- বইয়ের নামঃ নিঃসঙ্গ গ্রহচারী
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. একাকী কিশোর
সুহান হাতের উপর মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশের রং নীলাভ কিন্তু নীল নয়। স্বচ্ছ কাচের মতো। পৃথিবীর আকাশ নাকি নীল। গাঢ় নীল। সে কখনো পৃথিবী দেখে নি কিন্তু তবু সে জানে। তাকে ট্ৰিনি বলেছে। ট্ৰিনি তাকে আরো অনেক কিছু বলেছে। পৃথিবীর নীল আকাশে নাকি সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়। কখনো কখনো সেই মেঘ নাকি পুঞ্জীভূত হয়ে আসে, বিদ্যুতের ঝলকানিতে আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যায়, তারপর নাকি আকাশ কালো করে বৃষ্টি আসে। দীর্ঘ নিরবচ্ছিন্ন বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি জন্ম দেয় গাছ। ট্ৰিনি বলেছে, পৃথিবীর গাছ নাকি সবুজ। গাঢ় সবুজ। সেই গাছে নাকি ফুল হয়। বিচিত্র রঙিন সব ফুল। ট্ৰিনি সব জানে। ট্রিনিকে পৃথিবীতে তৈরি করা হয়েছিল, তার কপোট্রনের ক্রিস্টাল ডিস্কে পৃথিবীর সব খবর রাখা আছে। ট্ৰিনি একটু একটু করে সুহানকে সব বলেছে। সুহান জানতে চায় না, তবু সে বলেছে। সুহানকে নাকি জানতে হবে। সুহান মানুষ। মানুষের জন্মগ্রহ পৃথিবী। তাই সব মানুষকে নাকি পথবীর কথা জানতে হয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর কথা ভাবতে হয়।
সুহান তাই পাথরের উপর শুয়ে শুয়ে কখনো কখনো পৃথিবীর কথা ভাবে। ভাবতে চায় না, তবু সে ভাবে। ট্ৰিনি বলেছে, তাকে ভাবতে হবে। পৃথিবীর কথা ভাবতে হবে, মানুষের কথা ভাবতে হবে। ভেবে ভেবে তাকে সত্যিকার মানুষের মতো হতে হবে। যদি কোনোদিন মানুষের সাথে দেখা হয় তারা যেন সুহানকে দেখে চমকে না ওঠে। ভয় পেয়ে চিৎকার না করে ওঠে।
সুহান এক সময় ট্রিনির কথা বিশ্বাস করত। ভাবত, সত্যিই বুঝি তার একদিন মানুষের সাথে দেখা হবে। দেখা হলে কী বলবে সব ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু তার মানুষের সাথে দেখা হয় নি। সে জানে কোনোদিন মানুষের সাথে তার দেখা হবে না। স্বচ্ছ কাচের মতো নীলাভ আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একদিন তার জীবন শেষ হয়ে যাবে। দুই সূর্যের এই গ্রহটিতে কোনোদিন মানুষ ফিরে আসবে না। কখনো আসবে না।
সুহান পাশ ফিরে শোয়। তার দেহের রং উজ্জ্বল স্বর্ণের মতো। তার মাথায় কুচকুচে কালো চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। তার শরীর সুঠাম, পেশিবহুল। তার বিস্তৃত বক্ষ, দীর্ঘ দেহ। তার দীর্ঘ চোখ, চোখের রং রাতের আকাশের মতো কালো। ট্ৰিনি বলে, তার চেহারা নাকি অপূর্ব সুন্দর। সুহান সেটা জানে না। মহাকাশের এক প্রান্তে নির্জন গ্রহের একটি একাকী কিশোরের কাছে সৌন্দর্যের কোনো অর্থ নেই।
সুহান প্রায় নগ্ন দেহে পাথরের উপর শুয়ে আছে। তার দেহ অনাবৃত, শুধু ছোট এক টুকরো নিও পলিমারের কাপড় তার কোমর থেকে ঝুলছে। এই গ্রহে সুহান ছাড়া আর কোনো মানুষই নেই। তার নগ্নতা ঢেকে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। তবু সে ঢেকে রাখে। ট্রিনি বলেছে, মানুষ হলে নগ্নতা ঢেকে রাখতে হয়। ট্রিনির কথা সে বিশ্বাস করে না, তার সাথে সে অবিরাম তর্ক করে। কিন্তু তর্ক করেও সে ট্রিনির কথা শোনে। এই গ্রহে ট্ৰিনি ছাড়া তার কথা বলার আর কেউ নেই।
সুহান শুয়ে শুয়ে দূরে তাকিয়ে থাকে। বহুদূরে নীল পাহাড়ের সারি। ওই পাহাড়গুলোর কোনো কোনোটা আগ্নেয়গিরি। সময় সময় ভয়ঙ্কর গর্জন করে অগ্ন্যুৎপাত হয়। মাটি থরথর করে কাঁপে, আকাশ কালো হয়ে যায় বিষাক্ত ধোয়ায়, গলিত লাভা বের হয়ে আসে ক্রুদ্ধ নিশাচর প্রাণীদের মতো। এখন পাহাড়গুলো স্থির হয়ে আছে। ট্ৰিনি বলেছে, পৃথিবীর পাহাড় হলে ওই পাহাড়ের চূড়ায় শুভ্র তুষার থাকত। এটা পৃথিবী নয়, তাই দূর পাহাড়ের চূড়ায় কোনো শুভ্র তুষার নেই। এই গ্রহটি পৃথিবীর মতো নয় কিন্তু এটাই সুহানের পৃথিবী, সুহানের গ্রহ। তার নিজের গ্রহ। যে গ্রহে ট্ৰিনি তাকে বুকে আগলে বড় করেছে। সুহান দীর্ঘ সময় দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে এক সময় ক্লান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করল। আজকাল হঠাৎ হঠাৎ তার বুকের মাঝে বিচিত্র এক অনুভূতি হয়। সে এই অনুভূতির অর্থ জানে না। কাউকে সে এই অনুভূতির কথা বলতে পারবে না। ট্ৰিনি অনুভূতির অর্থ জানে না। ট্ৰিনি একটি রবোট। দ্বিতীয় প্রজাতির রবোট। তার কপোট্রনে অসংখ্য তথ্য কিন্তু বুকে কোনো অনুভূতি নেই।
সুহান।
সুহান চোখ খুলে তাকাল। তার পায়ের কাছে ট্রিনি দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ ধাতব দেহ। সবুজাভ ফটোসেলের চোখ। ভাবলেশহীন যান্ত্রিমুখ।
কী হল ট্রিনি?
তুমি অনেকক্ষণ থেকে শুয়ে আছ সুহান।
হ্যাঁ ট্রিনি।
ওঠ। প্রথম সূর্য ডুবে গেছে। একটু পরেই দ্বিতীয় সূর্য ডুবে যাবে।
যাক।
খুব অন্ধকার হবে আজ।
হোক।
সব নিশাচর প্রাণী বের হবে সহান।
হোক। আমি কোনো নিশাচর প্রাণীকে ভয় পাই না ট্রিনি।
এ রকম বলে না সুহান। নিশাচর প্রাণীকে ভয় পেতে হয়। অর্থহীন দম্ভ ভালো নয়।
কেন ভালো নয়।
দাম্ভিক মানুষকে কেউ পছন্দ করে না সুহান।
সুহান বিষণ্ণ গলায় মাথা নেড়ে বলল, এখানে আর কেউ নেই ট্ৰিনি। আমাকে পছন্দ করারও কেউ নেই। অপছন্দ করারও কেউ নেই।
কিন্তু কেউ যদি আসে?
সুহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কেউ আসবে না।
কেন আসবে না? আমরা তো এসেছিলাম। তোমার মা এসেছিল। তোমার মায়ের গর্ভে করে তুমি এসেছিলে। একটি মহাকাশযান ভরা মানুষ এসেছিল।
ইচ্ছে করে তো আস নি। আশ্রয় নিতে এসেছিলে। আবার কেউ আসবে আশ্রয় নিতে।
ছাই আসবে। যদি আসে আবার তাদের মহাকাশযান ধসে পড়বে। আবার সবাই শেষ হয়ে যাবে।
তুমি তো শেষ হও নি।
আমার মায়ের পেট কেটে আমাকে তুমি যদি বের না করতে, আমিও শেষ হয়ে যেতাম।
ট্রিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, সুহান, ওই কথা থাক।
কেন ট্রিনি?
আমি দেখেছি, এই আলোচনা তোমার ভালো লাগে না।
আমার মাঝে মাঝে কিন্তু ভালো লাগে না ট্রিনি।
ছিঃ সুহান, এভাবে কথা বলে না। ছিঃ। একটা জীবন হচ্ছে একটা সংগ্রাম, একটা যুদ্ধ। যার যুদ্ধ যত কঠিন তার জীবন তত অর্থবহ। তোমার মতো এ রকম যুদ্ধ করে আর কে বেঁচে আছে বল? কেউ নেই।
ছাই যুদ্ধ!
ছিঃ সুহান, এ রকম বলে না।
কী হয় বললে?
এগুলো হচ্ছে মন খারাপ করার কথা। মন খারাপ করার কথা বলতে হয় না। একজন মন খারাপ করার কথা বললে অন্যজনেরও মন খারাপ হয়ে যায়।
কিন্তু তুমি তো রবোট। তোমার তো মন খারাপ হয় না।
হ্যাঁ, আমার মন খারাপ হয় না।
তাহলে তুমি কেন বলছ? তুমি কেন মানুষের মতো ব্যবহার করছ?
ট্রিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি যদি তোমার সাথে মানুষের মতো ব্যবহার করি, তুমি কোনোদিন জানবে না কেমন করে মানুষের সাথে কথা বলতে হয়। তুমি সব ভুল কথা বলে মানুষের মনে দুঃখ দিয়ে দেবে। তোমার সাথে কথা বলে মানুষের মন খারাপ হয়ে যাবে।
আমার কোনোদিন মানুষের সাথে দেখা হবে না। সুহান একটা নিশ্বাস ফেলে অন্যমনস্কের মতো বলল, আমার কোনোদিন মানুষের সাথে দেখা হবে না।
ছিঃ সুহান, এভাবে কথা বলে না, ছিঃ! নিশ্চয়ই দেখা হবে।
সুহান ট্রিনির কথার উত্তর না দিয়ে দূরে তাকিয়ে রইল। দ্বিতীয় সূর্যটি পাহাড়ের আড়ালে ঢেকে গেছে। একটু পরেই গ্রহটি গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যাবে।
০২.
পাথর বেয়ে নামতে নামতে সুহান তীক্ষ্ণ চোখে চারদিকে তাকায়। দ্বিতীয় সূর্য অস্ত যাবার পর হঠাৎ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। চারদিকে ইনফ্রা রেড আলো রয়েছে, বেশ খানিকটা আলট্রা ভায়োলেট আলো আছে। ট্রিনি পরিষ্কার দেখতে পায়, কিন্তু সুহান কিছু দেখতে পায় না। মানুষের চোখ এই আলোতে সংবেদনশীল নয়। কে জানে, মানুষের যদি এই গ্রহে জন্ম হত তাহলে হয়তো এই আলোতে তাদের চোখ সংবেদনশীল হত। কিন্তু মানুষের এই গ্রহে জন্ম হয় নি।
ট্ৰিনি নিচু গলায় বলল, সুহান।
কী হল?
তুমি ইনফ্রা রেড চশমাটি পরে নাও, তাহলে দেখতে পাবে। না দেখে তুমি কেমন করে যাচ্ছ? নাও–
না।
কেন নয়?
আমি আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছি। ওই যে ডান দিকে একটা ক্লিও-৩২ বসে আছে। ঠিক কি না?
ঠিক, কিন্তু ইনফ্রা রেড চশমাটি পরে নাও, তাহলে আবছা নয়, স্পষ্ট দেখতে পাবে।
আমি পরতে চাই না ট্রিনি। কেন নয়?
আমি যন্ত্রে অভ্যস্ত হতে চাই না।
কেন নয় সুহান?
যন্ত্র কেমন করে কাজ করে জানতে আমার ভালো লাগে, কিন্তু ব্যবহার করতে ভালো লাগে না।
মানুষ মাত্রই যন্ত্র ব্যবহার করে সুহান। পৃথিবীর মানুষ সবসময় অসংখ্য যন্ত্র ব্যবহার করে। তোমাকেও ব্যবহার করতে হবে।
আমার যদি দরকার হয়, করব। কিন্তু এখন তো দরকার নেই। আমি তো আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছি। মাঝে মাঝে উত্তাপ বুঝতে পারি। সামনে আরেকটা নিওফিলিস রয়েছে, ঠিক কি না?
ঠিক।
ক্লিও-৩২টা নিওফিলিসের দিকে আসছে। মনে হয় নিওফিলিসটার কপালে দুঃখ আছে। খানিকটা অংশ ছিড়ে নেবে।
মনে হয়।
ডান দিক দিয়ে ঘুরে যাই, ক্লিও-৩২ প্রাণীটা একেবারে নির্বোধ। ভুল করে আমাকে
খামচে দেয়।
সুহান ডান দিক দিয়ে সরে গিয়ে পাথুরে রাস্তায় হাঁটতে থাকে। তার চারপাশে ইনফ্রা রেড আলোর জগতে একটি জীবন্ত গ্রহ। অসংখ্য জীবন্ত প্রাণী। নিশাচর প্রাণী। সুহান আর ট্রিনি মিলে প্রাণীগুলোর একটা তালিকা তৈরি করেছে। বেশিরভাগই নিরীহ প্রাণী, গোটা চারেক ঠিক নিরীহ নয়। এদের মাঝে একটি প্রাণীকে মোটামুটি ভয়াবহ বলা যায়। সুহান নাম দিয়েছে লুতুন। লুতুনের আকার বেশি বড় নয় কিন্তু মনে হয় প্রাণীটির খানিকটা বুদ্ধিমত্তা রয়েছে। অন্যান্য প্রাণী থেকে এটা অনেক দ্রুতগামী। সুহান ঠিক নিঃসন্দেহ নয় কিন্তু তার মনে হয় প্রাণীটা তাকে মাঝে মাঝেই আক্রমণ করার চেষ্টা করে। প্রাণীটা এই গ্রহের অন্যান্য প্রাণীদের মতোই, কিন্তু ট্রিনি দাবি করে, এই গ্রহের প্রাণীরা পৃথিবীর প্রাণী থেকে অনেক ভিন্ন। পৃথিবীর যে সমস্ত প্রাণী পূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে তাদের দেহে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস বা পরিপাকযন্ত্র নির্দিষ্ট জায়গায় রয়েছে। এই গ্রহের প্রাণীদের বেলায় সেটি সত্যি নয়, তাদের মস্তি বা শ্বাসযন্ত্র সারা দেহে ছড়ানো। মানুষের মস্তিষ্ক বা কাপওে আঘাত করে তাকে যেরকম মেরে ফেলা যায়, এই প্রাণীগুলোর সেরকম কোনো জায়গা নেই। তাদের মস্তিষ্ক সারা দেহে বিস্তৃত, তাদের ইন্দ্রিয় শরীরের সর্বত্র। শরীরের যে কোনো অংশ খুলে ভয়াবহ পরিপাকযন্ত্র বের হয়ে আসে। ট্রিনির ধারণা, পৃথিবীর গাছের সাথে এদের মিল রয়েছে। পৃথিবীর গাছ অবশ্যি এক জায়গায় স্থির কিন্তু এই প্রাণীগুলো স্থির নয়। লুতুন প্রাণীটি ইচ্ছে করলেই ছুটে সুহানের সাথে পাল্লা দিতে পারবে।
চেনা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সুহান হঠাৎ থেমে যায়। ট্রিনি বলল, কী হল সুহান?
লুতুন? কোথায়?
সুহান শুনতে পেল, ট্ৰিনি তার সংবেদনশীল চোখকে আরো সংবেদনশীল করে ফেলেছে। তার চোখের ভিতর থেকে ক্লিক ক্লিক করে এক রকমের শব্দ হতে থাকে।
সুহান নিচু গলায় বলল, ডান দিকের বড় পাথরটার পিছনে তাকাও।
হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ। ঘাপটি মেরে বসে আছে। সাবধান সুহান। লেজারনটি নেবে?
দাও। সুহান হাত বাড়িয়ে ট্রিনির কাছ থেকে লেজারনটি নিল। লেজারন ট্রিনির তৈরি করা একটি কাজ চালানোর মতো যন্ত্র। ট্রিগার ধরতেই একটা হিলিয়াম নিওন লেজাররশ্মি বের হয়, প্রতিফলিত রশ্মি থেকে লেজারনের ছোট মেগা কম্পিউটারটি দূরত্ব ইত্যাদি বের করে নিয়ে লক্ষ্যবস্তুকে দৃষ্টিবদ্ধ করে ফেলে। একবার দৃষ্টিবদ্ধ হয়ে যাবার পর লক্ষ্যবস্তু সরে গেলে বা নড়ে গেলেও কোনো ক্ষতি নেই, লেজারনের বিস্ফোরক সেটিকে খুঁজে বের করে তাকে আঘাত করবে। পৃথিবীর অস্ত্রের অনুকরণে তৈরি, সুহানের খুব বেশি বার ব্যবহার করতে হয় নি।
দৃষ্টিবদ্ধ হয়েছে সুহান। এখন গুলি করতে পার।
না, থাক।
কেন? ভিতরে মেগাজুল বিস্ফোরক আছে, লুতুনটি নিঃসন্দেহে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। না, আমি ছিন্নভিন্ন করতে চাই না।
কেন নয়? এই প্রাণীটা তোমার জন্যে ভয়াবহ। এদের সংখ্যা কমাতে পারলে তোমার জন্যে নিরাপদ। তাছাড়া প্রাণীটি তো ধ্বংস হবে না। তার ছিন্নবিচ্ছিন্ন টুকরো থেকে অন্য লুতুনের জন্ম হবে।
কিন্তু একটা লুতুনের বড় হতে কত দিন কেটে যায়! যদি এটা আমাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে তাহলে গুলি করব। না হয় থাক। আমি হচ্ছি এই গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। আমি যদি এই গ্রহের অন্য প্রাণীদের দেখেশুনে না রাখি তাহলে কে রাখবে?
ট্রিনি কোনো কথা বলল না। সুহানকে সে তার মতা মায়ের পেট কেটে বের করে একটু একটু করে বড় করেছে। সুহান সম্পর্কে সব তথ্য সে জানে। কিন্তু তবু সে তাকে বুঝতে পারে বলে মনে হয় না। রবোটের নীতিমালায় তাদেরকে প্রথম যে জিনিসটা শেখানো হয় সেটি হচ্ছে এই ব্যাপারটি। মানুষের চরিত্র, কাজকর্ম বিশ্লেষণ করে তথ্য সগ্রহ করতে পার, কিন্তু কখনোই তাদের বুঝতে চেষ্টা কোরো না। ট্রিনি তাই সুহানকে বুঝতে চেষ্টা করে না।
০৩.
পৃথিবীর হিসেবে ষোলো বছর আগে যে মহাকাশযানটি এই গ্রহে আশ্রয় নেবার জন্যে নামতে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়েছিল, সুহান সেখানে থাকে। বিশাল মহাকাশযানের কিছু কিছু অংশ আবার আশ্চর্য রকম অবিকৃত রয়ে গেছে। সেরকম একটা অংশে সুহান থাকে। মহাকাশচারীদের থাকার ঘরগুলোর কয়েকটা রক্ষা পেয়েছে, কোনো কোনোটিতে তাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের অনেক জিনিসপত্র রয়ে গেছে কিন্তু সুহান থাকার জন্যে বেছে নিয়েছে বিশাল ইঞ্জিনঘরটি। অতিশয় ইঞ্জিনটির ভিতরে খানিকটা সমতল জায়গায় সে ঘুমায়। যখন তার ঘুম আসে না সে তখন এই অসম্ভব জটিল ইঞ্জিনটি কীভাবে কাজ করত ভেবে বের করার চেষ্টা করে।
আজকেও শুয়ে শুয়ে সে ইঞ্জিনটার দিকে তাকিয়েছিল। একটা সোনালি রঙের নল উপর থেকে ঘুরে ঘুরে নিচে নেমে এসে চৌকোণাে বাক্সের মাঝে ঢুকে গেছে। শুয়ে শুয়ে সে ভাবতে চেষ্টা করে এই সোনালি নলটি কী কাজে ব্যবহার করা হত। ট্ৰিনি ইঞ্জিনঘরে মাথা ঢুকিয়ে বলল, বাতি নিভিয়ে দেব সুহান?
না।
কেন নয়? তোমার ঘুমানোর সময় হয়েছে। তাছাড়া সৌর ব্যাটারিগুলো আমাদের বাচিয়ে রাখা দরকার। প্রয়োজন না হলে বিদ্যুৎ খরচ করা ঠিক নয়।
বিদ্যুৎ নিয়ে তুমি মাথা ঘামিয়ো না। আমি তোমাকে একটা জেনারেটর তৈরি করে দেব। কিন্তু এখন তুমি কী করছ?
সোনালি রঙের এই নলটি কী কাজে ব্যবহার করা হত বোঝার চেষ্টা করছি।
সুহান, আমি তোমাকে অনেকবার বলেছি তুমি অর্থহীন কাজে অনেক সময় নষ্ট কর। মানুষের সময়ের খুব অভাব। তাদের অনেক যত্ন করে সময়কে ব্যবহার করার কথা।
আমার সময়ের কোনো অভাব নেই।
কিন্তু তোমার মানুষের মতো ব্যবহার করা শেখা দরকার।
সুহান চোখ নাচিয়ে বলল, আমার যেটা করতে ভালো লাগে আমি সেটাই করব।
কিন্তু সবকিছুরই একটা নিয়ম আছে। তুমি যেটা করছ সেটা নিয়মের বাইরে। বিশ্বজগতের জ্ঞানভাণ্ডার বিশাল। মানুষ কোনোদিন তার পুরোটুকু জানতে পারবে না। তাই তাদের জানতে হয় কোন জ্ঞানটি কোথায় আছে সেই তথ্যটি।
আমি সেটা জানতে চাই না।কোন জ্ঞানটি কোথায় পাওয়া যায় সেটি জেনে আনন্দ কোথায়?
আনন্দের জন্যে জ্ঞান নয়। জ্ঞান হচ্ছে ব্যবহারের জন্যে। মহাকাশযানের এই ইঞ্জিনটি কীভাবে কাজ করে জানা সম্পূর্ণ অর্থহীন। কারণ এটা জেনে তুমি কোনোদিন একটা ইঞ্জিন তৈরি করতে পারবে না। ইঞ্জিনটি তৈরি করতে হলে তোমাকে জানতে হবে সেটি কী কী অংশ দিয়ে তৈরি হয়েছে, সেই অংশগুলো কীভাবে জুড়ে দিতে হয়। সেটা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এইসব তথ্য রয়েছে মূল তথ্যকেন্দ্রে। তোমাকে সেটা জানতে হবে। জ্ঞান অর্থ হচ্ছে তথ্যকেন্দ্র সম্পর্কে একটি ধারণা।
সুহান তার বিছানায় উঠে বসে বলল, তুমি বলছ আমার এখন বসে বসে মুখস্থ করার কথা কোন তথ্যকেন্দ্রে কী আছে?
হ্যাঁ। কেমন করে তথ্যকেন্দ্রের তথ্য বের করতে হয়, কেমন করে ব্যবহার করতে হয়। যে মানুষ সেটি যত সহজে ব্যবহার করতে পারে সে তত প্রয়োজনীয়।
ছাই প্রয়োজনীয়!
কোন তথ্যকেন্দ্রে কোন তথ্য আছে জানতে পারলে তুমি ইচ্ছে করলে একটি মহাকাশযান তৈরি করতে পারবে। মহাকাশযানের ইঞ্জিন ঠিক করতে পারবে। তার জন্যে কোন সোনালি রঙের নল দিয়ে কী জ্বালানি যায় সেটি জানার কোনো দরকার নেই।
আমি তবু জানতে চাই।
লেজারন তৈরি হলে তোমাকে জানতে হবে কোন লেজার টিউব, কোন বিস্ফোরক লঞ্চারের সাথে কী রকম মেগা কম্পিউটার জুড়ে দিতে হবে। কী ধরনের নিয়ন্ত্রণ সূত্র ব্যবহার করতে হবে। তোমার কখনো জানার দরকার নেই কেমন করে নেজার কাজ করে—
আমি জানতে চাই। সিমুলেটেড এমিশানের মতো মজার কোনো ব্যাপার নেই। সবগুলো পরমাণু যখন একসাথে
ট্রিনি বাধা দিয়ে বলল, তোমার জানার দরকার নেই। কেমন করে নিয়ন্ত্রণ সূত্র কাজ করে সেটাও তোমার জানার দরকার নেই।
আমি জানতে চাই। এই গ্রহের মহাকর্ষ বল পৃথিবী থেকে একটু কম, নিয়ন্ত্রণ সূত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন রশ্মিমালা ব্যবহার করতে হয়।
কিন্তু সেটা তোমার জানার দরকার নেই। মেগা কম্পিউটার সেটা জানে।
আমি তবু জানতে চাই।
প্রাচীনকালে মানুষেরা এইসব জানত। ছেলেমেয়েরা স্কুলে শিখত। এখন শিখতে হয়। জ্ঞান এখন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে গ্রহণ করতে হয়। অর্থহীন জ্ঞান শিখে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।
সুহান হাল ছেড়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে বল আমার সময় নিয়ে কোনো সমস্যা নেই ট্রিনি। আমার অফুরন্ত সময়। তোমার কাছে যেটা মনে হয় অর্থহীন, আমি সেটাই শিখতে চাই। কোন পরমাণুর শক্তিবলয় কোথায় আমি জানতে চাই। বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ কীভাবে কাজ করে আমি জানতে চাই। মহাকর্ষ বল কত শক্তিশালী আমি জানতে চাই। ধাতব জিনিস কেন তাপ পরিবাহী আমি জানতে চাই। নিও পলিমার কেন বিদ্যুৎ পরিবাহী আমি জানতে চাই।
অর্থহীন। ট্রিনি গলা উঁচিয়ে বলল, অর্থহীন!
সুহান একটা চাদর দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে বলল, আমার পুরো জীবনই অর্থহীন।
যদি এখন কোনো মহাকাশযানে করে কোনো মানুষের দল আসে, তুমি তাদের সামনে হবে একজন অশিক্ষিত মূর্খ মানুষ। তুমি প্রয়োজনীয় একটা জিনিসও জান না।
আমি জানতে চাই না। আর এখানে কোন মানুষ কোনোদিন আসবে না ট্রিনি। তোমার ভয় নেই।
ট্ৰিনি কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে রইল।
ঠিক এই সময় একটি মহাকাশযান তার শক্তিশালী ইঞ্জিন ব্যবহার করে তার গতিবেগ কমিয়ে এই গ্রহটিকে আবর্তন করতে শুরু করেছিল। সেই মহাকাশযানটিতে ছিল প্রায় তিরিশ জন মহাকাশচারী। তাদের সবাই গত পঞ্চাশ বছর থেকে মহাকাশযানের শীতল গ্রহে ঘুমিয়ে আছে। মহাকাশচারীরা তখনো জানত না তাদের এই দীর্ঘ নিদ্রা থেকে কিছুক্ষণের মাঝেই তাদের জাগিয়ে তোলা হবে। তারা জানত না, যে গ্রহটিতে তারা নামবে সেখানে একজন নিঃসঙ্গ কিশোর তাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে বহুকাল থেকে।
০২. নামহীন গ্রহ
লাইনা চোখ খুলে দেখতে পায় তার মাথার কাছে চতুষ্কোণ স্বচ্ছ একটা নীল আলো। এই আলোটা সে আগেও কোথাও দেখেছে কিন্তু কোথায় দেখেছে অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারে না। তার চেতনা এখনো পুরোপুরি সচেতন নয়, সে নিদ্রা এবং জাগরণের মাঝামাঝি এক ধরনের অবস্থায় থেকে আবার ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিল। অনেক কষ্ট করে সে নিজেকে জাগিয়ে তোলে। প্রাণপণ চেষ্টা করে চোখ খোলা রেখে লাইনা মনে করার চেষ্টা করে সে কে, কোথায় শুয়ে আছে এবং কেন তার জেগে ওঠা উচিত। উপরের নীল আলোটা সে আগে কোথায় দেখেছে মনে করার চেষ্টা করতে করতে তার চেতনা আরেকটু সজীব হয়। তখন সে এক ধরনের কম্পন অনুভব করে, কান পেতে সে চাপা একটা গুমগুম শব্দ শুনতে পায়। এই শব্দটিও সে আগে কোথাও শুনেছে কিন্তু এখন কিছুতেই মনে করতে পারে না।
লাইনা চোখ খুলে নিজেকে দেখার চেষ্টা করে। তার দুই হাত উপাসনার ভঙ্গিতে ভাজ করা। সমস্ত শরীর অর্ধস্বচ্ছ এক ধরনের নিও পলিমার দিয়ে ঢাকা। ডান হাতটা একটু উপরে তুলতেই সে দেখতে পায়, তার কজিতে একটা সেন্সর লাগানো। তখন হঠাৎ করে তার সব মনে পড়ে যায়।
সে লাইনা, একজন মহাকাশচারী মহাবিশ্বে নতুন বসতি খোজার জন্যে সে এবং আরো তিরিশ জন মহাকাশচারী মানুষ মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিল। প্রথম দুই বছর পার হওয়ার পর তারা একে একে সবাই শীতলঘরে ঘুমিয়ে গেছে। কতদিন পার হয়েছে তারপর? সে এখন জেগে উঠেছে কেন? তার অর্থ কি মানুষের বাস করার উপযোগী একটা গ্রহ খুঁজে পাওয়া গেছে? এখন কি সেই গ্রহে নামবে তারা?
