সাথে সাথে স্ক্রিনটি অন্ধকার হয়ে আসে। আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম। আমার বুকের ভিতরে গভীর বিষণ্ণতা এসে ভর করতে থাকে।
এরকম সময় আমার মাথায় কে যেন স্পর্শ করে নিচু গলায় ডাকল, কিহা–
আমি চোখ খুলে ঘুরে তাকালাম। লেন বিবর্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে, আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে লেন?
তোমার সাথে আমার কথা বলা প্রয়োজন কিহা। খুব জরুরি।
বল।
তুমি তো জান মিয়ারা আমাকে খাদ্য সরবরাহের একটা সমস্যা সামাধান করতে দিয়েছে–
হ্যাঁ জানি।
আমি সেটা নিয়ে কাজ করছিলাম, কোনো মানুষের জন্যে কতটুকু খাবার রয়েছে তার একটা তথ্যভাণ্ডার রয়েছে। আমি শিশুগুলির ফাইল খুলে দেখেছি। মূলতথ্যকেন্দ্র থেকে তাদের জন্যে মাত্র চার দিনের খাবার রাখা হয়েছে।
আমি চমকে উঠে বললাম, কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ। এই শিশুগুলিকে শীতল ঘর থেকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ে হত্যা করার জন্যে।
সত্যি?
হ্যাঁ।
কেন?
আমি জানি না।
মিয়ারা কী জানে?
আমি বলতে পারবো না।
আমি ইতস্ততঃ করে বললাম, আমার মনে হয় সে জানে।
কেন বলছ সে জানে?
আমি একটু আগে দেখছিলাম, সে মহাকাশযানের অন্য এলাকার মানুষদের সাথে কথা বলছে। সে শিশুগুলিকে বিক্রি করে দিচ্ছে। সে নিশ্চয়ই জানে আর চারদিন পর শিশুগুলির কোনো মূল্য নেই।
লেন আমার দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে বলল, কিহা!
কী হয়েছে লেন?
আমি শিশুগুলির সাথে সময় কাটিয়েছি, তাদের নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি। এরা একেবারে সাধারণ শিশু–একেবারে সাধারণ। এদের অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা নেই, কৃত্রিম অঙ্গপ্রতঙ্গ নেই বিশেষ জিনেটিক কোড নেই। এদের রবোট ফার্মে বড় করা হয়েছে, এরা কথা জানে না কেউ ওদের কথা শেখায় নি। এরা কখনো মানুষ দেখে নি, ওরা কখনো মানুষের ভালবাসা পায় নি, আমি ভেবেছিলাম তাই ওরা বুঝি ভালবাসা বুঝে না। কিন্তু–
কিন্তু কী?
বাচ্চাগুলি ভালবাসা বুঝে। আমি–আমি–লেন কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়। তার চোখ দুটিতে হঠাৎ পানি জমে ওঠে। আমি অবাক হয়ে লেনের দিকে তাকিয়ে রইলাম, শেষবার কবে আমি সত্যিকার মানুষকে কাঁদতে দেখেছি মনে করতে পারলাম না।
লেন হঠাৎ এগিয়ে এসে আমাকে দুই হাতে ধরে বলল, কিহা
আমি লেনের দিকে তাকালাম, হাসার চেষ্টা করে বললাম, লেন, এই ঘরে এই মুহূর্তে আমাদের দিকে অসংখ্য যান্ত্রিক চোখ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অসংখ্য সংবেদনশীল কান আমাদের কথা শুনছে। তোমার কিছু বলার প্রয়োজন নেই লেন। আমি জানি তুমি কী বলতে চাইছ।
তুমি জান?
হ্যাঁ, আমি জানি।
সামনের মনিটর থেকে হঠাৎ রীয়ের কথা ভেসে এল, সে বলল, বিস্ময়কর। যখন আমি প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাই যে আমি মানুষকে বুঝতে পারি, ঠিক তখন তোমরা এমন একটা কাজ কর যে আমি আবার বিভ্রান্ত হয়ে যাই।
কেন রী, কী হয়েছে?
