যোগাযোগ টানেলের সামনে মিয়ারা দাঁড়িয়েছিল। সত্যিকারের মিয়ারা, তার হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি নয়। আমাদের দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এল। আমি তাকে যে স্বল্প সময়ের জন্যে দেখেছি তার মাঝে তাকে একবারও হাসতে দেখি নি। মেয়েটি সত্যিকার অর্থে সুন্দরী নয় কিন্তু হাসিমুখে তাকে হঠাৎ বেশ আকর্ষণীয়া মনে হতে থাকে। মিয়ারা এগিয়ে এসে নরম গলায় বলল, কিহা, তুমি যে ভাবে এই আটজন মানুষকে আমাদের কেন্দ্রে নিয়ে আসছ তার তুলনা হয় না। তোমাকে অভিনন্দন।
আমি কথা না বলে কাঁধ ঝাকালাম। মিয়ারা ঝকঝকে চোখে বলল, মানুষগুলি কে জানার জন্যে আমার আর তর সইছে না। কী মনে হয় তোমার? সর্বোচ্চ ক্ষমতার বিশেষ আদেশে এদের জাগানো হচ্ছে–নিশ্চয়ই এরা অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ।
মিয়ারার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিবর্ণ চেহারার একজন মানুষ বলল, হয়তো এদের বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে দশ!
মিয়ারা শীষ দেয়ার মতো একটি শব্দ করতেই খুট করে গোলাকার একটা দরজা খুলে গেল, ভেতর থেকে এক ধরনের ঠাণ্ডা বাতাস বের হয়ে আসে। প্রায় সাথে সাথেই সেখানে নিবোধ চেহারার একটা রবোটের চেহারা উঁকি দেয়। রবোটটি মাথা নুইয়ে অভিবাদন করার ভঙ্গি করে বলল, আটজন মানুষ এইমাত্র তাদের ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এসেছে।
মিয়ারার পিছু পিছু আমরা ঘরটিতে ঢুকে থমকে দাঁড়ালাম। আমাদের সামনে আটটি ধাতব রংয়ের সিলিণ্ডার, সিলিন্ডারের উপরের ঢাকনা খোলা, ভেতর থেকে সরু সূতার মতো জলীয় বাষ্পের ধারা বের হয়ে আসছে। সিলিন্ডারগুলির সামনে প্রায় জড়াজড়ি করে আটটি নগ্ন শিশু দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে তারা চোখ বড় বড় করে তাকাল, সম্ভবত এরা রবোটের সাহায্যেই বড় হয়েছে, কোনোদিন সত্যিকারের মানুষ দেখে নি। আমাদের দেখে তাদের চোখে মুখে এক ধরনের অবাক বিস্ময় ফুটে ওঠে, যে ধরনের বিস্ময় সম্ভবত শুধুমাত্র শিশুদের মুখেই দেখা যায়।
মিয়ারা কয়েকমুহূর্ত হতচকিতের মতো দাঁড়িয়ে থেকে প্রায় আর্ত চিৎকারের মতো শব্দ করে বলল, হায় ঈশ্বর! এ কী?
