রিশানের কথার জন্যেই হোক আর অন্য যে কারণেই হোক, দেয়াল থেকে ছুটে আসা আধা তরল, আঠালো লকলকে জিনিসটা তাকে ছেড়ে দিয়ে আবার গড়িয়ে গড়িয়ে দেয়ালের দিকে ফিরে গেল। রিশান সাবধানে উঠে বসতে চেষ্টা করে, সমস্ত শরীর প্যাঁচপ্যাঁচে আঠালো তরলে ঢেকে গেছে, কোনোমতে নিজেকে টেনেহিঁচড়ে সে সোজা করে দাঁড়া করায়। সানি গুহার এককোনা থেকে তার দিকে ছুটে এসে বলল, ওরা অনেক রেগে আছে। অনেক রেগে আছে।
কেন?
তুমি কথা বলেছ তাই। তোমার কথা ওরা শুনতে চায় না।
কেন আমার কথা শুনতে চায় না?
আমি জানি না।
কিন্তু ওদের আমার কথা শুনতে হবে, আমি ওদের বাঁচাতে এসেছি। রিশান এমপ্লিফায়ারটা হাতে নিয়ে চিৎকার করে বলল, আমি তোমাদের বাঁচাতে এসেছি
রিশানের কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ অন্ধকার গুহাটিতে যেন প্রলয় কাও শুরু হয়ে গেল। পাথরের দেয়ালে ঝুলে থাকা থলথলে জিনিসগুলো ফুলে ফেঁপে ওঠে, লকলকে জিভের মতো লম্বা লম্বা ঔড় বের হয়ে আসে, হিসহিস হিংস্র শব্দে সমস্ত গুহা প্রতিধ্বনিত হতে থাকে–
রিশান এটমিক ব্লাস্টারটি চেপে ধরে রেখে বলল, খবরদার কেউ আমার কাছে আসবে, আমি গুলি করে শেষ করে দেব–
সাথে সাথে আবার ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা যেতে থাকে, সমস্ত গুহা যেন থরথর করে কেঁপে ওঠে। রিশান নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, আমি তোমাদের বাঁচাতে এসেছি। আমি ছাড়া আর কেউ তোমাদের বাঁচাতে পারবে না। বিশ্বাস কর আমার কথা
রিশান নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সমস্ত গুহাটি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে, হিংস্র শব্দেও থরথর করে কাঁপতে থাকে। কিছু একটা যেন অসহ্য ক্রোধে ফেটে পড়তে চায়। রিশান মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকিয়ে এটমিক ব্লাস্টারটি শক্ত করে ধরে রেখে বলল, পৃথিবী থেকে নিক্সিরল পাঠিয়েছে, সেখান থেকে বাচার একত্র উপায় অক্সিজেন। আমি তাই অক্সিজেনে ভাসিয়ে দিচ্ছি তোমাদের–
রিশান ভীত চোখে চারদিকে তাকাল, তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয় কিন্তু হঠাৎ তার মনে হতে থাকে কেউ একজন তার কথা শুনছে আগ্রহ নিয়ে। সে বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, আমি বাইরেও অসংখ্য অক্সিজেনের উৎস ছড়িয়ে এসেছি। তারা অক্সিজেন বের করছে এখন। তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্যে বিস্ফোরক রেখেছি। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হবে কিছুক্ষণের মাঝেই, তোমরা ভয় পেয়ো না।
সানি খুব ধীরে ধীরে রিশানের কাছে এগিয়ে এসে তার হাত স্পর্শ করে। রিশান ঘুরে তার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, তুমি কিছু বলবে সানি?
তোমার কথা শুনছে!
হ্যাঁ।
আর রাগ করছে না, দেখেছ?
