মেয়েটির মালিক মুখ বাঁকা করে হেসে বলল, তাহলে এটমিক ব্লাস্টারই কিছু কেন? নিওন বাতি জ্বালিয়ে সেটা কোলে নিয়ে বসে থাকো, সেটার সাথে মিষ্টি মিষ্টি ভালবাসার কথা বলো–
তার কথার ভঙ্গিতে উপস্থিত মানুষেরা হো হো করে হেসে দিল, মধ্যবয়স্ক মানুষটা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আর আমি এত দাম দিয়ে কিনে নিয়ে যদি দেখি এটা রবোট?
রবোট? মেয়েটার মালিক চোখ কপালে তুলে বলল, এই সুন্দরী মেয়েকে তোমার রবোট মনে হচ্ছে? চোখের দিকে তাকিয়ে দেখ কী দুঃখি চোখ, দেখ চোখের পানি একেবারে খাঁটি অশ্রু–ভাল করে দেখ!
মধ্যবয়স্ক মানুষটি মেয়েটির চোখের পানি সত্যিকারের অশ্রু কি না দেখার জন্যে এগিয়ে গেল এবং আমার হঠাৎ করে কেন জানি ব্যাপারটিকে একটি অসহনীয় ধরনের অমানবিক ব্যাপার বলে মনে হতে থাকে। আমি ভিড় ঠেলে বের হয়ে এলাম। আমার কাছে যদি দশ হাজার ইউনিট থাকত আমি তাহলে মেয়েটিকে কিনে মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু আমার কাছে একটি কপর্দকও নেই, বুড়ো লী বলেছে আমার কোনো অর্থের প্রয়োজনও নেই।
আমি ভিড় ঠেলে বের হয়ে হাঁটতে থাকি, কাছাকাছি অনেকগুলি খাবার জায়গা। সুন্দর টেবিল ঘিরে পুরুষ এবং রমণীরা সুদৃশ্য খাবার খাচ্ছে, বাতাসে খাবার এবং পানীয়ের ঝাঁঝালো গন্ধ। আমি হঠাৎ করে এক ধরনের তীব্র খিদে অনুভব করতে থাকি। শীতল ঘরে ঢোকার আগে আমি শেষবার সত্যিকার অর্থে খেয়েছিলাম, শরীরে নানা ধরনের জৈবিক পদার্থ থাকায় আমি খিদেয় কাতর হচ্ছি না, শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে না, কিন্তু খাবারের লোভটি আমাকে তাড়না করতে থাকে। আমি সরে এলাম। কাছেই আলোকজ্জ্বল একটি ঘরের সামনে অনেকগুলি ছোট ছোট টেবিল। সেখানে কিছু পুরুষ এবং মহিলা খুব মনোযোগ দিয়ে একটি মনিটরে কী যেন লিখছে। আমি একটু এগিয়ে গেলাম এবং ঠিক তখন একটা রবোট এগিয়ে এসে উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি কি বুদ্ধিমান? যদি সত্যি বুদ্ধিমান হয়ে থকেন তাহলে আমাদের বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষায় অংশ নিন। যদি পঞ্চম স্তরে পৌঁছাতে পারেন আপনার পুরস্কার পাঁচ হাজার ইউনিট। ষষ্ঠ স্তরে দশ হাজার ইউনিট। আর যদি সপ্তম স্তরে পৌঁছাতে পারেন–রবোটটি তার গলায় একধরনের হাস্যকর উত্তেজনা ফুটিয়ে বলল, পঞ্চাশ হাজার ইউনিট! এক নয়, দুই নয়, দশ কিংবা বিশ নয়–পঞ্চাশ হাজার ইউনিট!
