মহামতি গ্রাউলের হাসি না থামা পর্যন্ত আমি চুপ করে রইলাম, তারপর নিচু গলায় বললাম, মানুষের স্বাভাবিক হিসেবে আপনি একজন উন্মত্ত দানব ছাড়া কিছু নন। আমি যদি আজ ব্যর্থ হই অন্য কোনো একজন আপনাকে হত্যা করবে। আপনাকে হত্যা করে এই মহাকাশযানকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
ঘরের মাঝামাঝি মহামতি গ্রাউলের যে প্রতিচ্ছবিটি ছিল সেটি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে শুরু করে, তার আকার আরো বড় হয়ে আসে এবং গায়ের রং পরিবর্তিত হতে থাকে, একটু আগে যেটিকে শান্ত সৌম্য একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছিল ধীরে ধীরে সেটা সত্যিই যেন দানবের রূপ নিতে শুরু করে। লেন শক্ত করে আমার হাত ধরে রেখে আবার ফিস ফিস করে বলল, রক্ষা কর ঈশ্বর তুমি। রক্ষা কর। রক্ষা কর।
মহামতি গ্রাউলের গলার স্বরে একটা ধাতব প্রতিধ্বনি শোনা যেতে থাকে। তিনি খনখনে গলায় বললেন, কিহা, আমি তোমার সাহস দেখে মুগ্ধ হয়েছি। সাহস পুরোপুরি মানবিক অনুভূতি। শুধুমাত্র মানুষ সাহস নামক ব্যাপারটি দেখাতে পারে। পশুরা পারে না। রবোর্টরাও পারে না। তার কারণ এটি পুরোপুরি যুক্তিহীন এক ধরনের নির্বুদ্ধিতা। তবে তোমার সাহসের একটি পুরস্কার আমি দেব। তোমাকে আমি আমার নিজেকে দেখতে দেব। দেখ আমি দেখতে কেমন!
সাথে সাথে সমস্ত ঘর অন্ধকার হয়ে গেল এবং আমারা যে স্বচ্ছ মেঝের উপরে দাঁড়িয়েছিলাম তার নিচে আলো জ্বলে ওঠে। সেখানে বিশাল একটি স্বচ্ছ পাত্রে এক ধরনের তরল পদার্থে থলথলে একটা জিনিস কিলবিল করতে থাকে সেখান থেকে শিরা উপশিরা বের হয়ে গিয়েছে। তাকে ঘিরে আটটি হৃদপিণ্ড ধ্বক ধ্বক করে তার মাঝে রক্ত প্রবাহিত করে যাচ্ছে সেই রক্তের স্রোত পাশে পুষ্টি এবং অক্সিজেন ট্যাংকের ভেতর দিয়ে চলে আসছে। সমস্ত দৃশ্যটি একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো, দেখে লেন একবার আর্ত চিৎকার করে উঠল।
আমি মহামতি গ্রাউলের গলার স্বর শুনতে পেলাম, আমার দেহ–যদি সেটাকে দেহ বলতে চাও, যেভাবে রক্ষা করা আছে এর উপরে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটালেও কিছু হবে না। তোমরা যে আটটি হৃদপিণ্ড দেখতে পাচ্ছ এখন আমরা সেগুলি পাল্টে দেব আটটি সতেজ হৃদপিণ্ড দিয়ে। এই মুহূর্তে তার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে
না। আমি শক্ত গলায় বললাম, আপনি সেটা করবেন না মহামতি গ্রাউল। আটটি শিশুর হৃদপিণ্ডে আমরা বিস্ফোরক লাগিয়ে রেখেছি। আমি সেগুলি যে কোনো মুহূর্ত বিস্ফারিত করে দিতে পারি কিন্তু আমি করব না। আমি মানুষ, মানুষ অনেক অন্যায় করতে পারে, কিন্তু শিশু হত্যা করতে পারে না। আপনি আপনার নিরাপত্তার জন্যে কখনই সেই হৃদপিণ্ড ব্যবহার করবেন না। প্রায় অদৃশ্য সেই বিস্ফোরক রক্তস্রোতে মিশে আপনার মস্তিষ্কে যেতে পারে। কিংবা কে জানে মহামতি হিংস্র গলায় বললেন, কে জানে কী?