লেন কথাটি বলার আগে তুমি কেমন করে বুঝতে পারলে সে কী বলবে?
আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, চেষ্টা কর, তুমিও পারবে।
সে কী শিশুগুলির জীবন বাঁচানোর কথা বলছে? কিন্তু সেটা তো হতে পারে না, সেটা তো অসম্ভব। শুধু যে অসম্ভব তা নয়, এর সাথে আমাদের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। আমাদের অস্তিত্ত্বের প্রশ্ন জড়িত আছে। তাহলে কী হতে পারে—
আমি লম্বা পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। হ্যাঁ, আমাকে একটা অসম্ভব কাজ করতে হবে। মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্রের বিশেষ ক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করে আটটি অত্যন্ত সাধারণ শিশুর প্রাণ বাঁচাতে হবে। এর সাথে হয়তো আমাদের নিরাপত্তার এবং অস্তিত্ত্বের প্রশ্ন জড়িত আছে কিন্তু আমার কিছু করার নেই।
লম্বা করিডোরের আবছা অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে আমি আবিষ্কার করলাম আমার বুকের ভিতরের গুমোট বিতাটি কেটে গেছে, সেখানে এসে ভর করেছে বিচিত্র এক ধরনের ক্রোধ।
আমি মিয়ারার আস্তানায় করিডোর ধরে হাঁটতে থাকি, আমার পিছু পিছু একটু দূরত্ব রেখে ত্রিনিও হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে আমি পুরো সমস্যাটি চিন্তা করে দেখি–স্বাভাবিক অবস্থায় মাহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্রের বিশেষ আদেশ উপেক্ষা করে কিছু একটা করা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু মহাকাশযানে এখন স্বাভাবিক অবস্থা নেই। সেটাই হচ্ছে আমাদের একমাত্র শক্তি।’
আমাদের সবার জন্যে এখন সবচেয়ে সহজে পালিয়ে যাবার একটি মাত্র উপায়। আমাদের শরীরে যে ট্রাকিওশানটি দিয়ে মহাকাশযানের মূল এবং আনুষাঙ্গিক তথ্যকেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ রাখা হয় সেই ট্রাকিওশানটি বের করে সেখানে অন্য একটি ট্রাকিওশান ঢুকিয়ে দেওয়া। সেই ট্রাকিওশানে থাকবে ভিন্ন একজনের পরিচয় যার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এই পরিচয় নিয়ে আমরা শীতল ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে যাব। আগামী শতাব্দী পর্যন্ত কেউ আর আমাদের খুঁজে পাবে না। ব্যাপারটি অনেকটা আত্মহত্যা করার মতো, মহাকাশযানের বিশাল তথ্যকেন্দ্র থেকে নিজেকে অদৃশ্য করে দেয়া। ভবিষ্যতে কোনো এক সময়ে যদি এই মহাকাশযান পৃথিবীতে পৌঁছায়, সবকিছু আবার নূতন করে শুরু হয় তখন হয়তো সত্যিকারের পরিচয় নিয়ে জীবন শুরু করতে পারব। হয়তো পারব না। কিন্তু সেটা নিয়ে এখন ভেবে লাভ নেই।
আমি হাঁটতে হাঁটতে নিচে নেমে এলাম, আটটি শিশুর জন্যে এখানে আলাদা একটা ঘর তৈরি করা হয়েছে। ঘরটিতে উঁকি দিয়ে দেখি লেন ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় হাটু মুড়ে বসে আছে, তাকে ঘিরে আটটি শিশু বসে আছে। শিশুগুলির মুখ আনন্দোজ্জ্বল এবং কিছু একটা নিয়ে সেখানে প্রচণ্ড হৈ-চৈ হচ্ছে। আমাকে দেখে লেন হাসি মুখে বলল, কিহা, দেখ বাচ্চাগুলি কথা শিখে যাচ্ছে!