কালো চুলের সুন্দরী মেয়েটাকে ঘিরে যেখানে মানুষের ভিড় ছিল জায়গাটা এখন ফাঁকা। মোটা মতো একজন মানুষ দেয়ালে হেলান দিয়ে চৌকোনা একটা পাত্র থেকে এক ধরনের পানীয় খাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এখানে একটা মেয়ে বিক্রি হচ্ছিল, কালো চুলের, দুঃখী মতোন চেহারা
সোমারিয়া! বিক্রি হয়ে গেছে।
বিক্রি হয়ে গেছে?
হ্যাঁ। ভাল দাম পেয়েছে, নয় হাজার ইউনিট। খাঁটি মেয়ে মানুষ ছিল, কোনো ভেজাল নেই।
আমি শুকনো গলায় আবার বললাম, বিক্রি হয়ে গেছে?
হ্যাঁ। তোমার দরকার কোনো মেয়ে মানুষ? আমার হাতে আছে একটা। আশি ভাগ খাঁটি। যকৃত আর কিডনিগুলি কৃত্রিম–এ ছাড়া সব খাটি। রুপালি চুল নীল চোখ। ধবধবে সাদা চামড়া—
আমি হেঁটে বের হয়ে এলাম, হঠাৎ কেন জানি আমার ভিতরে এক ধরনের বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
আমি পুরো এলাকাটি ঘুরে বেড়াতে থাকি। বিচিত্র সব দোকানপাট, বিচিত্র ধরনের মানুষ, তারা তাদের থেকেও বিচিত্র সব কাজকর্ম করছে। ভালবাসা ঘৃণা লোভকে পুঁজি করে এখানে এখানে তাদের ব্যবসা চলছে। আমি খাবারের এলাকাটা হেঁটে এলাম, এখন আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। অস্ত্রশস্ত্রের দোকান রয়েছে। মানুষ যে কী পরিমাণ অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারে এখানে এলে সেটা বোঝা যায়। ঘুরতে ঘুরতে আমিও একটা জিনিস কিনলাম পাঁচশ ইউনিট দিয়ে। জিনিসটা বিক্রি করছিল একজন বুড়ো মতোন মানুষ। সে সেটার নাম দিয়েছে মন মেশিন। সেটা দিয়ে নাকি একজন মানুষ তার মানসিক শক্তি দিয়ে অন্য মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কেমন করে কাজ করে?
বুড়ো মতন মানুষটি বলল, বলা যাবে না।
কেন?
ব্যবসার কারণে।
আমি হতচকিতের মতো মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম, কী দ্রুত এই মহাকাশযানের সব মানুষকে লোভ শিখিয়ে দেয় হয়েছে। আমি মন মেশিনটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কাজ করে তার কী প্রমাণ আছে?
তুমি হেলমেটটা মাথায় পর আমি দেখাচ্ছি, প্রমান করে দিচ্ছি।
আমি হেলমেটটা মাথায় পরতে গিয়ে থেমে গেলাম, হেলমেটে মস্তিষ্কের বিদ্যুৎ প্রবাহের সংকেত ধরার ছোট ছোট মডিউল দেখা যাচ্ছে এবং সেটা কী ভাবে কাজ করে হঠাৎ করে আমি বুঝে গেলাম। আমি হাসি গোপন করে বললাম, এটার নাম মন মেশিন দেয়া ঠিক হয় নি।
বুড়ো মানুষটি ভুরু কুচকে বলল, কেন একথা বলছ?
আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি মস্তিষ্কের বিদ্যুৎ তরঙ্গ থেকে এক ধরনের সংকেত বের করে ট্রান্সমিটারে দিয়ে অন্যত্র পাঠাচ্ছ! মনের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
বুড়ো মানুষটির চোয়াল ঝুলে পড়ল, সে আমতা আমতা করে বলল, তুমি কেমন করে বুঝতে পারলে?
