গ্রহটি অসম্ভব শীতল; কিন্তু মাটির নিচে প্রচণ্ড চাপে আটকে থাকা কিছু গলিত আকরিক থাকার কারণে স্থানে স্থানে তাপমাত্রা সহ্য করার পর্যায়ে রয়েছে। চল্লিশ বছর আগে মানুষ যখন এখানে বসতি করেছিল এ রকম একটা উষ্ণ জায়গা বেছে নিয়েছিল।
গ্রহটি সম্পর্কে আরো নানারকম ঘুঁটিনাটি তথ্য রয়েছে, তোমরা ইচ্ছে করলে তথ্যকেন্দ্র থেকে পেতে পার, আমি আর সেগুলো জোর করে শোনাতে চাই না।
রিশানের কথা শেষ হতেই হান বলল, কিন্তু আমি এখনো বুঝতে পারছি না তোমরা গ্রহটা পচে গেছে কেন বলছ?
লি–রয় হাসার মতো এক ধরনের ভঙ্গি করে বলল, পচে যাওয়া মানে কী হান?
হান মাথা চুলকে বলল, রূপক অর্থে বোঝানো হয় নষ্ট হয়ে যাওয়া, ধ্বংস হয়ে যাওয়া। তুমি কি বলতে চাইছ–এখানকার মানুষের যে বসতি রয়েছে তারা নিজেদের সাথে নিজেরা ঝগড়াঝাটি করছে? যুদ্ধ–বিগ্রহ করছে? ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
না, সেরকম কিছু না। পচে যাওয়ার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণুর ভোজসভা। এই গ্রহটিতে সেরকম কিছু ঘটেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
উপস্থিত যারা ছিল তারা সবাই চমকে উঠে বলল, এই গ্রহে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে?
হা। খুব নিম্নস্তরের এককোষী প্রাণ। কিন্তু প্রাণ। মানুষের বসতি হয়েছিল সে কারণেই। পৃথিবীর বাইরে যে প্রাণের বিকাশ হয়েছে সেটা সম্পর্কে তথ্য সগ্রহ করা।
নিডিয়া ইতস্তত করে বলল, আমি জীববিজ্ঞানী নই, প্রাণের রহস্য আমার জানা নেই, কিন্তু এককোষী প্রাণ সম্পর্কে তথ্য সগ্রহ করতে মানুষের চল্লিশ বছর লেগে গেছে?
সেটাই সমস্যা। লি–রয় চিন্তিত মুখে বলল, এই এককোষী প্রাণীদের নিয়ে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে এই গ্রহে। মানুষ সেটা ধরতে পারছে না। অনেক চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে, এখন যে কয়জন মানুষ বেঁচে আছে তারা ফিরে যেতে চাইছে। আমাদের কাছে। বিপদ সঙ্কেত পাঠিয়েছে তাদের উদ্ধার করে ফেরত পাঠানোর জন্যে।
ষুন ঘুরে তাকাল লি–রয়ের দিকে, ব্যস? আর কিছু নয়?
না, আর কিছু নয়।
তাহলে রিশান যেটা ভেবেছিল, আমাদের পাঠানো হচ্ছে ভয়ানক একটা নৃশংস কাজ করার জন্যে সেটা সত্যি নয়?
না, সেরকম কিছু নয়।
রিশানের দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। রিশান মাথা নেড়ে বলল, ষুন, তুমি কি ভাবছ আমার খুব মন খারাপ হয়েছে যে আমার সন্দেহটি মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে?
ষুন তার মঙ্গোলীয় সরু চোখকে আরো সরু করে বলল, না, আমি তা বলছি না।
তাছাড়া এখনো সময় শেষ হয়ে যায় নি। ব্যাপারটা যেরকম সহজ মনে হচ্ছে হয়তো তত সহজ নয়। এককোষী কিছু জীবাণু নিয়ে গবেষণা করতে মানুষের চল্লিশ বছর সময় লাগার কথা নয়। এর মাঝে অন্য কোনো ব্যাপার থাকা এতটুকু বিচিত্র নয়।
ষুন ঘুরে তাকাল রিশানের দিকে। তুমি তাই মনে কর?
