চাই না চাই না আমি
তুমি চাও সানি। তোমার মাও তাই চায়।
ছায়ামূর্তিটি মাথা নেড়ে ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ সানি, আমিও তাই চাই।
সানি কোনো কথা না বলে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তার চোখ আবার পানিতে ভরে আসছে, সবকিছু ঝাঁপসা হয়ে আসছে চোখের পানিতে। তার বুকের ভিতরে এক গভীর শূন্যতা এসে ভর করছে, মনে হচ্ছে কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। কিছু না।
.
রিশান সানিকে নিয়ে সুড়ঙ্গ দিয়ে বের হবার ঠিক আগের মুহূর্তে থমকে দাঁড়াল। গুহাটির মাঝামাঝি এখনো সেই ছায়ামূর্তিটি দাঁড়িয়ে আছে। রিশান একটু ইতস্তত করে বলল, নারা, তোমাদের মাঝে কি লি–রয় আছে?
ছায়ামূর্তিটি মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ রিশান। এই তো আমি।
তুমি? রিশান চমকে উঠে বলল, তুমি তো নারা—
আমি নারা আমি লি–রয় আমি কিশি আমি রন আমি আরো অনেকে
রিশান হতচকিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল, বলল তোমরা সবাই এক?
হ্যাঁ। আমরা সবাই এক। আমরা বিশাল একটা মস্তিষ্ক যেখানে সবার নিউরন কাছাকাছি
তোমরা আলাদা আলাদা নও?
না। আমরা এক
তার মানে তার মানে—
তার মানে আমরা মানুষের চাইতেও বুদ্ধিমান হবার ক্ষমতা রাখি রিশান
রিশান হতচকিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। গুহার ভিতরের থলথলে জিনিসটাকে সে চিনতে পেরেছে–এটি দেখতে মানুষের মস্তিষ্কের মতো। বিশাল একটা মস্তিষ্ক মানুষের করোটির মাঝে যেভাবে সাজানো থাকে।
কেন জানি না রিশান হঠাৎ একবার শিউরে ওঠে।
» ১৬. রিশান আর সানি ছোট একটা ঘরে
রিশান আর সানি ছোট একটা ঘরে বসে আছে। ঘরটিতে একটা বৈচিত্র্যহীন বেঞ্চ এবং উপর থেকে আসা কর্কশ এক ধরনের তীব্র আলো ছাড়া আর কিছু নেই। সানি চারদিকে একবার তাকিয়ে বলল, আমাদেরকে এখনো কেন এখানে আটকে রেখেছে?
আমাদেরকে এখানে আটকে রাখে নি, এখানে আমাদের জীবাণুমুক্ত করছে।
কিন্তু অন্য দুজন তো চলে গেল।
হ্যাঁ তারা তো আমাদের মতো গ্রুনি কলোনিতে যায় নি। তাদের জীবাণুমুক্ত করা সহজ। আমাদের দুজনের অনেক সময় নেবে।
ও। সানি খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলল, কিন্তু চুপচাপ বসে থাকতে তো ভালো লাগে না। কিছু তো দেখতেও পারি না
এই তো আর কিছুক্ষণ, তারপর আমরা মূল মহাকাশযানে চলে যাব, সেখানে অনেক কিছু দেখতে পাবে। এই যে গ্ৰহটাতে এতদিন তুমি ছিলে সেটা কেমন তাও দেখবে!
সানি একটা ছোট নিশ্বাস ফেলল, কিছু বলল না। রিশান তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, মন খারাপ লাগছে সানি?
সানি কোনো কথা বলল না। রিশান তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, এই তো আর কয়েকদিনের মাঝে আমরা পৃথিবীতে রওনা দেব–সেখানে পৌঁছে দেখবে তোমার কত ভালো লাগবে। সেখানে তোমার আর কোনোদিন মহাকাশচারীর পোশাক পরে বের হতে হবে না। বাতাস ঝকঝকে পরিষ্কার, তুমি বুক ভরে নিশ্বাস নেবে। আকাশ হবে গাঢ় নীল, মাঝে মাঝে সেখানে থাকবে সাদা মেঘ। কখনো কখনো সেখানে বিদ্যুৎ চমকে চমকে উঠবে, তারপর বৃষ্টি প্রু হবে!
বৃষ্টি?
হ্যাঁ বৃষ্টি! আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি নেমে আসবে।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
তখন তুমি ইচ্ছে করলে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পার, দেখবে বৃষ্টির পানি এসে তোমাকে ভিজিয়ে দেবে!
সত্যি?
হ্যা সত্যি। এই গ্রহে যেরকম কোনো পানি নেই, তুমি প্রত্যেক ফোঁটা পানি বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রাখ–পৃথিবী সেরকম নয়। পৃথিবীর প্রায় বেশিরভাগই পানি!
কী মজা!
হ্যাঁ–খুব মজা। রিশান হেসে বলল, তারপর তুমি যখন তোমাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যাবে, দেখবে তোমার বয়সী ছেলেমেয়ে! তাদের মাঝে কেউ কেউ তোমার প্রাণের বন্ধু হয়ে যাবে–তোমার মনে হবে তোমার সেই বন্ধুদের ছাড়া তুমি কেমন করে একা একা ছিলে এতদিন!
কিন্তু, কিন্তু
কিন্তু কী?
আমি তো কখনো পৃথিবীতে থাকি নি–আমি তো জানি না কী করতে হয়, কী বলতে হয়—
সেটা নিয়ে তুমি কিছু ভেবো না! তারা যখন জানবে তুমি ভিন্ন গ্রহ থেকে এসেছ দেখবে কেমন অবাক হয়ে যাবে!
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
রিশান এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে এই শিশুটির দিকে তাকিয়ে রইল। রহস্যের খোঁজে সে গ্রহ থেকে গ্রহে, মহাকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভয়ঙ্কর সব অভিযানে জীবনের বড় অংশ কাটিয়ে এসেছে; ছোট একটা শিশুর অর্থহীন কৌতূহলের মাঝে যে এত বড় বিষয়, এত অপূর্ব রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে সে কল্পনাও করে নি।
রিশান আর সানি যখন ছোট আলোকিত ঘরটিতে বসে থেকে–থেকে ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেল তখন হঠাৎ একটা সবুজ আলো জ্বলে ওঠে এবং প্রায় সাথে সাথেই ঘরঘর শব্দ করে দরজা খুলে যায়। দরজার অন্য পাশে হান এবং বিটি দাঁড়িয়ে আছে। হান একটু এগিয়ে এসে সানির সামনে দাঁড়িয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, সম্মানিত সানি! আমাদের মহাকাশযানে তোমাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
সানি একটু অবাক হয়ে হানের দিকে তাকাল, ঠিক কী বলবে বুঝতে পারল না। বিটি একটু এগিয়ে এসে সানির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এস আমার সাথে। তোমাকে আমাদের মহাকাশযানটি দেখাই।
সানি একটু ইতস্তত করে বলল, কী আছে মহাকাশযানে?
কত কী আছে, তুমি কোনটা দেখতে চাও সেটা তোমার ইচ্ছে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কুৰু ইঞ্জিন আছে। কৃত্রিম মহাকর্ষ নিয়ন্ত্রণকক্ষ আছে, তুমি ইচ্ছে করলে সেখানে গিয়ে মহাকর্ষ বল অদৃশ্য করে দিতে পারবে, তখন তুমি শূন্যে ভেসে বেড়াবে!