আমার কাছাকাছি যারা ছিল তাদের অনেকেই নিজেদের বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করার জন্য এগিয়ে গেল। আমার বুড়ো লীয়ের কথা মনে পড়ল, সে আমাকে বলেছিল আমার কোনো অর্থের প্রয়োজন নেই। আমার যা প্রয়োজন নিজে থেকেই আমার কাছে চলে আসবে। সে হয়তো এর কথাটিই বলেছিল। আমার একটু লজ্জা লাগছিল তবুও সামনে এগিয়ে গেলাম।
মনিটরে নিজের কমিউনিকেশান্স মডিউলটি জুড়ে দেবার সাথে সাথেই সেখানে কিছু প্রশ্ন ভেসে আসে। সাধারণ যুক্তিতর্কের এবং সহজ গাণিতিক সমস্যা। প্রথম তিন চারটি স্তর খুব সহজেই সমাধান হয়ে গেল। পঞ্চম স্তরটি বেশ কঠিন। সমাধান বের করতে আমার বেশ সময় লেগে যায়। ষষ্ঠ স্তরে গিয়ে প্রথমবার আমার সন্দেহ হতে থাকে যে আমি হয়তো সমাধানটি বের করতে পারব না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমাধানটি বের হয়ে গেল। সপ্তম স্তরের সমস্যাটি মনিটরে এল খুব ধীরে ধীরে এবং আমি সেটিকে নিয়ে মগ্ন হয়ে যাবার আগের মুহূর্তে মনে হল আমাকে কেউ একজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করছে এবং আমি চোখ তুলে তাকাতেই সোনালি চুলের একটি মেয়ে হঠাৎ করে চোখ সরিয়ে নিল। আমি আবার সমস্যাটির দিকে তাকালাম এবং ঠিক তখন আমার পিছনে দাঁড়ানো একজন মানুষ নিচু গলায় বলল, এন্ড্রোমিড়ার দোহাই! তুমি সপ্তম স্তরে চলে এসেছ!
আমি কোনো কথা না বলে লোকটার দিকে তাকালাম। লোকটার চোখে-মুখে বিস্ময়! সে অবাক হয়ে বলল, নিনীষ স্কেলে তোমার বুদ্ধিমত্তা কত? ছয়ের কম নয়, তাই না?
আমি মনিটরের দিকে তাকালাম এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম আমি মহাকাশযানের লোভী মানুষদের একটা ফাদে পা দিয়ে ফেলেছি। এই মহাকাশযানের এখন সুন্দরী মেয়েমানুষ বা সুদর্শন পুরুষ থেকেও মূল্যবান সামগ্রী হচ্ছে বুদ্ধিমান মানুষ। এই পরীক্ষাকেন্দ্রটি আসলে সেরকম বুদ্ধিমান মানুষদের খুঁজে বের করার একটা ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছু নয়। আমি মনিটরটি টেবিলে রেখে উঠে দাড়ালাম, পিছনে দাঁড়ানো মানুষটি বলল, কী হল সমাধান করবে না?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না!
কেন?
মনে হয় কঠিন।
চেষ্টা করে দেখ, চেষ্টা না করলে তুমি কেমন করে জানবে? পঞ্চাশ হাজার ইউনিট পেয়ে যেতে পার!
আমি কমিউনিকেশান্স মডিউলে আমার পুরস্কারের দশ হাজার ইউনিট জমা করতে করতে বললাম, এত ইউনিট দিয়ে আমি কী করব?
লোকটা অবাক হয়ে বলল, কী বলছ তুমি! ইউনিট কত কাজে আসে। তুমি আর আমি মিলে একটা এজেন্সি খুলতে পারি। মহাকাশযানের কঠিন সব সমস্যার সমাধান করে দেব। তুমি দেখবে বুদ্ধি খাটানোর অংশ, আমি দেখব অর্থনৈতিক দিক। রাজি আছ?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না রাজি নই–তারপর লোকটাকে কোনো কথা না বলতে দিয়ে আমি বের হয়ে এলাম। খাবারের জায়গার পাশেই মানুষ বেচা-কেনার দোকান। আমি এখন ইচ্ছে করলে কমবয়সী সেই দুঃখী মেয়েটাকে কিনে ফেলতে পারি। তাকে বলতে পারি তুমি এখন স্বাধীন, তোমার যেখানে ইচ্ছে তুমি চলে যাও। কোন মধ্যবয়স্ক মানুষ চোখে লালসা নিয়ে আর তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে না।