আমি এই মহাকাশযানের সর্বশেষ তথ্য জানতে এসেছি।
সুদর্শন মানুষটির মুখে সহৃদয় একটা হাসি ফুটে উঠল, সে নিচু গলায় বলল, খুব বড় একটা তথ্য এসেছে, জানতে চাও?
কী তথ্য?
তুমি সেটা শুনতে চাইলে আমার জানা প্রয়োজন তুমি তার জন্যে কত ইউনিট খরচ করতে চাও।
আমি ইতস্ততঃ করে বললাম, তথ্যের জন্যে যে অর্থ ব্যয় করতে হয় আমি সেটাও জানতাম না। আমার ধারণা ছিল তথ্য জানতে পারা হচ্ছে মানুষের জন্মগত অধিকার।
মানুষটা ষড়যন্ত্রীদের মতো মাথা এগিয়ে এনে বলল, বেঁচে থাকাও মানুষের জন্মগত অধিকার, এই মহাকাশযানে মানুষজন কীভাবে মারা পড়ছে তুমি জান?
আমি ভাল জানতাম না, জানার কোনো কৌতূহলও অনুভব করলাম না। একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, আমার কাছে সাড়ে সাত হাজার ইউনিটের মতো রয়েছে। কী ধরনের তথ্য পাওয়া যাবে?
মানুষটা জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলল, সাড়ে সাত হাজার ইউনিট অনেক অর্থ হতে পারে–মোটামুটি সুন্দরী একটা মেয়েমানুষ কিনে ফেলা যায় কিন্তু তথ্যের জন্যে এটা খুব বেশি নয়। কিন্তু তোমাকে আমি বড় তথ্যটা এর বিনিময়েই দিয়ে দেব। তার আগে তোমাকে কিছু অঙ্গীকার করতে হবে। তথ্যটা কাউকে বলবে না, যদি বল তোমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এই সব রুটিন ব্যাপার।
বেশ। কী করতে হবে বল।
আমাকে বেশ সময় নিয়ে নানা ধরনের অঙ্গীকার করতে হল সেসব অঙ্গীকারপত্র কমিউনিকেশান্স মডিউল দিয়ে নিশ্চিত করতে হল এবং তখন সুদর্শন মানুষটি আমার হাতে ছোট একটা ক্রিস্টাল ধরিয়ে দিয়ে বলল, নাও এই সব তথ্য এখন তোমার।
আমি ক্রিস্টালটি আমার কমিউনিকেশান্স বক্সে লাগাতে লাগাতে জিজ্ঞেস করলাম, তথ্যটি কীসের উপর?
মানুষটি ঝুকে পড়ে বলল, মিয়ারার আস্তানায় নিনীষ স্কেলে আটমাত্রার একজন মানুষ এসেছিল, নাম কিহা। সে এবং লেন নামে আরো একটি মেয়ে মূল তথ্যকেন্দ্রের জন্যে আলাদা করে রাখা আটজন মানুষকে নিয়ে পালিয়ে গেছে।
আমি হতচকিতের মতো মানুষটির দিকে তাকালাম, মানুষটি আমার দৃষ্টি দেখে ভাবল আমি তার কথা বিশ্বাস করছি না। সে গলায় জোর দিয়ে বলল, আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না, সব তথ্য আছে এই ক্রিস্টালে। আমি নিজে দেখেছি।
আমি খানিকক্ষন চেষ্টা করে বললাম, আর কোনো তথ্য আছে?
আর কী চাও তুমি? গত দশ বছরে এরকম তথ্য বের হয় নি। ছয় মাত্রার গোপন খবর এটা। কিহা নামের মানুষটার ছবিও আছে এখানে।
সুদর্শন মানুষটি হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, মজার ব্যাপার জান–তোমার সাথে কিহার চেহারার অনেক মিল।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। ক্রিস্টালটা দাও আমি দেখাচ্ছি।
থাক, আমি নিজেই দেখে নেব।
লোকটাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমি বের হয়ে এলাম। আমার খবর এখানে আট দশ হাজার ইউনিটে বিক্রি হচ্ছে? কী সর্বনাশা কথা!
