বিটি দুই হাত সামনে তুলে বলল, কিছু আপত্তি নেই।
রিশান হান এবং বিটির কথাপকথন খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল এবং দুজন একটু থামতেই গলার স্বরে একটু গুরুত্ব ফুটিয়ে বলল, তোমরা কী বলবে জানি না, আমি কিন্তু এই অভিযানটিতে এর মাঝে একটা বিশেষত্ব লক্ষ করতে শুরু করেছি।
টেবিলে বসে থাকা চার জনই রিশানের দিকে ঘুরে তাকাল। পাশে বসে থাকা কোমল চেহারার মেয়েটি বলল, তুমি কী বিশেষত্ব খুঁজে পেয়েছ?
আমি আগে যেসব মহাকাশ অভিযানে গিয়েছি সেখানে সবসময় ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মানুষকে একসাথে পাঠানো হত। কেউ পদার্থবিজ্ঞানী কেউ জীববিজ্ঞানী কেউ ইঞ্জিনিয়ার
নিডিয়া নামের কোমল চেহারার মেয়েটি রিশানকে বাধা দিয়ে বলল, কিন্তু তথ্য তো আজকাল আর মানুষের মস্তিষ্কে পাঠানো হয় না; সে জন্যে শক্তিশালী কপোট্রন, কম্পিউটার, রবোট, ডাটাবেস এসব রয়েছে। এখন মানুষকে পাঠানো হয় তার মানবিক দায়িত্বের। জন্যে
তুমি সেটা ঠিকই বলেছ নিডিয়া। রিশান মাথা নেড়ে বলল, আমিও ঠিক একই কথা বলছি। মহাকাশ অভিযানে মানুষের দায়িত্ব হয় মানবিক। দলটি এমনভাবে তৈরি করা হয়। যেন কেউ খুব কঠোর, কেউ অবিশ্বাস্য সুশৃঙ্খল, কেউ আশ্চর্যরকম কোমল, কেউ বা খেয়ালি। দেখা গেছে দীর্ঘকাল একসাথে কাজ করার জন্যে এ রকম ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মানুষের একটি দল খুব চমৎকারভাবে কাজ করে। আমি নিজে একাধিকবার এ রকম অভিযানে গিয়েছি, অসম্ভব দুঃসহ সব অভিযান কিন্তু আমরা কখনো ভেঙে পড়ি নি, তার একটি মাত্র কারণ–আমরা ছিলাম ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মানুষ। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কী জান?
কী?
আমাদের এই দলটিতে আমরা সবাই মোটামুটি একই ধরনের মানুষ।
নিডিয়া ভুরু কুঁচকে বলল, সেটি কী ধরনের?
আমরা সবাই মোটামুটি কঠোর প্রকৃতির মানুষ আমি তোমাদের সবার ফাইল দেখেছি, তোমরা সবাই কোনো–না–কোনো অভিযানে অত্যন্ত কঠোর পরিবেশে পড়েছ এবং সবচেয়ে বড় কথা সেইসব পরিবেশে খুব কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছ।
কেউ কোনো কথা বলল না কিন্তু সবাই স্থির দৃষ্টিতে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল। রিশান খানিকক্ষণ তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, সেইসব কঠোর সিদ্ধান্ত সময় সময় ছিল নিষ্ঠুর, অমানবিক। আমি নিশ্চিত তোমরা সেইসব কথা ভুলে থাকতে চাও।
হান মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, তুমি কী বলতে চাও রিশান?
