব্যাখ্যা করা আছে–সবাই নিজের দায়িত্ব পালন করে যাই এবং পুরো সমাজ ব্যবস্থা এগিয়ে যায়। এই মুহূর্তে যে পৃথিবী আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে সেখানে সমাজ-ব্যবস্থা অন্যরকম। সেখানে সমস্যার জন্ম হলে একজনকে নেতৃত্ব নিয়ে তার সমাধান করতে হয়। আমাদের পৃথিবীতে যাবার আগে সেটা শিখতে হবে।
আমি শীতল গলায় বললাম, সেটা আমরা কীভাবে শিখব?
মধ্যবয়স্ক মানুষটিকে কেমন যেন অসহায় দেখায়, সে একধরনের ক্লান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, খুব সহজে। এই মহাকাশযানের যে নিয়ন্ত্রণটুকু ছিল সেটা সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
কী বললে?
হ্যাঁ। এই বিশাল মহাকাশযান, এর দশ হাজার অধিবাসী প্রায় আঠাইশটি ভিন্ন ভিন্ন স্তর, বায়ুমণ্ডল পরিশোধণের ব্যবস্থা, কৃত্রিম মহাকর্ষ বল, জৈবিক বিভাগ, শক্তি সঞ্চয়, যোগাযোগ ব্যবস্থা সবকিছু এখন আলাদা আলাদাভাবে কাজ করছে। কিন্তু এর যে সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণটুকু ছিল সেটা প্রায় দশ বছর আগে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এই মহাকাশযানটি, এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে মহাকাশের ভেতর দিয়ে বিশাল একটা উপগ্রহের মতো ছুটে যাচ্ছে। আমাদের এখন এর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। দশ হাজার মানুষের জন্যে সেটি প্রায় এক শতাব্দীর কাজ। আমাদের এত সময় নেই। আমাদের সেটা অর্ধ শতাব্দীর মাঝে শেষ করতে হবে। সেটি করার একটি মাত্র উপায়
মধ্যবয়স্ক মানুষটি হঠাৎ করে চুপ করে গেল, সে আশা করছিল আমরা কিছু বলব, কিন্তু আমরা কেউ কিছু বললাম না। মানুষটি কয়েকমুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, আমাদের সেটি করার একমাত্র উপায় হচ্ছে নিজেদের মাঝে এক ধরনের নেতৃত্ব সৃষ্টি করে কাজ শুরু করা। সেজন্যে শীতল ঘর থেকে সবাইকে জাগিয়ে তোলা শুরু হয়েছে।
আমি অনেক কষ্ট করে এতক্ষন নিজেকে শান্ত করে রেখেছিলাম এবারে আর পারলাম না। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ক্রোধকে গোপন করার এতটুকু চেষ্টা না করে বললাম, তুমি কে আমি জানি না। কেন তুমি এখানে এসেছ তাও আমি জানি না কিন্তু আমার কাছে থেকে শুনে রাখ, আমি তোমার একটা কথাও বিশ্বাস করি না। তুমি কার নির্দেশে এইসব বলছ আমি জানি না, আমার জানার এতটুকু ইচ্ছেও নেই। আমি শীতল ঘরে ফিরে যাচ্ছি, পৃথিবীতে পৌঁছানোর আগে তুমি যদি আবার আমাকে জাগিয়ে তোলো আমি পরিস্কার ভাবে বলে দিচ্ছি সেটা তোমার জন্যে ভাল হবে না।