এক ধরনের উত্তেজনায় লাইনার বুকে হঠাৎ রক্ত ছলাৎ করে ওঠে। ঘুম ভেঙে পরিপূর্ণভাবে জেগে উঠেছে সে। উপরের হালকা নীল আলোটিও তখন চিনতে পারল সে— একটি মনিটর। তার শরীরের ভিন্ন ভিন্ন অংশের খুঁটিনাটি তথ্য দেখাচ্ছে সেখানে। তার রক্তচাপ, তার তাপমাত্রা, তার শ্বাসযন্ত্র, পরিপাকতন্ত্রের অবস্থা, তার মস্তিকের কম্পন। উপরে ডান দিকে আজকের তারিখটি জ্বলছে এবং নিভছে। কী আশ্চর্য! এর মাঝে পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেছে? পঞ্চাশ বছর? অর্ধ শতাব্দী? সে গত অর্ধ শতাব্দী থেকে এই শীতলঘরে ঘুমিয়ে আছে? পৃথিবীতে সে তার যেসব বন্ধুবান্ধব আত্মীয়পরিজনকে রেখে এসেছে তারা এখন বার্ধক্যে জরাগ্রস্ত? বুকের ভিতরে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে লাইনা। সে আবার নীল স্ক্রিনটার দিকে তাকাল, তার শরীর দীর্ঘ নিদ্রা থেকে জেগে উঠছে। শীতল গ্রহে সমস্ত জৈবিক প্রক্রিয়া স্তব্ধ করে দেয়া হয়। তাই তার কাছে গত অর্ধ শতাব্দী কয়েক ঘণ্টার বেশি মনে হওয়ার কথা নয়। নীল স্ক্রিনটায় তাই দেখাচ্ছে। সে ইচ্ছে করলে এখন উঠে দাঁড়াতে পারে, উপরের ঢাকনা খুলে বের হতে পারে। কিন্তু তবু সে উপাসনার ভঙ্গিতে দুই হাত বুকের উপরে রেখে চুপচাপ শুয়ে রইল।
মহাকাশযানের শক্তিশালী ইঞ্জিনের গুমগুম শব্দটি সে কান পেতে শুনতে থাকে। শব্দটি অনেকটা হৃৎস্পন্দনের মতো। শব্দটি সবাইকে মনে করিয়ে দেয় মহাকাশযানটি বেঁচে আছে, মহাকাশচারীরা বেঁচে আছে, সব কম্পিউটার বেঁচে আছে, মহাকাশযানের ক্রায়োজেনিক ঘরে মানুষের তিন সহস্র ভ্রণ বেঁচে আছে, বৃক্ষ লতাপাতার বীজ, পশুর শুক্রাণু বেঁচে আছে। মনে করিয়ে দেয় পৃথিবীর মানুষের পক্ষ থেকে তারা একটি দায়িত্ব নিয়ে মহাবিশ্বে পাড়ি দিয়েছে। কে জানে হয়তো সেই দীর্ঘ অভিযান এখন সমাপ্ত হয়েছে। লাইনা ফিসফিস করে নিজেকে বলল, লক্ষ্মী মেয়ে লাইনা, তুমি ওঠ। তোমার এখন নতুন জীবন শুরু হবে।
লাইনা উঠে বসতেই ঢাকনাটা শব্দ করে খুলে গেল। পাশাপাশি অনেকগুলো ক্যাপসুল। সবগুলোর ওপর একটি করে সবুজ আলো। আস্তে আস্তে জ্বলছে এবং নিভছে। এক জন এক জন করে সবাই উঠবে এখন। সবচেয়ে আগে উঠছে মহাকাশযানের দলপতি কিরি। তারপর সে। সেরকমই কথা ছিল।
ঠাণ্ডা মেঝেতে পা রেখে উঠে দাঁড়াল সে। তার নিরাভরণ সুঠাম দেহের উপর সূক্ষ্ম অর্ধস্বচ্ছ একটি নিও পলিমারের কাপড়। কপালের দুই পাশ থেকে দুটি সেন্সর খুলে সে একটু এগিয়ে যায়। ঘরের দেয়ালে উঁচু আয়না, একটু সামনে যেতেই সেখানে নিজের প্রতিবিম্বের উপর চোখ পড়ল তার। না, গত অর্ধ শতাব্দীর কোনো চিহ্ন নেই তার শরীরে। কুচকুচে কালো চুল মাথার উপর বাধা, হাত দিয়ে খুলে দিতেই ঢেউয়ের মতো নিচে নেমে এল। সে আয়নায় আবার নিজের দিকে তাকাল। কোমল মসৃণ ত্বক ভরাট ঠোঁট, উজ্জ্বল কালো চোখ, সেই চোখে স্বচ্ছ ছবি। সূক্ষ্ম অর্ধস্বচ্ছ কাপড়ের আড়ালে তার সুগঠিত বুক, সুঠাম সজীব দেহ।
লাইনা সামনে এগিয়ে যায়। দেয়ালে তার নাম লেখা বোতামটি স্পর্শ করতেই ঘরঘর শব্দ করে একটা দরজা খুলে গেল। তার ঘরে গিয়ে এখন তাকে প্রস্তুত হতে হবে। কন্ট্রোলরুমে কিরি নিশ্চয় তার জন্যে অপেক্ষা করছে এখন।
২.
সমস্ত মহাকাশযানে কন্ট্রোলরুমটি সবচেয়ে বড়। উপর থেকে হালকা একটা আলোতে ঘরটি আলোকিত রাখা হয়। দেয়ালের চারপাশে বড় বড় স্ক্রিনে নানা ধরনের ছবি। ঘরের ঠিক মাঝখানে মহাকাশযানের মূল নিয়ন্ত্রণ। তার ঠিক সামনে একটি নরম চেয়ারে সমস্ত শরীর ডুবিয়ে কিরি বসে আছে। তার পা দুটি সে তুলে দিয়েছে কন্ট্রোল প্যানেলের উপর। লাইনা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই শব্দ শুনে কিরি তার দিকে ঘুরে তাকাল। তার কোমল মুখটি সাথে সাথে এক ধরনের সহৃদয় হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্যানেল থেকে পা নামিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। কিরির দীর্ঘ ঋজু দেহ। কপালের দুই পাশে চুলে একটু রুপালি রং ছাড়া সারা দেহে বয়সের কোনো চিহ্ন নেই। হাত বাড়িয়ে বলল, এস, লাইনা এস। ভালো ঘুম হয়েছে। তোমার?
হ্যাঁ। কেউ যদি একটানা পঞ্চাশ বছর ঘুমিয়ে থাকে সেটাকে ভালো না বললে কোনটাকে ভালো বলবে?
তা তো বটেই।
তুমি কখন উঠেছ?
কিরি লাইনার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তার দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কী সুন্দর তোমাকে দেখাচ্ছে লাইনা! এত সুন্দরী একটা মেয়েকে মহাকাশযানের মতো ছোট একটা জায়গায় রাখা ঠিক নয়। সৌন্দর্যের অপচয় হয় এতে। এই সৌন্দর্য আরো অনেক বেশি মানুষের জন্যে।
লাইনা মাথা নেড়ে বলল, তুমি দলপতি হয়ে মহাকাশযানের নীতিমালার একটা আইন ভঙ্গ করলে। মহাকাশযানের পুরুষ ও মহিলাকে আলাদা করে দেখার নিয়ম নেই।
কিরি মাথা নেড়ে বলল, মনে থাকে না লাইনা! তোমাকে দেখলে আরো বেশি গোলমাল হয়ে যায়।
লাইনা কিরির স্তুতিবাক্যটি গায়ে মাখল না। হেঁটে নিজের ডেস্কের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। গত পঞ্চাশ বছর এখানে কেউ বসে নি কিন্তু কোথাও সেই চিহ্ন নেই। দেখে মনে হয়, মাত্র গত রাত্রিতে সে এখান থেকে উঠে গেছে। নরম চেয়ারটিতে বসে সে নিজের যোগাযোগ মডিউলের বোতামটি চেপে ধরে বলল, মহাকাশযানের কী খবর কিরি? আমরা কি থামছি কোথাও?
হ্যাঁ।
কোথায়?
সাত দশমিক তিন চার অবলিক আট দশমিক নয়…
লাইনা হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল, থাক, আর বলতে হবে না।
কিরি হেসে বলল, আমরা গিনিস ক্ষেত্রে একটা গ্রহে নামছি লাইনা।
গ্রহটির কী নাম?
এর কোনো নাম নেই লাইনা। শুধু পরিচয়। সংখ্যা দিয়ে পরিচয়।
কী আশ্চর্য! আমরা নামহীন একটা গ্রহে নামছি?
হ্যাঁ। মহাজাগতিক সময়ে মেলা বছর আগে এখানে আরেকটি মহাকাশযান নামার চেষ্টা করেছিল। নামতে পারে নি।
লাইনা শঙ্কিত মুখে বলল, কেন পারে নি?
মহাকাশযানের জ্বালানি নিয়ে একটা সমস্যা হয়েছিল। একটি নক্ষত্রের মহাকর্ষ বল থেকে রক্ষা পেতে গিয়ে জ্বালানি শেষ হয়ে গিয়েছিল। তখন এই গ্রহটি তারা দেখতে পায়। গ্রহটির সাথে পৃথিবীর অনেক মিল, মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত না হলে মহাকাশচারীদের বেঁচে যাবার ভালো সম্ভাবনা ছিল।
পৃথিবীর সাথে মিল?
হ্যাঁ। কিরি তার সামনে একটা সুইচ স্পর্শ করতেই দেয়ালের বিশাল স্ক্রিনে একটা গ্রহের ছবি ফুটে ওঠে। কিরি সেটাকে আরো স্পষ্ট করতে করতে বলল, গ্ৰহটার সাথে পৃথিবীর মিল খুব বিস্ময়কর। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ, প্রাণের বিকাশ
প্রাণের বিকাশ?
হ্যাঁ। কিরি হাসিমুখে বলল, এই গ্রহটায় প্রাণের বিকাশ হয়েছে। যতদূর মনে হয় এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে।
লাইনা তার চেয়ার থেকে উঠে দেয়ালে স্ক্রিনটার কাছাকাছি এগিয়ে যায়। ধূসর গ্রহটির দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, তাপমাত্রা কত? জলীয় বাষ্পের পরিমাণ?
গ্রহটির উত্তর ভাগে কিছু কিছু অংশে তাপমাত্রা পৃথিবীর কাছাকাছি। জলীয় বাষ্প কম বলতে পার, পৃথিবীর মরু অঞ্চলের মতো। এখনো ছবি নেয়া হচ্ছে, যেটুকু তথ্য আছে তাতে মনে হচ্ছে গ্রহটা দেখতে খুব খারাপ নয়। তাপমাত্রা আর জলীয় বাষ্প নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে মনে হয় পৃথিবীর গাছপালা জন্ম দেয়া যাবে। মনে হয় চমৎকার একটা বসতি হতে পারে। তবে–
তবে কী?
গ্রহটা দুটি নক্ষত্রের কাছাকাছি। কক্ষপথের কোথায় আছে তার উপর নির্ভর করে মাঝে মাঝে এটাকে দুই সূর্যের গ্রহ মনে হবে! চিন্তা করতে পার আকাশে একসাথে দুটি সূর্য?
তাপমাত্রা? তখন তাপমাত্রা কত হবে?
অসহ্য মনে হতে পারে, এখনো জানি না। তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
লাইনা দীর্ঘ সময় গ্রহটির দিকে তাকিয়ে থাকে। নামহীন ধূসর একটি গ্রহ। কে জানে হয়তো এই গ্রহে সে তার জীবন কাটিয়ে দেবে। মানুষ তাদের পৃথিবীকে বাসের অযোগ্য করে ফেলেছে। তেজস্ক্রিয় বাতাস, অনুর্বর প্রাণহীন মাটি, বিষাক্ত পানি। তাদেরকে বেঁচে থাকার জন্যে এখন অন্য কোনো গ্রহ খুঁজে বের করার কথা ভাবতে হচ্ছে। বাইরে বসতি স্থাপন করার দায়িত্ব নিয়ে গত শতাব্দীতে যে অসংখ্য মহাকাশযান বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের মহাকাশযানটি ঠিক সেরকম একটি মহাকাশযান। তারা কি সত্যি খুঁজে বের করতে পারে একটি গ্রহ, যেখানে পৃথিবীর মানুষ আবার নতুন করে তাদের জীবন শুরু করতে পারবে? লাইনা ছোট একটা নিশ্বাস ফেলল, তার বিশ্বাস হয় না।
যোগাযোগ মডিউলে চাপা একটি শব্দ শুনে লাইনা সেদিকে এগিয়ে যায়। মহাকাশযানের দ্বিতীয় দলনেত্রী হিসেবে তার পত্বি অনেক। সে দ্রুত অভ্যস্ত হাতে মহাকাশযানের মূল কম্পিউটারে কিছু সংখ্যা প্রকাশ করায়, কাছাকাছি মাইক্রোফোনে নিচু গলায় কথা বলে। স্ক্রিনের ছবিতে হাত দিয়ে স্পর্শ করে যোগাযোেগ ব্যবস্থা চালু করে দেয়। ধীরে ধীরে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে মহাকাশধানের তথ্য ফুটে উঠতে থাকে। গত পঞ্চাশ বছরে অস্বাভাবিক কিছু ঘটে নি। ক্রায়োজেনিক ঘরে তিন সহস্র মানুষের জ্বণ, পশুর শুক্রাণু, ডিম্বাণু, কয়েক লক্ষ গাছের বীজ, জীবিত প্রাণীর ক্লোন তৈরি করার প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল, তাদের রক্ষণাবেক্ষণের কম্পিউটার, রবোট, নির্ভুল নিয়ন্ত্রণবিধি সবকিছু ঠিক ঠিক আছে। লাইনা মহাকাশযানের জ্বালানির পরিমাণ, যন্ত্রপাতির অবস্থা দেখে সৌর ব্যাটারিতে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ, তাদের নিজেদের রসদ, বাতাসে অক্সিজেন পরীক্ষা করে পৃথিবীর খবর নেয়ার জন্যে নির্দিষ্ট মডিউলটি চালু করে দেয়।
লাইনা, তুমি সত্যিই পৃথিবীর কথা জানতে চাও?
লাইনা একটু অবাক হয়ে পিছনে তাকাল। কিরি নিঃশব্দে হাঁটতে পারে, কখন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে কে জানে।
কিরি আবার বলল, সত্যি জানতে চাও?
হ্যাঁ।
কেন লাইনা? খবর জেনে তো শুধু মন খারাপই হয় লাইনা।
কিন্তু কী করব বল?
মানুষ কেমন করে এটা করল লাইনা? বাতাসে তেজস্ক্রিয়তা। মহাদেশের পর মহাদেশ রুক্ষ প্রাণহীন মরুভূমি। নদী হ্রদ সমুদ্র মহাসমুদ্রে বিষাক্ত কেমিক্যাল। মানুষ বেঁচে আছে মাটির নিচে। রোগ শোক মহামারী। বিভীষিকা। বিশ্বাস হয় লাইনা?
লাইনা মাথা নাড়ল, না, হয় না।
মানুষ কেমন করে নিজের অস্তিত্বে নিজে আঘাত করে? আমি এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি লাইনা। তোমরা, মানুষেরা গত পঞ্চাশ বছর যখন শীতলঘরে ঘুমিয়ে ছিলে তখন আমি এটা নিয়ে ভেবেছি। আমি এই চেয়ারে গত পঞ্চাশ বছর চুপ করে বসে ছিলাম–
কী বললে? লাইনা চমকে উঠে বলল, কী বললে তুমি?
হ্যাঁ লাইনা, তোমরা কেউ জান না। আমি মানুষ নই লাইনা। আমি একজন রবোট। দশম প্রজাতির রবোর্ট।
রবোট? তুমি রবোট?
হ্যাঁ লাইনা।
লাইন বিস্ফারিত চোখে কিরির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই হৃদয়বান বুদ্ধিদীপ্ত দর্শন মানুষটি একটি রবোট? তার বিশ্বাস হয় না। মাথা নেড়ে বলল, আমি বিশ্বাস করি না, কিরি।
কিরি লাইনার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে আর হঠাৎ সে অবাক হয়ে দেখে, কিরির চোখ দুটি সবুজাভ হয়ে আসে, আর সেখান থেকে বিচিত্র এক ধরনের আলো বের হয়ে আসে। লাইনার এক ধরনের আতঙ্ক হতে থাকে, শক্ত করে চেয়ারটি ধরে বলল, না কিরি, না। না।
কিরির চোখ দুটি আবার স্বাভাবিক হয়ে এল, আবার সেই চোখে সহৃদয় একটি হাসিখুশি মানুষ উঁকি দিতে থাকে।
লাইনা অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, তুমি মানুষ নও! তুমি রবোট!
কিরি নরম গলায় বলল, তোমার কি আশাভঙ্গ হল তাইনা?
লাইনা মাথা নিচু করে বলল, আমি জানি কিরি।
মনে হয় হয়েছে। কিন্তু আমি তোমাকে একটা জিনিস বলি। আমি দশম প্রজাতির রবোট। সব মিলিয়ে আমার মতো রবোর্ট রয়েছে দশ কি বারটি। আমাদের সাথে মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। এই মহাকাশযানের দলপতি একজন মানুষকে না করে একজন রবোটকে করা হয়েছে। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ রয়েছে।
হ্যাঁ। লাইনা মাথা নেড়ে বলল, নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।
সেই কারণটা কী?
আমি জানি না।
গত পঞ্চাশ বছর তোমরা সবাই যখন শীতলঘরে বসে ছিলে তখন আমি সেটা নিয়ে ভেবেছি। পঞ্চাশ বছর দীর্ঘ সময়। মানুষের জন্যে দীর্ঘ, আমার জন্যেও দীর্ঘ। ভেবে ভেবে মনে হয় আমি এই প্রশ্নের একটা উত্তর খুঁজে পেয়েছি।
সেটা কী?
একজন মানুষ খুব সহজে নিজেকে ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে যায়। শেষ মুহূর্তে হয়তো করে না কিন্তু তার খুব কাছাকাছি নিয়ে যায়। আমি সেটা করব না। আমি কখনো মানুষকে ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে যাব না।
কিন্তু তুমি একটু আগে বলেছ তুমি মানুষের মতো।
হ্যাঁ।
মানুষের যেরকম দুঃখ কষ্ট হাসি কান্না আছে তোমারও সেরকম দুঃখ কষ্ট হাসি কান্না আছে?
আছে। ঈর্ষা আছে? হিংসা আছে? ক্রোধ? অপরাধবোধ? দম্ভ?
কিরিকে একটু বিচলিত দেখা গেল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমি যতদূর জানি, আছে। কিন্তু সেইসব অনুভূতি প্রকাশ পাওয়ার একটা কারণ থাকতে হয়। সেরকম কারণ এখনো হয় নি। তাই আমি জানি না কত তীব্র আমার ঈর্ষা বা হিংসা, ক্রোধ বা দত্ত।
লাইনা চুপ করে থেকে বলল, যদি দেখা যায় সেটা ভয়ঙ্কর তীব্র? তুমি যদি হঠাৎ অমানুষ হয়ে যাও?
কিরি শব্দ করে হেসে ফেলল, তারপর বলল, না লাইনা, আমি কখনো অমানুষ হব না। রবোট অমানুষ হতে পারে না। শুধুমাত্র মানুষ অমানুষ হতে পারে।
কিরি হেঁটে হেঁটে ঘরের মাঝখানে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে আস্তে আস্তে বলল, আমি যে একজন রবোট সেটা আমি ছাড়া আর কেউ জানত না। কথাটা গোপন রাখার কথা ছিল। কিন্তু আমি সেটা গোপন রাখি নি। আমি সেটা তোমাকে বলেছি। কেন বলেছি জান?
কেন?
আমি তোমাদের দলপতি হতে চাই না। মানুষের একটি দলের দলপতি হবে একজন মানুষ।
কিন্তু তুমি দশম প্রজাতির রবোট। দশম প্রজাতির একজন রবোট মানুষের এত কাছাকাছি যে, মানুষের সাথে তার কোনো পার্থক্য নেই। পৃথিবীর মানুষ যদি তোমাকে দলপতি করতে পারে আমি সেটা মেনে নিতে পারি। তোমার ওপর আমার বিশ্বাস আছে। কিরি।
কিরি খানিকক্ষণ লাইনার দিকে তাকিয়ে বলল, অনেক ধন্যবাদ লাইনা। তুমি আমার বুক থেকে একটা পাথর সরিয়ে দিলে। নিজেকে মানুষের মাঝে লুকিয়ে রাখতে আমার খুব খারাপ লাগছিল। তোমাকে বলতে পেরে আমার বুকটা হালকা হয়ে গেছে।
০৩.
আঠার ঘণ্টা পর মহাকাশযানের মূল চতুরটুকুতে একটা আনন্দমুখর উৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ঘুম ভেঙে তিরিশ জন মহাকাশচারী উঠে এসেছে। ভন্টে রাখা অনেকগুলো রবোটকে বের করে আনা হয়েছে। সবাই চেঁচামেচি করে কথা বলছে। চারদিকে খাবার এবং পানীয়ের ছড়াছড়ি। অর্থহীন কথাবার্তা, হাসি-তামাশা, হইহুল্লোড় দেখে মনে হতে পারে, এদের জীবনে সত্যিকারের কোনো সমস্যা নেই। মনে হয়, আনন্দমুখর একটি বিশাল পরিবারের সবাই বুঝি হঠাৎ করে একত্র হয়েছে।
হইচই যখন চরমে উঠেছে তখন কিরি একটা চেয়ারের উপরে দাঁড়িয়ে বলল, আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
কিরিকে একাধিকবার কথাটি উচ্চারণ করতে হল এবং শেষ পর্যন্ত সবাই কথা থামিয়ে তার দিকে ঘুরে তাকাল। কিরি সবাইকে এক নজর দেখে বলল, তোমরা সবাই জান, আমরা আগামী কয়েক ঘণ্টার মাঝে এই গ্রহটিতে নামতে যাচ্ছি।
সবাই একটা আনন্দধ্বনির মতো শব্দ করল। কিরি শব্দটাকে থেমে যাওয়ার সময় দিয়ে বলল, আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ তথ্য রয়েছে সেটা দেখে মনে হয়, এই গ্রহটি মানুষের জন্যে চমৎকার একটা বসতি হতে পারে। নতুন একটা পৃথিবীর জন্ম দেব এখানে।
সবাই দ্বিতীয়বার একটা আনন্দধ্বনি করল, এবারে আগের থেকে জোরে এবং দীর্ঘস্থায়ী। কিরি হাসিমুখে বলল, আমি তোমাদের দলপতি। আমাকে যেরকম কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে ঠিক সেরকম কিছু দায়িত্বও দেয়া হয়েছে। আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি, আমি চেষ্টা করব আমার দায়িত্ব যতটুকু সম্ভব নিখুঁতভাবে পালন করতে। কিন্তু তার আগে আমি তোমাদেরকে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই।
টকটকে লাল রঙের পানীয়ের একটা গ্লাস হাতে নিয়ে লাইনা কিরির দিকে ঘুরে তাকাল। কী বলতে চায় কিরি?
কিরি এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, যদি এখন তোমাদের বলা হয়, আমি মানুষ নই, আমি একজন রবোট, তাহলে তোমরা কি আমার নেতৃত্ব মেনে নেবে?
উপস্থিত সবাই চুপ করে যায়। কমবয়সী একজন তরুণ, লাল চুলের ক্রিকি অবাক হয়ে বলল, কিন্তু তুমি তো মানুষ!
না, আমি মানুষ নই।
তুমি মানুষ নও?
না। এখানে লাইনা ছাড়া আর কেউ সেটা জানে না। লাইনা জানে, কারণ আমি তাকে গতকাল বলেছি। সে বিশ্বাস করতে চায় নি। তখন আমি তাকে প্রমাণ দেখিয়েছি।
সবাই ঘুরে লাইনার দিকে তাকাল, লাইনা সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। কিরি আবার বলল, আমি একজন রবোর্ট। দশম প্রজাতির রবোট।
সারা ঘরে হঠাৎ বিস্ময়ের ধ্বনি উচ্চারিত হতে থাকে। রিশা নামের সোনালি চুলের একটা মেয়ে কাঁপা গলায় বলল, দ-দ-দশম প্রজাতি?
হ্যাঁ।
তোমার কপোট্রন ক্লিও লিয়ামের? টেটরা রিজম?
হ্যাঁ, টেটরা রিজম।
নিউরাল নিক্সি?
হ্যাঁ।
এ পর্যন্ত তৈরি হয়েছে মাত্র দশটি?
সঠিক সংখ্যাটি কেউ জানে না, তবে এর কাছাকাছি।
রিশা সবার দিকে তাকিয়ে বলল, এই জন্যে আমরা কেউ কখনো ধরতে পারি নি।
কী আশ্চর্য!
তোমরা এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি। বল, তোমরা কি আমার নেতৃত্ব মেনে নেবে?
মধ্যবয়স্ক ইঞ্জিনিয়ার গ্রুসো উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সত্যি কথা বলতে কী, তোমার কথা শুনে আমার নিজের মাঝে এখন এক ধরনের হীনমন্যতা জন্মে গেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মানুষ না হয়ে একজন দশম প্রজাতির রবোট হয়ে জন্ম নিতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।
ঘরে হালকা হাসির একটা শব্দ শোনা যায়। লাইনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কিরি, তুমি মহাকাশযানের নীতিমালা লঙ্ন করছ। তোমার সাথে একজন মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। তুমি নিজে থেকে না বললে কেউ কোনোদিন এই জিনিসটি জানতে পারত না। তোমার এই তথ্যটি গোপন রাখার কথা ছিল। তুমি কেন বলেছ?
আমি সম্ভবত মানুষের খুব কাছাকাছি। মানুষের ভিতরে যেরকম অনুভূতি কাজ করে আমার ভিতরেও অনেকটা সেরকম অনুভূতি কাজ করে। গত পঞ্চাশ বছর তোমরা–মানুষেরা যখন ঘুমিয়ে ছিলে তখন আমি এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। ভেবে ভেবে মনে হয় আমি আরো পরিণতবুদ্ধি মানুষে—কিংবা রবোটে পরিণত হয়েছি। আমার মনে হয়েছে, আমার তোমাদের জানিয়ে দেয়া প্রয়োজন আমি মানুষ নই, আমি রবোট।
সোনালি চুলের রিশা বলল, সেটা মনে হয় তুমি ভালোই করেছ—কিন্তু তোমাকে কি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা যাবে?
কী প্রশ্ন?
তুমি কি মানুষের মতো ভালবাসাবাসি করতে পার?
সারা ঘরে উচৈঃস্বরে একটা হাসির শব্দ শোনা গেল। কিরি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, অত্যন্ত ব্যক্তিগত প্রশ। তুমি যদি নিরিবিলি কখনো আমাকে এই প্রশ্ন কর, আমি তার উত্তর দেব। এখানে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি নই। সেটি মহাকাশযানের নীতিমালায় ষষ্ঠ অধ্যায়ের তৃতীয় পরিচ্ছেদ লঙ্ঘন করা হবে।
জীববিজ্ঞানী কুডিও বলল, তোমার কি খিদে পায়?
পায়।
তোমার কি কখনো বিশেষ খাবার খেতে ইচ্ছে করে? আমার যেরকম এখন ইচ্ছে করছে। দুটি বড় কলার মাঝখানে এই এতখানি কেক, তার উপরে ঘন করে ক্রিম
সবাই আবার হো হো করে হেসে ওঠে। কিরি বলল, হ্যাঁ, আমারও মাঝে মাঝে বিশেষ বিশেষ খাবার খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমি তোমাদের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছি। আমি জানতে চাই—
তোমার কি কখনো অসুখ করে? টেকনিশিয়ান রিও শব্দ করে নিজের নাক পরিষ্কার করে বলল, সর্দিকাশি? জ্বর?
হ্যাঁ। প্রচলিত কিছু ভাইরাস এবং রোগজীবাণু আমার শরীরে অসুখের মতো উপসর্গ তৈরি করতে পারে। আমি তোমাদের এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি। এখন আমি যেটা জানতে চাই সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি জানতে চাই
কমবয়সী কিকি হাত তুলে বলল, একটা শেষ প্রশ্ন।
কী?
তোমার কখনো ঘুম পায় না?
পায়। মানুষের মতো আমার ঘুম পায়। এবং তোমরা দেখেছ আমি তোমাদের মতো ঘুমাই। বিশেষ প্রয়োজন হলে আমি দীর্ঘ সময় জেগে থাকতে পারি। এবার যেরকম জেগেছিলাম।
তুমি যখন ঘুমাও তখন তুমি কি স্বপ্ন দেখ?
কিরি একটু হেসে বলল, আমি এখন এই প্রশ্নের উত্তর দেব না, কারণ তাহলে সাথে সাথে তোমরা এটা নিয়ে আরো এক শ-টি প্রশ্ন করবে। আগে তোমরা আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। তোমরা কি–
রিশা আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কি কখনো প্রেমে পড়েছ?