হ্যাঁ সানি। আর রাগ করছে না–
রিশানের কথা শেষ হবার আগেই বাইরে থেকে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে, ভিতরে থলথলে জিনিসগুলো আবার হিসহিস করতে শুরু করে, সরসর করে নড়তে থাকে, স্থানে স্থানে প্যাঁচপ্যাঁচে আঠালো তরল ফিনকি দিয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। রিশান গলা উচিয়ে বলল, তোমরা ভয় পেয়ো না, আমি এই বিস্ফোরকগুলো দিয়েছি। একটু পরে আরো বড় একটা বিস্ফোরণ হবে, একটা আগ্নেয়গিরির মাথা উড়িয়ে দেয়া হবে অগ্ন্যুৎপাত শুরু করার জন্যে–আশপাশে তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্যে আমি ইচ্ছে করে করেছি।
খুব ধীরে ধীরে ভিতরের পরিবেশ একটু শান্ত হয়ে আসে এবং ঠিক তখন প্রচণ্ড বিস্ফোরণটি এসে তাদের আঘাত করে–
হান নিশ্চয়ই পারমাণবিক বিস্ফোরণে আগ্নেয়গিরির চূড়োটি পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছে। সমস্ত গুহাটি ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে উঠল, উপর থেকে পাথরের টুকরো ভেঙে ভেঙে পড়ছে, ধুলো উড়ছে, দেয়ালে থলথলে প্রাণীগুলো থরথর করে কাঁপছে, এক ধরনের জান্তব চিৎকার। দেয়াল থেকে ভয়ঙ্কর আক্রোশে কিছু একটা তাদের দিকে ছুটে আসতে শুরু করেছে, রিশান লাফিয়ে সরে গিয়ে সানিকে জাপটে ধরে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। কিছু একটা আঘাত করল তখন এবং কিছু বোঝার আগেই রিশান জ্ঞান হারাল।
১৫. রিশানের মনে হল
রিশানের মনে হল সে একটা পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। যতদূর চোখ যায় নিচে একটা বিস্তৃত অরণ্য। সবুজ দেবদারু গাছ ঝোঁপঝাড় লতাগুল্ম জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। একটা ছোট নদী কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে। নদীর পানিতে রোদ পড়ে ঝিকমিক করছে। নদীর পানি থেকে হঠাৎ হুস করে ভেসে উঠল একটি মেয়ে দুই হাত উপরে তুলে চিৎকার করে উঠল, বাচাও বাঁচাও আমাকে বাঁচাও
রিশান ছুটে যেতে চাইল নিচে কিন্তু হঠাৎ গাছের লতাগুল্ম তাকে পেঁচিয়ে ধরল সাপের মতো, সে ছুটে যেতে চাইছে কিন্তু যেতে পারছে না। পা বেঁধে পড়ে যাচ্ছে নিচে। মেয়েটি ভেসে যাচ্ছে পানিতে, চিৎকার করে ডাকছে তাকে রিশান–রিশান–রিশান–
রিশান চোখ খুলে তাকাল। চারদিকে চাপা অন্ধকার, তার মাঝে সত্যি সত্যি কেউ ডাকছে তাকে। রিশান তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল, তার উপর ঝুঁকে আছে সানি, ভয়ার্ত গলায় ডাকছে, রিশান রিশান
রিশান শুকনো গলায় বলল, কী হয়েছে সানি?
তুমি বেঁচে আছ? আমি ভেবেছিলাম মরে গেছ।
আমি মরি নি। রিশান উঠে বসার চেষ্টা করে। চোখ তুলে চারদিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছিল আমার?
পড়ে গিয়েছিলে। পুরো পাহাড়টা ভেঙে পড়ে গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম সবাই মরে যাব আমরা।
রিশান হাতড়ে হাতড়ে যন্ত্রপাতির বাক্সটা বের করে একটা সবুজ মনিটরের দিকে তাকাল, বাইরে তাপমাত্রা কম করে হলেও বিশ ডিগ্রি বেড়ে গেছে। বাইরে নিক্সিরলের পরিমাণ হঠাৎ করে দ্রুত কমতে শুরু করেছে, এভাবে আরো কিছুক্ষণ চলতে থাকলে মনে হয় বিপদ কেটে যাবে। রিশান সানির দিকে তাকিয়ে বলল, সানি, মনে হয় আমরা গ্রুনি কলোনিকে বাঁচিয়ে ফেলেছি।