কে জানে সেই বিস্ফোরকে ভয়ংকর কোনো ভাইরাস রয়েছে কী না সেই ভাইরাস আপনার রক্তকে দূষিত করে দেবে কিনা–
যেভাবে নিচে আলো জ্বলে উঠেছিল ঠিক সেভাবে আলো নিভে গেল এবং আবার আমরা আমাদের সামনে মহামতি গ্রাউলকে দেখতে পেলাম। তার চেহারায় এক ধরনের বিকৃতি হয়েছে ভয়ংকর একটা দৃষ্টিতে তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাকে দেখে আমি নিজের ভেতরে এক ধরনের অশুভ অসহায় আতংক অনুভব করতে থাকি। মহামতি গ্রাউল হিংস্র গলায় বললেন, তোমরা কীভাবে আমাকে হত্যা করতে চাও?
আমরা নই। আমি। আমি আপনাকে বুদ্ধি দিয়ে হত্যা করতে চাই।
বুদ্ধি দিয়ে?
হ্যাঁ মহামতি গ্রাউল। আমি জানি আপনি মিয়ারাকে এনেছেন। আমি জানি মহাকাশযানের অন্য ছয়জন নেতাও এখানে আছে। আপনি তাদের সাথে সময় কাটাবেন, কোন একটি বুদ্ধির খেলা খেলবেন। আমি চাই–আমি এক মুহূর্তের জন্যে থামলাম।
মহামতি গ্রাউল বললেন, তুমি চাও–
আমি চাই আপনি অন্য ছয়জনের সাথে আমাকে যুক্ত করবেন। আমিও আপনার সাথে সেই ভয়ংকর খেলায় অংশ নিতে চাই। অন্যদের সাথে আমিও আপনার মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি যুক্ত হতে চাই।
মহামাতি গ্রাউলের চেহারা হঠাৎ আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠে। তিনি তীব্র চোখে। আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কঠিন গলায় বললেন, তুমি কেমন করে জান তারা আমার মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি যুক্ত?
আমি জানি না মহামতি গ্রাউল, কিন্তু আমি অনুমান করছি। আমি জানি আপনার চোখ নেই, কান নেই, বাইরের জগতের সাথে সরাসরি যোগাযোগ নেই। অন্য এক বা একাধিক মস্তিষ্কের সাথে যোগাযোগের আপনার একটি মাত্র উপায়, এক সাথে যুক্ত করে দেয়া। সেই মস্তিষ্ক আপনার মস্তিষ্কের একটা অংশ হয়ে থাকবে। আপনি তাকে পীড়ন করবেন। আমি জানি মহামান্য গ্রাউল। আপনি একজন দানব ছাড়া আর কিছু নন।
মহামতি গ্রাউল একটা নিঃশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি তোমার দুঃসাহস দেখে মুগ্ধ হয়েছি কিহা। তুমি স্বেচ্ছায় আমার মস্তিস্কের সাথে যুক্ত হতে চাও?
চাই মহামান্য গ্রাউল। আপনাকে আমি ধ্বংস করতে চাই।
তুমি আমাকে ধ্বংস করতে পারবে?
আমি জানি না পারব কি না। কিন্তু আমাকে চেষ্টা করতে হবে। মানুষ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে। আপনি মানুষের মস্তিষ্ক দিয়ে তৈরী কিন্তু আমি জানি না আপনি মানুষ কী না।
তুমি কীভাবে আমাকে হত্যা করবে?
আমি আপনাকে এখন বলব না। যদি আপনি আমার মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত হন। তাহলে আপনি জানবেন।