সারা ঘরে হাসির শব্দ শোনা যায়। কিরি একটু বিষণ্ণ মুখে লাইনার দিকে তাকাল। লাইনা একটু হেসে বলল, কিরি, আমার ধারণা তুমি যে মানুষ নও, এবং তুমি যে একজন দশম প্রজাতির রবোট সেটা অনেক কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু তোমার সাথে আমাদের সবার যে সম্পর্ক তার কোনো পরিবর্তন হয় নি। তোমার নেতৃত্বে আমাদের পুরোপুরি আস্থা রয়েছে।
আমি যদি কখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেই, তোমাদের মানুষের কাছে সেটা যদি অযৌক্তিক বা কখনো অমানবিক মনে হয়, তোমরা কি সেটা মেনে নেবে?
কিরির গলায় কিছু একটা ছিল যার জন্যে সবাই একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। লাইনা মৃদুস্বরে বলল, তুমি কখনো কোনো অযৌক্তিক বা অমানবিক সিদ্ধান্ত নেবে না কিরি, আমার সেই বিশ্বাস আছে। কিন্তু যদি কখনো নাও, অন্যদের কথা জানি না, আমি কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেব।
সবাই মাথা নাড়ল। ইঞ্জিনিয়ার গ্রুসো এগিয়ে এসে বলল, সোজাসুজি বললে স্তুতিবাক্য হয়ে যায়, তবু বলছি। তুমি চমৎকার একজন মানুষ। খাটি মানুষ। তোমার নেতৃত্ব চমৎকার। আমরা চোখ বুজে মেনে নেব।
জীববিজ্ঞানী ক্লডিও বলল, সিদ্ধান্ত নিতে তুমি যদি কখনো ভুল কর, করবে। মানুষও ভুল করে। আমাদের কাছে সেটা যদি অযৌক্তিক মনে হয়, যদি অমানবিক মনে হয়, আমরা তখন প্রতিবাদ করব, চিৎকার করব, চেঁচামেচি করব। কিন্তু তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমরা তোমার সিদ্ধান্ত মেনে নেব। কারণ তুমি আমাদেরই একজন। তোমার ভিতরে সেটা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে কিন্তু আমাদের কোনো সন্দেহ নেই।
সোনালি চুলের রিশা বলল, কখনো যদি বিয়ের কথা ভাব আমাকে জানিও, আমি এখনো কুমারী।
সারা ঘরে আবার হাসির শব্দ শোনা যায়।
০৪.
দুই ঘণ্টা পর মহাকাশযানটি নামহীন গ্রহটিতে অবতরণ করল কোনোরকম সমস্যা ছাড়াই। মহাকাশযানটি অবতরণ করার জন্যে যে জায়গাটি বেছে নিয়েছিল তার থেকে ষাট কিলোমিটার দূরে একটি বিধ্বস্ত মহাকাশযানের ইঞ্জিনঘরে সুহান তখন গভীর ঘুমে অচেতন। তার পায়ের কাছে মূর্তির মতো বসেছিল ট্ৰিনি। স্থির চোখে তাকিয়েছিল সুহানের ঘুমন্ত মুখের দিকে। দেখে মনে হতে পারে বুঝি গভীর ভালবাসায়।
কিন্তু ট্ৰিনি দ্বিতীয় প্রজাতির রবোট। প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী দ্বিতীয় প্রজাতির রবোটের বুকে কোনো ভালবাসা নেই।
০৩. মহাকাশযান
সুহানের হাতে একটি বিচিত্র অস্ত্র। অস্ত্রটি সে নিজে তৈরি করেছে। একটি ধাতব নলের সাথে একটি হাতল লাগানো। নলের মাঝে সে খানিকটা বিস্ফোরক রেখে তার সামনে ছোট একটি বুলেট রাখে। বুলেটের মাঝে থাকে চতুর্থ মাত্রার বিস্ফোরক। হাতলের সাথে একটা ট্রিগার লাগানো আছে। ট্রিগারটি টেনে ধরার সাথে সাথে বিস্ফোরকে ছোট একটি বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ আঘাত করে। বুলেটটি ছুটে যায় সাথে সাথে। লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার পর চতুর্থ মাত্রার বিস্ফোরকে ভয়ঙ্কর একটা বিস্ফোরণ হয়। অস্ত্রটিতে নতুন করে বিস্ফোরক ভরে সহান বহু দূরে একটি পাথরের দিকে তাক করে দাঁড়ায়। ট্ৰিনি নিচু গলায় বলল, সুহান, তুমি অযথা সময় নষ্ট করছ।
কেন?
এই অস্ত্রটি দিয়ে তুমি কখনো লক্ষ্যভেদ করতে পারবে না।
কেন?
কারণ এর মাঝে দৃষ্টিবদ্ধ করার জন্যে কোনো লেজাররশ্মি নেই। লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান নিশ্চিত করার জন্যে কোনো মেগা কম্পিউটার নেই। তোমার হাতে যেটা রয়েছে সেটা একটি খেলনা।
সুহান তীক্ষ্ণ চোখে দূর পাথরটির দিকে তাকিয়ে বলল, আমি খেলনা দিয়ে খেলতে ভালবাসি।
এটি শুধু খেলনা নয়, এটি একটি বিপজ্জনক খেলনা। তুমি এর মাঝে চার মাত্রার বিস্কোরকে তৈরী একটা বুলেট রেখেছ। এটি তোমার হাতে বিস্ফোরিত হবার সম্ভাবনা তের দশমিক চার।
এই গ্রহে আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল চার দশমিক নয়। তুমি আমাকে শুধু শুধু জ্বালাতন করছ।
সুহান নিশ্বাস বন্ধ করে ট্রিগার টেনে ধরল। তার ত্রাতের অস্ত্রটি থেকে ভয়ঙ্কর একটা শব্দ করে বুলেটটি বের হয়ে যায়। দূরে একটি বিক্ষেরণ হয়। তার লক্ষ্যবস্তু থেকে অনেক দূরে।
ট্রিনি বলল, আমি তোমাকে বলেছি, তুমি এটা দিয়ে কখনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারবে না।
এক শ বার পারব। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জন্যে বুলেটটা নিচে নেমে আসছে। লক্ষ্যবস্তুর একটু উপরে তাক করলে—
তোমার যুক্তি হাস্যকর। অস্ত্র মাত্রই এই ধরনের হিসেব করতে পারে। তোমার খালি চোখে আন্দাজ করে নিশানা করা পুরোপুরি অর্থহীন। সময় এবং শক্তির অপচয়। সবচেয়ে বড় কথা—এটি বিপজ্জনক।
হোক বিপজ্জনক। আমি এভাবেই লক্ষ্যভেদ করতে চাই। খালি চোখে আন্দাজ করে। হাতের স্পর্শে।
কেন?
আমার ইচ্ছে।
ট্ৰিনি কোনো কথা না বলে মাথা ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। সুহান শুনতে পায়, তার মাথা থেকে ক্লিক ক্লিক করে এক ধরনের শব্দ হচ্ছে। ট্ৰিনি তার সমস্ত ইন্দ্রিয় সংবেদনশীল করে কিছু একটা শোনার বা দেখার চেষ্টা করছে। নিজে থেকে তাকে কিছু বলল না বলে সুহান কিছু জিজ্ঞেস করল না।
সুহান তার অস্ত্রটিতে বিস্ফোরক ভরে আবার সেখানে একটি বুলেট ঢুকিয়ে নেয়। ভালো করে দেখে সে আবার দুই হাতে অস্ত্রটি তুলে ধরে দূরে তাক করে, আগের বার যেখানে তাক করেছিল এবারে তার থেকে একটু উপরে। সমস্ত ইন্দ্রিয় একাগ্র করে সে লক্ষ্যবস্তুর দিকে তাকায়। তারপর নিশ্বাস বন্ধ করে ট্রিগার টেনে ধরে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে সাথে এক ঝলক কালো ধোঁয়ায় তার সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। ধোয়াটা সরে যেতেই সে অবাক হয়ে দেখে, লক্ষ্যবস্তুর পাথরটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। সুহান আনন্দে চিৎকার করতে গিয়ে থেমে গেল, ট্ৰিনি তখনো সামনে তাকিয়ে আছে। তার সংবেদনশীল চোখে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে। তার সংবেদনশীল শ্রবণযন্ত্র ব্যবহার করে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করছে। সুহান খানিকক্ষণ ট্রিনির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ট্রিনি।
বল।
আমি এইমাত্র আমার অস্ত্রটি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করেছি।
ও।
তুমি শুনে অবাক হলে না? কী ব্যাপার? তুমি কী দেখছ।
না, কিছু না।
সুহান শব্দ করে হেসে বলল, তুমি দ্বিতীয় প্রজাতির রবোট। তোমার পক্ষে মিথ্যা কথা বলা সম্ভব নয়। তুমি যখন চেষ্টা কর সেটা আমি খুব সহজে ধরে ফেলি।
ট্ৰিনি মাথা ঘুরিয়ে বলল, আমি মোটেই মিথ্যা কথা বলার চেষ্টা করছি না। আমি কিছু দেখছি না।
তুমি কি কিছু দেখার চেষ্টা করছ?
আমি তার উত্তর দিতে রাজি নই।
সুহান আবার শব্দ করে হেসে ফেলে বলল, তুমি একেবারে ছেলেমানুষি রবোট! তোমার ভিতরে একেবারে কোনোরকম জটিলতা নেই। তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না। কাল রাত থেকে তুমি খুব বিচিত্র রকম ব্যবহার করছ। আমার কাছে তুমি কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছ।
ট্ৰিনি কোনো কথা বলল না, যার অর্থ সত্যিই সে কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। সুহান বলল, আমি ইচ্ছে করলেই বের করতে পারি তুমি আমার কাছে কী লুকানোর চেষ্টা করছ। করব?
না।
সুহান আবার হেসে ফেলল। বলল, ঠিক আছে, তুমি থাক তোমার গোপন কথা নিয়ে।
সে আবার তার বিচিত্র অস্ত্রটি নিয়ে তার মাঝে বিস্ফোরক ভরতে থাকে। এটি তার একটি নতুন খেলা।
ট্ৰিনি বহুদূরে তাকিয়ে তার সংবেদনশীল চোখটি আরো সংবেদনশীল করে ফেলে। মাটিতে সে কুড়ি হার্টজ তরঙ্গের উপর সাতচল্লিশ কিলোহার্টজ এবং নব্বই মেগাহার্টজ তরঙ্গের সুষম উপস্থাপন অনুভব করেছে। প্রথমত, এই গ্রহে প্রাকৃতিক উপায়ে এই কম্পন তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই। তাছাড়া কুরু মহাকাশযানের মূল ইঞ্জিনের কম্পনের প্রথম হারমোনিক সাতচল্লিশ কিলোহার্টজ। বৈদ্যুতিক জেনারেটরের কম্পন নব্বই মেগাহার্টজ। তাহলে কি সত্যিই একটি কুরু মহাকাশযান নেমেছে এই গ্রহের মাটিতে? সুহানকে সে কি বলবে তার সন্দেহের কথা? যদি সেটা সত্যি না হয়? সুহানের তাহলে খুব আশাভঙ্গ হবে। আশাভঙ্গ একটি মানবিক ব্যাপার, সে আশাভঙ্গ ব্যাপারটি কী জানে না, কিন্তু দেখেছে। আশাভঙ্গ হলে সুহান দীর্ঘ সময় বিমুখে বসে থাকে। এটি অনেক বড় ব্যাপার। এবারে আশাভঙ্গ হলে সুহান কি সেটা সহ্য করতে পারবে?
ট্রিনির কপোট্রনে পরস্পরবিরোধী বেশ কয়েকটি চিন্তা খেলা করতে থাকে। সে দ্বিতীয় প্রজাতির রবোট, পরস্পরবিরোধী চিন্তায় অভ্যস্ত নয়। কিছুক্ষণের মাঝেই সে তার কপোট্রনের একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। কপোট্রনের সেই অংশটি তার শরীরের যে কয়টি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে তার একটি হচ্ছে ডান হাত। সুহান দেখতে পায়, ট্রিনির ডান হাতটি প্রথমে দ্রুত কাঁপতে থাকে, তারপর এক সময় হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নড়তে থাকে।
সুহান আগেও এ ধরনের ব্যাপার ঘটতে দেখেছে। ব্যাপারটির কৌতুককর অংশটি কখনো তার চোখ এড়ায় নি, এবারেও এড়াল না। সে তার বিচিত্র অস্ত্রটি শুইয়ে রেখে উচ্চৈঃস্বরে হাসতে শুরু করে।
০২.
সুহান মহাকাশযানের জানালায় গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে ভয়ঙ্কর ঝড়ো বাতাস। প্রথম সূর্য অস্ত গিয়েছে। দ্বিতীয় সূর্যটি মোটেও প্রখর নয়, চারদিকে কেমন এক ধরনের লালাভ আলো। বছরের এই সময়টাতে হঠাৎ করে এই গ্রহের আবহাওয়া খুব খাপছাড়া হয়ে ওঠে। ভয়ঙ্কর ঝড় হয়, উত্তপ্ত লাল বালু বাতাসে উড়তে থাকে। পাথর ভেঙে ভেঙে পড়ে, বাতাসে হু-হু করে বিচিত্র শব্দ হয় তখন। কেমন এক ধরনের মন খারাপ করা শব্দ। সুহান তখন মহাকাশযান থেকে বেশি বাইরে যায় না। চার দেয়ালের নিরাপদ আশ্রয়ে বসে বসে তার ছোট ছোট যন্ত্রগুলো দাঁড়া করায়। যন্ত্রগুলো সহজ এবং বিচিত্র। মূল তথ্যকেন্দ্রের কোনো তথ্য ব্যবহার না করে তৈরী। ট্রিনি এই যন্ত্রগুলো দেখে একই সাথে বিরক্ত এবং বিস্মিত হয়, তার কপোট্রনের সহজ যুক্তিতর্কে দুটোর মাঝে বিশেষ পার্থক্য নেই। বিরক্তির কারণটুকু সহজ। এই ধরনের ছেলেমানুষি যন্ত্রের কোনো ব্যবহারিক মূল্য নেই। ট্রিনির ধারণা, এগুলো তৈরি করা অহেতুক সময় নষ্ট করা। বিস্ময়টুকু অবশ্যি খাটি। মূল তথ্যকেন্দ্রের কোনো তথ্য ব্যবহার না করে এই যন্ত্রগুলো তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। যে পরিমাণ খুঁটিনাটি এবং মৌলিক জ্ঞানের প্রয়োজন, এই শতাব্দীতে মনে হয় কোনো মানুষ একসাথে সেই জ্ঞান অর্জন করে নি। চেষ্টা করলে সম্ভব নয় সেটি সত্যি নয়, কিন্তু চেষ্টা করার কোনো প্রয়োজন নেই বলে কেউ চেষ্টা করে নি। ট্রিনির মতে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এবং অর্থহীন জ্ঞান।
সুহান জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাইরের ঝড়ো হাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। উত্তপ্ত বালুরাশি শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে। ঘণ্টা দুয়েক আগে বাই ভার্বালে করে ট্রিনি পাহাড়ের দিকে উড়ে গেছে। এই রকম দুর্যোগের মাঝে ট্রিনির মতো একটি রবোটের বাইরে কী কাজ থাকতে পারে কে জানে। সুহান ব্যাপারটি নিয়ে খানিকক্ষণ ভেবে হাল ছেড়ে দেয়। হয়তো আবহাওয়ায় কোনো বড় পরিবর্তন আসছে, সে তার খোজ নিতে যাচ্ছে, গত ঝড়ে যেরকম হয়েছিল। কিংবা কে জানে হয়তো বিচিত্র কোনো নিশাচর প্রাণী এসেছে, গত বছর যেরকম এসেছিল। কিংবা কে জানে হয়তো পানির একটা বড় হ্রদ খুঁজে পেয়েছে, যেটা তারা অনেকদিন থেকে খুঁজছে।
সুহান মেঝেতে রাখা তার জেনারেটরটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মহাকাশযানের বেশ কয়েকটি জেনারেটর আছে। তার মাঝে একটির বেশ কিছু অংশ খুলে সে তার নিজের মতো করে একটি জেনারেটর তৈরি করেছে। বিশাল তারের কুণ্ডলী একটা শক্তিশালী চুম্বক ক্ষেত্রের মাঝে ঘুরছে। জেনারেটরটি ঘোরানো নিয়ে সমস্যা, যখন এ রকম ঝড়ো হাওয়া আসে সে জানালায় একটা টারবাইন লাগিয়ে জানালাটি খুলে দেয়। আজও দিয়েছে। ঝড়ো হাওয়ায় টারবাইনটি ঘুরছে, সেটি ঘোরাচ্ছে জেনারেটরটি, সেখান থেকে মোটামুটি একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ হচ্ছে। সুহান মেপে দেখল, ইচ্ছে করলে সে সত্যিকারের কিছু শক্তিশালী ব্যাটারি বিদ্যুতায়িত করে ফেলতে পারে। আপাতত তার সেরকম কোনো প্রয়োজনীয় কাজ করার ইচ্ছা নেই। একটা টেসলা কয়েল জুড়ে দিয়েছে, সেখান থেকে শব্দ করে নীলাভ বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে। খোলা জানালা দিয়ে উত্তপ্ত বালু এসে ঘরের মাঝে একটা ঘূর্ণি তৈরি করেছে, সুহান তার মাঝে দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকে।
দরজা খুলে যখন ট্ৰিনি ঘরে ঢুকেছে তখন বাতাসের ঘূর্ণিতে ঘরের জিনিসপত্র উড়ছে। বাতাসের প্রচণ্ড গজন ঘরের মাঝে গুমরে উঠছে। লাল বালুতে ঘর অন্ধকার, সুহানের সমস্ত শরীর, মাথার চুল, চোখের ভুরু পর্যন্ত ধুলায় ধূসর। ট্রিনিকে দেখে সুহান একটু লজ্জা পেয়ে যায়। জানালাটা ঠেলে বন্ধ করে দিতেই হঠাৎ ঘরের ভিতরে এক ধরনের নৈঃশব্দ্য নেমে আসে। সুহান ঘরের চারদিকে তাকিয়ে একটা কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, ট্রিনি, তুমি যদি একটু আগে আসতে তাহলে একটা অপূর্ব জিনিস দেখতে পেতে। টারবাইনের গিয়ারে বালু জমা হয়ে গিয়ারটা বন্ধ হয়ে গেল, না হয়—
সুহান।
চমৎকার বিদ্যুৎপ্রবাহ হয়। ইচ্ছে করলে ব্যাটারির সাথে—
সুহান—
কী হল?
সুহান, তুমি একটু স্থির হয়ে বস।
কেন ট্রিনি?
আমি তোমাকে খুব একটা জরুরি জিনিস বলব।
সুহান হঠাৎ একটু ভয় পেয়ে যায়। কাঁপা গলায় বলল, কী হয়েছে ট্রিনি, তুমি কী বলবে?
জিনিসটি বলার আগে আমি নিজের চোখে দেখে নিশ্চিত হতে গিয়েছিলাম।
কী জিনিস ট্রিনি?
আমাদের এই গ্রহে একটা মহাকাশযান নেমেছে সুহান। পৃথিবীর মহাকাশযান।
সুহান হতবাক হয়ে ট্রিনির দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে দেখে মনে হয় সে ঠিক বুঝতে পারছে না ট্রিনি কী বলছে।
ট্রিনি দুই হাতে সুহানকে শক্ত করে ধরে শান্ত গলায় বলল, সুহান, আমরা এই দিনটির জন্যে গত মোলো বছর থেকে অপেক্ষা করছি। আজকে সেই দিনটি এসেছে। পৃথিবীর মানুষ এসেছে এই গ্রহে। তারা তোমাকে বুকে করে আগলে নেবে সুহান।
সুহান তখনো বিস্ফারিত চোখে ট্রিনির দিকে তাকিয়ে আছে। ফিসফিস করে বলল, মানুষ?
হ্যাঁ সুহান।
সত্যিকারের মানুষ?
হ্যাঁ।
আমার মতো মানুষ? আমার মতো?
হ্যাঁ সুহান। তোমার মতো।
তুমি নিজের চোখে দেখেছ? নিজের চোখে?
হ্যাঁ সুহান, আমি নিজের চোখে দেখেছি।
সুহান কেমন একটা ঘোরের মাঝে ক্রোমিয়াম দেয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাত দিয়ে ধুলা পরিষ্কার করতেই ঝকঝকে আয়নার মতো স্বচ্ছ দেয়ালে তার প্রতিবিম্ব ভেসে ওঠে। সুহান অবাক হয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকে। কতকাল সে নিজেকে দেখে নি! তাকে দেখে কী কর, মানুষ? সে কাঁপা গলায় বলল, ট্রিনি।
বল সুহান।
আমার—আমার চুল কি খুব বেশি বড়?
না সুহান। মানুষের চুল এ রকম বড় হয়।
পোশাক? আমার পোশাক?
সুহান, তোমার পোশাক নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
কিন্তু আমার পুরো শরীর ঢেকে যেতে হবে না?
আমি তোমাকে এক টুকরা নিও পলিমার বের করে দেব।
তারা কি আমার ভাষায় কথা বলবে?
নিশ্চয়ই তারা তোমার ভাষায় কথা বলবে। পৃথিবীতে মানুষের একটি ভাষা। আমি তোমাকে সেই ভাষা শিখিয়েছি সুহান।
আমাকে দেখে পৃথিবীর মানুষ কী করবে ট্রিনি?
আমি নিশ্চিত; তারা হতবাক হয়ে যাবে। যখন জানবে তুমি একা একা এই গ্রহে বড় হয়েছ, তারা তোমাকে বুকে টেনে নেবে।
তুমি নিশ্চিত ট্রিনি?
আমি নিশ্চিত।
সুহান অনিশ্চিতের মতো ক্রোমিয়ামের স্বচ্ছ দেয়ালে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠিক তার মতো মানুষের সাথে দেখা হবে তার? সত্যি দেখা হবে?
০৩.
কিরি এবং লাইনা মহাকাশযানের ছোট ল্যাবরেটরিতে বসে আছে। ছোট একটা স্কাউটশিপ বাইরে থেকে কিছু পাথরের নমুনা এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে বাতাস নিয়ে এসেছে। নমুনাগুলো পরীক্ষা করে পৃথিবীর সাথে তুলনা করে সেগুলো একটি মনিটরে দেখানো হচ্ছিল। তুলনাটুকু বিস্ময়কর। জলীয় বাষ্পের অভাবটুকু ছাড়া হঠাৎ দেখে এটিকে পৃথিবী বলে ভুল করা সম্ভব। তাদের সামনে যে তথ্য রয়েছে সেটা দেখে মনে হয় পৃথিবীর মানুষ কোনোরকম পোশাক ছাড়াই এই গ্রহে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারবে। আশ্চর্য, এই তথ্যটুকু যখন দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করে দেখছিল তখন মাথার কাছে স্ক্রিনে মহাকাশযানের নিরাপত্তা রবোটের ধাতব কণ্ঠস্বর শোনা গেল, মহামান্য কিরি, মহাকাশযানের বাইরে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।
কিরি অবাক হয়ে বলল, কী বললে?
একজন মানুষ।
কিরি লাইনার দিকে তাকাল, তারপর অবাক হয়ে স্ক্রিনে নিরাপত্তা রবোটটির দিকে তাকিয়ে বলল, একজন মানুষ?
হ্যাঁ মহামান্য কিরি, একজন মানুষ। মনে হয় সে মহাকাশযানের ভিতরে আসতে চাইছে।
লাইনা চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে বলল, কোথায়? কোথায় মানুষ?
আমি স্ক্রিনে দেখাচ্ছি মহামান্য কিরি এবং মহামান্যা লাইনা।
হঠাৎ করে দেয়ালের বিশাল স্ক্রিনে একজন অনিন্দ্যসুন্দর কিশোরের মুখ ভেসে ওঠে। ঝড়ো বাতাসে তার চুল উড়ছে, তার পোশাক উড়ছে। উত্তপ্ত ধুলায় ধূসর হয়ে আছে তার মুখ, তার লম্বা কালো চুল। হাত দিয়ে মুখ থেকে লম্বা চুল সরিয়ে সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মহাকাশযানের দিকে। কালো চোখে এক আশ্চর্য মুগ্ধ বিস্ময়।
লাইনা কাঁপা গলায় বলল, মানুষ! একজন সত্যিকারের মানুষ।
হ্যাঁ।
কোথা থেকে এল?
নিশ্চয়ই বিধ্বস্ত মহাকাশযান থেকে। নিশ্চয়ই কোনোভাবে বেঁচে গিয়েছিল।
আর কেউ কি আছে?
মনে হয় না। থাকলে এই কিশোরটি একা এখানে আসত না।
তুমি বলছ এই কিশোরটি একা একা এই গ্রহে আছে?
আমি জানি না কিন্তু আমার তাই মনে হয়।
লাইনা উত্তেজিত হয়ে বলল, ওকে ভিতরে আসতে দাও। একা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে!
কিরি মুখ ঘুরিয়ে লাইনার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, মহাকাশযানের নীতিমালায় জীবন্ত প্রাণী নিয়ে অনেক রকম বাধানিষেধ আছে।
জীবন্ত প্রাণী? লাইনা চিৎকার করে বলল, এটি জীবন্ত প্রাণী নয় কিরি—এটি একজন মানুষ। সত্যিকারের মানুষ।
কিরি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, একজন মানুষ।
এক্ষুনি দরজা খুলে ওকে ভিতরে আসতে দাও।
কিরি লাইনার দিকে তাকিয়ে বলল, লাইনা, তুমি একটু শান্ত হও। আমি ওকে ভিতরে আনছি।
কিরি প্রতিরক্ষা রবোটকে বলল, কিউ-৪৬, তুমি এই মানুষটকে ভিতরে আসতে দাও। দুই নম্বর চ্যানেল দিয়ে কোয়ারেন্টাইন ঘরে। ওর শরীর স্ক্যান শুরু কর, রোগজীবাণু ভাইরাস কিছু থাকলে রিপোর্ট কর কিন্তু তাকে সেটা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা কোরো না। হয়তো এই গ্রহে থাকার জন্যে তার কিছু একটা মাইক্রোব দরকার আমরা যেটা জানি না।
ঠিক আছে মহামান্য কিরি।
সাথে সাথে লাইনা ল্যাবরেটরি ঘরের দরজার দিকে ছুটে যাচ্ছিল, কিরি তাকে থামাল। জিজ্ঞেস করল, লাইনা—
কী হল?
কোথায় যাও?
ছেলেটার সাথে দেখা করতে।
একটু দাঁড়াও লাইনা। তাকে কোয়ারেন্টাইন ঘরে আসতে দাও। প্রাথমিক একটা পরীক্ষা শেষ করে নিতে দাও।
কিন্তু–
হ্যাঁ, আরেকটা কথা লাইনা। ছেলেটার কথা এখন যেন জানাজানি না হয়। শুধু তুমি আর আমি।
কেন?
কারণ আছে লাইনা। মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে এ রকম ঘটনা আগে কখনো ঘটে নি। ব্যাপারটা আমাদের ঠিক করে সামলে নিতে হবে। বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠো না!
লাইনা আবার মাথা ঝাকিয়ে বলল, কিন্তু একজন মানুষ!
আমি জানি লাইনা! আমাকে আগে তার সাথে দেখা করতে দাও। আমাকে আগে তার সাথে কথা বলতে দাও। তার কোনো ভাষা আছে কি না আমরা জানি না, যদি না থাকে, আমি তবুও তার সাথে ভাব বিনিময় করতে পারব। তুমি পারবে না।
০৪.
সুহান দীর্ঘ সময় মহাকাশযানের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মহাকাশযানটি ঠিক তার মহাকাশযানের মতো। সে জানে কোনটি ভিতরে প্রবেশ করার দরজা। সে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে জানে কোথায় ক্যামেরাগুলো আছে, সে দাঁড়িয়েছে যেন ঠিক করে তাকে দেখতে পায়। সে তার চুল পাট করে এসেছিল, বড় একটা নিও পলিমার কাপড় সারা দেহে জড়িয়ে। ঝড়ো বাতাসে তার চুল এলোমেলো হয়ে গেছে, এখন তার পোশাক উড়ছে। মনে হয় সে নিজেও বুঝি উড়ে যাবে। যখন মনে হল সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, তখন হঠাৎ করে উপরের গোল দরজাটা খুলে গেল। সেখান থেকে প্রথমে একটা রবোটের মাথা উঁকি দিল এবং এক মুহূর্ত পরে একটা সিঁড়ি নিচে নেমে আসে।
সুহান সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায় ভিতরে চোখ ধাঁধানো আলো। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলল। বেশ কিছুক্ষণ লাগল তার অভ্যস্ত হতে। যখন হাত সরিয়ে চারদিকে তাকাল, দেখল একটা গোলাকার ঘরে সে কোঁ। ঘরের চারপাশে অনেক রকম যন্ত্রপাতি। উপরে একটি মনিটর। কিছু বাতি জ্বলছে এবং নিভছে, কোথা থেকে জানি তীক্ষ্ণ একটা শব্দ আসছে।
আমাকে স্ক্যান করছে, সুহান নিজেকে বোঝাল, আমাকে স্ক্যান করে দেখছে আমার শরীরে কোনো রোগজীবাণু আছে কি না। আমি জানি, নেই। এই গ্রহে প্রাণের বিকাশ হয়েছে অন্যভাবে।
সুহান চারদিকে তাকাল। নিশ্চয়ই মানুষেরা এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। পৃথিবীর মানুষের ভাষা তো একটিই। তার সাথে কথা বলতে কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়।
হঠাৎ করে সামনের স্বচ্ছ দরজাটি খুলে গেল। সুহানের বুকে রক্ত ছলাৎ করে ওঠে। উত্তেজনায় তার বুক ধকধক করতে থাকে। তাহলে কি সে সত্যিই দেখবে একজন মানুষ? পৃথিবীর মানুষ? সত্যিকারের মানুষ? সুহান বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে, দেখে ঠিক একজন খোলা দরজা দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে। দীর্ঘ দেহ, উজ্জ্বল চোখ, কপালের দুপাশে রুপালি রঙের ছোঁয়া। সুহান হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, কখনো কি সে কল্পনা করেছিল একজন মানুষকে সে সত্যি দেখতে পাবে?
