আপনি এই মহাকাশযানটি তৈরি করেছেন। এর মূল নক্সা আপনার, খুঁটিনাটি সব কিছু আপনার। দীর্ঘ সময় নিয়ে এটি মহাকাশে তৈরি হয়েছে। একসময় এটি পৃথিবীর দিকে রওনা দিয়েছে। মানুষ যখন কিছু একটা সৃষ্টি করে তার এক ধরনের আনন্দ হয়। সাধারণ মানুষ সৃষ্টি করে সাধারণ জিনিস তার আনন্দটুকু হয় সাধারণ। আপনি সাধারণ মানুষ নন–আপনার সৃষ্টিও তাই সাধারণ নয় এবং সেটা সৃষ্টি করে আপনি যে আনন্দটুকু পেয়েছেন সেই আনন্দও নিশ্চয়ই অসাধারণ। আপনার সেই তীব্র আনন্দের অনুভূতি আমরা কল্পনাও করতে পারব না।
এই মহাকাশযান যখন পৃথিবীর দিকে রওনা দিয়েছে আপনি সেখানে স্থান করে নিয়েছেন। এই মহাকাশযানের সৌভাগ্য, মহাকাশ অভিযাত্রীদের সৌভাগ্য আপনি তার নেতৃত্ব দিতে রাজি হয়েছেন। সেই নেতৃত্বটুকু এসেছে গোপনে। সাধারণ মানুষের কাছে আপনার কোনো অস্তিত্ত্ব নেই। তাদের ধারণা মূল তথ্যকেন্দ্র এই মহাকাশযানকে চালিয়ে নিচ্ছে মহাকাশ দিয়ে। বহুদূরে পৃথিবীতে।
যখন মহাকাশযান পৃথিবীর দিকে রওনা দিয়েছে হঠাৎ করে আপনি আবিষ্কার করলেন আপনার আর কিছু করার নেই। সাধারণ মানুষ শীতল ঘরে ঘুমিয়ে সময় কাটাতে পারে, আপনার ঘুমানোর সুযোগ নেই। আটটি সতেজ হৃদপিণ্ড আপনার জটিল বহুমুখী মস্তিষ্ক স্তরের নানা অংশে রক্ত সঞ্চালন করে। আপনি প্রতি মুহূর্তে সজীব, প্রতি মুহূর্তে কর্মক্ষম। সাধারণ মানুষের চোখ রয়েছে। কান রয়েছে, নাক, মুখ, ইন্দ্রিয় রয়েছে। শারীরিক বা আধা শারীরিক আনন্দের সুযোগ রয়েছে। আপনার সমস্ত কার্যকলাপ বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে। আপনি হঠাৎ করে আবিষ্কার করলেন আপনি নিঃসঙ্গ।
আমি কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলাম। মাথা নিচু করে সম্মান প্রদর্শন করে বললাম, আমি কি ভুল বলেছি মহামান্য গ্রাউল?
মহামতি গ্রাউল এক মুহূর্ত নীরব থেকে বললেন, না। তুমি ভুল বল নি কিহা।
আমি কি আরো একটু বলব?
বল।
আমাদের, সাধারণ মানুষের নিঃসঙ্গতা সাধারণ। সেটা দূর করার জন্যে আমরা সাধারণ কাজ করি। আপনি সাধারণ মানুষ নন–আপনি তাই সাধারণ কাজ করতে পারেন না। আপনি ঠিক করলেন সময় কাটানোর জন্যে একটা কৌতুক করবেন। কিছু বুদ্ধিমান মানুষকে বেছে নিয়ে তাদের সাথে বুদ্ধির কোনো একটা খেলা খেলবেন। এমনি-এমনি আপনি বুদ্ধিমান মানুষ বেছে নিতে চাইলেন না। আপনি ঠিক করলেন সত্যিকারের বুদ্ধিমান মানুষকে বেছে নিবেন। তাই একদিন। মহাকাশযানের সব মানুষকে জাগিয়ে তুলতে শুরু করলেন। তাদেরকে হানাহানি শুরু করতে দিলেন, তাদেরকে নেতৃত্ব নিয়ে যুদ্ধ করতে দিলেন। আপনি ঠিক করলেন যারা সবচেয়ে উপরে উঠে আসবে আপনি তাদের বেছে নিবেন।
মহামতি গ্রাউলের মুখ ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে আসছিল, আমি হঠাৎ বুকের ভিতরে ভয়ের এক ধরনের কম্পন অনুভব করি। তিনি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, তুমি কেমন করে এসব জান?