বাচ্চাগুলি জড়াজড়ি করে একটু পিছিয়ে গেল, তাদের চোখে মুখে এক ধরনের ভয়ের ছাপ পড়ে, সহজাত প্রবৃত্তি থেকে হঠাৎ করে তারা মনে হয় বুঝতে পেরেছে এখানে তাদের জন্যে কোনো ভালবাসা সঞ্চিত নেই।
৪. আমি একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে
আমি একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে দেয়ালে বিশাল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছি। স্ক্রিনে ছোট একটা হলঘরের ছবি। হলঘরের এক কোণায় মিয়ারা বসে আছে, তার সামনে কুচকুচ কালো একটি টেবিল। টেবিলের চারপাশে আরো পাঁচজন মানুষ। মানুষগুলির দুজন পুরুষ, একজন মহিলা এবং অন্য একটি নবম প্রজাতির ট্রিটন রবোট–যাকে মানুষের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। পঞ্চম মানুষটি পুরুষ কী মহিলা বোঝার উপায় নেই। হলঘরে শুধু মিয়ারাই সত্যি সত্যি শারীরিক ভাবে বসে আছে। অন্যেরা সরাসরি উপস্থিত নেই যতদূর সম্ভব নেটওয়ার্কে এসেছে। এই পাঁচজন। মানুষ মহাকাশযানের বিভিন্ন অংশের নেতৃত্ব দখল করেছে।
ট্রিটন রবোটটি নিচু গলায় বলল, আমার ধারণা আমরা এখানে সময় নষ্ট করছি। আমরা একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করি না। কাজেই এখানে বসে আলোচনা করা অর্থহীন। এখানে কেউ সত্যি কথা বলছে না।
মিয়ারা হাসির মতো শব্দ করে বলল, ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে কৌতুককর যে একটি ট্রিটন রবোট নৈতিকতার কথা বলছে।
রবোটটি মিয়ারার দিকে তাকিয়ে বলল, মিয়ারা, তুমি খুব ভাল করে জান আমি নৈতিকতার কথা বলছি না। এই মহাকাশযানে এক ধরনের সংঘাত হচ্ছে, আমরা সেখানে একজন আরেকজনকে ধ্বংস করে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করার চেষ্টা করছি, সেখানে সম্মিলিত শক্তির কথা বলা অর্থহীন।
হলঘরের দ্বিতীয় মহিলাটি নরম গলায় বলল, কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের সম্মিলিত শক্তির প্রয়োজন। মূল তথ্যকেন্দ্র এখনো বিশাল শক্তি নিজের কাছে রেখেছে, আমাদের প্রথমে সেটা বের করে আনতে হবে, শুধুমাত্র তাহলেই আমরা তার জন্যে হানাহানি শুরু করতে পারি।
মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি-গোঁফের জংগল এরকম মানুষটি তার গাল ঘষতে ঘষতে বলল, ভালই বলেছ তুমি। সবাই মিলে আক্রমণ করে খানিকটা সম্পদ কেড়ে নিয়ে নিজেরা মারামারি শুরু করি
মিয়ারা এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল, এবারে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, তোমরা জান মূল তথ্যকেন্দ্রের সাথে আমরা এখন বড় ধরনের বোঝাপোড়া করতে পারি। মূল তথ্যকেন্দ্রের বিশেষ আদেশে যে আটজন মানুষকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে আমার কাছে সেই মানুষগুলি রয়েছে।
দেখে বোঝা যায় না পুরুষ না মহিলা সেরকম মানুষটি বলল, আমি জানি তুমি আমাকে সত্যি কথাটি বলবে না, তবু জিজ্ঞেস করছি, এই মানুষগুলির কি বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য রয়েছে?
মিয়ারা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি সেটা বলব না। তবে আমি উচ্চমূল্যে তাদের বিক্রি করতে রাজি আছি।
ঘরের সবাই নড়ে চড়ে বসল এবং তাদের চোখে মুখে হঠাৎ আগ্রহ উত্তেজনা এবং কৌতূহল ফুটে ওঠে। মুখে মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি-গোঁফের মানুষটি একটু সামনে ঝুঁকে এসে বলল, আমি কমপক্ষে দুজন মানুষ কিনতে চাই। তুমি কী মূল্য চাও মিয়ারা?
অষ্টম এবং নবম স্তরের এক চতুর্থাংশ জায়গা। মানুষটির চোখে বিস্ময় ফুটে ওঠে, কী বলছ তুমি?
আমার পক্ষে এই ধূর্ত মানুষ এবং মানুষ জাতীয় রবোটগুলির কথাবার্তা শোনা রীতিমত কষ্টকর হয়ে ওঠে। নিচু গলায় মনিটরটিকে বললাম, আমি আর দেখতে চাই না।