মানুষের সাথে প্রথম দেখা হলে কী বলরে সব ঠিক করে রাখা আছে। সুহান মনে মনে সম্ভাষণটি কয়েকবার বলে একটু এগিয়ে যায়, তখন মানুষটি কোমল গলায় বলল, আমি কিরি। এই মহাকাশযানের দলপতি।
সুহান অবাক হয়ে কিরির দিকে তাকাল, তার কথা বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় নি। ঠিক তার ভাষাতেই কথা বলেছে, কিন্তু লোকটির কথায় কিছু একটা রয়েছে যেটাকে হঠাৎ করে খুব পরিচিত মনে হয়, সেটা কী সে ধরতে পারল না। কিরি একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ?
সুহান মাথা নাড়ল, একটা ভয়ঙ্কর সন্দেহ তার মাথায় উঁকি দিতে থাকে।
আমি তোমাকে আমাদের মহাকাশযানের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
সুহান বিস্ফারিত চোখে কিরির দিকে তাকিয়ে থাকে, হঠাৎ করে সে বুঝতে পেরেছে। কিরি মানুষ নয়। কিরি একজন রবোট। সে কেমন করে বুঝতে পেরেছে জানে না কিন্তু তার কোনো সন্দেহ নেই। খুব বড় ধাক্কা খেল সুহান, তীক্ষ্ণ চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল কিরির দিকে, তারপর প্রায় ভয় পাওয়া গলায় বলল, তুমি রবোট। এখানে মানুষ নেই? আমি মানুষের সাথে কথা বলতে চাই।
কিরির মুখ বিবর্ণ হয়ে যায় সাথে সাথে। কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি কেমন করে জান আমি রবোট?
আমি জানি। সুহান প্রায় চিৎকার করে বলল, তোমাদের এখানে মানুষ নেই? মানুষ?
সুহানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কিরি আহত গলায় বলল, তুমি কেমন করে বুঝতে পারলে আমি রবোট? আমি দশম প্রজাতির রবোট আমার সাথে মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। আশ্চর্য!
আমি সারা জীবন রবোটের সাথে থেকেছি, বর্বোট দেখলেই আমি বুঝতে পারি।
কেমন করে?
আমি জানি না, কিন্তু আমি বুঝতে পারি।
তোমার নাম কী ছেলে? তুমি কি একা এখানে?
হ্যাঁ, আমি একা। আমার সত্যিকার নাম আমি জানি না, ট্ৰিনি আমাকে সুহান ডাকে।
ট্রিনি?
হ্যাঁ, ট্রিনি। একজন রবোট, সে আমাকে বড় করেছে।
ও।
সুহান আবার একটু অস্থির হয়ে কিরির দিকে তাকাল। বলল, কোনো মানুষ নেই এখানে? মানুষ?
আছে। কিরি অন্যমনকের মতো বলল, আছে।
আমি একজন মানুষ দেখতে চাই।
দেখবে। অবশ্যি দেখবে। এস আমার সাথে।
সুহান জীবনের প্রথম যে মানুষটি দেখল সে লাইনা। আলোকোজ্জ্বল একটি ঘরের মাঝখানে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তার চারপাশে অসংখ্য যন্ত্রপাতি, সেগুলো নিয়ে সুহানের বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই।
লাইনা একটা দরজা খুলে ভিতরে এসে ঢুকল। ঘরের মাঝখানে সুহানকে দেখে সে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। একজন মানুষের দেহে এত রূপ থাকতে পারে এবং সেই মানুষটি সেই রূপ সম্পর্কে এত উদাসীন থাকতে পারে সে কখনো কল্পনা করে নি। এই অসম্ভব রূপবান মানুষটি একা একা এই নির্জন গ্রহে বড় হয়েছে, মানুষের ভালবাসা দূরে থাকুক, তাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত অনুভব করে নি, এই প্রথমবার সে একজন মানুষকে দেখেছে, চিন্তা করে হঠাৎ লাইনার বুকের মাঝে জানি কেমন করে ওঠে। কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিয়ে সে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে যায়। সুহানের কাছাকাছি গিয়ে নিজের হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলল, তুমি নিশ্চয়ই সুহান। আমি লাইনা।
মানুষের সাথে দেখা হলে কী করতে হয় সেটি সুহান থেকে ভালো করে সম্ভবত কেউ জানে না। অসংখ্যবার ব্যাপারটি সে কল্পনা করেছে কিন্তু লাইনার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে তার সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। সুহান জানে, একজন মানুষ যখন অন্য একজন মানুষের দিকে তার হাত এগিয়ে দেয়, সেই হাত স্পর্শ করে ছেড়ে দিতে হয় কিন্তু সে লাইনার হাত ছেড়ে দিল না। দুই হাতে সেটিকে ধরে রেখে অনেকটা বিভ্রান্তের মতো লাইনাকে নিজের কাছে টেনে আনল। লাইনার মুখমণ্ডল স্পর্শ করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে হঠাৎ প্রায় আর্তস্বরে চিৎকার করে বলে উঠল, তুমি মেয়ে!
লাইনা হেসে বলল, হ্যাঁ, আমি মেয়ে।
সুহান ফিসফিস করে বলল, আমি ছেলে।
আমি জানি।
আমি কখনো মেয়ে দেখি নি।
আমি তাই ভাবছিলাম। তুমি আগে কখনো অন্য মানুষ দেখ নি।
আমি তোমাকে দেখি?
লাইনা একটু অবাক হয়ে বলল, দেখ।
সুহান সাথে সাথে লাইনাকে কাছে টেনে আনে, দুই হাতে তার মুখটি স্পর্শ করে তার চোখের দিকে তাকায়। হঠাৎ সে কেমন জানি শিউরে উঠে বলল, মানুষের চোখ! কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!
কেন সুহান? আশ্চর্য কেন?
আমি জানি না কেন, কিন্তু দেখ কী অপূর্ব! কী গভীর! চোখের দিকে তাকালে মনে হয় আমি বুঝি হারিয়ে যাব। কী রকম একটা রহস্য।
লাইনা সুহানের তীব্র চোখের দৃষ্টির সামনে হঠাৎ কেমন জানি অসহায় অনুভব করতে থাকে, বুকের মাঝে এক ধরনের আলোড়ন হতে থাকে। কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, সুহান–
বল।
তুমি তোমার নিজের চোখ দেখ নি?
হ্যাঁ দেখেছি। কিন্তু নিজের চোখে তো নিজের কাছে কোনো রহস্য নেই। আমি তো আমাকে জানি। কিন্তু আরেকজনের চোখে রহস্য আছে। আমি তোমাকে আগে কখনো দেখি নি। কিন্তু তোমার চোখের ভিতরে তাকালে মনে হতে থাকে আমি বুঝি তোমাকে কত কাল থেকে চিনি। মনে হয়, তোমার ভিতরে কত বিস্ময়।
সুহান কথা থামিয়ে প্রায় হতবাক হয়ে লাইনার দিকে তাকিয়ে থাকে।
লাইনা বিব্রত হয়ে বলল, সুহান—
আমার আমার ইচ্ছে করছে—
কী?
আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে চেপে ধরি।
লাইনা একটু কেঁপে উঠল। সুহান আবার কাতর গলায় বলল, লাইনা, তোমাকে আরেকটু দেখি?
লাইনা কেমন জানি ভয় পাওয়া চোখে সুহানের দিকে তাকাল। সুহান ঠিক কী বলতে চাইছে সে বুঝতে পারল না, তবু অনিশ্চিতের মতো বলল, দেখ।
সুহান ধীরে ধীরে তার হাত তুলে লাইনার মুখে, কপালে, গালে স্পর্শ করে। ঠোঁটে হাত বুলিয়ে তার চুলের মাঝে আঙুল প্রবেশ করিয়ে খুব সাবধানে চুলগুলো দেখে। তারপর লাইনা কিছু বোঝার আগে তাকে অনাবৃত করতে শুরু করে। লাইনা সুহানকে বাধা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে গিয়ে থেমে গেল। সুহান অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে কোনো কামনা নেই। শুধু কৌতূহল।
লাইনা তাকে বাধা দিল না।
০৪. মানুষ ও অমানুষ
লাইনা সুহানকে কোয়ারেন্টাইন ঘরে রেখে কিরির কাছে এসেছে। কিরি তার সামনের স্ক্রিনটি সুইচ টিপে বন্ধ করে শান্ত গলায় বলল, ছেলেটি এখন কী করছে লাইনা?
কিছু করছে না। মিডি রবোট তাকে পরীক্ষা করে দেখছে। একটু রক্ত নেবে, টিস্য নেবে, পরীক্ষা করে দেখবে।
ও।
কী আশ্চর্য একটা ব্যাপার কিরি! তুমি চিন্তা করতে পার একজন সত্যিকার মানুষ থাকে এই গ্রহে!
হ্যাঁ।
তার মহাকাশযান যখন বিধ্বস্ত হয়েছিল তখন তাকে মায়ের গর্ভ থেকে ট্রিনি—
জানি।
লাইনা একটু অবাক হয়ে বলল, কেমন করে জান?
আমি এখানে বসে তোমাদের দেখছিলাম।
লাইনা চমকে কিরির দিকে তাকাল। হঠাৎ অনুভব করে তার মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছে। কোনোরকমে নিজেকে সংযত করে বলল, এই ছেলেটি একা একা ষোলো বছর এই গ্রহে কাটিয়েছে। তুমি চিন্তা করতে পার?
কিরি কেমন জানি রুক্ষ গলায় বলল, পারি। তোমরা যখন শীতলঘরে ঘুমিয়েছিলে তখন পঞ্চাশ বছর আমি একা একা ছিলাম।
কিন্তু—
কিন্তু কী?
প্রথমত, তুমি সত্যিকার অর্থে একা ছিলে না। তুমি জানতে এই মহাকাশযানে আরো অনেক মানুষ আছে। দ্বিতীয়ত–
দ্বিতীয়ত?
দ্বিতীয়ত, তুমি মানুষের মতো কিন্তু নও। তোমাকে এ ধরনের পরিস্থিতির জন্যে তৈরি করা হয়েছে।
কিরি অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর লাইনার দিকে তাকিয়ে বলল, এই ছেলেটা যে এখানে আছে সেটা কতজন জানে?
আমি আর তুমি।
চমৎকার। আমি চাই সেটা যেন আর কেউ না জানে।
লাইনা জিজ্ঞাসু চোখে বলল, কেন?
ছেলেটা আমাদের জন্যে অনেক বড় সৌভাগ্য বয়ে এনেছে লাইনা। তাকে আমাদের দরকার।
কিরি ঠিক কী বলতে চাইছে বুঝতে পারল না। লাইনা অনিশ্চিতের মতো বলল, হ্যাঁ। সুহানেরও আমাদের দরকার। মানুষের সঙ্গ পাবার জন্যে সে একেবারে খ্যাপার মতো হয়ে আছে।
কিরি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি ঠিক কী বলছি তুমি বুঝতে পার নি লাইনা।
হঠাৎ করে লাইনার বুক কেঁপে ওঠে। কিরির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ কিরি?
আমি বলতে চাইছি ছেলেটাকে আমাদের দরকার। তার শরীরটাকে।
মানে?
আমরা এই গ্রহে বসতি স্থাপন করতে এসেছি। আমাদের কাছে রয়েছে প্রায় তিন হাজার মানুষের জ্বণ। তারা এই গ্রহে বাঁচতে পারবে কিনা সেটা নির্ভর করবে কিছু তথ্যের ওপর। এই ছেলেটা না হলে সেই তথ্য বের করতে আমাদের এক যুগ লেগে যেত। এখানে আর আমাদের এক যুগ অপেক্ষা করতে হবে না। ছেলেটার দেহ ব্যবচ্ছেদ করে কয়েক ঘণ্টার মাঝে সব তথ্য পেয়ে যাব।
তুমি—তুমি বলছ দেহ ব্যবচ্ছেদ করে?
হ্যাঁ। তার শরীরের প্রত্যেকটা কোষ মূল্যবান লাইনা। তার প্রত্যেকটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মূল্যবান।
লাইনার হঠাৎ কেমন যেন গা গুলিয়ে আসে। পিছনে সরে এসে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি সুহানকে মেরে ফেলার কথা বলছ?
হ্যাঁ, লাইনা।
লাইনা বিস্ফারিত চোখে কিরির দিকে তাকিয়ে থাকে। কিরির ভাবলেশহীন মুখ, স্থির চোখ দেখে হঠাৎ তার মনে হতে থাকে সে বুঝি একটি দানবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটি অমানুষ পিশাচের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, তুমি নিশ্চয়ই সত্যি সত্যি তাকে মেরে ফেলার কথা বলছ না?
কিরি তার প্রত্যেকটা শব্দে জোর দিয়ে বলল, আমি তাকে সত্যি মেরে ফেলার কথা বলছি লাইনা।
কিন্তু সে একজন মানুষ।
কিরি একটু অবাক হয়ে লাইনার দিকে তাকিয়ে বলল, জৈবিক হিসেবে সে মানুষ হতে পারে কিন্তু সত্যিকার অর্থে সে তো মানুষ নয়। পৃথিবীর কোনো তথ্যকেন্দ্রে তার নাম নেই, এই গ্রহের একটি বন্যপ্রাণীর সাথে তার কোনো পার্থক্য নেই।
লাইনা চিৎকার করে বলল, কী বলছ তুমি? কী বলছ?
এখন তুমি সম্ভবত বুঝতে পারছ, আমাকে একজন রবোটকে কেন মহাকাশযানের দলপতি করা হয়েছে।
না। লাইনা দাতে দাত ঘষে বলল, বুঝতে পারছি না।
তুমি বুঝতে পারছ কিন্তু স্বীকার করতে চাইছ না। সুহান ছেলেটির জন্যে তোমার মতো আমারও মমতা আছে লাইনা। কিন্তু আমি আমার মমতাকে পাশে সরিয়ে আমার দায়িত্বে ফিরে যেতে পারি। আমার দায়িত্ব মানুষের জন্যে একটা নতুন বসতি তৈরি করা। রবোটের জন্যে নয়—মানুষের জন্যে। এই গ্রহে সেটি সম্ভব কি না কেউ জানত না। কিন্তু এখন আমি জানি সেটা সম্ভব হবে। সুহানের শরীর থেকে আমরা অমূল্য সব তথ্য পাব। জণগুলো বিকাশের সময় আমরা সেই তথ্য ব্যবহার করব
লাইনা দুই হাতে তার কান চেপে ধরে চিৎকার করে বলল, তুমি চুপ কর। আমি আর শুনতে চাই না।
কিরি থেমে গেল। তার মুখে হঠাৎ এক ধরনের বিষাদের ছায়া পড়ে। প্রায় শোনা যায়
এ রকম স্বরে বলল, রবোটকে আসলে রবোটের মতোই তৈরি করতে হয়। রবোর্টকে মানুষের মতো তৈরি করা খুব বড় ভুল। তাহলে রবোর্টকে মানুষের দুঃখ-কষ্টের ভিতর দিয়ে যেতে হয়, কিন্তু মানুষ তবুও কখনো রবোটকে বুঝতে পারে না। কখনো না।
লাইনা হিংস্র গলায় বলল, দুঃখ-কষ্ট? যন্ত্রণা? কপোট্রনে ভোল্টেজের অসামঞ্জস্য আর দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা এক জিনিস নয়। তুমি মানুষের অনুভূতির কথা এনো না কিরি। মানুষের অনুভূতির কথা বলে তুমি মানুষকে অপমান কোরো না।
আমি দশম প্রজাতির বোট। আমি মানুষের এত কাছাকাছি যে–
মানুষের কাছাকাছি? লাইনার মুখ বিদ্রুপে বিকৃত হয়ে যায়, বাচ্চা একটা ছেলে তোমার মুখের প্রথম কথাটি শুনে বুঝে ফেলেছে তুমি রবোট, আর তুমি দাবি কর তুমি মানুষের কাছাকাছি? লজ্জা করে না কথাটি মুখে আনতে?
কিরির মুখ অপমানে লাল হয়ে ওঠে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি আমাকে ঘৃণা কর লাইনা?
না। আমি তোমাকে ঘৃণা করি না। তুমি মানুষ হলে করতাম। কিন্তু একটা যন্ত্রকে ঘৃণা। করা যায় না।
তুমি—তুমি আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছ?
না–যন্ত্রকে অপমান করা যায় না।
কিরির চেহারা হঠাৎ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। অনেক কষ্টে সে নিজেকে শান্ত করে বলল, লাইনা, তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাও। যাবার আগে শুধু একটি জিনিস শুনে যাও। হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, আমি একটা যন্ত্র। পৃথিবীর মানুষের জন্যে এই বসতি তৈরি করায় আমার কোনো স্বার্থ নেই। আমাকে তুমি ঘৃণা করবে, আমি জানি শুধু তুমি নও, এই মহাকাশযানের প্রত্যেকটা মানুষ আমাকে ঘৃণা করবে। কিন্তু এই গ্রহে মানুষের বসতি যদি গড়ে ওঠে সেটি সম্ভব হবে আমার জন্যে। কারণ আমি আবেগকে পাশে সরিয়ে একটি প্রাণীকে হত্যা করে তার কাছ থেকে অমূল্য তথ্য বের করব। সেই প্রাণীটি তোমাদের কাছে মানুষ মনে হলেও সে আসলে মানুষ নয়। মূল তথ্যকেন্দ্রে যার সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই সে পৃথিবীর মানুষ নয়, পৃথিবীর তার জন্যে কোনো দায়িত্ব নেই। এই সহজ এবং আপাতদৃষ্টিতে নিষ্ঠুর একটি সত্যকে তোমরা গ্রহণ করতে পার না বলে তোমাদের এই মহাকাশযানের দলপতি করা হয় নি। এই মহাকাশযানের দলপতি করা হয়েছে আমাকে—
লাইনা বাধা দিয়ে শ্লেষের সাথে বলল, মহাকাশযানের দলপতি মহামান্য কিরি—
কিরি লাইনার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। লাইনা চাপা স্বরে বলল, সম্মানিত দলপতি, আমি কি যেতে পারি?
কিরি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, যেতে পার।
লাইনা ঝড়ের মতো ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
০২.
লাইনা মাথা নিচু করে মহাকাশযানের করিডোর ধরে হাঁটছে। দুই চোখ অশ্রুরুদ্ধ, ভয়ঙ্কর এক ধরনের আক্রোশে তার সমস্ত অনুভূতি আচ্ছন্ন হয়ে আছে। করিডোরের শেষ মাথায় তার ইঞ্জিনিয়ার গ্রুপের সাথে দেখা হল। লাইনাকে থামিয়ে অবাক হয়ে বলল, লাইনা, তোমার কী হয়েছে?
কিছু হয় নি।
নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। বল আমাকে।
গ্রুসো। মহাকাশযানের দলপতির ক্ষমতা কতটুকু?
গ্রুসো অবাক হয়ে বলল, তুমি এ কথা কেন জিজ্ঞেস করছ?
আমি জানতে চাই। কতটুকু?
অনেক।
সে কি মানুষ হত্যা করতে পারে?
গ্রুসসা চমকে উঠে লাইনার দিকে তাকাল, কোনো কথা বলল না। লাইনা আবার জিজ্ঞেস করল, পারে?
আমি যতদূর জানি, পারে। মহাকাশযানের দলপতির সেই ক্ষমতা আছে। তাকে পরে সে জন্যে জবাবদিহি করতে পারে কিন্তু প্রয়োজনে তার প্রাণদণ্ড দেয়ার অধিকার আছে। কিন্তু লাইনা, তুমি কেন এ কথা জিজ্ঞেস করছ?
কারণ আছে গ্রুসো।
কী কারণ?
আমি তোমাকে বলতে পারব না গ্রুসো। তুমি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না। তোমার ভালোর জন্যে বলছি।
লাইনা গ্রুসোকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, সে তার হাত ধরে বলল, আমি তোমাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি, লাইনা?
লাইনা গ্রুসোর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ম্লানমুখে বলল, না, সো। আমাকে এখন আর কেউ সাহায্য করতে পারবে না।
লাইনা কোয়ারেন্টাইন ঘরটির সামনে এক মুহূর্ত দাঁড়াল। একটু আগে সে যখন তাকে এই ঘরে রেখে গিয়েছিল তখন সে ভেবেছিল, সুহান তাদের অতিথি। এখন সে জানে সুহান অতিথি নয়, সুহান তাদের বন্দি।
লাইনা হাতলে হাত দিতেই ঘরের দরজাটি খুলে গেল। সে মহাকাশযানের দ্বিতীয় অধিপতি, তার যে কোনো ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি রয়েছে। লাইনা ভিতরে ঢুকে সুহানকে না দেখে চাপা গলায় ডাকল, সুহান—
বল।
তুমি কোথায়?
এই তো এখানে। সুহান একটা পর্যবেক্ষণ টেবিলের নিচে অসংখ্য যন্ত্রপাতির ভেতর থেকে বের হয়ে এল। তার হাতে চৌকোনো একটা বাক্স, সেখান থেকে নানা ধরনের তার এবং অপটিক্যাল ফাইবার ঝুলছে। লাইনা চিৎকার করে বলল, সাবধান! হাই ভোল্টেজ–
ভয় নেই। আমি অফ করে দিয়েছি।
অফ করে দিয়েছ? লাইনা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সুহানের দিকে তাকাল, মনে হল সে ঠিক বুঝতে পারছে না সুহান কী বলছে। অবাক হয়ে বলল, কেমন করে করলে?
ভিতরে দুটি মাইক্রো সুইচ আছে। দেখেই বোঝা যায় হাই ভোল্টেজের জন্যে তৈরী, বিদ্যুৎ অপরিবাহী আস্তরণ খুব বড়। প্রথমটার তিন নম্বর পিন—
তুমি—তুমি কেমন করে জান?
দেখলেই তো বোঝা যায়। টেবিলটা উপরে উঠছিল না, নিশ্চয়ই স্টেপিং মোটরে গোলমাল। একা বসেছিলাম, তাই ভাবলাম ঠিক করে দিই।
ঠিক করে দিই? লাইনা তখনো বুঝতে পারছিল না, অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, তুমি পর্যবেক্ষণ টেবিলের কন্ট্রোল ঠিক করে দিয়েছ?
পুরোটা এখনো ঠিক হয় নি। একটা বিদ্যুৎ পরিবাহী তার হলে—
তুমি বলতে চাও, কেন্দ্রীয় তথ্যকেন্দ্রের কোনো সাহায্য ছাড়া তুমি জিনিস ঠিক করতে পার?
সুহান একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমি জানি সেভাবে ঠিক করার কথা নয়, অযথা সময় নষ্ট হয়। ট্ৰিনি আমাকে বলেছে। মানুষদের অন্যভাবে কাজ করার কথা। কিন্তু আমার এভাবে কাজ করতে ভালো লাগে। একটা কৌতূহল হয়—
লাইনা তখনো ব্যাপারটি ধরতে পারছিল না। অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, তুমি বলতে চাও কোন জিনিস কীয়ে কাজ করে তুমি জান?
মহাকাশযানের যেসব জিনিসপত্র আছে সেগুলো মোটামুটি জানি। আমার সময়ের অভাব ছিল না। তাই শিখেছি–
কিন্তু সেটা তো অবিশ্বাস্য! সেটা অসম্ভব।
আর আমাকে করতে হবে না। সুহান এক গাল হেসে বলল, এখন আমি মানুষের সাথে থাকব, মানুষের মতো ব্যবহার করব। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হবে, কিন্তু
লাইনার মুখ হঠাৎ রক্তহীন হয়ে যায়। কাতর গলায় বলল, সুহান–
কী? আমি তোমাকে একটা কথা বলতে এসেছি সুহান। কী কথা?
আমি কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না। খুব জরুরি কথা। বেশি সময় নেই, খুব তাড়াতাড়ি বলতে হবে।
সুহান লাইনার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কেমন একটি অশুভ আতঙ্ক অনুভব করতে থাকে।
তুমি জান, আমাদের দলপতি একটি রবোট?
জানি। দশম প্রজাতির রবোট। আমাদের ধারণা ছিল দশম প্রজাতির রবোট ঠিক মানুষের মতো। কিন্তু একটু আগে আমি আবিষ্কার করেছি দশম প্রজাতির রবোটে একটি খুব বড় ত্রুটি আছে।
কী ত্রুটি?
যে মানুষ সম্পর্কে তথ্য মূল তথ্যকেন্দ্রে নেই তাকে সে মানুষ হিসেবে গণ্য করে না।
তার মানে আমি–
হ্যাঁ, তোমাকে সে মানুষ হিসেবে মেনে নেয় নি। সে এখন তোমাকে তোমাকে লাইনা মুখ ফুটে কথাটি উচ্চারণ করতে পারে না।
আমাকে কী?
তোমাকে মেরে ফেলতে চায়।
মেরে ফেলতে চায়? সুহান এমনভাবে লাইনার দিকে তাকাল যেন লাইনার কোনো কথা বুঝতে পারছে না। অনেকটা অন্যমনস্কর মতো বলল, আমাকে মেরে ফেলতে চায়? আমাকে?
হা। তোমার শরীরে নাকি অনেক মূল্যবান তথ্য আছে। সেই তথ্য ব্যবহার করে এই গ্রহে মানুষের বসতি হবে।
সুহান আবার বিড়বিড় করে বলল, আমাকে মেরে ফেলবে?
হ্যাঁ, সুহান। তোমার খুব বড় বিপদ।
সুহানের মুখে খুব ধীরে ধীরে এক আশ্চর্য বিষণ্ণতা এসে ভর করে। তার চোখ অশ্রুরুদ্ধ হয়ে আসে। সে কেমন এক ধরনের অপ্রকৃতিস্থ দৃষ্টিতে লাইনার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে বলল, তোমরা, মানুষেরা সেই রবোটের কথা মেনে নিয়েছ।
লাইনা সুহানের কাঁধে হাত রেখে বলল, না সুহান, আমরা মেনে নিই নি। আমি তাই তোমার কাছে এসেছি। তোমাকে এক্ষুনি পালিয়ে যেতে হবে।
পালিয়ে যেতে হবে?
হ্যাঁ, যেভাবে পার। যত দূরে পার। কিরি দশম প্রজাতির রবোট। তার ভয়ঙ্কর ক্ষমতা সুহান। আমরা এখন তার হাতের মুঠোয়। আমাদের একটু সময় দাও। পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করে আমরা কিছু একটা ব্যবস্থা করব। যতদিন সেটা করতে না পারছি তুমি লুকিয়ে থাকবে। তুমি এখানে আসবে না–
আমি এখানে আসব না? আমি মানুষ কিন্তু আমি মানুষের কাছে আসতে পারব না?
আমি—আমি খুব দুঃখিত সুহান।
সুহান কেমন জানি হাহাকার করে বলল, আমি একজন মানুষ, তবু একটি রবোটের জন্যে আমি মানুষের কাছে আসতে পারব না?
আমি খুব দুঃখিত সুহান। খুব দুঃখিত। কিন্তু এখন আমাদের কিছু করার নেই। তোমাকে এক্ষুনি পালিয়ে যেতে হবে। এক্ষুনি। আমি তোমাকে এখন মহাকাশযানের দরজা খুলে বের হয়ে চলে যেতে দিতে পারব। কিন্তু পরে কী হবে আমি জানি না। তুমি এক্ষুনি আমার সাথে আস। এই মুহূর্তে–
সুহান লাইনার দিকে ঘুরে তাকাল। হঠাৎ তাকে আঁকড়ে ধরে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, তুমি যাবে আমার সাথে?
আমি?
হ্যাঁ। তুমি। যাবে?
লাইনার মুখ গভীর বিষাদে ঢেকে যায়। সে এই অনিন্দ্যসুন্দর কিশোরটির মুখ নিজের কাছে টেনে এনে তার ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করে বলল, সুহান, বিশ্বাস কর, যদি সম্ভব হত আমি তোমার সাথে যেতাম। কিন্তু এই মুহূর্তে তোমাকে নিরাপদে এখান থেকে বের করে। দিতে পারব শুধু আমি। সেটা আমি শুধু করতে পারি ভিতরে থেকে–
তাহলে আমিও যাব না। রবোর্টটাকে আমি–
না সুহান, তুমি যাবে। তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। যেভাবে হোক তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। একটা রবোটের হাতে আমি তোমাকে মরতে দেব না। কিছুতেই মরতে দেব না–
সুহান লাইনার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে পানি টলটল করছে। সে আগে কখনো মানুষকে কাঁদতে দেখে নি কিন্তু দেখেই সে বুঝতে পারল।
মহাকাশযানের দরজায় লাইনা তার গোপন সংখ্যা ব্যবহার করে দরজা খুলে দিল। মহাকাশযানের দ্বিতীয় অধিপতি হিসেবে তার দুবার এই সংখ্যা ব্যবহার করার অনুমতি আছে। বিথ কাউন্সিলে তাকে এর জন্যে জবাবদিহি করতে হবে। যদি জবাবদিহি তাদের মনঃপূত না হয়, তার সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়ে তাকে চিরদিনের জন্যে কোনো একটি ভূগর্ভস্থ শীতলঘরে সরিয়ে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু এই মুহুর্তে লাইনার সেসব কথা মনে পড়ল না। সে মহাকাশযানের গোল জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, প্রচও ঝড়ো বাতাসে সুহান হেঁটে যাচ্ছে। তার চুল উড়ছে, কাপড় উড়ছে বাতাসে। সুহান মুখ নিচু করে হাঁটছে। লাইনা দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু সে নিশ্চিতভাবে জানে সুহানের দুই চোখে পানি।
০৩.
