আমি দরজা খুলতে খুলতে বললাম, আমাদেরকে বাঁচানোর জন্যে ধন্যবাদ। কেন বাঁচিয়েছ জানলে আরো স্বস্তি বোধ করতাম।
কণ্ঠস্বরটি হালকা গলায় বলল, বলতে পার অল্প খানিকটা সমবেদনা এবং অনেকখানি কৌতূহল! তোমাদের স্কাউটশিপে যারা আছে তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারা সেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ? তুমি নাকি অন্য কেউ?
আমি হেসে বললাম, না আমি নই। তারা আসছে।
আমার কথা শেষ হবার আগেই শিশুগুলি উচ্চঃস্বরে হাসতে হাসতে এবং আনন্দে গড়াগড়ি খেয়ে ভাসতে ভাসতে স্কাউটশিপের দরজা দিয়ে বের হয়ে আসতে থাকে। এক মুহূর্ত পর আমি আবার কণ্ঠস্বরটি শুনতে পেলাম সেটা শিস দেবার মতো শব্দ করে বলল, এরাই তাহলে সেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ?
আমি মাধ্যকর্ষণহীন অবস্থায় অভ্যস্ত নই। শুধু মনে হতে থাকে যে কোথাও পড়ে যাচ্ছি, কোনোভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে করতে বললাম, হ্যাঁ, এরাই সেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। কিন্তু তুমি কে?
আমি?
হ্যাঁ তুমি।
আমি সেরকম কেউ নই। একটু পরেই দেখবে। তোমরা ডকিং স্টেশন পার হয়ে ভিতরে চলে এসো।
স্কাউটশিপ থেকে নেমে শিশুগুলি একেকজন একেকদিকে ভেসে চলে যেতে শুরু করে এবং তাদের সবাইকে আবার ধরে আনতে লেন এবং আমার বিশেষ বেগ পেতে হল। শিশুদের সম্পূর্ণ বিনা কারণে আনন্দ পাওয়ার এবং সেই অকারণ আনন্দ অন্যদের মাঝে সঞ্চালিত করে দেয়ার একটা বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। দেখা গেল আমরাও শিশুগুলির পিছনে ছুটতে ছুটতে হাসাহাসি করছি।
পাশের ঘরটি মাঝারি আকারের, মাধ্যকর্ষণহীন যেকোনো জায়গার মতো এখানেও অসংখ্য যন্ত্রপাতি এবং দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিস ভেসে বেড়াচ্ছে। ঘরটিতে অনুজ্জ্বল একটা আলো জ্বলছে এবং ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় একটা পিলারে একজন মানুষ উল্টো করে বাধা। মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থায় উল্টো সোজা বলে কিছু নেই কিন্তু তবুও দৃশ্যটি দেখে আমরা চমকে উঠলাম। মানুষটি বৃদ্ধ, সত্যি কথা বলতে কী আমি এর আগে কোনো বৃদ্ধ মানুষ দেখি নি। নূতন প্রযুক্তিতে মানুষের চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ পড়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এই মানুষটির চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ ভয়াবহ ভাবে এসে স্থান নিয়েছে। তার মাথায় ধবধবে সাদা চুল, মুখে সাদা লম্বা দাড়ি-গোঁফ। তার মুখের চামড়া কুঞ্চিত, চোখ কোটরাগত। সেই কোটরাগত চোখ অঙ্গারে মতো জ্বলছে। মানুষটি আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি লী। সবাই ডাকে বুড়ো-লী। আমি বুড়ো-লীয়ের আস্তানায় তোমাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমি দুঃখিত তোমাদের কাছে আসতে পারছি না। বয়স হয়ে গিয়েছে, শরীরে জোর নেই, নিজেকে তাই পিলারের সাথা বেঁধে রেখেছি আজ প্রায় তিরিশ বছর।
লেন আর্ত শব্দ করে বলল, তিরিশ বছর?
