আর যদি না হই?
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, তাহলে আমার কিছু করার নেই। সম্ভবত আপনি তাহলে এখন আমাদের হত্যা করবেন। আমি একটু অপেক্ষা করে বললাম, যদি সত্যিই আমাদেরকে হত্যা করেন আমি আশা করব আপনি আমাদের কয়েক মুহূর্ত সময় দেবেন। আমি আমার সাথে দাঁড়ানো মেয়েটির কাছে ক্ষমা চাইব তারপর বিদায় নেব। এবং
এবং কী?
এবং তাকে বলব যদি সত্যিই আমরা পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারতাম তাহলে আমি তার সামনে হাটু গেড়ে বসে বলতাম, লেন তুমি কি আমাকে তোমার জীবনের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিবে?
মাহামতি গ্রাউলের মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে উঠে তিনি এক ধরনের কোমল গলায় বললেন, লেন তুমি তাহলে কী বলবে?
লেন কোন কথা বলল না, আমাকে শক্ত করে ধরে হঠাৎ হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেলল। আমি তাকে বুকে আকড়ে রেখে তার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বললাম, লেন, এক মুহূর্তের ভালবাসা আর এক যোজনের ভালবাসার কোন পার্থক্য নেই। ভালবাসা ভালবাসাই। তুমি আমাকে ক্ষমা কর।
মহামতি গ্রাউল এক ধরনের কৌতুকের দৃষ্টি নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর শান্ত গলায় বললেন, কিহা। আমি তোমার প্রার্থনা মঞ্জুর করলাম। তোমার মস্তিষ্ককে আমি আমার মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত করব। তুমি অসাধারণ বুদ্ধিমান। তোমার মরণ খেলাটি দেখার আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে।
আমি খুব সাবধানে আমার বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিলাম। এই মহাকাশযান মহামতি গ্রাউলের থাবা থেকে হয়তো শেষপর্যন্ত রক্ষা করা যাবে। বুড়ো লী যেভাবে বলেছিল সেভাবে, শক্তিশালী যন্ত্রের সাথে যেভাবে দাবা খেলতে তার নিয়মে। যন্ত্র প্রস্তুতি নেয় নিখুঁত একটি খেলার যেখানে কোন ভুল হয় না, তার সাথে খেলতে হয় নির্বোধের মতো যে নির্বুদ্ধিতা আসলে সুপরিকল্পিত। আমিও তাই করছি, যে বুদ্ধির খেলায় মহামতি গ্রাউল আগ্রহ নিয়ে রাজি হয়েছে সেটি আমাকে খেলতে হবে না। কারণ আমার মস্তিষ্কে কিটুনিয়া ভাইরাসের ছোট একটা ক্যাপসুল ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। মুক্ত এলাকা থেকে আমি দুই হাজার ইউনিট দিয়ে কিনেছিলাম। ক্যাপসুলটি নির্দিষ্ট সময় পরে নিজে থেকে ফেটে বের হয়ে আসবে, কিলবিল করে ছড়িয়ে যাবে মস্তিষ্কে, নিউরন সেলকে ধ্বংস করে বাড়তে থাকবে প্লাবনের মতো, দেখতে দেখতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আমার মস্তিষ্ক! নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মহামতি গ্রাউলের মস্তিষ্ক, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মিয়ারার মস্তিষ্ক–অন্য সবার মস্তিষ্ক যারা যারা যুক্ত হয়েছে এই বিশাল মস্তিষ্ক স্তরে। মহামতি গ্রাউলকে ধ্বংস করার জন্যে যে পদ্ধতিটি আমি বেছে নিয়েছি সেটি আসলে বুদ্ধিহীন নির্বোধ একটা প্রক্রিয়া। বুদ্ধির খেলায় তাকে পরাজিত করার সেই দুঃসাহস কার আছে?
আমি আবার একটা নিঃশ্বাস ফেলে লেনের দিকে তাকালাম। লেন আমার মস্তিষ্কের কিটুনিয়া ভাইরাসের কথা জানে না, সে তাই অবিশ্বাস্য চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।
বিশাল এই মহাকাশযানটিকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেয়ার একটি মাত্র উপায়, মহামতি গ্রাউল নামের দানবটিকে ধ্বংস করা। আমাকে তাই করতে হবে, আমার নিজের প্রাণ দিয়ে। সৃষ্টি জগতের ইতিহাসে সেরকম অসংখ্য আত্মত্যাগের কথা লেখা আছে একজন বা একাধিক মানুষ হাসিমুখে প্রাণ দিয়ে যুদ্ধে জয়ী হয়েছে, বিশাল জনপদ নগর রক্ষা করেছে দেশকে শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছে। এই মহাকাশযানের ইতিহাস যখন লেখা হবে সেই ইতিহাসে আমার কথা নিশ্চয়ই উল্লেখ করা হবে, কীভাবে আমি মহামতি গ্রাউল নামের একটি দানবকে ধ্বংস করে পৃথিবীর মানুষকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে গেছি। সেটা অনেক বড় করে ব্যাখ্যা করা হবে। আমার বুকের ভেতর এখন আত্মত্যাগের এক মহান পরিতৃপ্তির অনুভূতি হওয়ার কথা।
কিন্তু আমার ভিতরে এক গভীর বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল। এক ভয়ংকর শূন্যতা আমার বুকের ভিতর হুঁ হুঁ করে বইতে থাকল। আমার না দেখা পৃথিবী নয়, ফেলে আসা গ্রহটি নয়, বিস্ময়কর এই মহাকাশযানটি নয়, সৃষ্টিজগৎ এবং তার বিশাল রহস্য নয়, আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কালো চোখের একটি মেয়ের ভালবাসা আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে সেই গভীর বেদনায় আমার সমস্ত হৃদয় সমস্ত অনুভূতি আচ্ছন্ন হয়ে আসতে থাকে।
কিন্তু আমি আমার মুখে একটা আত্মবিশ্বাসের চিহ্ন ফুটিয়ে রাখলাম, আমি জানি মহামতি গ্রাউল তার সংবেদনশীল যন্ত্র দিয়ে আমাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করছেন।
৮. ঘরটির ছাদ নিচু
ঘরটির ছাদ নিচু, দেখে ঘর না মনে হয়ে একটি সুড়ঙের মতো মনে হয়। আমি স্বচ্ছ একটা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আমার পাশে দুজন অস্ত্রোপাচারকারী রবেট নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষনের মাঝেই তারা আমার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার শুরু করবে। আমার কাছেই লেন দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখমণ্ডল রক্তহীন। আমি আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত কয়টি একটি ভয়ংকর নৈরাশ্যে ড়ুবিয়ে দিতে চাইছিলাম না, প্রাণপন চেষ্টা করছিলাম লেনের সাথে আনন্দদায়ক কিছু বলতে। কিন্তু বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না এবং অনুভব করছিলাম ধীরে ধীরে দুজনেই আরো বেদনাতুর হয়ে উঠছি।
আমি মুখে জোর করে একটা স্বাভাবিক ভাব ফুটিয়ে রেখে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোটটির সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী?