বায়ো নিয়ন্ত্রণ ঘর থেকে বের হয়ে আমি একটা ছোট হলঘরে হাজির হলাম। সেখানে আরামদায়ক চেয়ারে জনা বিশেক নানাবয়সের মানুষ গা এলিয়ে বসে আছে। আমি ঘরে ঢুকতেই সবাই ঘুরে আমার দিকে তাকাল এবং মধ্যবয়সী একজন মানুষ সহজ গলায় বলল, এই হচ্ছে কিহ। এখন আমরা কাজ শুরু করে দিতে পারি।
আমি সবাইকে লক্ষ করতে করতে একটা খালি চেয়ারে বসে পড়লাম। চেয়ারগুলি দেখতে যত আরামদায়ক বসতে সেরকম নয়, ইচ্ছে করেই নিশ্চয় এভাবে তৈরি করা হয়েছে। মনে হয় আমাদের জরুরি কোনো তথ্য দেয়া হবে, তাই বেশি আরামে ঠেলে দিতে চায় না, একটু তটস্থ রাখতে চায়। মধ্যবয়সী মানুষটি হেঁটে হেঁটে ঘরের মাঝখানে যেতে যেতে বলল, প্রতিদিন শীতল ঘর থেকে যে সব মানুষকে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে তাদের মাঝে যাদের বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে ছয় এর বেশি তাদেরকে এই ঘরে আনা হয়। মস্তিষ্ক স্ক্যান করার পদ্ধতিটি এখনো পুরোপুরি আয়ত্তে আনা হয় নি। মাঝে মাঝে ভুল করে বুদ্ধিমান মানুষের বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে ধরা পড়ে না। কিন্তু উল্টোটা কখনো হয় নি। যাদের বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে ছয়ের বেশি ধরা পড়েছে তারা কখনো নির্বোধ প্রমাণিত হয় নি। কাজেই এই ঘরে তোমরা যারা আছ তারা সবাই নিশ্চিতভাবে অত্যন্ত বুদ্ধিমান–আমার কাজ সে কারণে খুব সহজ।
সামনের দিকে বসে থাকা একজন তরল গলায় বলল, তোমার কাজটা কী?
আমার কাজ তোমাদেরকে তোমাদের পরবর্তী দায়িত্বের জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা। তোমরা সবাই শীতলঘরে ঘুমিয়েছিলে এবং তোমাদের বলা হয়েছিল পৃথিবী নামক গ্রহটার কাছে পৌঁছানোর পর তোমাদের জাগিয়ে তোলা হবে। পৃথিবী এখনো অর্ধশতাব্দী বৎসর দূরে, তোমাদের এখনই জাগিয়ে তোলা হয়েছে, তার পিছনে নিশ্চয়ই একটা কারণ রয়েছে। কারণটা কী?
আমার পাশে বসে থাক ঝকঝকে চেহারার একটা মেয়ে বলল, আমাদের সেটা অনুমান করতে হবে?
না। মধ্যবয়স্ক মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, সেটা তোমাদের অনুমান করতে হবে। এটি গোপন কিছু নয়, কিন্তু তুমি যেহেতু প্রশ্ন করেছ আমার একটু ব্যক্তিগত কৌতূহল হচ্ছে। তুমি কি কিছু অনুমান করছ?
মেয়েটি মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ।
আমরা কি সেটা শুনতে পারি?
অবশ্যি পার। আমার ধারণা সত্যিকার কারণটি যেন আমরা জানতে না পারি সেজন্যে তুমি আমাদের বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে এখন মিথ্যে একটা কারণের কথা বলবে।
মেয়েটার কথা শুনে আমরা সবাই উচ্চঃস্বরে হেসে উঠলাম, মধ্য বয়স্ক মানুষটি হাসল সবচেয়ে জোরে। সে হাসতে হাসতেই বলল, এই মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণের পুরো ব্যাপারটি এত জটিল যে তোমার ধারণা সত্যি হবার পুরোপুরি সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আমি তোমাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমি তোমাদের যদি মিথ্যে একটা কারণের কথাও বলি সেটা সত্যি জেনেই বলব। মানুষকে যখন বিভ্রান্ত করার প্রয়োজন হয় তখন রবোটকে ব্যবহার করা হয়। আমি রবোট নই, জলজ্যান্ত মানুষ।
সামনের দিকে বসে থাকা একজন মানুষ বলল, ঠিক আছে, এখন তাহলে কারণটা শোনা যাক।
মধ্যবয়স্ক মানুষটির মুখ একটু গম্ভীর হয়ে আসে। সে কীভাবে কথাটা বলবে সম্ভবত সেটা মনে মনে একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল, এই মহাকাশযানটি প্রায় এক শতাব্দী আগে যখন পৃথিবীর দিকে রওনা দিয়েছিল তখন পরিকল্পনা করা হয়েছিল পৃথিবীর কাছাকাছি এসে আমাদের সবাইকে জাগিয়ে তোলা হবে। সে ভাবেই এই অভিযান শুরু হয়েছিল। বেশির ভাগ মহাকাশচারী শীতল ঘরে ঘুমিয়েছিল অল্প কিছু ক্রু পালা করে মহাকাশযানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছিল। তোমরা নিশ্চয়ই জান মহামতি গ্রাউল যখন এই মহাকাশযানটি তৈরি করেছিলেন তখন সেটিকে সৃষ্ট জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এটি মহকাশ পারাপার করতে পারে।
আমরা মাথা নাড়লাম, মহাকাশচারী হিসেবে এই মহাকাশযানে পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার জন্যে আমরা যারা স্বেচ্ছায় নাম লিখিয়েছিলাম তাদেরকে নানাভাবে এই তথ্যগুলি অনেকবার দেয়া হয়েছে। এই মহাকাশযানের পরিকল্পনা করেছিলেন গ্রাউল নামের একজন মানুষ, তাকে সবসময় মহামতি গ্রাউল বলা হয়। জনশ্রুতি রয়েছে মহামতি গ্রাউল বিকলাঙ্গ, তার চোখ কান অন্যকোন ইন্দ্রিয় নেই, তিনি সরাসরি সংবেদন জাতীয় যন্ত্র দিয়ে বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি কোথায় থাকেন সেটি কেউ জানে না। তিনি কি বেঁচে আছেন না মারা গেছেন সেটিও কেউ জানে না। মহামতি গ্রাউল নিয়ে যে পরিমাণ রহস্যের জন্ম দেওয়া হয়েছে যে আমার মনে হয় পুরো ব্যাপারটি কাল্পনিক। গ্রাউল নামে কোনো মানুষ কখনো ছিল না। এটি কিছু প্রতিভাবান বিজ্ঞানী এবং কিছু শক্তিশালী কম্পিউটার জাতীয় যন্ত্রের একধরনের সুষম উপস্থাপন।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এই অভিযানের প্রথম অংশটুকু ঠিক পরিকল্পনা মাফিক কেটেছে। কিন্তু যখন আমরা পৃথিবীর কাছাকাছি পৌঁছাতে শুরু করেছি হঠাৎ করে অবস্থার পরিবর্তন হল। পৃথিবী থেকে আমাদের কাছে কিছু সংবাদ পৌঁছাত শুরু করল।
আমার পাশে বসে থাকা ঝকঝকে চেহারার মেয়েটি বলল, কী ধরনের সংবাদ?
অত্যন্ত নিরীহ ধরনের সংবাদ। পৃথিবীর ফসল তোলা হচ্ছে। পানি সরবরাহ করার জন্যে মেরু অঞ্চলের বরফ গলানো হচ্ছে। আয়োনোস্ফিয়ারে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। নূতন ধরনের আন্তঃগ্যালাক্টিক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হচ্ছে এই ধরনের সংবাদ। আপাত দৃষ্টিতে এই সংবাদগুলির মাঝে এতটুকু বৈচিত্র নেই। কিন্তু মহাকাশযানের তথ্য বিশ্লেষণের যে সমস্ত উপায় রয়েছে সেগুলির মাঝে এই