হ্যাঁ। মহাকাশযানে যখন হানাহানি শুরু হল, তোমরা তখন নিশ্চয়ই শীতল ঘরে ঘুমিয়ে, আমাকে কিছু খুনোখুনির দায়িত্ব দিয়েছিল। করতে রাজি হই নি বলে খুব যন্ত্রণা গিয়েছে। পালিয়ে শেষ পর্যন্ত বুড়ো লী হঠাৎ কথা থামিয়ে বলল, তোমাদের কেমন জানি বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। তোমরা বিশ্রাম নিয়ে এসো। দেখতেই পাচ্ছ এটা নিয়মিত মানুষের আস্তানা নয় তোমাদের নিশ্চয়ই কষ্ট হবে। তবে জায়গাটা নিরাপদ। একেবারে শক্তিকেন্দ্রে আস্তানা করেছি তো কারো ধারে কাছে আসার ক্ষমতা নেই। আমার এখানে মানুষজন নেই, কাজ চালানোর মতো কিছু রবোট তৈরি করেছি, তারাই সাহায্য করে।
বুড়ো লী মুখ ঘুরিয়ে ডাকল, কিশি–
ঘরের মাঝে ইতস্তত যেসব যন্ত্রপাতি ঘুরে বেড়াচ্ছিল তাদের মাঝে বড় ধরনের একটি যন্ত্র হঠাৎ যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। দেখতে দেখতে দুপাশে দুটি যান্ত্রিক হাত এবং একটি বিদঘুটে মাথা গজিয়ে ওঠে। পিছনে ছোট একটা জেট ইঞ্জিন চালু হয়ে যায় এবং সেটি ভাসতে ভাসতে বুড়ো-লীয়ের দিকে এগিয়ে আসে।
বুড়ো লী রবোটটির দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে অতিথি এসেছে। তুমি তাদের নিয়ে যাও। বিশ্রাম এবং খাবারের ব্যবস্থা কর।
রবোর্টটি কোনো কথা না বলে এগিয়ে যেতে থাকে। আমি এবং লেন কোনোভাবে শিশুগুলিকে ধরে বেঁধে তার পিছু পিছু যেতে থাকি। আসলে বুঝতে পারি নি, আমি সত্যিই অসম্ভব ক্লান্ত।
৫. আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল
আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলাম আমি ছোট ঘরটার মাঝামাঝি ভেসে আছি। আমাকে ঘিরে ইতস্ততভাবে আটজন শিশু ঘুমন্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিচে মেঝের কাছাকাছি একটা গ্রিলকে ধরে লেন আধশোয়া হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি নিচু গলায় বললাম, লেন, তুমি ঘুমাও নি?
ঘুমিয়েছিলাম, কিন্তু ঘুম ভেঙে গেল। মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থায় ভেসে ভেসে ঘুমিয়ে আমার অভ্যাস নেই। তা ছাড়া মনে হয় রিটালিন-৪০০ এখনো শরীরে রয়ে গেছে।
।আমি ঘরের মাঝে থেকে ভেসে ভেসে নিচে আসার চেষ্টা করতে করতে বললাম, আমিও ঘুমুতে পারছি না। কিন্তু বাচ্চাগুলি দেখেছ কী আরামে ঘুমিয়ে গেছে।
লেনের বিষণ্ণ মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে খানিকক্ষণ ঘুমন্ত বাচ্চাগুলির দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাসতে ভাসতে বাচ্চাগুলি যখন একজন আরেকজনের কাছে চলে আসে তখন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। আবার ঘুমের মাঝেই একজন আরেকজনকে ছেড়ে দেয়, দুজন দুদিকে ভেসে চলে যায়। লেন ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এই সৃষ্টিগজতে শিশু থেকে সুন্দর কিছু নেই।
তুমি মনে হয় ঠিকই বলেছ। আমি কিন্তু আগে কখনো কোনো শিশুকে ভাল করে লক্ষ করি নি।