সম্ভব।
অমির উওর গুনে বুড়ো লী আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কেমন করে তুমি জান?
আমি জানি, কারণ আমি এই ধরনের যন্ত্রপাতিকে দাবা খেলায় হারিয়েছি। কী ভাবে হারিয়েছ?
এই সব যন্ত্রপাতি কখনো ভুল করে না। সেটাই হচ্ছে তাদের দুর্বলতা। আমি এই দুর্বলতা ব্যবহার করে তাদের খেলায় হারিয়েছি।
বুড়ো লী আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, তার চোখে একটা কৌতুকের ছায়া পড়ল। সে হাত বাড়িয়ে আমার হাত স্পর্শ করে বলল, আমি পৃথিবীর নামে তোমাকে আশীর্বাদ করছি, তুমী জয়ী হও।
কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ গোলাকার দরজা খুলে গেল এবং ঘরে প্রথমে সোনালি চুলের মেয়েটি এবং তার পাশাপাশি অনেকগুলি রবোট এসে ঢুকল। ভরশূন্য পরিবেশে আমরা ওলট পালট খাচ্ছিলাম। কিন্তু যারা এসে ঢুকল তারা সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সোনালী চুলের মেয়েটি তার হাতের ভয়ংকর দর্শন অস্ত্রটি উঁচু করে ধরে বলল, বুড়ো লী, মহাকাশযানের কেন্দ্রস্থলে শক্তি কেন্দ্রে বিস্ফোরক বসানোর জন্যে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
বুড়ো লী ক্লান্ত, স্বরে বলল, কথা বলে সময় নষ্ট করো না সোনালি চুলের রবোট।
আমি রবোট নই। আমি মানুষ। আমার নাম ইফা।
ইফা, তুমি জান না যে তুমি রবোট। তোমাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে নিজেকে মানুষ বলে ভাবার জন্যে।
মিথ্যা কথা।
বেশ। আমি তোমার সাথে তর্ক করতে চাই না। তুমি গুলি কর। কিহ এবং লেন তোমরা চোখ বন্ধ কর। প্রতিহিংসামূলক হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত ভয়ংকর ব্যাপার।
লেন একটা আর্ত চিৎকার করে আমাকে জাপটে ধরল এবং সোনালি চুলের মেয়েটি ঠিক সেই সময় বুড়ো লীকে গুলি করল, আমি দেখতে পেলাম বুড়ো লীয়ের দেহ চোখের পলকে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। হত্যা করার কত রকম পদ্ধতি থাকার পরেও কেন এখনো মানুষকে এরকম প্রতিহিংসা নিয়ে ভয়ংকর ভাবে হত্যা করা হয় কে জানে। সোনালি চুলের মেয়েটি এবারে অস্ত্রটি আমার এবং লেনের দিকে তাক করল। আমার ভয় পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু আমি ভয় পেলাম না, শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এখন কী চাও?
মূল তথ্যকেন্দ্রের আটজন মানুষ কোথায়?
পাশের ঘরে।
ইফা নামের সোনালি চুলের মেয়েটি ইঙ্গিত করতেই চারটি রবোট তাদের স্বয়ংক্রিয় জেট চালিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল। কিছুক্ষণের মাঝেই পাশের ঘরে শিশুগুলির চিঙ্কার এবং নানা কণ্ঠের প্রতিবাদ শুনতে পেলাম। লেন এতক্ষণ আমার বুকে মুখ গুজে রেখেছিল, এবার ভয় পাওয়া গলায় বলল, বাচ্চাগুলিকে কী করবে?
আমি জানি না।
লেন ইফার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি জান মূল তথ্যকেন্দ্রের আটজন মানুষ আসলে শিশু?
শিশু?
হ্যাঁ। তাদের সামলানো খুব সহজ নয়। তারা আমার কথা শোনে। তুমি রোটগুলিকে ওদের স্পর্শ করতে নিষেধ কর, আমি তাদের নিয়ে আসছি।
ইফা এক মুহূর্তে কী একটা ভেবে বলল, ঠিক আছে যাও।
লেন ভেসে ভেসে পাশের ঘরে চলে গেল। আমি ইফার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, আমি তোমাকে মুক্ত এলাকায় দেখেছিলাম, তখন তুমি আমাকে দেখে পালিয়ে যাচ্ছিলে–এখন অনেক সাহস দেখাচ্ছ, কারণটা কী?