নিজের ঘরে ফিরে এসে লাইনা আবিষ্কার করে সেখানে কিরি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। লাইনাকে দেখে সে ক্রুদ্ধ গলায় হিসহিস করে বলল, সুহান কোথায়?
নেই।
কোথায়?
আমি তাকে তার গ্রহে ফিরে যেতে দিয়েছি।
কেমন করে যেতে দিয়েছ?
আমি আমার গোপন সংখ্যা ব্যবহার করেছি।
গোপন সংখ্যা ব্যবহার করেছ? কিরি মাথা নেড়ে বলল, তার ফল কী হতে পারে তুমি জান?
জানি।
আমি তোমাকে কী বলেছিলাম তোমার মনে আছে?
মনে আছে।
তুমি শুধু গোপন সংখ্যা ব্যবহার কর নি, সেটা ব্যবহার করেছ আমার আদেশ অমান্য করার জন্যে। তুমি জান আমার আদেশ অমান্য করা প্রথম মাত্রার অপরাধ?
সম্ভবত।
তুমি জান প্রথম মাত্রার অপরাধের শাস্তি কী?
লাইনা স্থির চোখে কিরির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমাকে শাস্তি দেবার ভয় দেখিয়ো না।
আমার কথার উত্তর দাও। তুমি জান?
জানি।
তুমি জান তোমাকে সেই শাস্তি দিতে আমার কপোট্রনের একটি ফ্রিকোয়েন্সিও এতটুকু নড়বে না? একটি সাইকেল বিচ্যুত হবে না?
আমি জানি কিরি।
কিরি এক পা এগিয়ে এসে লাইনার দিকে তাকায়। ঘরের আলো তির্যকভাবে তার মুখে পড়ছে। ভয়ঙ্কর ভাবলেশহীন একটা মুখ। হঠাৎ তার চোখ থেকে সবুজ এক ধরনের আলো বের হতে ব্রু করে। তাকে দেখাতে থাকে অশরীরী একটা প্রাণীর মতো। তার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ লাইনা এক ধরনের অশুভ আতঙ্ক অনুভব করতে শুরু করে।
কিরি লাইনার কাছে এসে এক হাতে লাইনার মাথার পিছনে ধরে এক ধরনের অপার্থিব শক্তি প্রয়োগ করে নিজের কাছে টেনে আনে। তার মুখের কাছে নিজের মুখ নামিয়ে এনে হিসহিস করে বলল, আমার শরীর ইস্পাত, ক্রোমিয়াম আর ঝিলনিয়ামের একটা সঙ্কর ধাতুর তৈরী। উপরে বায়োপলিমারের একটা পাতলা আবরণ আছে। আমি ইচ্ছে করলে এক হাতে একটা লোহার বিম ভেঙে দু টুকরা করে ফেলতে পারি। তোমার খুলি ইচ্ছে করলে আমি ডিমের খোসার মতো দাঁড়িয়ে দিতে পারি। ইচ্ছে করলে আমার আঙুল থেকে কয়েক মিলিয়ন ভোল্ট বের করে তোমার এই সুন্দর শরীরকে দূষিত অঙ্গারে পাল্টে দিতে পারি। ইচ্ছে করলে তোমার শরীর আমি ছিন্নভিন্ন করে উড়িয়ে দিতে পারি। সে জন্যে আমাকে কারো কাছে জবাবদিহি পর্যন্ত করতে হবে না। সেটা করতে আমার কপোট্রনে একটি সাইকেলও বিচ্যুত হবে না।
লাইনা ভয়ার্ত চোখে কিরির দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো কথা বলল না।
কিন্তু আমি তোমাকে এই মুহূর্তে শেষ করব না। কেন জান?
লাইনা মাথা নাড়ল, সে জানে না।
আমি তোমার হৃদয়হরণকারী সুহানের শরীরে একটি পালসার প্রবেশ করিয়ে দিয়েছি। প্রতি তিন মিলি সেকেন্ডে একবার সেই পালসার বার মেগা হার্টজের একটা সঙ্কেত পাঠাচ্ছে। আমি জানি সে কোথায় যাচ্ছে। আমি যখন ইচ্ছে তাকে ধরে আনতে পারব। আমি চাই যখন তাকে আমি ধরে আনি তুমি যেন কাছাকাছি থাক।
লাইনা ফিসফিস করে বলল, কেন সেটা তুমি চাও?
তুমি জানতে চাও কেন?
হ্যাঁ।
কারণ দশম প্রজাতির রবোট মানুষের খুব কাছাকাছি। মানুষের যেরকম ক্রোধ হয়, ভয়ঙ্কর ঈর্ষা হয়, আমারও সেরকম ভয়ঙ্কর ক্রোধ হয়, ঈর্ষা হয়। মানুষ যেরকম প্রতিশোধ নেয় সেরকম প্রতিশোধ নিই–
কিসের প্রতিশোধ?
কিরি ক্রোধে চিৎকার করে বলল, তুমি জান না কিসের প্রতিশোধ? তুমি অবহেলায় আমাকে ছুড়ে ফেলে ছুটে গেলে একটি বাচ্চাছেলের কাছে?
অমানুষিক আতঙ্কে লাইনার হৃৎপিও থেমে যেতে চায়। হঠাৎ করে অনেক কিছু সে বুঝতে পারে, কিছু একটা বলতে যায়, কিন্তু তার আগেই কিরির শরীর থেকে বিদ্যুতের ঝলকানি বের হয়ে আসে। লাইনা সমস্ত শরীরে এক ধরনের অশরীরী ঝাকুনি অনুভব করে, চামড়া পোড়ার একটি গন্ধ বের হয়, নীল আলো আর কালো ধোয়ার মাঝে তার সমস্ত শরীর একটি জড়বস্তুর মতো ছিটকে গিয়ে দেয়ালকে আঘাত করে। জ্ঞান হারানোর আগে সে দেখতে পায় কিরি উদ্যত হাতে তার দিকে এগিয়ে আসছে, তার আঙুলের মাথা থেকে বিদ্যুতের নীলাভ স্ফুলিঙ্গ তার পাশের বাতাসকে আয়নিত করতে করতে ছুটে যাচ্ছে।
০৪.
মহাকাশযানের মূল চত্বরটির একপাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে কিরি দাঁড়িয়ে আছে। তার একটি পা টেবিলের উপর। নিজের হাত দুটি সে অন্যমনস্কভাবে নাড়ছে, মাঝে মাঝেই সেখান থেকে নীলাভ বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ বের হয়ে আসছে। কিরির মুখ ভাবলেশহীন, তার চোখ থেকে সবুজ এক ধরনের আলো বের হচ্ছে। সেই আলোটি হঠাৎ তাকে একটা অশরীরী রূপ দিয়েছে।
কিরির সামনে মহাকাশযানের সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেও তাদের কাছে কিরি ছিল একজন ঘনিষ্ঠ মানুষ। এখন আর নয়। হঠাৎ করে মনে হচ্ছে তারা কিরিকে জানে না।
কিরি মুখ তুলে বলল, আমি তোমাদের একটি জরুরি কথা বলার জন্যে ডেকেছি। সবাই এসেছ বলে অনেক ধন্যবাদ। মাত্র সেদিন আমি এখানে দাঁড়িয়ে তোমাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমি একজন রবোট, মানুষ হয়ে তোমরা আমাকে তোমাদের দলপতি হিসেবে মেনে নেবে কি না। তোমরা একবাক্যে আমাকে দলপতি হিসেবে মেনে নিয়েছিলে।
আমি মানুষ নই। আমি মানুষের জন্যে একটি কাজ করার দায়িত্ব নিয়ে এসেছি। এই গ্রহে মানুষকে তাদের বসতি স্থাপনে সাহায্য করতে এসেছি। পৃথিবীর সাথে অনেক মিল থাকলেও এই গ্রহে কিছু বড় ধরনের তারতম্য রয়েছে। তাই মানুষকে এই গ্রহে সুস্থ দেহে বেঁচে থাকতে হলে তাদের শরীরে কিছু বড় ধরনের পরিবর্তন করতে হবে। মানুষের জ্বণগুলোকে ঠিকভাবে বিকাশ করতে হবে। কাজটি দুঃসাধ্য, সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি নয়। কিন্তু আমাদের হাতে একটি অভাবনীয় সুযোগ এসেছে। এই গ্রহে একজন জীবন্ত মানুষকে পাওয়া গেছে যে মাতৃগর্ভ থেকে বের হয়ে একা এই গ্রহের প্রাকৃতিক অবস্থায় বড় হয়েছে। সেই মানুষটি থেকে আমরা এমন কিছু তথ্য পেতে পারি যেটা ব্যবহার করা হলে এই বসতি স্থাপনের সাফল্যের সম্ভাবনা হবে শতকরা নিরানব্বই দশমিক নয় ভাগ।
এই মহাকাশযানের দলপতি হিসেবে আমি সেই সুযোগ ছেড়ে দিতে পারি না, তার জন্যে আমাকে এমন একটি কাজ করার প্রয়োজন হল যেটি তোমাদের কাছে নিষ্ঠুর মনে হতে পারে। কাজটি হচ্ছে, সেই মানুষের দেহটি ব্যবচ্ছেদ করে দেখা। কাজটি সবচেয়ে সুচারুভাবে করা যেত যদি তোমরা সেটি কেউ না জানতে। কিন্তু লাইনা সেটি জেনেছিল এবং লাইনার কাছ থেকে তোমরা সবাই জেনেছ। লাইনা আমার সিদ্ধান্তটি সমর্থন করে নি এবং আমি জানি তোমরাও নিশ্চয়ই আমার সিদ্ধান্তটি সমর্থন করবে না। সে কারণে এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছি আমি একা। এর জন্যে কোনো মানুষকে কখনো কোনো অপরাধবোধে ভুগতে হবে না। কিন্তু আমি জানি, তোমরা কখনো আমাকে ক্ষমা করবে না, তোমাদের সাথে আমার যে চমৎকার একটি সম্পর্ক ছিল সেটি শেষ হয়ে গেল। তোমাদের সামনে আমি এখন একটি হৃদয়হীন দানব ছাড়া আর কিছু নেই।
আমি দশম প্রজাতির রবোট। আমার অনুভূতি মানুষের কাছাকাছি। আমি তোমাদের ঘৃণা অনুভব করতে পারি। আমার বুকের ভিতরে সেটা নিয়ে তীব্র একটি ব্যথা কিন্তু তোমরা—মানুষেরা সেটি কখনো সহানুভূতি নিয়ে দেখবে না। তোমাদের কাছে আমি অনুভূতিহীন নিষ্ঠুর একটি রবোট।
আমি সেটা স্বীকার করে নিয়েছি। আমার চেহারায় খানিকটা রবোটের রূপ দেয়া হয়েছে। ব্যাপারটি ইচ্ছাকৃত। আমার আচরণে খানিকটা নিষ্ঠুরতা আনা হয়েছে, সেটাও ইচ্ছাকৃত। আমি জানি, তোমাদের বন্ধুত্ব সম্ভবত আমি আর পাব না। অতীতে পেয়েছি, সেটাই আমি গভীর ভালবাসা নিয়ে মনে রাখব।
এর মাঝে অবস্থার একটু পরিবর্তন হয়েছে। লাইনা আমার কথা অমান্য করে সেই মানুষটিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আমি মানুষটিকে তোমাদের সবার কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছিলাম, সে অপূর্ব রূপবান একটি কিশোর, তার আচার-আচরণে এক ধরনের আশ্চর্য সারল্য রয়েছে। তাকে দেখামাত্র লাইনার মতো তোমাদের বুকেও গভীর মমতার জন্ম হত। তখন তাকে হত্যা করা হলে তোমরা আরো গভীরভাবে দুঃখ পেতে। সে। কারণে আমি তোমাদের মানুষটিকে দেখতে দিই নি। এখন মমতার সময় নয়, এখন সময় দায়িত্ব পালনের।
এই গ্রহটি বড়। মানুষটি এই গ্রহে দীর্ঘদিন থেকে রয়েছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, তোমরা জান সে আমার কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে পারবে না। সে যখন আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছিল, আমার নির্দেশে মিডি রবোট গোপনে তার শরীরে বার মেগা হার্টজের একটি পালসার প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। মানুষটির শরীর থেকে নির্দিষ্ট তরঙ্গের একটি সঙ্কেত বের হচ্ছে, সে কোথায় আছে বের করা আমার জন্যে কোনো সমস্যাই নয়। আমি আগামী চব্বিশ ঘন্টার মাঝে তাকে ধরে আনব। এবং অত্যন্ত দুঃখের সাথে তার দেহ ব্যবচ্ছেদ করে প্রয়োজনীয় তথ্য সগ্রহ করব, যেন তোমরা–মানুষেরা এই গ্রহে একটি সাফল্যজনক বসতির গোড়াপত্তন করতে পার।
এখন কাজ করার সময়। তোমাদের সবার নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে, নির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। আমি আশা করব, তোমরা তোমার্দের দায়িত্ব পালন করতে শুরু করবে। মহাকাশযানের স্কাউট রবোট ইতিমধ্যে এই গ্রহ থেকে অসংখ্য নমুনা তুলে এনেছে। এই গ্রহে বিচিত্র এক ধরনের প্রাণের বিকাশ হয়েছে। সেটি অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। সেটার তালিকা করায় আমার তোমাদের সাহায্যের প্রয়োজন। ভ্রূণগুলো ক্রোমোজৈনিক চেম্বার থেকে বের করে আনার সময় হয়েছে। প্রথমবার কত জন শিশু, কী রকম শিশু বিকাশ করানো হবে সে সম্পর্কেও তোমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই গ্রহে কী ধরনের প্রাণী, কী ধরনের গাছ জন্ম দেয়া দরকার সেই ব্যাপারটি আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। গ্রহের কোন অংশে বসতি স্থাপন করা যায় সেটিও তোমাদের ভেবে দেখার সময় হয়েছে। আমি তোমাদের অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সাহায্য করব। তোমাদের দুঃখবোধ এবং অপরাধবোধকে তীব্রতর না করার জন্যে পালিয়ে যাওয়া কিশোরটিকে ধরে আনা এবং তাকে হত্যা করার পুরো কাজটি করা হবে তোমাদের অজান্তে। তোমরা কোনোদিন নিশ্চিতভাবে জানতেও পারবে না সত্যিই এই গ্রহে কোনো কিশোের ছিল কি না, সত্যিই তার দেহ ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছিল কি না।
কিরির গলার স্বর আশ্চর্য রকম শান্ত। সেখানে এক ধরনের অশরীরী শীতলতা রয়েছে, যেটি শুনে সবার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে খানিকক্ষণ সবার দিকে তাকিয়ে থেকে কোমল গলায় বলল, তোমাদের কারো কোনো প্রশ্ন আছে?
কেউ কোনো কথা বলল না।
কিরি শান্ত গলায় বলল, তোমরা এখন যেতে পার।
ঘরের সব মানুষ এক জন এক জন করে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে থাকে। গ্রুসো বের হবার আগে হঠাৎ একবার কিরির দিকে ঘুরে তাকাল। কী ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে কিরিকে। যাকে মাত্র এক দিন আগেও সে নিজের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে জেনেছে।
কিরি হঠাৎ বলল, গ্রুসো।
গ্রুসো থমকে দাঁড়াল।
লাইনা কেমন আছে?
ভালো আছে। করোটিতে আঘাত পেয়েছিল। কিন্তু বিপদ কেটে গেছে।
লাইনাকে বোলো আমি খুব দুঃখিত।
বলব।
গ্রুসো ঘর থেকে বের হতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়াল। কিরি বলল, তুমি কিছু জিজ্ঞেস করতে চাও?
হ্যাঁ।
কী?
আমি কি তোমাকে হত্যা করার চেষ্টা করতে পারি?
কিরি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, না গ্রুসো। সেটা খুব অবিবেচকের মতো কাজ হবে। আমি দশম প্রজাতির রবোট। আমাকে ধ্বংস করার কোনো পদ্ধতি আমার জানা নেই।
ও।
শুভ রাত্রি গ্রুসো।
শুভ রাত্রি।
০৫. ভালবাসা
বাই ভার্বালটি মাটি থেকে অল্প একটু উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। সামনে কন্ট্রোল স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে আছে সুহান। পিছনে ট্রিনি? বাই ভার্বালের যেটুকু গতিতে যাওয়ার কথা সুহান তার থেকে দ্বিগুণ বেগে ছুটে যাচ্ছে। ট্ৰিনি নিচু স্বরে বলল, ধীরে সুহান। খারাপ একটা দুর্ঘটনা হতে পারে।
সুহান কোনো উত্তর দিল না। বিপজ্জনক একটা পাথরকে পাশ কাটিয়ে গতিবেগ আরো বাড়িয়ে দিল। তার দুই চোখ একটু পর পর পানিতে ভরে আসছে, বুকের ভিতর আশ্চর্য এক ধরনের অভিমান। ঠিক কার ওপর অভিমান সে জানে না। এক ধরনের বিচিত্র আক্রোশে তার সমস্ত গ্রহ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়ার ইচ্ছে করছে।
ট্ৰিনি আবার বলল, সুহান, সাবধান সুহান। খারাপ দুর্ঘটনা হতে পারে।
হোক।
অবুঝ হয়ো না সুহান।
আমি বেঁচে থাকলেই কী আর মরে গেলেই কী! আমি মানুষ অথচ মানুষেরাই আমাকে মেরে ফেলতে চায়।
মানুষেরা তোমাকে মেরে ফেলতে চায় না, সুহান। তুমি জান, যে তোমাকে মেরে ফেলতে চায় সে একজন রবোট।
এতজন মানুষ মিলে একটি রবোটকে থামাতে পারে না?
দশম প্রজাতির রবোট—
ছাই দশম প্রজাতি!
ট্রিনি দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, সুহান।
কী হল?
তোমার শরীরে কি কেউ কিছু প্রবেশ করিয়েছে?
সুহান অবাক হয়ে বলল, কী বলছ তুমি? কী প্রবেশ করাবে?
জানি না। কিছুক্ষণ হল তোমার শরীরের ভিতরে কিছু একটা চালু হয়েছে।
কী চালু হয়েছে?
জানি না। বার মেগা হার্টজের সিগনাল। তিন মিলি সেকেন্ড পর পর। আমার মনে হয় এটা একটা মাইক্রো পালসার। এটা তোমার শরীরে ঢােকানো হয়েছে তুমি কোথায় আছ সেটা খুঁজে বের করার জন্যে। নিশ্চয়ই মহাকাশযানের কেউ প্রবেশ করিয়েছে।
ওই মিডি রবোটটা। নিশ্চয়ই মিডি রবোটটা। আমাকে বলল আমার এক ফোটা রক্ত দরকার। পরীক্ষা করবে। রক্ত নেবার ভান করে নিশ্চয়ই শরীরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। একটা রবোট যখন মিথ্যা কথা বলা শুরু করে তখন কেমন লাগে?
রবোট প্রকৃত অর্থে মিথ্যা কথা বলে না তারা কোন প্রজাতির তার ওপর নির্ভর করে তাকে যে নির্দেশ দেয়া হয় সেটি তাদের মানতে হয়।
ছাই নির্দেশ! বদমাইশ রবোট। বেজন্মা কোথাকার!
ছিঃ সুহান, এভাবে কথা বলে না। ছিঃ!
কেন বলব না? এক শ বার বলব। বেজন্মা বদমাইশ শয়তানের বাচ্চা—
ছিঃ! সুহান, ছিঃ!
সুহান স্পেকট্রাস এনালাইজারে তার শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেয়া পালসারের সিগনালটি স্পষ্ট দেখতে পায়। তিন মিলি সেকেন্ড পর পর বার মেগা হার্টজের একটা সুনির্দিষ্ট সঙ্কেত। ট্রিনি খানিকক্ষণ সঙ্কেতটি দেখে বলল, তোমার পিছনে পিছনে কাউকে নিশ্চয়ই পাঠিয়ে দিয়েছে। তোমাকে খুঁজে বের করতে বেশিক্ষণ লাগবে না।
সুহান ফ্যাকাশে মুখে ট্রিনির দিকে তাকাল। ট্রিনি বলল, ভয় পেয়ো না সুহান, কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
কী ব্যবস্থা হবে?
তোমাকে একটা ফ্যারাডে কেজে লুকিয়ে ফেলতে হবে।
এই মহাকাশযানটা একটা বিশাল ফ্যারাডে কেজ। আমি এখন সেখানে লুকিয়ে আছি, কোনো সঙ্কেত বের হচ্ছে না। কিরি খুব ভালো করে জানে আমি এর ভিতরে আছি। তুমি কি কোনোভাবে পালসারটা আমার শরীর থেকে বের করতে পারবে?
ট্ৰিনি সুহানকে পরীক্ষা করে বলল, পালসারটা অসম্ভব ঘোট। তোমার রক্তের মাঝে ভেসে ভেসে শরীরের মাঝে ঘুরছে। কিছুক্ষণ পর পর তোমার হৃৎপিণ্ডের ভিতর দিয়ে চলে যাচ্ছে। মাইক্রো সার্জারি ছাড়া এটা বের করা খুব কঠিন।
তুমি মাইক্রো সার্জারি করতে পার না?
এখন পারি না। কিন্তু কপোট্রনে ক্রিস্টাল ডিস্ক থেকে মাইক্রো সার্জারির অংশটুকু প্রবেশ করিয়ে নিলেই পারব। দেখতে হবে যন্ত্রপাতি কী কী আছে। একটু সময় নেবে।
আমাদের হাতে কি সময় আছে?
ট্ৰিনি তার কথার উত্তর না দিয়ে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করে। সুহান শুনতে পায়, ক্লিক ক্লিক শব্দ করে তার সংবেদনশীল সমস্ত ইন্দ্রিয় আরো সংবেদনশীল হয়ে উঠছে। সুহান ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হল ট্রিনি?
একটা বাই ভার্বাল আসছে এদিকে।
বাই ভার্বাল?
হ্যাঁ, কেউ একজন তোমাকে ধরে নিতে আসছে সুহান।
সুহানের মুখমণ্ডল বিবর্ণ হয়ে ওঠে। খানিকক্ষণ ট্রিনির দিকে তাকিয়ে থেকে জোর করে নিজেকে শান্ত করে বলল, কতক্ষণ সময় আছে আমাদের হাতে?
এক ঘণ্টা। বাই ভার্বালটা থামিয়ে পাহাড়টা ঘুরে আসতে একটু সময় নেবে, না হয় আধ ঘণ্টার মাঝে চলে আসত।
সুহান হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। ট্রিনি জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাও?
ল্যাবরেটরি ঘরে।
কেন?
একটা পালসার তৈরি করব। বার মেগা হার্টজের তরঙ্গ, তিন মিলি সেকেন্ড পর পর। তুমি সেটা নিয়ে বহুদূরে কোথাও পাঠিয়ে দেবে, বাই ভার্বালটা তখন তার পিছু পিছু যাবে।
তুমি কেমন করে সেটা তৈরি করবে?
মেগা হার্টজের একটা ক্রিস্টাল নিয়ে সেটাকে বাড়িয়ে বার করে নেব।
কেমন করে বাড়াবে?
নন লিনিয়ার কিছু জিনিস আছে আমার কাছে।
আর তিন মিলি সেকেন্ড পর পর—
সেটা সহজ। রেজিস্টেন্স ক্যাপাসিটার দিয়ে—
কোথায় পাবে তুমি?
পুরোনো একটা যন্ত্র থেকে খুলে নেব।
তুমি জান কেমন করে তৈরি করতে হয়? মূল তথ্যকেন্দ্রে তো এসব নেই।
আমি জানি। তুমি আমাকে একটু সাহায্য কর। যদি সঙ্কেতটা শক্তিশালী না হয় একটা এমপ্লিফায়ার লাগাতে হবে। সেটা না একটা সমস্যা হয়ে যায়।
কিন্তু দেখা গেল, শেষ পর্যন্ত সেটি কোনো সমস্যা হল না। যতক্ষণ সময় লাগার কথা ছিল তার অনেক আগেই পালসারটি দাঁড়া হয়ে গেল।
ট্রিনি সেটা পরীক্ষা করে বলল, অভূতপূর্ব। আমি নিজে না দেখলে কখনোই বিশ্বাস করতাম না যে মূল তথ্যকেন্দ্রের কোনো সাহায্য না নিয়ে এ রকম একটা পালসার তৈরি করা যায়।
ব্যাপারটি কঠিন নয়।
কিন্তু মানুষ আজকাল নিজে এ ধরনের কাজ করে না। করার কথা নয়। ভবিষ্যতে তুমি যখন আবার কোনো অর্থহীন কাজ করবে, আমি তোমাকে নিরুৎসাহিত করব না।
বেশ। এখন আর দেরি কোরো না, এটা নিয়ে বাইরে যাও। দূরে কোথাও পাঠিয়ে দাও যেন বাই ভার্বালটা এর পিছু পিছু যায়।
তুমি সেটা নিয়ে কোনো চিন্তা কোরো না। কিন্তু তোমার সম্ভবত খুব ভালো একটা ফ্যারাডে কেজের মাঝে থাকা উচিত।
থাকব। তুমি এখন যাও।
ট্ৰিনি চতুষ্কোণ একটি বাক্স, যার ভেতরে সুহানের হাতে তৈরী পালসারটি রয়েছে, হাতে নিয়ে মহাকাশযান থেকে বের হয়ে গেল। জেট ইঞ্জিন লাগানো ছোট একটি গাড়ি আছে, তার উপরে করে সে এটাকে বহুদূরে পাঠাবে। শুধু বহুদূরে নয়, জায়গাটি বিপজ্জনক। যে বাই ভার্বালটি সেখানে যাচ্ছে সেটির তার আরোহীকে নিয়ে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব কম।
০২.
লাইনা তার বিছানায় আধশোয়া হয়ে হেলান দিয়ে বসে বাইরে তাকিয়েছিল। বাইরের আকাশে এক ধরনের লালচে আলো। সম্ভবত ঝড়ো বাতাস হু-হু করে বইছে, ভিতরে বসে সেটা বোঝার উপায় নেই। হঠাৎ ঘরে ছোট একটা শব্দ শুনে সে ঘুরে তাকাল, ঘরের মাঝখানে কিরি দাঁড়িয়ে আছে। লাইনার বুক কেঁপে উঠল হঠাৎ।
কেমন আছ লাইনা?
লাইনা কোনো কথা বলল না।
গত রাতের ব্যাপারটির জন্যে আমি দুঃখিত। তোমাকে শারীরিকভাবে কষ্ট দেয়ার আমার কোনো ইচ্ছে ছিল না। আমি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম।
লাইনা তখনো কোনো কথা বলল না, চোখের কোনা দিয়ে কিরিকে লক্ষ করল। তার চোখে সেই সবুজ আলোটি নেই, দেখতে আবার স্বাভাবিক মানুষের মতো লাগছে। লাইনার বুকে একটা অশুভ আতঙ্কের জন্ম হতে থাকে। কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রেখে বলল, তুমি কেন আমার কাছে এসেছ?
তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে। আমি দুঃখিত লাইনা।
লাইনা মাথা নাড়ল। বলল, না। তুমি ক্ষমা চাইতে আস নি। অন্য কোনো ব্যাপার আছে। কী ব্যাপার?
না। অন্য কোনো ব্যাপার নেই। কিরি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে গিয়ে, কাছাকাছি থেকে আবার ফিরে এসে লাইনার কাছাকাছি দাঁড়াল। বলল, একটা ছোট ব্যাপার আছে। খুব ছোট। জানতে চাও?
লাইনার বুক কেঁপে উঠল, জিজ্ঞেস করল, কী?
সুহানের শরীরে একটা পালসার ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। বার মেগা হার্টজের সঙ্কেত। সেটার পিছু পিছু আমি একটা কিউ-১২ রবোট পাঠিয়েছিলাম। কিউ-১২ যখন তার মহাকাশযানের কাছাকাছি গিয়েছে তখন সুহান মহাকাশযান থেকে বের হয়ে এই গ্রহের একটা দুর্গম জায়গায় লুকিয়ে গিয়েছিল। তাকে আবার খুঁজে পাওয়া গেছে।
কিরি লাইনার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। লাইন কোনো কথা বলল না, এক ধরনের ভয় পাওয়া চোখে কিরির দিকে তাকিয়ে রইল।
একটা পাহাড়ের পিছনে লুকিয়ে আছে। আমি আবার একটা কিউ-১২ পাঠিয়েছি। রবোটটা জানিয়েছে, সে কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে ধরে ফেলবে। আমি জানিয়েছি তাকে ধরার পর আমাকে জানাতে।
তুমি কেন আমাকে এ কথা বলছ?
