আমি চোখ খুলে তাকালাম, সামনের সাড়িতে আটটি শিশুকে নিয়ে সে শান্ত মুখে বসে আছে–মুখে গভীর উদ্বেগের ছায়া। শিশুগুলি তাকে জড়াজড়ি করে ধরে রেখেছে, কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে দুজন, তার গালের সাথে গাল লাগিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে একজন শিশু। সে হাত দিয়ে আকড়ে রেখেছে। সবাইকে। শিশুগুলির চোখে মুখে কোনো ভয় নেই, আতংক বা উদ্বেগ নেই। তাদের মুখে এক গভীর নিশ্চিন্ত বিশ্বাস। তারা জানে যতক্ষণ লেন তাদেরকে আকড়ে ধরে রাখবে ততক্ষণ তাদের কোনো ভয় নেই, বিপদ নেই।
আমি এই অপূর্ব দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে থাকি। আর কী আশ্চর্য! কিছুক্ষণ পর আমারও মনে হতে থাকে এই আটটি নিস্পাপ শিশুর কোনো ভয় নেই, কোন বিপদ নেই!
ঠিক এরকম সময় বাই-ভার্বালে একটা মৃদু কম্পন অনুভব করলাম এবং সাথে সাথে ভিতরের সব রবোটেরা সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের ঘিরে দাড়াল। আমরা নিশ্চয়ই গন্তব্য স্থানে পৌঁছে গেছি।
বাই-ভার্বালের গোল দরজা দিয়ে আমরা বের হয়ে এলাম। স্বচ্ছ মেঝে, স্বচ্ছ দেয়াল, উপরে স্বচ্ছ ছাদ প্রতি মুহূর্তে মনে হতে থাকে বুঝি কোথাও পড়ে যাব। সাবধানে হেঁটে হেঁটে আমরা দ্বিতীয় একটি ঘরে হাজির হলাম। সেখানে জোর করে শিশুগুলিকে লেনের কাছ থেকে আলাদা করা হল। শিশুগুলি ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করে কিন্তু এবোটগুলি তাতে ভ্রুক্ষেপ করল না। লেন জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখে শিশুগুলিকে অভয় দিয়ে, বলল, তোমরা যাও, আমি এক্ষুনি আসছি।
তারা কী বুঝল কে জানে! একজন একজন করে কান্না থামিয়ে একে অন্যকে জড়াজড়ি করে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তখন আমাকে আর লেনকে পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে পাশের একটা ঘরে নিয়ে আসা হল। আমাদের বিবস্ত্র করা হল এবং আমাদের কাছে যা ছিল সব সরিয়ে নেয়া হল। আমি দেখতে পেলাম খাবারের ক্যাপসুলগুলি সরিয়ে নিল প্রাচীন ধরনের একটি রবোট। তথ্য ক্রিস্টালগুলি আধুনিক ধরনের কিছু রবোট, কমিউনিকেশান্স মডিউলটি যে পরীক্ষা করতে শুরু করল তাকে একজন মানুষের মতো দেখাচ্ছিল, যদিও আমি মোটামুটি নিশ্চিত সেও একজন রবোট।
আদের বিবস্ত্র অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকতে হল না। কিছুক্ষণের মাঝেই নূতন এক প্রস্ত নিও-পলিমার দিয়ে আমাদের আবৃত করা দেয়া হল। সত্যিকার পোষাক নয় তবে পোষাকের কাজ চলে যায়।
এতক্ষণ পর্যন্ত কেউ আমাদের সাথে একটা কথাও বলে নি আমরাও কিছু বলি নি। আমি এবারে আমার প্রথম কথাটি উচ্চরণ করলাম, স্পষ্ট গলায় জোর দিয়ে বললাম, আমি মহামতি গ্রাউলের সাথে দেখা করতে চাই।
সাথে সাথে ঘরটিতে একটি নীরবতা নেমে এল। যে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। খুব ধীরে ধীরে সবাই ঘুরে আমার দিকে তাকাল। আমি শুনতে পেলাম বিশাল এই ভবনে দূরে কোথাও তারস্বরে এলার্ম বাজতে শুরু করেছে।
দীর্ঘ সময় সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। আমি এবার আরো স্পষ্ট গলায় বললাম, আমি মহামতি গ্রাউলের সাথে দেখা করতে চাই। মহামতি গ্রাউল, যিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, যিনি এই বিশাল মহাকাশযানটি তৈরি করেছেন। যার চোখ কান অন্যকোন ইন্দ্রিয় নেই। যিনি সংবেদনশীল যন্ত্র দিয়ে বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ করেন।
আমরা সমানে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা তখনো নিঃশব্দে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমি শুনতে পেলাম অনেকে এই ঘরের দিকে ছুটে আসছে। ঘরের দরজা খুলে গেল এবং বেশ কয়েকজন পুরুষ এবং মহিলা ভেতরে ঢুকে আমাদের ঘিরে দাঁড়াল। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের লক্ষ করতে থাকি, কেন জানি মনে হয় এদের কেউই সত্যিকারের মানুষ নয়। হয় পুরোপুরি রবোট কিংবা রবোটের দেহে আটকে পড়ে থাকা কোনো একজন হতভাগ্য মানুষ।
বয়স্ক ধরনের একজন কয়েক পা এগিয়ে এসে ভীত গলায় বলল, তুমি কী বলছ?
আমি প্রায় ধমক দেয়ার মতো করে বললাম, আমি জানি আকি কী বলছি। আটটি শিশুকে কেন আনা হয়েছে আমি তাও জানি। মহামান্য গ্রাউলের রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতির নিয়ম মাফিক পরিবর্তন করার কথা। আটটি সুস্থ সবল হৃদপিণ্ড দরকার। আটটি শিশু থেকে সেই আটটি হৃদপিণ্ড নেয়া হবে।
বয়স্ক ধরনের মানুষটির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে কাঁপা গলায় বলল, তুমি এসব কী বলছ? কোথায় শুনেছ এই সব?
আমি কোথায় শুনেছি সেটা তোমার জানার দরকার নেই। আমি এই মুহূর্তে মহামতি গ্রাউলের সাথে কথা বলতে চাই। এই মুহূর্তে–
কিন্তু সেটা তো অসম্ভব।
অসম্ভব?
হ্যাঁ।
বেশ। তুমি জান আমি কী করতে পারি?
কী করতে পার?
আমি তোমাদের পুরো এলাকা ধ্বংস করে দিতে পারি।
সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলি এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারা কেউ আমার কথা বিশ্বাস করছে না। আমি হিংস্র গলায় বললাম, তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করলে না? ঠিক আছে আমি তোমাদের আমার ক্ষমতা দেখাব।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, আমার অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে। এক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বললাম, আমি ধ্বংস করে দেব সব।
নির্দিষ্ট সময় পর পর দুটি মিথ্যা কথা উচ্চারিত হওয়া মাত্র খাবার ক্যাপসুলে রাখা বিস্ফোরণটি প্রচন্ড শব্দ করে বিস্ফোরিত হল। প্রাচীন ধরনের রবোটের আশে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রবোটগুলিও ছিটকে উঠল উপরে, তারপর ঘুরতে ঘুরতে নিচে এসে পড়ল প্রচণ্ড শব্দে। হল ঘরটি কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেল, জঞ্জাল ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।
আমাদের যারা ঘিরে দাঁড়িয়েছিল তারা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একজন কী একটা বলতে চাইছিল আমি বাধা দিয়ে বললাম, আমার কথা বিশ্বাস হল?