ইফা কোনো কথা না বলে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি নিচু গলায় বললাম, মানুষ ইচ্ছে করলে নিয়ম তৈরি করতে পারে আবার নিয়ম ভাঙতে পারে। রবোটেরা পারে না। তাদেরকে যেভাবে প্রোগ্রাম করা হয় ঠিক সেভাবে চলতে হয়। তোমাকে নিশ্চয়ই এখন সাহসী এবং নিষ্ঠুর হওয়ার জন্যে প্রোগ্রাম করা। হয়েছে।
ইফা ক্রুদ্ধ গলায় বলল, আমি রবোট নই। আমাকে কেউ প্রোগ্রাম করে নি।
তুমি হয়তো রবোট নও, কিন্তু তোমাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে ইফা। একজন। রবোটকে প্রোগ্রাম করা সহজ কিন্তু মানুষকে প্রোগ্রাম করা এত সহজ নয়। কিন্তু একবার যদি মানুষকে প্রোগ্রাম করা হয় সেখান থেকে তার কোনো মুক্তি নেই।
ইফা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ফিসফিস করে বললাম, তোমার জন্যে আমার করুণা হয় ইফা। অসম্ভব করুণা হয়।
ঠিক এরকম সময় বাইরে থেকে অনেকগুলি রবোট ভেতরে এসে হাজির হল, তাদের একজন মাথা নিচু করে বলল, মহামান্যা ইফা আমরা শক্তিকেন্দ্র পরীক্ষা করে এসেছি। সেখানে কোনো বিস্ফোরক নেই।
বিস্ফোরক নেই?
না।
আমি ইফার দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি সম্পূর্ণ বিনা কারণে বুড়ো লীকে হত্যা করেছ।
বিস্ফোরক রাখা আর বিস্ফোরক রাখার কথা বলা সমান অপরাধ। বুড়ো লী তার কাজের যথাযযাগ্য শাস্তি পেয়েছে।
তোমার ভিতরে কী কোনো অপরাধবোধ জন্ম নিয়েছে ইফা?
অপরাধবোধ?
কেন?
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি নিশ্চয়ই একজন রবোট। নিশ্চয়ই রবোট।
ইফা ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, না, আমি রবোট নই। আমি মানুষ। মানুষ। মানুষ।
আমি বুড়ো লীয়ের ছিন্নভিন্ন দেহের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, তুমি মানুষ নও। আমি প্রার্থনা করি তুমি মানুষ হও।
৭. বাই-ভার্বালটি নিঃশব্দে
বাই-ভার্বালটি নিঃশব্দে মহাকাশযানের মাঝে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। প্রথমে জানালা দিয়ে বাইরে দেখা যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ হল আর দেখা যাচ্ছে না। জানালাগুলি অন্ধকার করে দিয়ে বাইরের সাথে আমাদের যোগাযোগ কেটে দেয়া হয়েছে। নিরাপত্তার বাধাধরা নিয়ম কানুন, কিছু করার নেই, কিন্তু আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। আমি সাধারণ মানুষ, আমার সাধারণ দায়িত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যচক্রে আমি এক বিশাল ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছি। এর থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরে আসব তার সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই। এখন যে ঘটনাগুলি ঘটছে সেটাই হবে আমার জীবনের শেষ ঘটনাগুলি। এগুলি একটু মধুর হতে পারত কিন্তু হয় নি। বুড়ো লীয়ের হত্যাকাণ্ড নিজের চোখে দেখেছি। আটটি ফুটফুটে শিশুর হত্যাকাণ্ড দেখতে হবে, আমার আর লেনের কথা তো ছেড়েই দিলাম। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেললাম, জোর করে মাথা থেকে সবকিছু সরিয়ে দিলাম, এখন সুন্দর একটা কিছু ভাবতে হবে, মিষ্টি একটা কিছু ভাবতে হবে যেটি আমার বিক্ষিপ্ত মনটিকে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও শান্ত করে দিতে পারে। কী হতে পারে সেই জিনিস? আমার শৈশব? ফেলে আসা গ্রহটির বিশাল প্রান্তর? স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ আকাশ? একটু পর আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম যে আমি লেনের কথা ভাবছি।