আমিও করি নি। একটা তথ্য কেন্দ্রে একবার দেখেছিলাম প্রাচীনকালে নাকি শিশুদের জন্ম হত মেয়েদের গর্ভে, সন্তান জন্ম দিতে হত অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে তারপর মেয়েটিকে সেই শিশুকে বুকের দুধ খাইয়ে বুকে ধরে বড় করতে হতো।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমিও শুনেছি কথাটা–জন্মের পুরো ব্যাপারটা ছিল অবৈজ্ঞানিক। অনিশ্চয়তা আর বিপদ দিয়ে ভরা
লেন আমাকে বাধা দিয়ে বলল, গত কয়েকদিন এই বাচ্চাগুলিকে দেখে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ব্যাপারটা হয়তো খারাপ ছিল না। বাচ্চাগুলি আমার কাছাকাছি রয়েছে তাতেই তাদের জন্যে আমার বুকে কী ভয়ানক ভালবাসা জন্মে গেছে। একটি মেয়ে যখন বাচ্চাটিকে দীর্ঘ সময় নিজের গর্ভে ধরে রাখবে তখন তার জন্যে কী রকম ভালবাসা হবে তুমি চিন্তা করতে পার?
আমি ব্যাপারটা চিন্তা করে একটু শিউরে উঠে বললাম, আমার নূতন পদ্ধতিটাই পছন্দ–যেখানে শিশুর জন্ম হয় ল্যাবরেটরিতে, জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারদের তত্ত্বাবধানে। নিখুঁত সুস্থ সবল বুদ্ধিমান একটা শিশু পাওয়া যায়।
লেন একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যাই হোক, এসব নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। এখন নিজেদের কথা বলি, আমাদের এখন কী হবে?
আমি মুখে এক ধরনের হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বললাম, মনে আছে তুমি মানুষের নেতৃত্ব নিয়ে মারামারি ব্যাপারটি দেখতে চাইছিলে! এখাননা কী দেখতে চাও?
লেন মাথা নাড়ল, বলল, না। চাই না। যথেষ্ট দেখেছি। কিন্তু এখন কী হবে আমাদের? আমরা কী করব?
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, বুড়ো লীয়ের এই আস্তানাটা নিরাপদ। আমাদের আপাতত এখানেই থাকতে হবে।
লেন চারিদিকে তাকিয়ে বলল, এই ছোট জায়গায়? মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থায় ভেসে ভেসে? কয়েকদিনের মাঝেই শরীরে মাংশপেশী দুর্বল হয়ে যাবে তখন আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারব না–
মাংশপেশী ঠিক রাখার নিয়মকানুন আছে। তা ছাড়া চেষ্টা করে দেখা যাবে একটা শীতল ক্যাপসুল আনা যায় কিনা, তাহলে এখানেই একটা ছোট শীতল ঘর তৈরি করে ঘুমিয়ে পড়া যায়। পৃথিবীতে পৌঁছে ঘুম থেকে ওঠা যাবে।
সেটা কী করতে পারবে?
বুড়ো লী খুব কাজের মানুষ, দেখলে না আমাদের কী চমৎকার ভাবে উদ্ধার করে নিয়ে এল, কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
লেন আমার হাত স্পর্শ করে বলল, আমি আর পারছি না কিহা।
আমার বুকের ভিতরে হঠাৎ লেনের জন্যে এক ধরনের বিচিত্র অনুভূতির জন্ম হয়, তাকে নিজের বুকের কাছে টেনে এনে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু নরম কোমল ভালবাসার কথা বলতে ইচ্ছে করে, আমি অবশ্যি কিছুই করলাম না। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললাম, তোমাকে আরো শক্ত হতে হবে লেন। আরো অনেক শক্ত হতে হবে।
আমি যখন বুড়ো লীয়ের ঘরে গেলাম তখনো সে ঘরের মাঝামাঝি একটা। পিলার বাঁধা অবস্থায় ঝিমুচ্ছিল। তাকে ঘিরে নানারকম যন্ত্রপাতি জঞ্জাল ভেসে বেড়াচ্ছে। এক কোণােয় একটি ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক স্ক্রিন, সেখানে মহাকাশযানের কিছু খবরাখবর প্রচারিত হচ্ছে। বুড়ো লী সেগুলি দেখছে কিনা ঠিক বোঝা গেল না। আমি কাছাকাছি পৌঁছাতেই সে চোখ খুলে তাকিয়ে বলল, কিছু একটা হবে এখন!
আমি থতমত খেয়ে বললাম, কিসের কী হবে?
জানি না। কিন্তু কিছু একটা হবে। আমি ত্রিশ বছর থেকে শুধু দেখছি–কখন কী হয় সেটা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা আছে। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে এখন কিছু একটা হবে।
আমি কিছু বললাম না, কাছাকাছি ধরে রাখার কিছু নেই, একটু পরে পরে ওলটপালট খেয়ে যাচ্ছিলাম, এরকম অবস্থায় কারো সাথে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলা যায় না।
বুড়ো লী আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কিছু খেয়েছ?
আমি মাথা নাড়লাম, না। শীতল ঘর থেকে বের হয়েছি, তাই কয়েকদিন না খেয়েই চলে যাবে।
আমার কাছে সত্যিকারের খাবার নেই। আঙ্গুরের রস দিয়ে তিতির পাখির ঝলসানো রোস্ট আর যবের রুটি যদি চাও তাহলে পাবে না। তবে আমার কাছে কিছু খাবারের ক্যাপসুল আছে, একটা দিয়ে সপ্তাহ দুয়েক চলে যায়। বাথরুমে যেতে হয় না–যা সুবিধে! বুড়ো লী হঠাৎ খিক খিক করে হাসতে থাকে।
আমি কিছু বললাম না। সে পকেট থেকে কয়েকটা খাবারের ক্যাপসুল বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, নাও সাথে রাখ।
আমি ক্যাপসুলগুলি পকেটে রাখতে রাখতে বললাম তোমার এই এলাকাটা কি নিরাপদ?
এই মহাকাশযানে কোনো এলাকা আর নিরাপদ নয়। তবে তুমি যদি জানতে চাইছ কেউ তোমাদের ধরে নিতে আসবে কিনা তাহলে ভয় পাবার কিছু নেই। বুড়ো লীকে কেউ ঘাটায় না।
কেন? তুমি শক্তিকেন্দ্রের কাছে বলে?
ঠিকই ধরেছ। শক্তি কেন্দ্রের চারিদিকে ঘিরে বিস্ফোরক লাগানো আছে আমি শুধু মুখে উচ্চারণ করব সাথে সাথে পুরো শক্তিকেন্দ্র উড়ে যাবে। মহাকাশযান হয়ে যাবে মহাকাশ কবরখানা–হা হা হা হা! বুড়ো লী খুব একটা মজার কথা বলেছে
এরকম ভাব করে হাসতে লাগল।
তুমি কেমন করে এই জায়গাটা দখল করলে?
বুড়ো লী তার মাথায় ঠোকা দিয়ে বলল, মাথা খাটিয়ে। যখন দেখতে পেলাম মহাকাশযানে ভাগ-বাটোয়ারা শুরু হয়ে গেছে তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম কয়দিনের মাঝেই কামড়া-কামড়ি শুরু হয়ে যাবে, এই বেলা নিরাপদ একটা জায়গায় আরাম করে আস্তানা না গেড়ে নিলে আর হবে না।
সবচেয়ে ভাল জায়গাতেই আস্তানা করেছ!
বুড়ো লী খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, না, সবচেয়ে ভাল জায়গাটা আমি পাই নি।