তুমি জান আমি কী বলতে চাই।
তবু তোমার মুখে শুনি।
আমার ধারণা মহাকাশ অভিযানের কেন্দ্রীয় দফতর ইচ্ছে করে এ রকম একটি দল তৈরি করেছে। আমাদের ব্যবহার করে তারা খুব একটি নিষ্ঠুর কাজ করাবে।
ষুন এতক্ষণ সবার কথা শুনে যাচ্ছিল, এই প্রথম মুখ খুলল, শান্ত চোখে রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার মনে হয় তোমার সন্দেহ অমূলক। আমাদের অভিযানটি পঞ্চম মাত্রার অভিযান। মানুষের ব্যবহার উপযোগী একটা আবাসস্থল খুঁজে বের করা যার প্রধান উদ্দেশ্য। এর ভিতরে নিষ্ঠুরতার কোনো ব্যাপার নেই।
রিশান খানিকক্ষণ ষুনের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, আমি সন্দেহপ্রবণ কুটিল প্রকৃতির মানুষ, আমি তোমার সাথে একমত নই। আমার ধারণা আমাদের পঞ্চম মাত্রার অভিযানের কথা বলে পাঠানো হচ্ছে, কিন্তু গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দেখব একটি দ্বিতীয় মাত্রার নৃশংসতা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।
ষুনের পূর্বপুরুষ সম্ভবত দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার কাছাকাছি কোনো অঞ্চল থেকে এসেছে, তার মাথার চুল কুচকুচে কালো, মঙ্গোলীয় চাপা নাক এবং সরু চোখ। সে স্থির দৃষ্টিতে রিশানের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কঠিন মুখে বলল, তুমি যে কাজটি করছ সেটি মহাকাশ নীতিমালায় একটি আইনবহির্ভূত কাজ–একটি অভিযানের আগে মহাকাশচারীদের সেই অভিযান সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা দেয়া।
রিশান ষুনের দিকে তাকিয়ে রইল, মানুষটি কোনো কারণে তাকে অপছন্দ করেছে, না হয় মহাকাশ নীতিমালার কথা টেনে আনত না। রিশান কী একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই হান কাঠ–কাঠ গলায় হেসে উঠে বলল, ষুন, মহাকাশ নীতিমালার কথা বলে ভয় দেখানোও নীতিমালাবহির্ভূত কাজ–
আলোচনাটি অন্য একদিকে মোড় নিতে যাচ্ছিল ঠিক তখন দরজা খুলে দীর্ঘকায় একজন মানুষ প্রবেশ করে। মানুষটি অত্যন্ত সুদর্শন কিন্তু চেহারায় নিষ্ঠুরতার কাছাকাছি এক ধরনের কাঠিন্য রয়েছে। শরীরে হালকা হলুদ রঙের ঢিলেঢালা একটি পোশাক, হাতের কাছে তিনটি লাল রঙের তারা জ্বলজ্বল করছে। মানুষটি তার জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখা চেয়ারে বসে রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি লি–রয়। এই অভিযানের আনুষ্ঠানিক দলপতি!
নিডিয়া লি–রয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যিকারের দলপতিটি তাহলে কে?
সেটা এখনো ঠিক হয় নি। এই ধরনের দীর্ঘ অভিযানের নেতৃত্ব খুব ধীরে ধীরে যে মানুষটি সবচেয়ে কর্মক্ষম তার কাছে চলে আসে।
ষুন বলল, কিন্তু মহাকাশ নীতিমালা
লি–রয় হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, মহাকাশ নীতিমালা একটি মানসিক আবর্জনা ছাড়া আর কিছু নয়। তোমরা জান মহাকাশ নীতিমালা অনুযায়ী আমি ইচ্ছে করলে তোমাদের প্রাণদণ্ড দিতে পারি।
প্রাণদণ্ড?
তাঁ। আগে প্রমাণ করতে হবে যে তোমরা মানবসভ্যতাবিরোধী কাজ করছ। যখন পাঁচ–ছয় জন মানুষ ছোট একটা মহাকাশযানে করে কয়েক শতাব্দীর জন্যে কোনো অজানা গ্রহের দিকে যেতে থাকে তখন মানবসভ্যতা জাতীয় বড় বড় কথাগুলোর কোনো অর্থ থাকে না। ওই মানুষগুলো তখন একটা পরিবারের সদস্য হয়ে যায়। তাদের ভিতরে তখন কোনো আনুষ্ঠানিক নিয়মকানুন থাকে না, থাকা উচিত না।