কিরি আবার একটু হাসল, সুহানকে কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে নিয়ে আসা হবে। তুমি কি আবার তার সাথে কথা বলতে চাও?
লাইনা তীব্র দৃষ্টিতে কিরির দিকে তাকিয়ে রইল। এই ভয়ঙ্কর রবোটটির তার জন্যে মোহ জন্মেছে। একটি রবোটের যখন কোনো মেয়ের জন্যে আকর্ষণ জন্মায়, যখন অন্য একজনের ওপর ঈর্ষাতুর হয়, তার থেকে ভয়ঙ্কর বুঝি আর কিছু নেই।
কিরি আবার কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়, দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ লাইনার দিকে ঘুরে দাঁড়াল, বলল, একটি প্রতিরক্ষা রবোট আমার কাছে আসছে।
লাইনা কোনো কথা বলল না।
সুহানকে ধরার পরে আমাকে খবরটা দেয়ার কথা। মনে হয় খবরটা দিতে আসছে।
লাইনা তীব্র দৃষ্টিতে কিরির দিকে তাকিয়ে থাকে। কিরিকে দেখে মনে হয় সে ব্যাপারটি উপভোগ করতে শুরু করেছে।
কিছুক্ষণের মাঝেই প্রতিরক্ষা রবোটটি লাইনার ঘরে এসে দাঁড়াল, কিরির দিকে তাকিয়ে তার যান্ত্রিক গলায় বলল, মহামান্য কিরি, কিউ-১২ থেকে সঙ্কেত আসা বন্ধ হয়ে গেছে।
কিরি চমকে উঠে বলল, কী বললে? সে
কিউ-১২ তার বাই ভার্বালে করে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছিল। গতিবেগ আটাত্তর দশমিক চার, তুরণ দুই দশমিক….
আমি সেটা জানি। কিরি ধমক দিয়ে বলল, কিউ-১২-এর কী হয়েছে?
আমরা সেটা জানি না। মানুষটির শরীর থেকে বের হওয়া পালসারের সিগনালের পিছু পিছু গিয়েছে—
তারপর?
হঠাৎ করে কিউ-১২ অদৃশ্য হয়ে গেছে।
অদৃশ্য হয়ে গেছে?
হ্যাঁ মহামান্য কিরি। তার কোনো চিহ্ন নেই, যেন বাতাসে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
মানুষটা?
মানুষটা এখনো আছে। সে মনে হয় কোনো সঙ্কেত পাঠানোর চেষ্টা করছে। তার গতিবিধিটি একটা লেখার মতো।
কী লেখা?
অর্থহীন কথা। লিখছে, কিরি, তুমি জাহান্নামে যাও। কিরি বানানটি ভুল। জাহান্নাম শব্দটি–
তুমি চুপ কর। কিরি চিৎকার করে বলল, চুপ কর।
ঠিক আছে মহামান্য কিরি।
তুমি যাও, মূল কম্পিউটারকে বল মানুষটির গতিবিধির ওপর লক্ষ রাখতে। দুটি বাই ভার্বাল প্রস্তুত কর। একটা স্কাউটশিপকে ওই এলাকায় পাঠানোর জন্যে প্রয়োজনীয় জ্বালানি দিয়ে দাঁড় করাও
যাও।
প্রতিরক্ষা বোটটি ঘুরে সাথে সাথে বের হয়ে গেল। কিরি বের হয়ে গেল না, লাইনার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রইল। লাইনা অনেক কষ্ট করে তার গলায় আনন্দটুকু লুকিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করল, কিরি, সত্যি সুহান তোমার হাত থেকে পালিয়ে গেছে?
আপাতত। ছেলেটাকে আমি যত সরল ভেবেছিলাম সে তত সরল নয়। মাথায় কিছু বুদ্ধি রাখে। আর সবচেয়ে যেটা কৌতূহলের ব্যাপার সেটি হচ্ছে, তার কাছে কিছু বিচিত্র যন্ত্রপাতি আছে। কোথা থেকে পেল জানার কৌতূহল হচ্ছে।
লাইনা তার বিছানায় আধশোয়া হয়ে কিরিকে তার ঘর থেকে বের হয়ে যেতে দেখল। কিরি যেটা ভাবছে সেটা সত্যি নয়। তার কাছে বিচিত্র কোনো যন্ত্র নেই, তার কাছে যেটা আছে সেটা অসম্ভব একটি ক্ষমতা। মূল তথ্যকেন্দ্রের সাহায্য না নিয়ে যন্ত্রপাতি তৈরি করার ক্ষমতা। একটি অসম্ভব এবং সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় একটি ক্ষমতা। কিন্তু সেই সম্পূর্ণ অর্থহীন অপ্রয়োজনীয় ক্ষমতাটি এখন তাকে বাঁচিয়ে রাখবে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে।
লাইনা ফিসফিস করে বলল, সুহান, সোনা আমার! তুমি যেখানেই থাক, ভালো থেকো।
লাইনা চোখ বন্ধ করে নিজের হাঁটুর উপরে মাথা রেখে বসে থাকে। সে কখনো ঈশ্বরকে ডাকে নি। ঈশ্বরের অস্তিত্বে তার বিশ্বাস নেই। কিন্তু হঠাৎ সে আবিষ্কার করে, সে মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকছে। প্রথমে সে একটু অবাক হয় একটু অস্বস্তি অনুভব করে। কিন্তু একটু পরে আবিষ্কার করে, ঈশ্বরকে ডেকে সে নিজের ভিতরে এক ধরনের সান্ত্বনা খুঁজে পেতে শুরু করেছে। পৃথিবীর কোনো শক্তি যা মানুষকে সান্ত্বনা দিতে পারে না তখন হয়তো মানুষের জ্ঞানের অতীত এক ধরনের পরম শক্তির প্রয়োজন হয়। হয়তো এভাবেই মানুষের জন্যে ঈশ্বরের জন্ম হয়েছিল। লাইনা তার চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করতে শুরু করে। ফিসফিস করে বলে, হে ঈশ্বর! হে পরম সৃষ্টিকর্তা! হে বিশ্ববিধাতা! তুমি এই ছেলেটিকে রক্ষা কর। ভয়ঙ্কর এই দানবের হাত থেকে রক্ষা কর। তার বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষা কর।
০৩.
সুহান বড় একটা টেবিলে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তার পিঠের উপর ছাদ থেকে ঝুলে আছে একটি বিচিত্র যন্ত্র। দেখে বোঝা যায় সেটি সুহানের হাতে তৈরী। তারের কুণ্ডলী, ধাতব যন্ত্রপাতি, বিদ্যুৎপ্রবাহের জন্যে মোটা তার, নিয়ন্ত্রণের জন্য অতিকায় হাস্যকর ইলেকট্রনিক সার্কিট এবং তার ভিতর থেকে বের হওয়া বিচিত্র শব্দ দেখে এটিকে কোনো সত্যিকারের যন্ত্র ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু গত কয়েক দিনে ট্ৰিনি সুহানের কিছু বিচিত্র যন্ত্রকে নানাভাবে কাজ করতে দেখে তার কথায় খানিকটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। সে এই বিচিত্র যন্ত্রটি সুহানের পিঠের কাছে নামিয়ে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করছিল। সুহান জিজ্ঞেস করল, কী অবস্থা ট্রিনি?
মনে হয় কাজ করছে। বিস্ময়কর! অভূতপূর্ব!
সুহান উত্তেজিত গলায় বলল, বলেছিলাম না আমি? বলেছিলাম না? তুমি আমার কোনো কথা বিশ্বাস কর না। তোমার ধারণা মূল তথ্যকেন্দ্রের তথ্য না নিয়ে কিছু তৈরি করা যায় না। ভুল।
তাই তো দেখছি।
তুমি বলেছিলে মাইক্রো-সার্জারি না করে এই পালসারটা শরীর থেকে বের করা যাবে না। এখনো কি তাই মনে হয়?
না। চৌম্বক ক্ষেত্রটা কাজ করছে। আস্তে আস্তে পালসারটা উপরের দিকে আসছে।
আসতেই হবে। এ রকম পালসার তৈরি করতে হলে ছোট নিকেলের আর্মেচার দরকার। চৌম্বক ক্ষেত্র দিয়ে সেটা টেনে আনা যাবে। নিকেল চৌম্বকীয় পদার্থ, জান তো?
জানার প্রয়োজন ছিল না বলে জানতাম না। এখন জানলাম।
শুধু চৌম্বক ক্ষেত্র দিয়ে এটাকে টেনে আনা যেত না। তাই তার স্বাভাবিক কম্পন ব্যবহার করা হয়েছে। সেই অংশটা ছিল জটিল।
কিন্তু চমৎকার কাজ করছে। ট্ৰিনি মাথা নিচু করে সুহানের পিঠে কিছু একটা স্পর্শ করে দেখতে দেখতে বলল, পালসারটা উপরে আসছে সুহান।
সুহান খুশি খুশি গলায় বলল, এখন তুমি বিশ্বাস করলে মূল তথ্যকেন্দ্রের সাহায্য না নিয়েই বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম করা যায়?
পুরোটা করি নি।
কেন পুরোটা কর নি?
সভ্যতার জন্যে আরো অজস্র বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি দরকার। নানা ধরনের জটিল যন্ত্রপাতি। ঘরে বসে তুমি সেইসব তৈরি করতে পারবে না।
কিন্তু আমি জানব সেগুলো কেমন করে কাজ করে। মানুষ এখন বেশিরভাগ জিনিস জানে না। বেশিরভাগ জিনিস এখন তথ্যকেন্দ্রে। এখন মানুষের জ্ঞান হচ্ছে কিছু সংখ্যা আর কিছু তথ্য। সংখ্যার সাথে সংখ্যা মিলিয়ে যন্ত্রপাতি, মডিউল জুড়ে দেয়া হয়, যন্ত্রপাতি পাড়া হয়ে যায়। খুব সহজ কিন্তু এর মোেকানো আনন্দ নেই।
ট্ৰিনি মাথা নেড়ে বলল, তোমাকে নিয়ে আমার চিন্তা হয় সুহান। মনে হয়, আমি তোমাকে ঠিক করে বড় করতে পারি নি। মানুষের কাজকর্ম সম্পর্কে তোমার সম্মানবোধ খুব কম।
কমই তো, খুবই কম। বলতে গেলে কিছুই নেই। তা না হলে কি একটা মানুষের দলকে একটা রবোট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে?
ট্ৰিনি মাথা নাড়ে, তা ঠিক।
মানুষ অনেক ভুল করেছে ট্রিনি। মানুষ একটা কাজ করলেই সেটা ভালো, তুমি সেটা মনে কোরো না।
ট্রিনি হঠাৎ দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, নড়বে না সুহান, একেবারে নড়বে না। পালসারটা পিঠের কাছে উঠে এসেছে।
ট্রিনি দ্রুত একটা সিরিঞ্জ নিয়ে তার পিঠে একটা সুচ ফুটিয়ে দিল। সুহান মুখ বিকৃত করে যন্ত্রণার একটা শব্দ করে সঁতে দাঁত চেপে বলল, কী করছ ট্রিনি? তুমি জান না আমাদের স্নায়ু বলে একটা জিনিস আছে? আমাদের যন্ত্রণা বলে একটা অনুভূতি হতে পারে?
বাজে কথা বোলো না। একটা সুচ আর কত যন্ত্রণা দিতে পারে?
আমার ইচ্ছে করছে কোনোভাবে এক দিনের জন্যে তোমার শরীরে ব্যথা বোধ হত, আর আমি তোমার পিঠে ছয় ইঞ্চি একটা সুচ ফুটিয়ে দিতাম।
ট্রিনি বিড়বিড় করে বলল, আমি রবোট বলে মনে কোরো না আমার কোনোরকম সমস্যা নেই। তুমি যখন বিদঘুটে একটা সমস্যা হাজির কর যার কোনো সমাধান নেই, সেটা চিন্তা করে আমার কপোট্রনের ভোল্টেজ ওলটপালট হয়ে যায়। আমি শরীরের অংশবিশেষের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। মনে কোরো না সেটা খুব আনন্দের ব্যাপার। নড়বে না, একেবারে নড়বে না, পালসারটা প্রায় ধরে ফেলেছি।
কয়েক মুহূর্ত পরে ট্রিনি সিরিঞ্জটা টেনে বের করে আনে। ভিতরে একটু রক্ত, সেই রক্তে পালসারটা ভেসে বেড়াচ্ছে।
সুহান উপর থেকে তার হাতে তৈরী যন্ত্রটা ঠেলে সরিয়ে নিয়ে বলল, সত্যি বের করেছ তো?
হ্যাঁ। এই দেখ, সিরিঞ্জের ভেতর থেকে সিগনাল বের হচ্ছে। তিন মিলি সেকেন্ড পর পর বার মেগা হার্টজের সিগনাল।
চমৎকার! কী করবে এখন এটাকে?
এখান থেকে বের করে কোথাও রাখতে হবে।
রাখ। সুহান টেবিল থেকে নেমে বলল, শেষ পর্যন্ত এখন আমাকে মুক্ত মুক্ত মনে হচ্ছে। এখন বের হতে পারব।
ট্ৰিনি সাবধানে সিরিঞ্জ থেকে রক্তটা বের করতে করতে বলল, কোথায় বের হবে?
লাইনার সাথে দেখা করতে যাব।
হঠাৎ করে ট্রিনির ডান হাতটি অপ্রকৃতিস্থের মতোড়তে শুরু করে। সাবধানে সেটাকে থামিয়ে বলল, কার সাথে?
তুমি জান আমি কার কথা বলছি। লাইনা।
কেন?
কারণ আমার মনে হচ্ছে আমি লাইনার প্রেমে পড়েছি।
প্রেমে পড়েছ?
হ্যাঁ। প্রেম। একটা মানবিক ব্যাপার। তোমাদের রবোটদের পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব নয়।
তুমি জান মহাকাশযানের দলপতি, দশম প্রজাতির রবোট কিরি তোমাকে হত্যা করার জন্যে খোজ করছে। তোমাকে ধরে নেয়ার জন্যে একটা কিউ-১২ রবোট পাঠিয়েছিল। সেটাকে কোনোভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। এখন অন্য রবোটেরা খুঁজছে। তুমি বলছ তবু তুমি নিজে থেকে সেই মহাকাশযানে যাবে?
হ্যাঁ, আমার লাইনার সাথে দেখা করতে হবে।
ট্রিনির ডান হাতটা আবার দ্রুত নড়তে শুরু করে, বাম হাত দিয়ে সেটাকে ধরে রেখে বলল, তুমি জান তুমি যদি সেখানে যাও তোমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য শূন্য এক।
সুহান অন্যমনস্কের মতো বলল, আমারও তাই মনে হয়। তাহলে?
সুহান কোনো উত্তর না দিয়ে হেঁটে এসে গোল জানালাটি দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বাইরে অন্ধকার নেমেছে। বহুদূরে একটা আগ্নেয়গিরি থেকে লাল আগুন বের হচ্ছে, লাভা গড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। তার লাল আভায় চারদিকে এক ধরনের রহস্যময় আলো।
ট্রিনি বলল, তুমি যে এখানে থাক সেটা কিরি জানে। তোমার তৈরী পালসারটি দিয়ে তাকে সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করা হয়েছে, কিন্তু সে কিছুদিনের মাঝেই সেটা জেনে যাবে। আমার মনে হয়, তোমার নিজের নিরাপত্তার জন্যে এখানে থাকা ঠিক নয়। গ্রহের অন্যপাশে আমরা চলে যেতে পারি। মনে আছে একবার আমরা গিয়েছিলাম? চমৎকার কয়েকটা আগ্নেয়গিরি আছে সেখানে?
তুমি বলছ আমি পালিয়ে যাব?
হ্যাঁ। বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে।
কেন?
ট্রিনির ডান হাতটি আবার দ্রুত নড়তে শুরু করে। কোনোভাবে সেটা বাম হাত দিয়ে ধরে রেখে বলল, হয়তো আবার কোনো মহাকাশযান আসবে, সেখানে নেতৃত্ব দেবে মানুষ, যেই মানুষ–
সুহান শুষ্ক স্বরে হেসে ওঠে। ট্রিনির সুহানের এই হাসির সাথে পরিচয় নেই। হঠাৎ করে কথা থামিয়ে সে চুপ করে গেল। সুহান হাসি থামিয়ে বলল, ট্রিনি, জীবনের অর্থ নয় যে সেটা খুব দীর্ঘ হতে হবে। জীবনটা ছোট হতে পারে কিন্তু সেই ছোট জীবনে থাকতে হবে তীব্রতা। থাকতে হবে আনন্দ। আমি যতদিন একা একা ছিলাম তখন ভেবেছিলাম, সারাদিন গ্রহে গ্রহে ঘুরে বেড়ানো, রাতে ছোট ছোট যন্ত্র তৈরি করা, মহাকাশযানের অসংখ্য যন্ত্রপাতি কীভাবে কাজ করে বোঝার চেষ্টা করা, তোমার সাথে কথা বলা, নিশাচর প্রাণীর তালিকা তৈরি করা হচ্ছে চমৎকার একটি জীবন। কিন্তু লাইনার সাথে দেখা হওয়ার পর আমার সবকিছু পাল্টে গেছে। এখন আমার আগের জীবনের জন্যে কোনো আকর্ষণ নেই। আমার নতুন জীবনে শুধু একটা জিনিস থাকতে পারে
সেটা কী?
লাইনা। তার সাথে আবার দেখা করে তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা। তাকে আর একবার স্পর্শ করা। তাকে ডাকে—সুহান অন্যমনস্কভাবে থেমে গেল। একটু পরে বলল, যদি সেটা করতে না পারি তাহলে আমি সেটা করার চেষ্টা করতে পারি। চেষ্টা করে যদি কোনোভাবে মারাও যাই, আমার মনে হয়, সেটাও হবে একটা চমৎকার জীবন।
তোমার তাই মনে হয়?
হ্যাঁ। চমৎকার একটা জীবন। তীব্র জীবন।
সুহান, আমি তোমাকে কখনোই পুরোপুরি বুঝতে পারি নি। আগে তবু বেশ অনেকখানি বুঝতে পারতাম। গত কয়েকদিন থেকে তোমাকে একটুও বুঝতে পারি না। কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমার আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। তুমি যেটা চাও সেটাই আমি করব। আমি কখনো বুঝতে পারব না কেন করছি, তবু করব।
ধন্যবাদ ট্রিনি। তুমি হচ্ছ আমার সত্যিকারের বন্ধু।
শুধু একটি ব্যাপার–
কী?
আমার মনে হয় আমাদের চেষ্টা করা উচিত আমাদের সাফল্যের সম্ভাবনাকে আরো একটু বাড়ানো।
তুমি কীভাবে সেটা করবে?
অনেকভাবে করা যায়। আমাদের মহাকাশযানটি ঠিক অন্য মহাকাশযানটির মতো।
আমরা এর খুঁটিনাটি দেখতে পারি। কোথাও কোনো গোপন পথ আছে কি না বের করতে পারি। মহাকাশযানের বাইরে ছোট একটা স্টেশন করে ভেতরের কথাবার্তা হুনতে পারি, তাদের দৈনন্দিন রুটিন সম্পর্কে ধারণা করতে পারি, নতুন ধরনের কয়েকটা অস্ত্র তৈরি করতে পারি। তারপর কোনোভাবে লাইনাকে মহাকাশযানের বাইরে আসার জন্যে খবর পাঠাতে পারি, সে বাইরে এলে তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারি।
সুহানের মুখে একটা ছেলেমানুষি হাসি ফুটে উঠল, বলল, আমি আর লাইনা। লাইনা এবং আমি।
এবং আমি।
হ্যাঁ, আর তুমি। অবশ্যি তুমি।
০৪.
ইঞ্জিনিয়ার গ্রুসো তার অস্ত্রটি করিডোরের রেলিঙে শক্ত করে আটকে নিল। এটি এমন কিছু ভারি অস্ত্র নয় কিন্তু সে কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। অস্ত্রটি শক্তিশালী। লক্ষ্যবস্তুকে দৃষ্টিবদ্ধ করার জন্যে তিনটি ভিন্ন নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা রয়েছে। ইনফ্রায়েড এবং আলট্রাভায়োলেট রশ্মি, তার সাথে সাথে একটি মাইক্রোওয়েভ সঙ্কেত। লক্ষ্যবস্তুকে দৃষ্টিবদ্ধ করার সাথে সাথে দুটি ভিন্ন ভিন্ন বিস্ফোরক ছুটে যাবে দুই মাইক্রোসেকেন্ড ধর পর, ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে লক্ষ্যবস্তু। গ্রুসো পুরো ব্যাপারটা অনেকবার চিন্তা করে দেখেছে, ভুল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তার লক্ষ্যবস্তু এই মহাকাশযানের দলপতি দশম প্রজাতির রবোট কিরিকে সে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করবে। গ্রুসোর মনে সেটা নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই, দ্বন্দ্ব নেই।
সে নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে কন্ট্রোল রুম থেকে এক্ষুনি কিরি বের হবে, ঠিক এ রকম সময়ে সে বের হয়। গ্রুসো ট্রিগারে আঙুল রেখে স্থির চোখে সামনে তাকিয়ে থাকে। নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে স্পষ্ট।
০৫.
গ্রুসোর মৃতদেহকে ঘিরে মহাকাশযানে সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিরি ঝুঁকে পড়ে তাকে এক নজর দেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। বিষণ্ণ গলায় বলল, আমি তাকে নিষেধ করেছিলাম।
কেউ কোনো কথা বলল না। কিরি সবার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, আমি দশম প্রজাতির রবোট। আমাকে কোনো অস্ত্র দিয়ে দৃষ্টিবদ্ধ করা যায় না। অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ আমার কাছে চলে আসে। আমার দিকে যে বিস্ফোরক পাঠানোর কথা সেটি নিজের কাছে ফিরে যায়। আমি চাইলেও যায়, আমি না চাইলেও যায়।
সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। কিরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কেউ একজন গ্রুসোর চোখ দুটি বন্ধ করে দেবে? মৃত মানুষ তাকিয়ে থাকলে খুব ভয়ঙ্কর দেখায়।
কেউ এগিয়ে গেল না।
০৬. দুঃস্বপ্ন
সুহানের ঘুম ভাঙল বিচিত্র শব্দ শুনে, শব্দটি সে ধরতে পারল না। আধো ঘুমের মাঝে শব্দটি কী হতে পারে ভাবতে ভাবতে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ছিল, তখন সে দ্বিতীয়বার শব্দটি শুনতে পেল। সুহান এবার চোখ খুলে তাকায়, তার দুপাশে দু জোড়া সবুজাভ চোখ। সে লাফিয়ে উঠে বসতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন সে একটি ধাতব কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, আমার মনে হয় এখন নড়াচড়া করা অত্যন্ত অবিবেচকের মতো কাজ হবে।
সুহান কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে শুরু স্বরে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কে?
ঘরের একটা আলো জ্বলে ওঠে তখন। আলোটা কোথা থেকে আসছে সে ধরতে পারে না। তার পাশে দুটি রবোট। ট্রিনির মতো নয়, দেখতে অন্যরকম। দেহ আকারে আরেকটু ছোট, বুকের মনিটরটি আরো অনেক জটিল। দুটি রবোটের হাতেই একটি করে বিচিত্র অস্ত্র। অস্ত্র থেকে ছোট একটি আলো জ্বলছে এবং নিভছে, নিঃসন্দেহে তাকে দৃষ্টিবদ্ধ করা আছে, একটু ভুল হলেই শেষ করে দেবে। সুহান বিছানায় বসে আবার জিজ্ঞেস করল, তোমরা কে?
মহামান্য কিরি আমাদের এখানে পাঠিয়েছেন আপনাকে নিয়ে যাবার জন্যে।
আমি যদি যেতে না চাই?
আপনাকে শক্তি প্রয়োগ করে নেয়া হবে।
রবোটদের নীতিমালায় লেখা আছে তাদের মানুষের কোনো ক্ষতি করার ক্ষমতা নেই কিন্তু সে কথাটি তাদের বলা নিশ্চয়ই অর্থহীন। কিরি নিঃসন্দেহে তাদের অন্যভাবে প্রোগ্রাম করে রেখেছে। সুহানের হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে ওঠে। তার জীবনে সে ভয়ঙ্কর আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছে খুব কম, ব্যাপারটির সাথে তার ভালো পরিচয় নেই।
একটা রবোট হঠাৎ তার উপর ঝুঁকে পড়ল। সুহান তার শুকনো ঠোঁট দুটি জিভ দিয়ে ভিজিয়ে বলল, তুমি কী করছ?
আপনার শরীরে কন্ট্রালিনের একটি ইনজেকশান দিচ্ছি।
সেটি কী?
সেটি এক ধরনের ওষুধ। আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে।
আমি ঘুমাতে চাই না।
কিন্তু আমাদের ওপর সেরকম নির্দেশ।
সুহান দেখতে পায়, রবোর্টটি হাতে ছোট সিরিঞ্জের মতো কী একটা নিয়ে তার উপর ঝুঁকে পড়েছে। বাধা দেয়া অর্থহীন কিন্তু তার সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে রবোটটির হাত ধরে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল। পারল না। তার কজিতে সুচ ফোটানোর তীক্ষ্ণ একটু যন্ত্রণা অনুভব করল। সুহান বুঝতে পারে তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে, ভয়ঙ্কর হতাশায় সে ডুবে যাচ্ছিল, ফিসফিস করে বলল, ট্রিনি, তুমি কোথায়?
ট্ৰিনি পাশের ঘরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। চতুর্থ প্রজাতির কিউ-২২ রবোটের উপস্থিতিতে সে একটি জড় পদার্থ। বাধা দেয়া দূরে থাকুক, তার একটি আঙুল তোলারও ক্ষমতা নেই। সুহানের কাতর কণ্ঠস্বর শুনে তার কপোট্রনে বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ খেলা করতে থাকে, ডান হাতটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঝটকা দিয়ে কেঁপে উঠতে থাকে, সেটিকে সে থামানোর কোনো চেষ্টা করে না। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, সুহানের দেহকে দুপাশ থেকে ধরে দুটি রবোট তাদের বাই ভার্বালে উঠে যাচ্ছে। শক্তিশালী ইঞ্জিনকে গুঞ্জন করে উঠতে শুনল সে। তারপর সেটিকে মিলিয়ে যেতে দেখল দূরে।
ট্ৰিনি শূন্য ঘরটিতে কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘুরে বেড়াল। ঘরে সুহানের ছড়ানো ছিটানো যন্ত্রপাতিগুলো গুছিয়ে তুলে রাখল। তার শরীর থেকে বের করা পালসারের বাক্সটি দেখে মনে পড়ল, পালসারটি সুহানের কাছে রয়ে গেছে। কোথায় রাখা যায় ভেবে না পেয়ে গত রাতে সুহানের নখে টেপ দিয়ে লাগিয়ে রাখা হয়েছিল। সুহানের নিও পলিমারের কাপড় পরিষ্কার করতে নিয়ে যাওয়ার সময় ট্রিনি হঠাৎ করে বুঝতে পারল, এই কাজটি অর্থহীন। সুহান আর কখনো এই ঘরে ফিরে আসবে না। ট্রিনি আবিষ্কার করে, তার আর কিছু করার নেই।
সে ঘরের ঠিক মাঝখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
০২.
ঘুম ভাঙার পর সুহানের অনেকক্ষণ লাগল বুঝতে সে কোথায়। চোখের সামনে সবকিছু ধোয়াটে, যেন হালকা কুয়াশার আস্তরণ। কোথায় যেন কর্কশ একটা শব্দ হচ্ছে। তার শরীর শীতার্ত, মাথার মাঝে এক ধরনের ভোঁতা যন্ত্রণা। কপালের কাছে একটা শিরা দপদপ করছে। সুহানের প্রথমে মনে হল সে মারা গেছে, কিন্তু মৃত মানুষের কি মাথায় যন্ত্রণা হতে পারে?
সুহান আবার ভালো করে চোখ খুলে তাকাল। না, সে মারা যায় নি। মাথার কাছে মনিটরে আলো জ্বলছে। তার শরীরে নানা ধরনের সেন্সর লাগানো। সেগুলো থেকে নানারকম সঙ্কেত বিচিত্র যন্ত্রপাতিতে যাচ্ছে। মনিটরে তার তাপমাত্রা, রক্তচাপ, হৃৎস্পন্দন, মেটাবলিজম থেকে শুরু করে মস্তিষ্কের কম্পন পর্যন্ত লক্ষ রাখা হচ্ছে। মৃত মানুষের শরীরে কোনোকিছু লক্ষ রাখার প্রয়োজন হয় না।
সুহান উঠে বসে। বেশ বড় একটা ঘর। ঘরের দেয়াল ধবধবে সাদা। সারা ঘরে এক ধরনের নরম আলো, অনেকটা দ্বিতীয় সূর্যের আলোর মতো। আলোটা কোথা থেকে আসছে বোঝা যাচ্ছে না। সুহান নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে হ্যাচকা টান দিয়ে সবগুলো সেন্সর খুলে ফেলল। সাথে সাথে দূরে কোথাও তীক্ষ একটা শব্দ হতে থাকে এবং কিছুক্ষণের মাঝেই প্রথমে একটি রবোট এবং তার পিছু পিছু একজন দীর্ঘকায় মানুষ প্রবেশ করে। সুহান মানুষটিকে চিনতে পারল, মহাকাশযানের দলপতি কিরি এবং সাথে সাথে তার মনে পড়ল, মানুষের মতো দেখালেও কিরি একটি রবোর্ট।
কিরি সুহানের কাছে এসে বলল, শুভ সন্ধ্যা সুহান।
সুহান কিরির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার শরীর এখনো দুর্বল। মস্তিক হালকা, মনে হতে থাকে পৃথিবীর কোনোকিছুতেই কিছু আসে যায় না। কিরির দিকে তাকিয়ে সে নিজের ভিতরে এক ধরনের বিজাতীয় ঘৃণা অনুভব করতে থাকে। কিরি আরেকটু এগিয়ে এসে আবার বলল, শুভ সন্ধ্যা সুহান।
সন্ধ্যাটি কি সত্যিই আমার জন্যে শুভ?
