আমি কোনো উত্তর না দিয়ে স্কাউটশিপের গতিবেগ আরো বাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকি। কণ্ঠস্বরটি আবার কঠোর গলায় বলল, এই মুহূর্তে নিচে নেমে আস–এই মুহূর্তে–
আমি স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করার চেষ্টা করতে করতে মহাকাশযানের উপর দিয়ে ছুটে যেতে থাকি, উপরে স্বচ্ছ জানালাগুলি দেখা যাচ্ছে, এর কোনো একটিতে আমার আঘাত করতে হবে, আমি সাহস সঞ্চয় করতে থাকি, একটি স্কাউটশিপ নিয়ে প্রচণ্ড বেগে সোজাসুজি মহাকাশেনের দেয়ালে আঘাত করার মতো সাহস সম্ভবত আমার নেই।
আমি মহাকাশযানের উপরে দিয়ে ছুটে যেতে যেতে নিচে তাকালাম, অনেক নিচে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি–যানবাহন দেখা যাচ্ছে, আমাকে ঘিরে নানা ধরনের আলোর বিচ্ছুরণ হতে থাকে। সম্ভবত অনেকেই আমাকে লক্ষ করছে। আমি শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণটুকু ধরে রাখি। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, আমার নিঃশ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে ওঠে, আমি স্কাউটশিপটাকে সোজাসুজি ওপরের দিকে ঘুরিয়ে আনতে শুরু করতেই হঠাৎ ভিতরে একটা নূতন কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। সেটি চাপা গলায় বলল, স্কাউটশিপের আরোহী, আমি একটি গোপন চ্যানেলে তোমার সাথে যোগাযোগ করছি, আমার কথা তুমি ছাড়া আর কেউ শুনছে না। তুমি আমার কথার কোনো উত্তর দেবে না।
কণ্ঠস্বরটি এক মুহূর্ত থেমে থেকে বলল, মাহাকাশযানের দেয়ালে আঘাত করে বের হয়ে যাবার পরিকল্পনাটির সাফল্যের সম্ভাবনা দশমিক দুই তিন। তুমি যদি চাও তোমাকে আমি অন্যভাবে রক্ষা করতে পারি। তার জন্যে স্কাউটশীপের পুরো নিয়ন্ত্রন আমাকে দিতে হবে। আমার কোড নম্বর সাত চার তিন দুই।
আমি অবাক হয়ে বিচিত্র কণ্ঠস্বরটি শুনছিলাম, ব্যাপারটি একটি ষড়যন্ত্র কী না যাচাই করার কোনো উপায় নেই। কণ্ঠস্বরটি আবার বলল, আমি দেখতে পাচ্ছি তোমাকে কয়েকটি বাই-ভার্বাল ধাওয়া করছে, তোমাকে গুলি করার সুযোগ পেয়েও গুলি করছে না, যার অর্থ এই স্কাউটশিপে তোমরা যারা আছ তারা সম্ভবত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তোমাদের ট্রাকিওশান নেই যার অর্থ তোমরা পালিয়ে যাচ্ছ। মহাকাশযানের প্রচলিত পদ্ধতি থেকে যারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাদের জন্যে আমার সমবেদনা রয়েছে, সেই জন্যে আমি তোমাদের সাহায্য করতে চাইছি। তুমি যদি আমার সাহায্য গ্রহণ করতে চাও কোড়-নম্বর সাত চার তিন দুইয়ে স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণটুকু হস্তান্তর কর। আমাদের হাতে সময় খুব কম।
আমি লেনের দিকে তাকালাম, সে ফ্যাকাশে মুখে বসে আছে। তার দুই পাশে বাচ্চাগুলি বসে আছে, তাদের চোখ মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। স্কাউটশিপের পুরো ব্যাপারটুকু তারা অত্যন্ত মজার কোনো খেলা হিসেবে ধরে নিয়েছে। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে কন্ট্রোল প্যানেলের একপাশে কোড়-নম্বরটি প্রবেশ করিয়ে স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণটুকু হস্তান্তর করে দিলাম।
