কে পেয়েছে?
কেউ পায় নি। মনে হয় কেউ পাবে না।
সেটা কোনো জায়গা?
বুড়ো লী আমার দিকে তাকিয়ে খিক খিক করে হাসতে শুরু করে, হাসতে হাসতে হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, আমি শুনেছিলাম তুমি নাকি নিনীষ স্কেলে আট মাত্রার বুদ্ধিমান! সেটা কোনো জায়গা এখনো জান না?
না।
ঠিক আছে তাহলে নিজেই ভেবে ভেবে বের কর।
আমি খানিকক্ষণ বুড়ো লীয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, মূল তথ্যকেন্দ্র?
বুড়ো লী তার ভুরু নাচিয়ে বলল, আমি বলব না।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, দেখতেই পাচ্ছ নিনীষ স্কেলে বড় ত্রুটি আছে, আটমাত্রার মানুষের যেটুকু বুদ্ধিমান হবার কথা আমি সেটুকু বুদ্ধিমান নই। তাছাড়া আমি মাত্র অল্প কিছুদিন হল শীতল ঘর থেকে বের হয়েছি, সব কিছু এখনও ভাল করে জানিও না।
জানবে, এই মহাকাশযানে সবচেয়ে সহজলভ্য জিনিস হচ্ছে তথ্য। আর যদি এক ধাক্কায় পুরো তথ্য জেনে নিতে চাও তাহলে মুক্ত এলাকা থেকে ঘুরে এস।
মুক্ত এলাকা? আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, সেটা কী?
তুমি এখনো মুক্ত এলাকার নাম শোন নি?
না-আমি এসেছি মাত্র অল্প কিছুদিন হল, কেউ আমাকে বলে নি।
ইচ্ছে করেই বলে নি, তুমি যদি দল ছেড়ে মুক্ত এলাকায় চলে যাও সেজন্যে।
মুক্ত এলাকায় কী রয়েছে?
মহাকাশযান নিয়ে যখন কামড়াকামড়ি শুরু হয়েছে, ভাগ-বাটোয়ারা যুদ্ধ-বিগ্রহ চলছে তখন সবাই মিলে একটা জায়গা ঠিক করেছে যার নাম দেয়া হয়েছে মুক্ত এলাকা। ঠিক করা হয়েছে এই এলাকাটা স্বাধীন। কেউ সেটা নিতে পারবে না।
কিন্তু যার জোর বেশি সে দখল করে নিচ্ছে না কেন?
নিজেদের স্বার্থেই নিচ্ছে না। জায়গাটা থাকায় সবার জন্যে লাভ। শুনেছি রমরমা বাজার। সব কিছু পাওয়া যায়! সুন্দরী মেয়েমানুষ, সুদর্শন পুরুষ মানুষ থেকে শুরু করে পারমাণবিক অস্ত্র, আধুনিক বাই ভার্বাল–কী নেই!
এসব কিনতে পাওয়া যায়?
হ্যাঁ।
কী দিয়ে বেচা-কেনা হয়?
প্রথম প্রথম নাকি শুধু জিনিসপত্র বিনিময় হতো। এক মাত্রার বিস্ফোরক দিয়ে একটা বাই-ভার্বাল নিয়ে গেলে, একটা সুন্দরী মেয়েমানুষ দিয়ে ভাল একটা অস্ত্র। দুইটা চতুর্থ জেনারেশন রবোট দিয়ে একটা পঞ্চম জেনারেশানের রবোটএইরকম। কিছুদিন হল একটা ব্যাংক খুলেছে, এখন ইলেকট্রনিক কারেন্সি ব্যবহার হচ্ছে। ব্যাংকে মূল্যবান কিছু জমা দিলে তুমি কারেন্সি পেয়ে যাবে। সেই কারেন্সি দিয়ে অন্য কিছু কিনবে। এখানে সেটাকে ইউনিট বলে।
আমি হতবাক হয়ে বুড়ো লীয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থে এ ধরনের কথাবার্তা লেখা আছে, যেখানে মানুষের লোভকে ব্যবহার করে এরকম সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠত। তাই বলে এই মহাকাশযানে?