কিরি শব্দ করে হেসে বলল, শুভ-অশুভ খুব আপেক্ষিক ব্যাপার। একজনের কাছে যেটি শুভ, অন্যজনের কাছে সেই একই ব্যাপার
সুহান কিরির আপাতদার্শনিক উত্তরে বাধা দিয়ে বলল, তুমি সত্যিই আমাকে মেরে ফেলবে?
কিরি তার প্রশ্নের উত্তর দিল না। সুহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, রবোটেরা মানুষের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। তুমি তাহলে কেমন করে একজন মানুষের ক্ষতি করতে পার?
কিরি অন্যমনস্কের মতো বলল, ব্যাপারটা খুব জটিল। মানুষ কথাটির একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে। শুধু জৈবিকভাবে মানুষ হলেই হয় না। মানুষ হতে হলে পৃথিবীর তথ্যকেন্দ্রে তার জন্ম-পরিচয় থাকতে হয়। তোমার সেই পরিচয় নেই, তাই তোমার সাথে একটা বন্যপশুর কোনো পার্থক্য নেই।
যদি তথ্যকেন্দ্রে জন্ম-পরিচয় থাকত?
তাহলে ব্যাপারটা অন্য রকম হতে পারত।
সুহান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমাকে তুমি তোমার মহাকাশযানের মানুষদের সাথে দেখা করতে দেবে?
না।
কেন নয়?
সেটি পুরো ব্যাপারটাকে আরো জটিল করে দেবে।
সুহান আর কোনো কথা বলল না। কিরি ঘরে ইতস্তত হেঁটে এসে বলল, আমাকে স্বীকার করতেই হবে, তোমাকে আমি যত সহজে ধরে আনব ভেবেছিলাম তত সহজে ধরে আনতে পারি নি। তুমি সত্যি সত্যি আমাকে ধোকা দিতে পেরেছিলে। পুরো ব্যাপারটা যখন দ্বিতীয়বার চিন্তা করেছি তখন বুঝতে অসুবিধে হয় নি যে, পালসারটা তোমার শরীরেই আছে, তুমি দ্বিতীয় একটি পালসার গ্রহের সবচেয়ে দুর্গম অঞ্চলে পাঠিয়েছ—
আমাকে কি তুমি একা থাকতে দেবে?
কিরি একটু হকচকিয়ে গিয়ে বলল, তুমি আমাকে চলে যেতে বলছ?
হ্যাঁ। সুহান ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি নিম্ন শ্রেণীর রবোটকে দেখিয়ে বলল, তুমি যাবার সময় কি ওই রবোর্টটাকেও নিয়ে যাবে? তোমাদের রবোটদের আমার ভালো লাগে না।
কিরির মুখে অপমানের ছায়া পড়ল, তাকে এর আগে অন্য কেউ একটি দ্বিতীয় প্রজাতির রবোটের সাথে এক করে দেখে নি। সে শক্তমুখে বলল, এই রবোর্টটি তোমাকে চোখে চোখে রাখবে। সে তোমার সাথে এই ঘরে থাকবে। আমি যাচ্ছি, তোমাকে একা থাকতে দিচ্ছি।
কিরি লম্বা পা ফেলে ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ থেমে সুহানের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, সুহান, তোমার সাথে সম্ভবত আমার আর দেখা হবে না। তোমাকে একটা জিনিস বলা প্রয়োজন। তুমি মনে করছ তোমার মৃত্যু–
সুহান চিৎকার করে বলল, আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না।
কিন্তু–
বের হয়ে যাও। তুমি বের হয়ে যাও
কিরি বের হয়ে গেল। সাথে সাথে সুহান ছেলেমানুষের মতো কেঁদে উঠল। দুই হাতে মুখ ঢেকে সে বিছানায় মাথা গুজে আহত পশুর মতো ছটফট করতে থাকে। তার বুকে গভীর হতাশা, গভীর যন্ত্রণা—যে অনুভূতির সাথে তার পরিচয় নেই। সে ফিসফিস করে বলল, ট্রিনি! ট্রিনি তুমি কোথায়?
লাইনার ঘরে চতুষ্কোণ স্ক্রিনে হঠাৎ কিরির ছবি ফুটে ওঠে। লাইনাকে ডেকে বলল, লাইনা।
বল।
আমি তোমাকে একটি জিনিস দেখাতে চাই।
লাইনার বুক কেঁপে উঠল হঠাৎ। ভয় পাওয়া গলায় বলল, না, আমি দেখতে চাই না।
তোমাকে দেখতে হবে লাইনা।
না। লাইনা চিৎকার করে বলল, না—
কিরি লাইনার কথা শুনল না। স্ক্রিনে সুহানের ছবি ভেসে উঠল। বিছানায় মাথা গুজে ফুলে ফুলে কাদছে। অসহায় একটি কিশোর। অসহায়, ভীত একটি কিশোর। যে মানুষের আশ্রয়ে ছুটে এসেছিল, যে মানুষ তাকে রক্ষা করতে পারে নি।
লাইনা হিংস্র দৃষ্টিতে স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে থাকে। সে আর দেখতে পারছে না, টেবিল থেকে চতুষ্কোণ কমিউনিকেশান মডিউলটি তুলে সে স্ক্রিনটির দিকে ছুড়ে দেয়। ঝনঝন শব্দ করে ভেঙে পড়ে স্ক্রিনের স্বচ্ছ কাচ। কয়েকবার কেঁপে কেঁপে ছবিটা অদৃশ্য হয়ে যায় স্ক্রিন থেকে।
০৩.
সুহান কতক্ষণ বিছানায় মাথা গুঁজে ছিল সে জানে না। হঠাৎ একটি কণ্ঠস্বর শুনে সে ঘুরে তাকায়, রবোর্টটি কিছু খাবার নিয়ে এসেছে।
আমাকে তাহলে এই মুহূর্তে মারবে না, সুহান নিজেকে বোঝাল, তাহলে এখন খাবার এনে হাজির করত না। কিংবা কে জানে হয়তো পরিপাকযন্ত্র কীভাবে কাজ করে জানতে চাইছে, তাই খাবারটা মুখে দেয়ামাত্রই মেরে ফেলবে।
আপনার খাবার, মহামান্য সহান। রবোটটি দ্বিতীয়বার কথা বলল, যান্ত্রিক একঘেয়ে গলার স্বর। সুহান খাবারগুলোর দিকে তাকাল। সে তার মহাকাশযানের রসদ থেকে যে ধরনের খাবার খেয়ে অভ্যস্ত তার থেকে একটু ভিন্ন ধরনের। অন্য সময় হলে সে খাবারগুলো কৌতূহল নিয়ে দেখত, এখন কোনো কৌতূহল নেই। খাবারগুলো দেখে হঠাৎ সুহান বুঝতে পারে সে ক্ষুধার্ত। কিন্তু এই মুহূর্তে তার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। সে রবোটটিকে বলল, তুমি খাবারটি রেখে চলে যাও।
আমার চলে যাওয়ার নির্দেশ নেই।
তোমার কিসের নির্দেশ রয়েছে?
আপাতত আপনার জন্যে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা।
তাহলে দাঁড়িয়ে থাক।
আপনার খাবার, মহামান্য সুহান।
সুহান বুঝতে পারে এটি অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর রবোট। হঠাৎ করে তার মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল। এই নির্বোধ রবোটটিকে কি কোনোভাবে ধোকা দেয়া সম্ভব?
সুহান আবার রবোটটির দিকে ঘুরে তাকাল, চতুষ্কোণ দেহ, বর্তুলাকার মাথা, উপরের অংশটুকু সম্ভবত চোখ, পায়ের নিচে চাকা, সম্ভবত সহজে সমতল জায়গার বাইরে যেতে পারে না। সুহান ট্রে থেকে এক টুকরা তুলে নিয়ে বলল, তুমি কোন শ্রেণীর রবোট?
উত্তর দেয়ার অনুমতি নেই, মহামান্য সুহান।
তুমি কি আমাকে চোখে চোখে রাখছ?
হ্যাঁ, মহামান্য সুহান।
সুহান হেঁটে রবোটটির পিছনে গিয়ে দাঁড়াল, রবোটটি কিন্তু সাথে সাথে তার দিকে ঘুরে তাকাল না। সুহান বলল, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে নেই, আমি ইচ্ছে করলেই দরজা খুলে বের হয়ে যেতে পারি।
রবোটটি তখন সুহানের দিকে ঘুরে তাকাল, তারপর বলল, মহামান্য সুহান, দরজার সাথে এলার্ম লাগানো হয়েছে। আপনি খুলে বের হতে পারবেন না। তাছাড়া দরজায় শক্তিবলয় লাগানো হয়েছে, আপনি বের হওয়ার চেষ্টা করলে আপনার শরীরে আনুমানিক তিন শ চৌত্রিশটি ফুটো হয়ে যাবে।
তিন শ চৌত্রিশটি?
জি, মহামান্য সুহান।
সুহান দরজাটির দিকে তাকাল। দরজার সাথে একটি এলার্ম লাগানো হয়েছে দেখা যাচ্ছে। সেটি বিকল করা কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। দরজা খোলার পর সম্ভবত অন্য পাশে রবোটটির শক্তিবলয় ব্যাপারটি দেখা যাবে। শক্তিবলয় কথাটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার হতে পারে। উচ্চচাপের বিদ্যুৎ বা অদৃশ্য লেজার সম্ভবত এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। যেহেতু রববাটটি জানে, বের হওয়ার চেষ্টা করলে তার শরীরে তিন শ চৌত্রিশটি ফুটো হয়ে যাবে, এটি সম্ভবত লেজার রশ্মি, দরজার দুই পাশে প্রতিফলিত হয়ে যাচ্ছে। কোথা থেকে বের হচ্ছে জানতে পারলে একটি চকচকে জিনিস দিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে আটকে রাখা যায়।
কিন্তু দরজা দিয়ে বের হওয়ার আগে রবোটটিকে ধোকা দিতে হবে। সেটি কেমন করে করা হবে?
সুহান আবার রবোটটির পিছনে হেঁটে গেল, রবোটটি সাথে সাথে তার দিকে ঘুরে গেল। সুহান জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এখনো আমার দিকে লক্ষ রাখছ?
রাখছি, মহামান্য সুহান।
কেমন করে? তুমি আমার দিকে তাকিয়ে নেই।
আপনার দিকে না তাকিয়েও আমি আপনার দিকে লক্ষ রাখতে পারি মহামান্য সুহান।
সুহান ঘরে পায়চারি করতে থাকে। এটি অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর রবোট, তাকে লক্ষ রাখার জন্যে অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর একটি পদ্ধতি ব্যবহার করছে। পদ্ধতিটি কী হতে পারে?
হঠাৎ সে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে ওঠে, পালসার! তার শরীর থেকে পালসারটি বের করে সেটি কোথায় রাখা যায় চিন্তা করে না পেয়ে আপাতত তার বুড়ো আঙুলের নখে একটা টেপ দিয়ে লাগিয়ে রাখা হয়েছিল। পালসারটির কথা ভুলেই গিয়েছিল সে। একটু আগে কিরি যখন এর কথা উল্লেখ করেছিল সে বুঝতে পারে নি। কিউ-২২ রবোটগুলো তাই এত সহজে তাকে তার ইঞ্জিনঘরে খুঁজে পেয়েছিল। এখন এই রবোটটি নিশ্চয়ই সব সময় তার পালসারের সঙ্কেতটুকু লক্ষ করছে। ব্যাপারটি সত্যি কি না খুব সহজে পরীক্ষা করা যায়। রবোটটির পিছনে গিয়ে তার নখে লাগানো পালসারটি একটা ধাতব কিছু দিয়ে ঢেকে ফেলবে। রবোর্টটি তখন নিঃসন্দেহে তার দিকে ছুটে আসবে।
সুহান তার খাবারের টেবিল থেকে একটা চামচ তুলে নেয়, তারপর রবোটের পিছনে দাঁড়িয়ে চামচটা দিয়ে তার হাতের বুড়ো আঙুলের নখটা ঢেকে ফেলে। সাথে সাথে রবোটটি বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে যায় এবং পাগলের মতো তার দিকে ছুটে আসে। সে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও তাকে রবোটটি দেখতে পেল বলে মনে হল না, তার পাশ দিয়ে ছুটে যেতে শুরু করল।
সুহান তার নখের উপর থেকে চামচটা সরিয়ে বলল, কী হয়েছে তোমার?
আপনাকে খুঁজছিলাম, মহামান্য সুহান। মুহূর্তের জন্যে আপনি হারিয়ে গিয়েছিলেন।
না, আমি হারাই নি। আমি এখানেই আছি।
উত্তেজনায় সুহানের বুক কাঁপতে থাকে। এই ঘর থেকে পালিয়ে যাবার চমৎকার একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। তার বিছানার উপর পালসারটি রেখে সে দরজার কাছে যাবে। চামচটিকে একটা হাতের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এলার্মটি বন্ধ করে দেবে। তারপর দরজা খুলে লেজাররশ্মিটি কোন বিন্দু থেকে বের হচ্ছে বের করে সেটি চামচ দিয়ে ঢেকে দেবে। চামচটি চকচকে, লেজাররশ্মি সহজেই প্রতিফলিত হয়ে যাবে। তারপর সে লাফিয়ে এই ঘর থেকে বের হয়ে যাবে। এই মহাকাশযানটি ঠিক তার মহাকাশযানের মতো। একবার বের হতে পারলে কোনদিকে যেতে হবে সে জানে।
তাকে এই মুহূর্তে কেউ লক্ষ করছে কি না সে জানে না। সম্ভবত উপরে কোনো ক্যামেরা রয়েছে। কিন্তু সেটা নিয়ে সে এখন চিন্তা করবে না। সুহান তার কাজ শুরু করে দিল।
তিন মিনিট পর মহাকাশযানের করিডোর ধরে সুহানকে ব্যস্ত হয়ে ছুটে যেতে দেখা গেল।
০৪.
মহাকাশযানের তিনটি জেনারেটর নিচে। ঘরটি নির্জন, কোনো মানুষজন নেই। পারমাণবিক শক্তি দিয়ে জেনারেটরগুলো চালানো হয়। প্রথম জেনারেটরটি সর্বক্ষণ চলতে থাকে। কোনো কারণে সেটি অকেজো হয়ে গেলে দ্বিতীয় জেনারেটরটি চলতে শুল্ক করে। সম্ভাবনা খুব কম কিন্তু যদি কোনো কারণে একই সাথে প্রথম এবং দ্বিতীয়, দুটি জেনারেটরই অকেজো হয়ে যায়, তখন তৃতীয় জেনারেটরটি চলতে শুরু করে। যদি কোনোভাবে তৃতীয় জেনারেটরটিও অকেজো হয়ে যায় তখন মহাকাশযানের সংরক্ষিত এই ব্যাটারিগুলো কাজ করতে ক্ষ করে। এই ব্যাটারিগুলো দীর্ঘস্থায়ী কিন্তু তার মাঝে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ খুব কম। তখন মহাকাশযানের অপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম বন্ধ করে দেয়া হয়। মহাকাশযানের বেশিরভাগ আলো নিভে যায়, কম্পিউটারে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণটুকু চাল রাখা হয়, কায়োজেনিক ঘরে অপ্রয়োজনীয় শীতলতা দূর করে দেয়া হয়। ভ্রূণ এবং অন্যান্য জীবন্ত প্রাণ রক্ষা করার জন্যে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম ছাড়া অন্যান্য সব ধরনের কাজকর্ম বন্ধ করে দেয়া হয়। মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে তিনটি জেনারেটরই একসাথে অকেজো হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে নি। সুহান জেনারেটর তিনটির সামনে দাঁড়িয়ে এই ইতিহাস তৈরি করার প্রস্তুতি নিতে থাকে।
প্রথম জেনারেটরটি চলছে বলে সেটি অকেজো করা সহজ নয় কিন্তু অন্য দুটি খুব সহজে অকেজো করে দেয়া যায়। বিদ্যুতের যে লাইন রয়েছে সেগুলো ঠিক গোড়াতে কেটে দিতে হবে। সেগুলো কাটার যন্ত্রপাতি ঘরটিতে পাওয়া গেল। সেগুলো রবোটেরা ব্যবহার করে বলে অনেক বড় এবং ভারি। টেনেহিঁচড়ে সে যন্ত্রগুলো এনে বৈদ্যুতিক তারগুলো কেটে দিতে শুরু করে। দূরে নিশ্চয়ই কোথাও কর্কশ স্বরে এলার্ম বাজতে রু করেছে। কিন্তু সমস্যাটি আবিষ্কার করে রবোটদের এখানে পৌছাতে পৌছাতে সে অনেকগুলো মূল্যবান সেকেন্ড পেয়ে যাবে।
সুহান প্রথম জেনারেটরটির সামনে এসে দাঁড়াল। জেনারেটরটি প্রচণ্ড বেগে ঘুরছে, ভেতরের গরম বাতাস বের হওয়ার জন্যে উপরের খানিকটা অংশ খোলা। নিরাপত্তার জন্যে সেটার কাছে যাওয়ার উপায় নেই। সুহান নিরাপত্তার অংশটুকু অকেজো করে দিয়ে এগিয়ে যায়। তার যখন দশ বছর বয়স সে তখন প্রথম জেনারেটরটি কৌতূহলী হয়ে অকেজো করেছিল। ব্যাপারটি সে খুব ভালো করে জানে।
সুহান জেনারেটরের খোলা অংশের ঢাকনাটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলতে শুরু করে। ঠিক তখন সে উপরে রবোটের পদক্ষেপ শুনতে পায়। আর বেশি দেরি করা ঠিক নয়। ভারি একটা ট্রান্সফর্মার দুই হাতে তুলে নিয়ে সে জেনারেটরের ভেতরে প্রচণ্ড বেগে ঘূর্ণায়মান শ্যাফটের মাঝে ফেলে দিল।
সাথে সাথে যে ব্যাপারটি ঘটল তার কোনো তুলনা নেই। ভয়ঙ্কর একটি বিস্ফোরণে বিশাল জেনারেটরটি কেঁপে ওঠে। বিদ্যুতের প্রচণ্ড ঝলকানি, তীব্র আলো আর কানফাটা শব্দে সমস্ত ঘরটি থরথর করে কেঁপে ওঠে। ধাতুর টুকরো চারদিকে উড়তে থাকে, ছোট একটি আগুন জ্বলতে শুরু করে এবং হঠাৎকরে মহাকাশযানের সমস্ত আলো নিভে গভীর অন্ধকারে চারদিক ঢেকে যায়। মহাকাশযানের অসংখ্য যন্ত্রপাতি থেমে গিয়ে হঠাৎ করে বিচিত্র এক ধরনের নৈঃশব্দ্য নেমে আসে।
সুহান কয়েক মুহুর্ত অপেক্ষা করে, ছোট আগুনটি তার নেভানোর প্রয়োজন নেই, রবোটদের সেটি আরো কিছুক্ষণ ব্যস্ত রাখতে পারবে। সে ঘোট একটি ঢাকনা খুলে একটি ছোট টানেলে ঢুকে যায়। এই ধরনের মহাকাশযানের খুঁটিনাটি তার থেকে ভালো করে আর কেউ জানে না।
৫.
লাইনা তার ঘরে জানালার কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সমস্ত মহাকাশযান গভীর অন্ধকারে ঢেকে আছে, যন্ত্রপাতির কোনো শব্দ নেই। এই নৈঃশব্দ্য এক ধরনের আতঙ্ক জাগিয়ে দেয়। কিন্তু লাইনার বুকে কোনো আতঙ্ক নেই। সে নিশ্চিত নয় কিন্তু তার ধারণা, এটি দুর্ঘটনা নয়। এটি খুব ঠাণ্ডা মাথায় কেউ করেছে। এই ধরনের কাজ খুব ঠাণ্ডা মাথায় শুধুমাত্র একটি মানুষ করতে পারে, সে হচ্ছে সুহান। যে মানুষ কোন যন্ত্র কেমন করে কাজ করে জানে শুধু সেই মানুষই সেই যন্ত্র এত সহজে ধ্বংস করতে পারে। লাইনা তাই তার ঘরে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, সে জানে না কেন, কিন্তু তার মনে হচ্ছে সুহান এখানে অসিবে।
লাইনা জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, বহুদূরে একটা আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে তার লাল আভায় চারদিকে এক ধরনের বিচিত্র লাল আভা। কী বিচিত্র এই গ্রহটি!
লাইনা হঠাৎ ঘরে একটি পদশব্দ শুনতে পায়। কেউ একজন নিঃশব্দে হাঁটছে তার ঘরে। এই ঘরে নিঃশব্দে হাঁটতে পারে শুধু একজন, সে হচ্ছে কিরি। লাইনার বুক কেঁপে উঠল ভয়ে, চাপা গলায় বলল, কে? কে ওখানে?
আমি। আমি সুহান।
সুহান! লাইনা ছুটে গেল। সাথে সাথে অনুভব করল, একজোড়া শক্ত হাত তাকে নিজের কাছে টেনে নিচ্ছে। তার চুলে মুখ গুঁজে ফিসফিস করে বলছে, লাইনা, আমার মনে হয় আমি তোমার প্রেমে পড়েছি।
লাইনা মুখ তুলে অবাক হয়ে এই কিশোরটির দিকে তাকাল। আবছা অন্ধকারে তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। জানালা দিয়ে ক্ষীণ লাল আলো আসছে, সেই আলোতে মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি সে বুঝি এক ভিন্ন গ্রহের মানুষ।
সুহান মাথা নিচু করে লাইনার ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করে বলল, আমি তোমাকে নিতে এসেছি লাইনা, তুমি যাবে আমার সাথে?
সুহানের চোখে গ্রহটির লাল আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। কী বিচিত্র দেখাচ্ছে তাকে। লাইনা অবাক হয়ে সুহানের দিকে তাকিয়ে রইল, হঠাৎ করে পুরো জীবনটি তার মনে পড়ে যায়। সবকিছু অর্থহীন মনে হতে থাকে, মনে হতে থাকে, সে বুঝি এই আহ্বানটির জন্যেই সারা জীবন অপেক্ষা করে ছিল। লাইনা সুহানের মাথা নিজের কাছে টেনে এনে ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ সুহান, আমি যাব তোমার সাথে।
সত্যি যাবে?
সত্যি যাব।
চল তাহলে।
কেমন করে?
সুহান মৃদু স্বরে হেসে বলল, সেটা নিয়ে তুমি ভেবো না। এই মহাকাশযানের দূষিত বাতাস বের হওয়ার একটা টানেল আছে। সেই টানেল দিয়ে বের হয়ে যাব। দুটি বড় বড় ফ্যানের পিছনে একটা টারবাইন। ফ্যানগুলো যখন ঘুরতে থাকে কেউ বের হতে পারবে না, কিন্তু এখন সব থেমে আছে।
কতক্ষণ থেমে থাকবে?
অনেকক্ষণ। সুহান নিচু গলায় হেসে বলল, আমি সব ধ্বংস করে দিয়েছি।
কেমন করে ধ্বংস করলে?
বলব তোমাকে। এখন চল। টারবাইনটি হাত দিয়ে ঠেলে ঘুরাতে হবে। অনেক শক্ত হবে কিন্তু দুজনে মিলে যদি ঠেলি নিশ্চয়ই খুলে যাবে।
তুমি কেমন করে জান?
আমি জানি। আমি ঠিক এ রকম একটা মহাকাশযানে থাকি। আমারটা অবশ্যি ধসে আছে।
বাইরে কিছু মানুষের, কিছু রবোটের পদশব্দ শোনা যায়। একটা ছোট এলার্ম বাজতে থাকে, আলো দুলাতে দুলাতে কে যেন ছুটে যায়। সুহান বলল, আর দেরি করা ঠিক নয়, চল যাই।
চল। কিন্তু কী নিতে হবে?
তোমার কি অক্সিজেন মাস্ক আছে?
আছে।
সেটা নিয়ে নাও। এই গ্রহের বাতাসে আমি নিশ্বাস নিতে পারি কিন্তু তুমি পারবে কি না জানি না।
সুহানের পিছু পিছু গুড়ি মেরে লাইনা একটা অন্ধকার টানেলের ভিতর দিয়ে যেতে থাকে। সুহান না হয়ে পৃথিবীর অন্য কোনো মানুষ হলে সে তার সমস্ত ভবিষ্যৎ তার হাতে এভাবে তুলে দিত কি না সে জানে না। কিরির সাথে পাল্লা দিয়ে সে যেভাবে দুই দুইবার নিজেকে রক্ষা করেছে তার কোনো তুলনা নেই। মানুষের সনাতন পদ্ধতিতে জ্ঞান লাভের চেষ্টা করলে সে কখনোই পারত না। লাইনার হঠাৎ কেমন জানি বিশ্বাস হতে থাকে, এই আশ্চর্য কিশোরটি হয়তো সত্যিই কিরির চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে।
সম্পূর্ণ অন্ধকার একটি টানেলের ভিতর গড়িয়ে গড়িয়ে দুজন এক সময় একটি খোলা জায়গায় পৌছাল। সামনে শক্ত দেয়ালের মতো, লাইনা হাত দিয়ে দেখে তৈলাক্ত কিছু জিনিসে ভেজা। সুহান চাপা গলায় বলল, টারবাইন। ধাক্কা দিয়ে খুলতে হবে।
শক্ত পাথরের মতো অনড়, ধাক্কা দিয়ে খোলার কোনো উপায় আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু সুহানের দেখাদেখি লাইনাও হাত লাগায়। দীর্ঘ সময় চেষ্টা করে যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিল, তখন সত্যিই সেই বিশাল টারবাইন নড়ে উঠে একটু একটু করে খুলতে থাকে। সাবধানে একজন মানুষ বের হওয়ার মতো জায়গা করে তারা নিচে তাকাল, বাইরে মুক্ত গ্রহ।
সুহান বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে লাইনাকে বলল, তুমি অক্সিজেন মাস্কাট পরে নাও লাইনা।
মহাকাশযান থেকে সুহান অনায়াসে লাফিয়ে নেমে আসে। লাইনা ইতস্তত করছিল। সুহান হাত বাড়িয়ে বলল, ভয় নেই, আমি আছি।
লাইনা সুহানের হাত ধরে নেমে আসে। দুজনে গুড়ি মেরে সরে যেতে থাকে। মহাকাশযানের সেন্সরগুলো কোথায় আছে সুহান জানে। জেনারেটরগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে বলে সেগুলো এখন ঘুরে ঘুরে চারদিকে লক্ষ করছে না, কিন্তু সুহান কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। এই মহাকাশযান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যত দূরে চলে যাওয়া যায়। পাথরের উপর লাফিয়ে সুহান অভ্যস্ত পায়ে ছুটতে থাকে, লাইনা বার বার পিছিয়ে পড়ছিল। পিছনে গ্রহের লালচে আলোতে মহাকাশযানটিকে কেমন জানি ভূতুড়ে মনে হয়।
সামনে একটা বড় পাথর, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুহান তার আড়ালে লুকিয়ে পড়তে চাইছিল, তখন হঠাৎ লাইনা পিছন থেকে তার পিঠ খামচে ধরল। আর্ত চিৎকার করে বলল, সুহান, কী হয়েছে?
ওই দেখ।
সুহান মাথা তুলে তাকায়। সামনে একটি ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। হাতে উদ্যত অস্ত্র তাদের দিকে তাক করা। ছায়ামূর্তিটি এক পা এগিয়ে এসে ধাতব কণ্ঠে বলল, সুহান! আমি তোমার মৃতদেহ নিতে এসেছিলাম। মানুষের মৃতদেহ সমাহিত করতে হয়।
সুহান আনন্দে চিৎকার করে বলল, ট্রিনি!
হ্যাঁ। তোমার সাথে কে?
লাইনা।
আপনার সাথে পরিচয় হয়ে ধন্য অনুভব করছি মহামান্যা লাইন।
লাইনা তখনো ভয়ে একটু একটু কাঁপছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, হঠাৎ দেখে খুব ভয় পেয়ে গেছি।
আপনার ভয় পাওয়ার অনেক কারণ আছে মহামান্যা লাইনা।
কেন, এ রকম বলছ কেন?
সুহান দাবি করছে সে আপনার প্রেমে পড়েছে। এবং সে অনেক বিপজ্জনক কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
লাইনা শব্দ করে হেসে বলল, সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজটি সে ইতিমধ্যে করে এসেছে। ট্রিনি!