আমি কিছু জানি না মহামতি গ্রাউল। সব আমার অনুমান। আমার অনুমান ভুল। হতে পারে। যদি হয় আপনি আমার ভুল ধরিয়ে দেবেন মহামতি গ্রাউল। আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, আমার অনুমান কী ভুল হয়েছে মহামতি গ্রাউল?
হয় নি। বল তুমি কী বলতে চাও। তোমার দীর্ঘ ভূমিকা তুমি শেষ কর। আমার ভূমিকা প্রায় শেষ মহামতি গ্রাউল। আমি এক্ষুনি বলব আমি কী চাই। আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের আশা আকাঙ্খ সাধারণ। আমাদের স্বপ্নও সাধারণ। আপনি সাধারণ নন, আপনার আশা আকাঙ্খও সাধারণ নয়। আপনার কল্পনাও সাধারণ নয়। আমরা সেটা বুঝতে পারি না। সেটা কল্পনা করতে পারি না। আপনার ছোট একটি খেয়ালে মাহকাশযানে শত শত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। হাজার হাজার মানুষকে স্বার্থপর লোভীতে পাল্টে দেয়া হয়েছে। এর অবসান ঘটাতে হবে মহামতি গ্রাউল।
লেন হঠাৎ করে আমার কনুই খামচে ধরল। আমি সাবধানে তার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে মহামতি গ্রাউলের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। তার মুখমণ্ডল ধীরে ধীরে কঠোর হয়ে উঠল, তার নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়ে ওঠে এবং একসময়ে থমথমে গলায় বললেন, তুমি কীভাবে এর অবসান ঘটাতে চাও?
আপনি এই মহাকাশযানটির কতৃত্ব মহাকাশযানের মানুষের হাতে ফিরিয়ে দিন।
আর যদি না দিই?
আপনাকে দিতে হবে মহামতি গ্রাউল। মহাকাশযানের সমস্ত মানুষের কাছে অঙ্গীকার করা হয়েছে এটি পৃথিবীতে যাচ্ছে, কিন্তু আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছি নক্ষত্রপুঞ্জ তার ঠিক জায়গায় নেই। ভেগা নক্ষত্র অনেক উপরে, কালপুরুষ বাম দিকে সরে রয়েছে। আপনি এই মহাকাশযানকে অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছেন।
মহামতি গ্রাউলের মুখে এক ধরনের বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল, তিনি সেই হাসি গোপন করার চেষ্টা না করে বললেন, আমি তোমার কথা শুনে মুগ্ধ হয়েছি কিহা। তোমার বুদ্ধিমত্তা নিশ্চয়ই নিনীষ স্কেলে আট এর কম নয়।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন কিন্তু সেটার কোনো অর্থ নেই মহামতি গ্রাউল।
আমি যদি তোমার অনুরোধ মহাকাশযানের কতৃত্ব মানুষের হাতে না দিই তুমি কী করবে কিহা?
আমি বুকভরা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, আমি আপনাকে হত্যা করতে বাধ্য হব মহামতি গ্রাউল।
মহামতি গ্রাউল বিস্মিত দৃষ্টিতে আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন তারপর হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। লেন আমার দুই হাত শক্ত করে ধরে রেখে ফিসফিস করে বলল, হায় ঈশ্বর। হায় পরম করুণাময় ঈশ্বর।