বুড়ো লী খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি ঘুরে আস, জায়গাটা তোমার ভাল লাগবে।
ভাল লাগবে? হ্যাঁ। বিচিত্র জিনিস মানুষের ভাল লাগে।
আমি ছোট ভাসমান গাড়িটি নিচে নামিয়ে আনলাম, কোথায় যেতে হবে কীভাবে যেতে হবে প্রোগ্রাম করা ছিল আমার নিজে থেকে কিছু করতে হয় নি। গাড়িটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে আমি দরজা খুলে বাইরে আসতেই হঠাৎ উদ্দাম এক ধরনের সংগীতের শব্দ শুনতে পেলাম। কাছাকাছি কোথাও এক ধরনের আনন্দোৎসব হচ্ছে বলে মনে হয়।
আরো কিছুদূর হেঁটে যেতেই আমি অসংখ্য মানুষকে দেখতে পেলাম, বিশাল এলাকায় ছোট বড় নানা আকারের ঘর, ভেতরে বাইরে উজ্জ্বল আলো, তার মাঝে তারা ব্যস্ত সমস্ত ভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমি সদ্য মিয়ারার আস্তানা থেকে পালিয়ে এসেছি, ভেতরে ভেতরে একধরনের ভয় রয়েছে কেউ বুঝি দেখে আমাকে চিনে ফেলবে, কিন্তু সেরকম কিছুই হল না। মানুষের ভিড়ে আমি মিশে গেলাম–কেউ দ্বিতীয়বার আমার দিকে ঘুরে তাকাল না।
মহাকাশযানের এই মুক্তাঞ্চলে নানা ধরনের দোকান-পাট গড়ে উঠেছে। তার একটা বড় অংশ অন্ত্রের দোকান। বিশাল অতিকায় এবং বিচিত্র ধরনের অস্ত্র, বিভিন্ন মানুষজন শক্ত মুখে সেগুলি পরীক্ষা করে দেখছে। দেখে মনে হল মহাকাশযানে অস্ত্র তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। সব অস্ত্রই যে ভয়ংকর তা নয়, কিছু অস্ত্র প্রায় হাস্যকর। একটি অস্ত্র দাবি করেছে ক্রোধকে ব্যবহার করে সেটি দিয়ে গুলি করা যায়। কপালের মাঝে লাগানো একটি নল, মাথায় একধরনের হেলমেট, ক্রোধের অনুভূতিকে অনুভব করে সেটা নলটি থেকে একটা বিস্ফোরক ছুড়ে দেয়!
অস্ত্রের দোকানপাটের কাছেই রয়েছে গাড়ি, ভাসমান যান এবং-বাই ভার্বালের দোকান পাট। আমি একটু অবাক হয়ে দেখলাম যানবাহনের ব্যাপারটাতে একটা নূতন মাত্রা যোগ হয়েছে, সেগুলি এখন শুধু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্যে তৈরি হয় নি। তার মাঝে নানা ধরনের অস্ত্র জুড়ে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় সেগুলিতে এখন অহেতুক সৌন্দর্য্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উজ্জল রং অপ্রয়োজনীয় নক্সা এবং নানাধরণের বিলাস সামগ্রী এগুলিতে গাদাগাদি করে রাখা আছে। এই মহাকাশযানটিতে যে একটি বিচিত্র ধরনের কালচার গড়ে উঠছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। যানবাহনের দোকানে মানুষের ভিড় খুব বেশি নয়এগুলি মূল্যবান এবং মনে হয় সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।
এর পাশেই সুন্দরী পুরুষ এবং রমণী বেচাকেনার জায়গা। স্বল্প কাপড় পরে তারা মোহনীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, এবং তাদের ঘিরে মানুষের ভিড়, আমি ভিড় ঠেলে একটু এগিয়ে গেলাম, একজন কমবয়সী সুন্দরী মেয়েকে কেনার জন্যে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ দরদাম করছে, যে কারণেই হোক মূল্য নিয়ে তর্কবিতর্ক হচ্ছে। শুনতে পেলাম মধ্যবয়স্ক মানুষটি গলায় বিস্ময় ঢেলে বলল, কী বললে? দশ হাজার ইউনিট? এন্ড্রোমিডার কসম! এই দামে আমি একটা এটমিক ব্লাস্টার পেয়ে যাব!