রিশানের কী হল কে জানে, শক্ত মুখ করে বলল, হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি। আমি দুঃখিত, কিন্তু সত্যি আমি তাই মনে করি।
০৫. ছোট একটা স্কাউটশিপ
ছোট একটা স্কাউটশিপে করে মহাকাশযান থেকে চার জন গ্রহটিতে নেমে আসছিল। স্কাউটশিপটা একটু বেশি ছোট, একসাথে দুজনের বেশি বসার কথা নয়। তার মাঝে চার জন চাপাচাপি করে বসেছে। দীর্ঘ সময় বায়ুশূন্য মহাকাশে ভেসে ভেসে এসেছে, বিশাল মহাকাশযানের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রিত ভ্রমণে তারা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ করে ছোট একটা স্কাউটশিপে করে গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করামাত্র প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে তাদের পৃথিবীর কথা মনে পড়ে যায়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সাথে এর অবিশ্যি একটি বড় পার্থক্য রয়েছে–এই বায়ুমণ্ডলটি বিষাক্ত। স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণে বসেছে লি–রয়, যদিও পুরো কাজটি করা হচ্ছিল মহাকাশযানের মূল কম্পিউটার থেকে।
স্কাউটশিপটা নিচে নেমে আসতে আসতে হলুদ রঙের একটি মেঘের ভিতর একটি বড় ঝাঁকুনি খেয়ে খুব সাবধানে দিক পরিবর্তন করল। নিডিয়া দুই হাতে শক্ত করে দেয়াল ধরে রেখে বলল, এ রকম ঝাঁকুনি হবে জানলে আমি মহাকাশযানেই থাকতাম। রিশান ঘোট গোল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে ধাকতে বলল, ঝাঁকুনিতে আমার বিশেষ আপত্তি নেই কিন্তু কোনোভাবে বিষাক্ত গ্যাস খানিকটা ভিতরে না ঢুকে যায়।
লি-রয় সামনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, আরেকটা বড় ঝাঁকুনি কোনভাবে সামলে নিয়ে বলল, এই শেষ, যদি এ রকম হতে থাকে, আমি ফিরে গিয়ে অন্য ব্যবস্থা করছি।
অন্য কী ব্যবস্থা করবে?
পুরো মহাকাশযানটা নামিয়ে আনব–এইসব ছোটখাটো স্কাউটশিপ যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছু নয়।
ষুন লি–রয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, সেটা হয়তো আরো বড় যন্ত্রণা হবে। বাইরে অসম্ভব ঠাণ্ডা, বড় একটি ইঞ্জিন যদি কোনোভাবে জমে যায়, মহাকাশযানকে চালু করতে গিয়ে তোমার জীবন শেষ হয়ে যাবে।
তা ঠিক।
বাইরে আবার গাঢ় হলুদ রঙের এক ধরনের মেঘ ভেসে এল এবং তার মাঝে ঝাঁকুনি খেতে খেতে স্কাউটশিপটা নিচে নামতে থাকে। চার জন যাত্রী কোনোভাবে নিশ্বাস বন্ধ করে। বসে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত স্কাউটশিপটা মাটির কাছাকাছি এসে গ্রহটাকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে। মানুষের বসতিটা কিছুক্ষণের মাঝেই খুঁজে পাওয়া যায়, স্বচ্ছ অর্ধগোলাকৃতি কিছু ডোম, কিছু চতুষ্কোণণা টাওয়ার এবং নানা আকারের এন্টেনা। এর মাঝে কোনো একটি চতুর্থ মাত্রার বিপদ সঙ্কেত পাঠিয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।