সাথে সাথে স্কাউটশিপটা বিদ্যুৎবেগে তার দিক পরিবর্তন করে উল্টোদিকে ছুটতে শুরু করে। খানিকদূর গিয়ে হঠাৎ প্রচণ্ড গতিতে ঘুরে গিয়ে আবার সোজাসুজি উপরের দিকে উঠতে শুরু করে। আমি উপরে তাকিয়ে হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম আমাদেরকে কোথাও নেয়া হচ্ছে।
মহাকাশযানটি একটি বিশাল চাকার মতো, এটি তৈরি করা হয়েছে মহাকাশে, দীর্ঘ সময় নিয়ে এর বিভিন্ন অংশ তৈরি করে এনে একটু একটু করে জুড়ে দেয়া হয়েছে। চাকার মতো অংশটির ঠিক মাঝখানে রয়েছে মহাকাশযানের শক্তিশালী ইঞ্জিন। ইঞ্জিনগুলি মহাকাশযানের সাথে ছয়টি রড দিয়ে লাগানো। রডগুলি ফাপা এবং এর ভেতর দিয়ে অনায়াসে কয়েকটা স্কাউটশিপ ঢুকে যেতে পারে। এই মুহূর্তে আমাদের স্কাউটশিপটা এরকম একটি ফাঁপা টিউবের মাঝে দিয়ে ভিতরে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। মহাকাশযানের এই অঞ্চলটি মানুষ বাসের অনুপোযোগী। এখানে বাতাস নেই, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই, মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে রক্ষা পাবার কোনো উপায় নেই। মহাকাশযানে কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণ বল তৈরি করার জন্যে এটি তার অক্ষের উপর ঘুরছে। সেন্ট্রিফিউগাল বল থেকে তৈরি হয়েছে মাধ্যকর্ষণের অনুভূতি। কেন্দ্রে সেই মাধ্যকর্ষন বলও নেই। এখানে এসে কেউ আশ্রয় নিতে পারে সেটি আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখতে পেলাম সত্যি সত্যি সেখানে আশ্রয় নেবার জন্যে আমরা স্কাউটশীপে ছুটে যাচ্ছি।
মহাকাশযানটি বিশাল এবং আমরা দীর্ঘ সময় এই অন্ধকার গহ্বর দিয়ে ছুটে যেতে থাকলাম। আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমরা জানি না আমার কথা বলা নিষেধ বলে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছিলাম না। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইলাম এবং হঠাৎ মনিটরে একটা অনুজ্জ্বল আলো দেখা গেল। আলোটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে এবং আমি বুঝতে পারলাম সেটি একটি ডকিং স্টেশন। স্কাউটশিপটার গতিবেগ কমে আসে এবং ডকিং স্টেশনের নির্দিষ্ট জায়গায় সেটি নিজেকে শক্ত করে লাগিয়ে নিয়ে স্থির হয়ে দাড়াল। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না, ঠিক তখন আগের কণ্ঠস্বরটি শুনতে পেলাম। সেটি বলল, তোমরা স্কাউটশিপটা থেকে বের হয়ে আসতে পার। এখানে মাধ্যাকর্ষণ নেই, কাজেই তোমাদের ভেসে বের হয়ে আসতে হবে, ব্যাপারটিতে অভ্যস্ত হতে হয়তো একটু সময় নেবে।
আমি কথা বলতে পারব কী না বুঝতে পারছিলাম না, নিঃশব্দে চেয়ার থেকে নিজেকে মুক্ত করতেই ভেসে উপরে উঠে এলাম, তাল সামলে কোনোমতে দরজার কাছাকাছি এসে হ্যান্ডেলটা ধরে রাখলাম। কণ্ঠস্বরটি আবার বলল, তোমরা এখন নিরাপদ দূরত্বে চলে এসেছ, ইচ্ছে করলে কথা বলতে পার।