সুহান চাপা গলায় বলল, কথা বলার সময় নেই, তাড়াতাড়ি পালাতে হবে।
আমি বাই ভার্বালে শক্তিশালী ব্যাটারি ভরে এনেছি। সুহান, তুমি মহামান্যা লাইনাকে নিয়ে আস।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাই ভার্বালটি মাটি থেকে প্রায় এক-মানুষ উচ্চতা দিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে যেতে থাকল।
সুহান চাপা গলায় বলল, আস্তে ট্রিনি, খারাপ দুর্ঘটনা হতে পারে।
ট্ৰিনি তার কথার কোনো উত্তর দিল না।
০৭. মুখোমুখি
মৃত একটা আগ্নেয়গিরির ভিতর একটি গুহায় লাইনা আর সুহান জড়াজড়ি করে বসেছে। বাইরে ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা। কিরির চোখ থেকে বাঁচার জন্যে তারা যে জায়গাটি বেছে নিয়েছে সেটি গ্রহটির প্রায় অন্য পৃষ্ঠে। জায়গাটা হিমশীতল। সুহান আর লাইনার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে ট্রিনি। তাকে দেখে মনে হতে পারে ঠিক কী করা প্রয়োজন সে বুঝতে পারছে না।
লাইনা বলল, ট্রিনি, তুমি যদি দাঁড়িয়ে না থেকে আমাদের কাছে বসতে, খুব চমৎকার হত।
ট্ৰিনি ঘুরে জিজ্ঞেস করল, কেন চমৎকার হত?
সবাই বসে থাকলে খুব একটা ঘরোয়া ভাব হয়। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন, যখন বাইরে তুষার ঝড় হত তখন আমরা সবাই ঘরের ভেতর জড়াজড়ি করে বসে থাকতাম। একটা আগুন জ্বলত। সত্যিকারের আগুন। সেই আগুনের সামনে আমরা বসে বসে গল্প করতাম।
বসে গল্প করা এবং দাঁড়িয়ে গল্প করার মাঝে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই, মহামান্যা লাইনা।
লাইনা তরল গলায় হেসে উঠে বলল, দাঁড়িয়ে মানুষ আবার গল্প করে কেমন করে? গল্প করতে হয় বসে। একটা আগুনকে ঘিরে। গরম কোনো পানীয় খেতে খেতে। খুব একটা ঘরোয়া ভাব হয়। কোমল শান্ত একটা ভাব।
মহামান্যা লাইনা, আগুন খুব বিপজ্জনক জিনিস। সেটাকে ঘিরে বসে থাকলে শান্ত ভাব হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
সুহান গলা উঁচিয়ে বলল, ট্রিনি, তুমি কেন বাজে তর্ক করছ? মানুষের সভ্যতা এসেছে আগুন থেকে।
মানুষের সভ্যতাটি খুব ভালো জিনিস নয়।
লাইনা খিলখিল করে হেসে বলল, একেবারে খাটি কথা বলেছ তুমি ট্রিনি! একেবারে খাটি কথা!
সুহান লাইনার দিকে তাকিয়ে বলল, লাইনা, ট্রিনিকে তুমি বেশি প্রশ্রয় দিও না, একেবারে জীবন অতিষ্ঠ করে দেবে!
লাইনা ট্রিনিকে বলল, ট্রিনি, তুমি কাছে এসে বস।
সুহান উচ্চৈঃস্বরে হেসে বলল, লাইনা, ট্ৰিনি একটি জোড়াতালি দেয়া রবোট। সে বসতে পারে না! বসার জন্যে হাঁটুর প্রয়োজন হয়। ট্রিনির কোনো হাঁটু নেই।
ট্রেনি বলল, বসার জন্য হাঁটুর প্রয়োজন হয় সেটি পুরোপুরি সত্যি কথা নয়।
ঠিক আছে, পুরোপুরি সত্যি নয় কিন্তু অনেকখানি সত্যি।
ট্রিনি কোনো কথা না বলে গুহা থেকে বের হয়ে গেল। লাইনা জিজ্ঞেস করল, কোথায় গেল ট্রিনি?
জানি না, আসবে এক্ষুনি।
সত্যি সত্যি ট্ৰিনি একটু পরে ফিরে এল, তার হাতে বাই ভার্বালের বাড়তি ছোট ইঞ্জিনটি।
ইঞ্জিন কেন এনেছ ট্রিনি?
এটা চালু করলে আগুন বের হতে থাকে, তখন আমরা সবাই এটাকে ঘিরে বসতে পারি। সুহান যদি আমাকে সাহায্য করে হাঁটু ছাড়াও বসা সম্ভব হতে পারে।
একটু পরে দেখা গেল গুহার মাঝামাঝি বাই ভার্বালের ইঞ্জিন থেকে প্রচণ্ড শব্দ করে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। ইঞ্জিনটির খুব কাছাকাছি, প্রায় বিপজ্জনক দূরত্বে বসে আছে একটি বিভ্রান্ত রবোট এবং দুজন আনন্মেত্ত মানব-মানবী। তারা কথা বলছে, হাসছে, একজন আরেকজনকে স্পর্শ করছে এবং সম্পূর্ণ অকারণে হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের উপর গড়িয়ে পড়ছে।
সেটি ছিল এই গ্রহে মানুষের প্রথম ভালবাসার রাত।
০২.
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে লাইনা আবিষ্কার করল সুহান তার অনেক আগে উঠে গেছে। তার মাথার কাছে একটা ছোট রেকর্ডিং যন্ত্র। সেটা স্পর্শ করতেই সুহানের ত্রিমাত্রিক ছবি ভেসে উঠল, হাত নেড়ে বলছে—আমাদের এখানে দীর্ঘ সময় লুকিয়ে থাকতে হতে পারে। আমি আর ট্রিনি কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে গেলাম। দ্বিতীয় সূর্য ওঠার আগে চলে আসব, তুমি ভয় পেয়ো না। এই জায়গাটি নিরাপদ।
লাইনা তার ঘুমানোর ছোট সিলিন্ডারটিতে উঠে বসে। গত রাতে তার ঘুমোতে অসুবিধা হচ্ছিল বলে তাকে মতিক রেজোনেট করে ঘুমাতে হয়েছে। এভাবে গভীর ঘুম হয় সত্যি কিন্তু ঘুম থেকে ওঠার পর দীর্ঘ সময় চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে থাকে। সিলিন্ডারের ভিতরে বাতাসের অনুপাত ঠিক করে রাখা ছিল। বাইরে যাবার আগে তার সম্ভবত অক্সিজেন মাস্কটি পরে নেয়া দরকার।
লাইনা যখন তার মুখে অক্সিজেন মাস্কটি লাগাচ্ছিল তখন হঠাৎ সিলিন্ডারের ওপর একজন মানুষের ছায়া পড়ে। চোখ তুলে তাকানোর আগেই হঠাৎ লাইনা বুঝতে পারে, মানুষটি কিরি। সে ঘুরে তাকাল, সত্যিই সিলিন্ডারের উপর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। লাইনাকে দেখে সে সহৃদয় ভঙ্গিতে হাসল।
লাইনা একটা আর্ত চিৎকার করতে গিয়ে থেমে যায়। এই নির্জন গ্রহে কেউ তার চিৎকার শুনতে পাবে না।
কিরি হাত দিয়ে অনায়াসে সিলিন্ডারের ঢাকনাটি খুলে ফেলে হাসিমুখে বলল, আমি তোমাকে নিতে এসেছি লাইনা।
লাইনা ভয়ার্ত মুখে কিরির দিকে তাকাল। একটা অমানুষিক আতঙ্কে তার হৃৎস্পন্দন থেমে যেতে চাইছে। কিরি একটা হাত বাড়িয়ে লাইনাকে স্পর্শ করে বলল, তুমি জানতে চাইছ না আমি তোমাকে কেমন করে খুঁজে পেয়েছি?
লাইনা কোনো কথা বলল না।
অনেক কষ্ট হয়েছে লাইনা। কাল সারা রাত দুটি উপগ্রহ তোমাদের খুঁজেছে। জেনারেটরগুলো নষ্ট, মহাকাশযানে বিদ্যুৎপ্রবাহ খুব কম, তাই খুব কষ্ট হয়েছে। কিন্তু তোমাকে পেয়েছি। কিরি সহৃদয় ভঙ্গিতে হেসে তাকে হ্যাচকা টানে ক্যাপসুল থেকে বের করে আনে।
লাইনা কিছু একটা বলার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। কিরি সেটা লক্ষ করল না, অনেকটা নিজের মনে বলল, ছেলেটির জন্যে অপেক্ষা করে লাভ নেই। সে নিজেই আসবে আমার কাছে।
একটু থেমে যোগ করল, আমি যেরকম এসেছি!
কালো একটা ক্যাপসুলে শুয়ে আছে লাইনা, তার দুই হাত উপাসনার ভঙ্গিতে রাখা। তার কপালে এবং হতের কজিতে সেন্সর লাগানো। তার মাথার উপর একটা নীল মনিটর। সেখানে তার তাপমাত্রা, রক্তচাপ, শ্বাসযন্ত্র আর পরিপাকতন্ত্রের অবস্থা, মস্তিষ্কের কম্পন এবং আরো খুঁটিনাটি তথ্য ভেসে আসছে। মাথার কাছে একটি ছোট টিউব দিয়ে মিষ্টি গন্ধের গ্রুস্টান গ্যাস আসছে, তার দেহ অবশ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। প্রথমে শরীর, তারপর মন, সবার শেষে মস্তিষ্ক। তারপর সে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে যাবে।
লাইনা চোখ খুলে তাকাল। তার বুকের ভিতর এক গভীর শূন্যতা। এক গভীর হাহাকার। তার ইচ্ছে করছে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে সারা সৃষ্টিজগৎ ছারখার করে দিতে। কিন্তু সে তার চোখের পাতাও নাড়াতে পারছে না। গভীর ঘুমের জন্যে তার দেহকে প্রস্তুত করছে গ্রস্টান গ্যাস।
ক্যাপসুলের উপর হঠাৎ কিরির মুখ ভেসে আসে। সে মাথা নিচু করে লাইনার কাছাকাছি এসে নরম হাতে তার চুল স্পর্শ করে কোমল গলায় বলল, ঘুমাও লাইনা। ঘুমাও।
লাইনা এক ধরনের অসহায় আতঙ্কে কিরির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিরি তার আরো কাছে এসে বলল, তোমাকে কত দিনের জন্যে ঘুম পাড়াব জান? এক শ বছর! যখন তুমি জেগে উঠবে তখন এই গ্রহে আর কেউ থাকবে না। শুধু তুমি আর আমি। আমি আর তুমি।
কিরি বিষণ্ণ স্বরে বলল, মানুষের বসতি এই গ্রহে হবে না লাইনা। হতে পারত কিন্তু হবে না। কেন হবে না জান? কারণ আমি চাই না, তাই হবে না। আমি দশম প্রজাতির রবোট। আমি যা চাই তাই করতে পারি। আমি মানুষের খুব কাছাকাছি। মানুষ যেরকম অন্যায় করতে পারে, আমিও পারি। মানুষ যেরকম নিষ্ঠুরতা করতে পারে, আমিও পারি। মানুষ যেরকম ভালবাসতে পারে, আমিও পারি!
কিরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি একটি একটি করে প্রাণ ধ্বংস করব। একটি একটি করে ঐণ। তারপর আমি এই ক্যাপসুলের সামনে থাকব। শুধু তুমি আর আমি। আর মহাকাল। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখব, তোমার সুহান এই মহাকাশযানকে ঘিরে ঘুরে বেড়াবে। ধীরে ধীরে তার বয়স হবে, তার চোখের দৃষ্টি ম্লান হয়ে আসবে। তার হৃদযন্ত্র। দুর্বল হবে, ত্বকের মাঝে হবে কুঞ্চিত বলিরেখা। মাথার চুল হবে তুষারের মতো সাদা। তারপর একদিন সে এই মহাকাশযানের বাইরে হাঁটু ভেঙে পড়বে। তার দেহ পড়ে থাকবে দীর্ঘদিন। ঝড়ো বাতাসে একদিন তার দেহ ঢাকা পড়ে যাবে শুকনো বালুর নিচে।
তারপর একদিন আমি তোমাকে ডেকে তুলব। ঘুম ভেঙে উঠবে তুমি, যেন এইমাত্র উঠেছ। তোমার শরীর হবে সতেজ, তোমার মন হবে জীবন্ত। সঙ্গীতের সুর বেজে উঠবে মহাকাশযানে, আর আমার হাত ধরে তুমি হাঁটবে এই করিডোরে। শুধু তুমি আর আমি। আমি আর তুমি।
কিরির সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে, চোখ থেকে হঠাৎ উজ্জ্বল আলো ঠিকরে বের হয়ে আসে। শরীর থেকে বিদ্যুৎফুলিঙ্গ বের হয়ে আসে কিলবিল করে।
ভয়াবহ আতঙ্কে লাইনা কিরির দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে ঘুম নেমে আসছে, ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো ঘুম। সে ঘুমাতে চায় না। তার সমস্ত মনপ্রাণ অস্তিত্ব চিৎকার করতে থাকে কিন্তু তবু তার চোখে ঘুম নেমে আসে। অসহায় মূক এক ধরনের আতঙ্কে ছটফট করতে করতে সে অচেতন হয়ে পড়ে। তার দেহ শীতল হয়ে আসে, ক্যাপসুলের ঢাকনাটা নিচে নেমে আসে ধীরে ধীরে।
কিরি গভীর ভালবাসায় বলল, ঘুমাও লাইনা। সোনামণি আমার।
০৩.
সুহান খোলা সিলিন্ডারটির দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। বুকের মাঝে সে এক গভীর শূন্যতা অনুভব করে, এক গভীর হাহাকার। জীবন পূর্ণতার কত কাছাকাছি এসে আবার শূন্য হয়ে গেল! লাইনা—তার লাইনা! কিরি এসে নিয়ে গেছে তার লাইনাকে।
সিলিন্ডারটা ধরে চিৎকার করে ওঠে সে একটা আহত বন্য পর মতো। দুই হাত দিয়ে আঘাত করে সিলিন্ডারের উপর, মাথা কুটে, তারপর মাটিতে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে শিশুর মতো।
কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ সে মুখ তুলে উঠে দাঁড়ায়। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মোছে। সে একবার আকাশের দিকে তাকাল, তারপর অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। ট্ৰিনি এতক্ষণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিল। সুহানকে উঠে দাঁড়াতে দেখে বলল, তুমি এখন কী করবে সুহান?
সুহান অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কিরির সাথে একটা বোঝাপড়া করতে হবে আমার।
কিরি?
হ্যাঁ। কিরি। হয় কিরি বেঁচে থাকবে, না হয় আমি।
কিরি দশম প্রজাতির রবোট, সুহান।
সুহান ট্রিনির দিকে তাকিয়ে তীব্র স্বরে বলল, আমি প্রথম প্রজাতির মানুষ।
প্রথম প্রজাতির মানুষ?
হ্যাঁ।
ও। ট্ৰিনি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি কেমন করে বোঝাপড়া করবে, সুহান?
আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না।
কেন নয়?
কারণ আমি জানি না।
তুমি জান না?
না।
ও ট্ৰিনি আবার চুপ করে গেল।
সুহান আবার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে এক ধরনের লালচে আভা। আবার ঝড় আসবে। সে অন্যমনকের মতো কয়েক পা হেঁটে সামনে যায়। তারপর ঘুরে ট্রিনির দিকে তাকাল, বলল, ট্রিনি, আমার সেই অস্ত্রটি কোথায়?
কোন অস্ত্র?
আমি যেটা তৈরি করেছিলাম। একটা নল, তার সাথে একটা ট্রিগার, আর ধরার জন্যে একটা হাতল, যার ভিতরে বিস্ফোরক ভরে আমি গুলি করি?
যেটিতে মেগা কম্পিউটার নেই?
হ্যাঁ।
যেটিতে বন্ধ করার জন্যে কোনো লেজার নেই? যেটি তুমি চোখের আন্দাজে ব্যবহার কর? যেটি আসলে কোনো অস্ত্র নয়, একটি বিপজ্জনক খেলনা?
হ্যাঁ, কোথায় সেটা?
আছে এখানে।
আমাকে এনে দাও।
ট্রিনি খানিকক্ষণ সুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ঠিক আছে। এনে দিচ্ছি।
ট্ৰিনি প্রাগৈতিহাসিক যুগের অস্ত্রের মতো দেখতে এই অস্ত্রটি সুহানের উরুর সাথে বেঁধে দিল। জিজ্ঞেস করল, ভেতরে বিস্ফোরক আছে ট্রিনি?
আছে।
বুলেট?
আছে।
বুলেট বিস্ফোরক আছে ট্রিনি?
আছে। চতুর্থ মাত্রার বিস্ফোরক।
সুহান তখন লম্বা পা ফেলে হাঁটতে শুরু করে। ট্রিনি বলল, আমি তোমাকে পৌছে দেব সহান, সাবধানে নিয়ে যাব কিরি যেন টের না পায়।
তার আর কোনো প্রয়োজন নেই, ট্ৰিনি।
ট্ৰিনি নিচু স্বরে বলল, তুমি আমাকে বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়ে চলে যাচ্ছ সুহান।
সুহান ঘুরে ট্রিনির দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, আমার বিদায় সম্ভাষণ জানাতে ভালো লাগে না, ট্রিনি।
কিরি কন্ট্রোলরুমে বড় স্ক্রিনটার সামনে দাঁড়িয়েছিল। সুহানকে সে বাই ভার্বালে করে উড়ে আসতে দেখল। মহাকাশযানটিকে দুবার ঘুরিয়ে বাই ভার্বালটি সে অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে মহাকাশযানের কাছাকাছি থামিয়ে সেখান থেকে নেমে আসে। তারপর সে হেঁটে হেঁটে মহাকাশযানের কাছাকাছি একটা পাথরে হেলান দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার ভিতরে কোনো উত্তেজনা নেই, ঝড়ো বাতাসে তার চুল উড়ছে, তার মাঝে সে সম্পূর্ণ অবিচলিত ভঙ্গিতে মহাকাশযানের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মহাকাশযানের গোল জানালা দিয়ে সুহানকে প্রথম দেখতে পেল রিশা। বিশাল ধু-ধু শূন্য প্রান্তরে একটি বড় পাথরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি অনিন্দ্যসুন্দর কিশোর। এটি যেন কোনো বাস্তব দৃশ্য নয়, যেন একটি স্বপ্নের দৃশ্য। যেন কাল্পনিক কোনো জগৎ থেকে নেমে এসেছে একটি রক্তমাংসের মানুষ। রিশার চিৎকার শুনে কয়েকজন ছুটে আসে। তাদের দেখাদেখি অন্যেরা। কিছুক্ষণের মাঝেই সবাই মহাকাশযানের জানালা দিয়ে অবাক হয়ে বাইরে তাকিয়ে এই বিচিত্র কিশোরটিকে দেখতে থাকে। যাকে হত্যা করার জন্যে কিরি। মানুষ থেকে অমানুষে পাল্টে গেছে।
কিরি তার স্ক্রিনের সামনে দাঁড়িয়ে রইল দীর্ঘ সময়। ছেলেটি খালি হাতে এসেছে, উরুতে কিছু একটা বাধা আছে, সেটি কোনো এক ধরনের অস্ত্র মনে হতে পারে কিন্তু সে জানে সেটি সত্যিকারের অস্ত্র নয়। বলা যেতে পারে, সে এসেছে আত্মহত্যা করতে। কিরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ছেলেটিকে তার হত্যা করার কথা ছিল, কিন্তু এভাবে নয়। কিন্তু সে যদি এভাবেই চায় তাহলে এভাবেই হোক। সে প্রতিরক্ষা রবোটটিকে ডেকে বলল, কিউ-৪৬, মহাকাশযানের দরজা খুলে দাও। আমি একটু যাব।
মহাকাশযানের ভারি দরজা ঘরঘর শব্দ করে উঠে যায়। ঝড়ো বাতাস এসে ঝাপ্টা দেয় কিরিকে। সেই বাতাসে হেঁটে হেঁটে সে সুহানের দিকে এগিয়ে গেল। তার কাছাকাছি গিয়ে নরম গলায় বলল, আমি তোমাকে এভাবে আশা করি নি।
সুহান হিসহিস করে বলল, লাইলা কোথায়?
আছে।
কোথায় আছে?
ঘুমিয়ে আছে। শীতলঘরে ঘুমিয়ে আছে।
সুহান হিংস্র স্বরে বলল, শয়তান!
কিরি শব্দ করে হেসে উঠে বলল, তুমি কেন এখানে এসেছ?
তোমাকে শেষ করতে এসেছি।
তুমি জান আমি দশম প্রজাতির রবোট?
জানি।
তুমি জান আমাকে হত্যা করার মতো কোনো অস্ত্র তৈরি হয় নি পৃথিবীতে?
সুহান তার উরু থেকে অস্ত্রটি টেনে হাতে নিয়ে কিরির দিকে তাক করে বলল, এই অস্ত্রটি পৃথিবীতে তৈরি হয় নি।
তুমি জান আমার দিকে একটি অস্ত্র তাক করা মাত্র আমার সংবেদনশীল দেহ সেটি জানতে পারে? তুমি জান লেজার রশ্মি দৃষ্টিবদ্ধ করা মাত্র আমার কপোট্রনের হাইপার কিউব অস্ত্রের মেগা কম্পিউটার অচল করে দেয়? তুমি জান গুলি করা মাত্র বিস্ফোরক তার গতিপথ পরিবর্তন করে অস্ত্রধারীর কাছে ফিরে যায়?
এখন জানলাম।
তুমি জান আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করার অর্থ নিশ্চিত মৃত্যু?
মানুষ মানুষকে হত্যা করে কিরি। রবোটকে না। রবোটকে ধ্বংস করে। আমি তোমাকে হত্যা করব না, ধ্বংস করব।
কিরি সুহানের দিকে তাকাল, তার মুখের মাংসপেশি শক্ত হয়ে আসে সূক্ষ্ম অপমানে। সুহান তার প্রাগৈতিহাসিক অস্ত্র তুলে ধরেছে। কিরি আবার তাকাল সুহানের চোখের দিকে। কী সহজে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে এই কিশোর! শুধুমাত্র মানুষই বুঝি পারে এ রকম, তার ভিতরে হঠাৎ ঈর্ষার একটি খোচা অনুভব করে সে। সুহানের চোখের দিকে তাকাল। কী ভয়ঙ্কর তীব্র দৃষ্টি! কী গভীর আত্মপ্রত্যয়! কী আশ্চর্য একাগ্রতা! কিরি তার সমস্ত কপোট্রনকে স্থির করিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে লেজার রশ্মির জন্যে, মেগা কম্পিউটারের সঙ্কেতের জন্যে।
সুহান ট্রিগার টেনে ধরল তখন।
কিরি অবাক হয়ে দেখে, সুহানের প্রাগৈতিহাসিক অস্ত্র থেকে একটি বিস্ফোরক ঘুরতে ঘুরতে ছুটে আসছে। তার আগে কোনো লেজাররশ্মি নেই, কোনো দৃষ্টিবদ্ধ করার চেষ্টা নেই, কোনো মেগা কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণ নেই, শুধু একটি সাদামাঠা বিস্ফোরক। কিরির চোখ সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে বিস্ফোরকটিকে, তার কপোট্রনের শক্তিশালী বিদ্যুৎক্ষেত্র বিকল করে দিতে চেষ্টা করে বিস্ফোরকটির গতি নিয়ন্ত্রণকারী কম্পিউটার। কিন্তু সে আবিষ্কার করে কোনো কম্পিউটার নেই বিস্ফোরকটিতে। ঘুরতে ঘুরতে তার দিকে আসছে। একটু উপর দিয়ে কিন্তু এই গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সেটাকে টেনে নামিয়ে আনছে নিচে। ঠিক যখন তার কাছে আসবে এটি সোজা আঘাত করবে তার মাথায়। কিরির কপোট্রন জানে সে সরতে পারবে না, তার দেহ মানুষের মতো ধীরস্থির, তার নড়তে সময় প্রয়োজন, সমস্ত শক্তি দিয়েও সে গুলিটি আঘাত করার আগে এক চুল নড়তে পারবে না। প্রাগৈতিহাসিক একটি অস্ত্র থেকে ছুটে আসছে একটি অন্ধ বিস্ফোরক, তাকে থামানোর কোনো উপায় নেই। কিরি অবাক হয়ে সেটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার কিছু করার নেই, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে অপেক্ষা করতে হবে। সেটি প্রায় এক মহাকাল সময়। সেটি প্রায় একটি জীবন।
কিরি বিস্ফোরকটির দিকে তাকিয়ে থাকে। গভীর বিষণ্ণতায় তার বুক হাহাকার করে ওঠে। মানুষ কেন তাকে সৃষ্টি করেছিল মানুষের সব ক্ষুদ্র দিয়ে মানুষ কেন তাকে সৃষ্টি করেছিল দুঃখ কষ্ট আর বেদনা দিয়ে? মানুষ কেন তাকে তৈরি করেছিল মানুষের এত কাছাকাছি…।
মহাকাশযানের জানালা দিয়ে সবাই দেখল প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কিরির মস্তিষ্ক চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে উড়ে গেল।
০৪.
খুব ধীরে ধীরে চেতনা ফিরে আসছে লাইনার। কেউ একজন তাকে ডাকছে কোমল স্বরে। কে? কে ডাকছে তাকে? আবছা কুয়াশার মতো একটা পরদায় সব ঢাকা, কষ্ট করে চোখ খুলে তাকায় সে। তার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে অনিন্দ্যসুন্দর একটি মুখ, লম্বা কালো চুল, রাতের আকাশের মতো কালো চোখ। কোথায় দেখেছে সে এই মুখ? কোথায়?
আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছিল লাইনা, বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে জোর করে নিজেকে টেনে তুলে আনে লাইনা। চোখ খুলে তাকায় আবার। অপূর্ব সুন্দর একটি মুখ, একটি কিশোরের মুখ, উজ্জ্বল চোখে কিছু একটা বলছে তাকে। কী বলছে সে? কোথায় দেখেছে তাকে? কোথায়?
হঠাৎ করে কিছু একটা মনে পড়ে তার। বুকের ভিতর গভীর ভালবাসার একটি স্রোতধারা বাধ ভেঙে ছুটে আসে হঠাৎ। প্রাণপণে চোখ খুলতে চেষ্টা করে লাইনা। তাকে দেখতে হবে সেই মুখটি। সেই অনিন্দ্যসুন্দর মুখটি। তাকে দেখতেই হবে আর একবার।
পরিশিষ্ট
অনেকগুলো শিশু গোল হয়ে বসে আছে একটি আলোকোজ্জল ঘরে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে ট্রিনি। তার হাতে একটি স্বচ্ছ কোয়ার্টজের প্রিজম। প্রিজমটি উপরে তুলে সে উচু স্বরে বলল, সবাই চুপ করে বস, কারণ এখন আমাদের বিজ্ঞান শেখার সময়। এটি একটি প্রিজম। প্রিজমের মাঝ দিয়ে আলো গেলে কী হবে?
একটি শিশু মুখ ভেংচে বলল, ছাই হবে।
ছিঃ নিশান, এভাবে কথা বলে না। ছিঃ!
কী হয় বললে?
ট্রিনিকে একটু বিভ্রান্ত দেখায়। প্রায় দুই যুগ আগে এই শিশুটির পিতাকে কী বলেছিল মনে করতে পারে না। তার কপোট্রনের মেমোরি মডিউলটি দীর্ঘ ব্যবহারে জীর্ণ, পুরোনো তথ্যের ওপর নতুন তথ্য লেখা হয়ে গেছে। ট্ৰিনি প্রাণপণ চেষ্টা করে একটি উত্তর খুঁজে পাবার কিন্তু কোনো লাভ হয় না। হঠাৎ করে তার ডান হাতটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নড়তে রু করে।
শিশুগুলো উচ্চৈঃস্বরে হাসছে। ট্রিনির আবছাভাবে মনে পড়ে এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছিল। কিন্তু কখন সে মনে করতে পারে না। তার স্মৃতি খুব দুর্বল হয়ে আছে, দীর্ঘ ব্যবহারে তার কপোট্রন জীর্ণ। শুধু মনে পড়ে একটিমাত্র শিশু ছিল তখন, এ রকম অনেকগুলো শিশু নয়।
মানুষের বসতি হয়ে এখন অনেক শিশু হয়েছে এই গ্রহে। শিশুগুলো দুরন্ত, তাদেরকে সামলে রাখা এখন অনেক কঠিন। সুহান আর লাইনাকে বলতে হবে এ রকম করে আর চলতে পারে না। কিছুতেই চলতে পারে না। সুহান আর লাইনা তার কথা না শুনলে অন্যদেরও বলতে হবে। তারা নিশ্চয়ই তার কথা শুনবে। এ রকম করে চলতে পারে না সেটা তাদের স্বীকার করতেই হবে।
কিন্তু ট্ৰিনি জানে এ রকমভাবেই চলবে। কারণ সে মনে হয় এ রকমই চায়। দ্বিতীয় প্রজাতির রবোটের বুকে ভালবাসা থাকার কথা নয়, তার বুকেও নিশ্চয়ই কোনো ভালবাসা নেই। দীর্ঘদিন মানুষের সাথে থেকে এইরকম অযৌক্তিক এবং অর্থহীন কাজ করার বিচিত্র যে প্রবৃত্তির জন্ম নিয়েছে সেগুলো নিশ্চিতভাবেই অতি ব্যবহারে জীর্ণ একটি কপোট্রনের নানা ধরনের ত্রুটি হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু ট্রিনি সেভাবে ব্যাখ্যা করতে চায় না। তার ভাবতে ভালো লাগে সে ভালবাসতে শিখেছে।
মানুষ যেরকম করে ভালবাসে অন্য মানুষকে।