ষুন একটু অবাক হয়ে হানের দিকে তাকিয়েছিল। এবারে আস্তে বলল, প্রমাণিত হল ঘরটি ছোট কিন্তু তার মানে নয় আমরা নৃশংসতা করতে যাচ্ছি।
লি–রয় মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। ষুন ঠিকই বলেছে। রিশান, তোমার সন্দেহের কোনো ভিত্তি নেই
রিশান একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, আমি স্বীকার করছি আমার সন্দেহের কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু আমি এটাও বলছি অতীতে অনেকবার আমার অনেক কিছু নিয়ে সন্দেহ হয়েছিল–ভিত্তিহীন সন্দেহ। যুক্তি নিয়ে তো আর সন্দেহ হতে পারে না, তাহলে তো সেটা সন্দেহ নয় সেটা সত্যি। আমার সেইসব ভিত্তিহীন সন্দেহ বেশিরভাগ সময়ে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু–
কিন্তু কী?
কখনো কখনো সেইসব ভিত্তিহীন সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হয়েছে, অন্তত একবার সেটি বার জন মহাকাশচারীর প্রাণ রক্ষা করেছিল।
লি–রয় হাসার ভঙ্গি করে বলল, আমরা সেটা মনে রাখব রিশান। এখন সেটা নিয়ে আর কিছু করার নেই, কাজেই সেটা মুলতুবি থাক।
থাক।
তাহলে এস মহাকাশ অভিযান নয় নয় শূন্য তিন–এর সদস্যরা, আমাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক সভা শুরু করি।
সবাই নিজের চেয়ারটি টেবিলের কাছাকাছি টেনে নিয়ে এসে ভিসুয়াল মনিটরটির উপর ঝুঁকে পড়ে।
০৩. রিশান প্রায় নগ্ন দেহে
রিশান প্রায় নগ্ন দেহে স্টেনলেস স্টিলের একটি টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে কয়েকটি স্বাস্থ্য–সহায়ক রবোট এবং দুজন টেকনিশিয়ান। শরীরের নানা জায়গায় নানা ধরনের মনিটর লাগাতে লাগাতে টেকনিশিয়ান দুজন বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছিল। রিশান তার এক পা থেকে অন্য পায়ে ভর সরিয়ে বলল, আর কতক্ষণ?
মোটামুটি শেষ। তুমি যখন শীতলঘর থেকে বের হবে তখন শরীরকে আবার ব্যবহারের উপযোগী করার জন্যে এই নূতন মাইক্রো ক্যাপসুলগুলো খুব চমৎকার।
কী করে এগুলো?
শরীরের ভিতরে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। ঠিক সময়ে এক ধরনের এনজাইম বের করতে থাকে।
আমি এর আগে যখন মহাকাশ অভিযানে গিয়েছিলাম তখন এগুলো ছিল না। কেন্দ্রীয় কম্পিউটার ধীরে ধীরে শরীরে মাংসপেশিকে জাগিয়ে তুলত।
সেটি প্রাগৈতিহাসিক প্রযুক্তি।
তাই হবে নিশ্চয়ই।
টেকনিশিয়ান দুজন এবারে ধীরে ধীরে রিশানের শরীরে এক ধরনের নিও পলিমারের পোশাক পরাতে শুরু করে। ভিতরে এক ধরনের কোমল উষ্ণতা, রিশান দুই হাত উপরে তুলে পোশাকটির উষ্ণতা অনুভব করে দেখে। টেকনিশিয়ান দুজনের একজন–যার চেহারায় এক ধরনের ছেলেমানুষি ভাব রয়েছে, জিজ্ঞেস করল, রিশান, এত বড় অভিযানে যাওয়ার আগে তোমার কি ভয় করছে?