ঘর থেকে বের হতেই দেখতে পেলাম সোনালি চুলের সেই মেয়েটি সামনে থেকে সরে গেল। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেললাম, আমার পরিচয় নিশ্চয়ই এখানকার কিছু মানুষ কিংবা রবোটের কাছে গোপন নেই। তারা এখন কী করবে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।
সোনালি চুলের মেয়েটি যেই হয়ে থাকুক আর তার দলে যত মানুষই থাকুক তারা আমাকে কিছু করল না। আমি আমার ছোট ভাসমানযানে করে উড়ে উড়ে অসংখ্য জটিল গলি ঘুচি দিয়ে বুড়ো লীয়ের আস্তানায় ফিরে এলাম। ভাসমান যানটি দেখতে সাদামাটা হলেও তার মাঝে নানারকম যন্ত্রপাতি রয়েছে, কেউ পিছু নিলে সেটি বুঝতে পারে এবং যেভাবেই হোক তাকে খসিয়ে দেয়। কেউ আমার পিছু নেয়নি, এবং নিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত আসতে পারেনি।
ডকিং স্টেশনে ভাসমান যানটি রেখে আমি ভেসে ভেসে দরজার কাছে পৌঁছালাম। বুড়ো লী ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করল, কেমন সময় কেটেছে কিহা?
ভাল।
ভেতরে আস।
আমি ভেতরে আসার আগে নিজেকে ভাল করে পরীক্ষা করতে চাই। আমার মনে হচ্ছে আমার শরীরে কিছু একটা ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে।
বুড়ো লী খানিকক্ষণ চুপ করে রইল তারপর বলল, যদি সত্যি তাই হয়ে থাকে আমার কিছু করার নেই কিহা। আমি তোমার শরীর থেকে সেটা বের করতে পারব না। আমার যন্ত্রপাতি দশ বৎসরের পুরানো! তুমি ভেতরে এস, তোমার মুখে শুনি কী হয়েছে।
আমি ভেতরে প্রবেশ করলাম। তখনো জানতাম না সেই মুহূর্তে বুড়ো লীয়ের মৃত্যুদণ্ডাদেশ স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে।
৬. বুড়ো লী যদিও খুব আগ্রহ নিয়ে
বুড়ো লী যদিও খুব আগ্রহ নিয়ে আমার মুখ থেকে কথা শুনবে বলে আমাকে ডেকে আনল কিন্তু আমি যখন বলতে শুরু করলাম সে খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনছে বলে মনে হল না। মাঝে মাঝেই সে অন্যমনস্ক হয়ে যেতে লাগল,এবং তার প্রশ্নগুলি হল অনাবশ্যক এবং সংগতিহীন। যখন ক্রিস্টালটি কমিউনিকেশান্স মডিউলে দিয়ে দেখানো হল, সে আধাবোজা চোখে পুরোটা দেখে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সময় হয়ে গেছে।
লেন জিজ্ঞেস করল, কীসের সময়?
যার জন্যে এই প্রস্তুতি।
কীসের প্রস্তুতি?
এই যে মহাকাশযানটিতে সবাইকে ঘুম থেকে তুলে আনা হচ্ছে, নিজেদের ভেতরে হানাহানি তৈরি করা হচ্ছে তার একটা কারণ আছে। সেটা কী আমি বলতে পারব না, তোমাদের নিজেদের ভেবে বের করতে হবে। তবে–
তবে কী?
তোমরা যে আটটা শিশুকে নিয়ে এসেছ সেটি মহাকাশযানের সব হিসেবকে গোলমাল করে দিয়েছে। কাজেই এই মহাকাশযানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তোমরা জড়িয়ে গেছ। তোমরা চাও কি নাই চাও তোমাদের এখন পেছানোর উপায় নেই।