কেউ কোনো কথা বলল না। আমি শান্ত গলায় বললাম, আমি তোমাদের আরো একটি সুযোগ দেব। দুই সেকেন্ড অপেক্ষা করে বললাম, সুযোগ গ্রহণ না করলে ধ্বংস করে দেব সবকিছু।
সাথে সাথে তথ্য ক্রিস্টালের বিস্ফোরকটি বিস্ফোরিত হল। এটি ছিল আরো শক্তিশালী। পুরো হল ঘর প্রায় অন্ধকার হয়ে গেল সাথে সাথে। ছিন্ন ভিন্ন রবোটের ধ্বংসাবশেষ উপর থেকে নিচে পড়তে শুরু করল। মনে হল বুঝি এখানে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছে। আমি তার মাঝে চিৎকার করে বললাম, এই মুহূর্তে আমাকে মহামতি গ্রাউলের কাছে নিয়ে যাও। শুধু তিনিই আমার সাথে কথা বলতে পারবেন, আর কেউ না।
এবার আমার সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলির মাঝে এক ধরনের চাঞ্চল্যের চিহ্ন লক্ষ করা গেল। আমি যেভাবে হাস্যকর ছেলেমানুষি যন্ত্র দিয়ে বড় বড় দুটি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছি কতক্ষণ সেটি তাদের কাছে গোপন রাখতে পারব জানি না, সময় আমার কাছে খুব মূল্যবান। যে কোনো মুহূর্তে আমি ধরা পড়ে যেতে পারি, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মহামতি গ্রাউলকে নিশ্চয়ই অচিন্ত্যনীয় প্রতিরক্ষা দিয়ে আগলে রাখা হয়, আমি নিজে থেকে সেখানে কখনোই যেতে পারব না।
আমার সামনে দাড়ানো মানুষগুলি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে। একজন একটু এগিয়ে এস বলল, তুমি কেন মহামতি গ্রাউলের সাথে দেখা করতে চাও?
আমি গলায় অধৈর্যের স্বর ফুটিয়ে বললাম, আমি তোমাকে সেটা বললে তুমি বুঝবে না। তোমার কিংবা তোমাদের কারো সেই মানসিক পরিপক্কতা নেই।
কথাটি সত্যি নয়, তাই তিন সেকেন্ড পর যখন বললাম, আমি আর সহ্য করতে পারছি না–তখন তৃতীয় বিস্ফোরণটি ঘটল।
ভয়ংকর বিস্ফোরণের ধাক্কাটা কমে যেতেই উপস্থিত মানুষেরা ছোটাছুটি শুরু করে এবং কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যি আমাকে এবং লেনকে একটা ভাসমান যানে তুলে দেয়। সেটি অন্ধকার একটা সুড়ঙ্গে ছুটে যেতে থাকে। বিশাল বিশাল কিছু গেট নিজে থেকে খুলে যায় আবার আমাদের পিছনে বন্ধ হয়ে যায়। অসংখ্য ধরনের যন্ত্রপাতি আমাদের পরীক্ষা করে তারপর ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়।
এক সময় আমি আর লেন একটা বড় হলঘরের মতো জায়গায় পৌঁছালাম। তার ধবধবে সাদা দেয়াল, উঁচু ছাদ এবং স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ মেঝে। ঘরটিতে হালকা নরম একটি আলো, যদিও কোথা থেকে সেই আলো আসছে বুঝতে পারছি না। ভিতরে একটু শীতল, আমি আর লেন কাছাকাছি এসে দাঁড়ালাম। কেউ কিছু বলে দেয় নি কিন্তু আমার মনে হল এখানেই মহামতি গ্রাউলের সাথে দেখা হবে।
আমি আর লেন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। কোথাও কোন চিহ্ন নেই কিন্তু তবু আমাদের মনে হতে থাকে কেউ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি হঠাৎ এক ধরনের আতংক অনুভব করতে থাকি। বুকে আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে আমি লেনের দিকে তাকালাম, ঠিক তখন শুনতে পেলাম কে একজন ভারি গলায় বলল, তোমরা কেন আমার সাথে দেখা করতে এসেছ?
আমি আর লেন চমকে উঠে চারিদিকে তাকালাম, কেউ কোথাও নেই। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি মহামতি গ্রাউল। আপনার ভবনে আমি আহাম্মকের মতো তিনটি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছি, আমি–
হ্যাঁ। আমি খবর পেয়েছি। আমি অনুভব করছি তোমার করোটিতে একটা ছোট ট্রান্সমিটার বসানো আছি। তুমি নিশ্চয়ই তোমার মস্তিষ্ক তরঙ্গ ব্যবহার করে সেটা দিয়ে কাছাকাছি রাখা বিস্ফোরকে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছ।
আপনি সত্যিই অনুমান করেছেন মহামতি গ্রাউল। আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে আমার এই ছলনাটুকু করতে হয়েছে। আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
আমার কর্মচারীদের ধোকা দেয়া খুব সহজ। তারা নির্বোধ।
আমি ক্ষমা চাই মহামতি গ্রাউল।
আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি।
আপনার প্রতি আমার অসংখ্য কৃতজ্ঞতা। অসংখ্য কৃতজ্ঞতা।
তুমি কেন এসেছ আমার কাছে?
আমার বলতে খুব দ্বিধা হচ্ছে মহামতি গ্রাউল। আমি আপনার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন না করে কথাটি কীভাবে উচ্চারণ করব বুঝতে পারছি না।
তুমি অসংকোচে বলতে পার কিহা।
তার আগে আমি কি একটা অনুরোধ করতে পারি?
কী অনুরোধ?
আমি কি আপনাকে দেখতে পারি?
মহামতি গ্রউল এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, আমাকে কেউ কখনন দেখে নি। যে মানুষ বেঁচে থাকবে সে আমাকে কখনো দেখবে না।
আমি আপনাকে সশরীরে দেখতে চাই নি মহামতি গ্রাউল। আমি আপনার একটা রূপ দেখতে চাইছি। আমি কাউকে না দেখে ভাল করে কথা বলতে পারি না মহামান্য গ্রাউল। না দেখে কথা বললে মনে হয় আমি তার উপাসনা করছি।
বেশ। তুমি আমাকে কী রূপে দেখতে চাও? পুরুষ না রমণী?
আপনার যা ইচ্ছে।
প্রায় সাথে সাথেই ঘরের মাঝামাঝি সৌম্য দর্শন একজন বৃদ্ধকে দেখা গেল। শরীরে আলগোছে একটি চাদর জড়ানো, সেখান থেকে এক ধরনের নরম আলো বের হচ্ছে। মাহমতি গ্রাউলের এই রূপটি দেখে আমার প্রাচীন গ্রন্থের দেবদূতের কথা মনে পড়ল। এটি সত্যিকারের কোনো মানুষ নয় কিন্তু রূপটি এত জীবন্ত যে আমরা অভিভূত হয়ে গেলাম। আমি আর লেন মাথা নত করে অভিবাদন করে বললাম, আপনাকে অভিভাদন। আমাদেরকে একটি শান্ত সমাহিত রূপে দেখা দেয়ার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
তুমি এখন কী বলতে চাও বল।
আমার কথাটি বলার আগে আমার একটু ভূমিকা দেয়ার প্রয়োজন। আপনার সময় অত্যন্ত মূল্যবান কিন্তু তবুও আমি একটু সময় ভিক্ষা চাইছি।
সৌম্য দর্শন বৃদ্ধ মানুষটি আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি তোমাকে সময় দিচ্ছি। তুমি বল।