না। আমাকে তোমরা নানা ধরনের ওষুধপত্রে বোঝাই করে রেখেছ। এই মুহূর্তে আমার ভিতরে ভয় ক্রোধ দুঃখ কষ্ট কিছু নেই। এক ধরনের ফুরফুরে আনন্দ।
যদি তোমাকে আনন্দের অনুভূতি না দেয়া হত, তাহলে কি তোমার ভয় করত?
মনে হয় করত। আমি ভীতু মানুষ।
তুমি যখন ফিরে আসবে তখন পৃথিবীতে আরো অনেকগুলো বছর কেটে যাবে, সেটা ভেবে তোমার ভিতরে কি একটু দুঃখের অনুভূতি হচ্ছে?
না। আমি এতবার মহাকাশ অভিযানে গিয়েছি যে পৃথিবীতে আমার পরিচিত কোনো মানুষ নেই। যারা ছিল তারা কয়েক শ বছর আগে মরে শেষ হয়ে গেছে।
সত্যি?
হ্যাঁ।
তোমার বয়স কত ছেলে? চব্বিশ?
আমার বিয়াল্লিশ। কিন্তু আমার কত বছর আগে জন্ম হয়েছে জান?
কত বছর আগে?
প্রায় ছয় শ বছর আগে। তোমার সামনে একজন খুব প্রাচীন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে
ছেলেমানুষি চেহারার টেকনিশিয়ানটি এক ধরনের বিস্ময়াভিভূত হয়ে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল, তোমার কি পরিবার আছে, রিশান?।
নেই। মহাকাশচারীদের পরিবার থাকতে হয় না। তাদের নিঃসঙ্গতা শেখানো হয়।
তোমার কোনো প্রিয়জন আছে?
না। আমার কোনো প্রিয়জনও নেই। মহাকাশচারীদের কোনো প্রিয়জন থাকতে হয় না। ছেলেমানুষি চেহারার টেকনিশিয়ানটি রিশানের হাতে একটি ফিতা লাগাতে লাগাতে হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, তোমাকে যদি আবার নূতন করে জীবন শুরু করতে দেয়া হয় তাহলে তুমি কি মহাকাশচারী হবে?
মনে হয় না।
তুমি কী হবে রিশান?
মনে হয় শিশুদের স্কুলের শিক্ষক।
এরপর টেকনিশিয়ান এবং রিশান দুজনেই দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল। রিশানকে মহাকাশ অভিযানের পোশাক পরিয়ে কালো ক্যাপসুলের মাঝে শুইয়ে দেবার পর রিশান নরম গলায় বলল, যাই ছেলে, ভালো থেকো তোমরা।
টেকনিশিয়ান দুজন হাত নেড়ে বলল, বিদায় রিশান। তোমার অভিযান সফল হোক। তুমি আরো সুন্দর পৃথিবীতে ফিরে এসো।
ক্যাপসুলের ঢাকনাটা লাগিয়ে দেবার আগের মুহূর্তে রিশান বলল, তোমাদের একটা কথা জিজ্ঞেস করি।
কর।
আমাদের যে মহাকাশযানে পাঠাচ্ছ সেটি কুরু ৪৩ জাতীয়।
হ্যাঁ। এর মাঝে যে পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র আছে দু–চারটে গ্রহ–উপগ্রহ উড়িয়ে দেয়া যায়, তোমরা সেটা জান?
শুনেছি।
আমরা যাচ্ছি পৃথিবীর মানুষের জন্যে নূতন বসতি খুঁজে বের করতে, আমাদের এত অস্ত্র দিয়ে পাঠাচ্ছে কেন জান?
টেকনিশিয়ান দুজন অবাক হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। ছেলেমানুষি চেহারার টেকনিশিয়ানটি ইতস্তত করে বলল, সেটা তো আমাদের জানার কথা নয়। আমরা হচ্ছি টেকনিশিয়ান–তোমাদের পোশাক পরিয়ে ক্যাপসুলে শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া আমাদের কাজ।
তা ঠিক। কিন্তু আমার কী মনে হয় জান?