আমি হেলমেটটা দেখিয়ে বললাম, ভিতরে তাকালে যে কেউ বুঝতে পারবে।
না, বুড়ো মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, পারবে না। কেউ পারে নি। তুমি কাউকে বলে দিও না, আমি তোমাকে অর্ধেক দামে দিচ্ছি।
আমি অর্ধেক দাম দিয়ে মন মেশিন কিনে নিয়ে বের হয়ে এলাম। দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্রের কাছাকাছি জৈবিক জিনিসপত্রের দোকন। ভেতরে ঢুকে আমার গা গুলিয়ে গেল কিন্তু আমি আবার বের হয়েও আসতে পারলাম না। বিচিত্র একটা কৌতূহল নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখি। মানুষের হৃদপিণ্ড, কিডনি, ফুসফুস এবং যকৃত বিক্রয় হচ্ছে। জীর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাল্টে নেয়ার জন্যে কাছেই অপারেশান থিয়েটার খোলা হয়েছে। মানুষজন দরদাম করে পছন্দসই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেছে নিয়ে সেই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে যাচ্ছে। এ ধরনের ব্যাপার যে ঘটতে পারে নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না।
এর কাছাকাছি রয়েছে জীবাণুর দোকান। সম্ভাব্য সবধরনের জীবাণু সেখানে পাওয়া যায়। কিটুনিয়া ভাইরাস নামের এক ধরনের ভাইরাসের ছোট ক্যাপসুল দেখতে পেলাম, সেগুলি এত ছোট যে খালি চোখে দেখা যায় না। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে এটাকে ফেটে যাবার জন্যে প্রোগ্রাম করা যায় তারপর কারো শরীরে ঢুকিয়ে দিলে সেটি তার মস্তিষ্কে এসে নির্দিষ্ট সময়ে ফেটে গিয়ে মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন সেল ধ্বংস করে দেয়। দুই হাজার ইউনিট করে দাম। কী কাজে লাগবে আমি জানি, না। তবু কেন জানি একটা কিটুনিয়া ভাইরাসের ক্যাপসুল কিনে নিলাম। মহাকাশযানে যেরকম পরিস্থিতি হয়তো কখনো নিজের জন্যে মৃত্যু বেছে নিতে হবে!
বুড়ো লী বলেছিল এখানে এলে আমার ভাল লাগবে, কিন্তু আমার ভাল লাগছে না। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম এই মুক্ত এলাকায় এসে আমি বরং আশ্চর্য ধরনের এক দূষিত বিষণ্ণতায় ভুগতে শুরু করেছি।
আধো অন্ধকারে একটা জটলা থেকে বের হবার সময় হঠাৎ আমার কনুইয়ে কে যেন স্পর্শ করল, আমি সেখানে একটু তীক্ষ্ণ জ্বালা অনুভব করলাম, মুখ ঘুরিয়ে দেখি সোনালি চুলের সেই মেয়েটি, আমার চোখে চোখ পড়তেই সে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেল। আমি কনুইটি লক্ষ করলাম, সেখানে কিছু নেই, মেয়েটি কি আমাকে কিছু বলতে চাইছে? আমাকে কিছু করতে চাইছে?
আমি খানিকটা দুশ্চিন্তা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে তথ্য বিনিময় কেন্দ্রটি আবিষ্কার করলাম। বাইরে বড় বড় করে লেখা, “নামমাত্র মূল্যে মহাকাশযানের সর্বশেষ তথ্য।” বুড়ো লী নিশ্চয়ই এই জায়গাটার কথা বলেছিল, আমি এক নজর দেখে ভেতরে ঢুকে গেলাম এবং সাথে সাথে আমার দিকে একজন মানুষ এগিয়ে এল। মানুষটি সুপুরুষ এবং সে বিষয়ে পুরোপুরি সচেতন, আমার দিকে ভদ্রতার হাসি হেসে বলল, তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?