খানিকক্ষণ যাওয়ার পর হঠাৎ খানিকটা খোলা জায়গা পাওয়া গেল। রিশান সাবধানে এক হাতে তার যন্ত্রপাতির ব্যাগ এবং অন্য হাতে এটমিক ব্লাস্টারটি নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মাথায় লাগানো আলোটি তার আশপাশে খানিকটা জায়গা আলোকিত করে রেখেছে, রিশান সেই আলোতে সামনে তাকায়। চারপাশে পাথরের দেয়াল এবং সেখানে বিচিত্র থলথলে এক ধরনের জিনিস ঝুলছে। জিনিসটি জীবন্ত এবং সেটি ক্রমাগত নড়ছে, এক জায়গা থেকে ধীরে ধীরে অন্য জায়গায় সরসর করে সরে যাচ্ছে। রিশান নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল। তার কেন জানি মনে হতে থাকে সেখান থেকে হঠাৎ কিছু একটা তার দিকে ছুটে আসবে, অক্টোপাসের মতো তাকে জড়িয়ে ধরে তার সমস্ত শরীরকে থলথলে শুড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরবে। কিন্তু সেরকম কিছু হল না, থলথলে জিনিসগুলো তার আশপাশে নড়তে থাকে, সরসর শব্দ করতে থাকে এবং ভিজে এক ধরনের তরল পদার্থ সেখান থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে।
রিশান চাপা গলায় ডাকল, সানি তুমি কোথায়?
এই যে এখানে।
আমি এখানে দেখতে পাচ্ছি না।
তুমি কোথায়?
আমি এইমাত্র ঢুকেছি, সুড়ঙ্গটার কাছে।
তুমি দাঁড়াও আমি আসছি।
হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি আস। এই সুড়ঙ্গের মুখটা আমাদের বন্ধ করে দিতে হবে।
সানি সাবধানে তার যন্ত্রপাতির ব্যাগটা নামিয়ে সেখান থেকে কিছু পলিমার বের করতে থাকে। সুড়ঙ্গটা খুব বড় নয়, সেটাকে বন্ধ করে দেয়া খুব কঠিন হবে না।
রিশান পলিমারের আস্তরণটা দাঁড় করাতে করাতেই দূরে ছোট একটা আলো দেখা। গেল, সানি আসছে।
সানির সমস্ত পোশাকে চটচটে এক ধরনের তরল—
রিশান অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে সানি? পড়ে গিয়েছিলে?
না।
তাহলে? আমাকে আমাকে ধরে ফেলেছিল।
ধরে ফেলেছিল?
হ্যাঁ। সানি ভয়ার্ত মুখে বলল, আমার মাকে আমি খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় গেছে আমার মা?
রিশান হাত বাড়িয়ে সানিকে স্পর্শ করে বলল, আছে নিশ্চয়ই আছে। তুমি ভয় পেয়ো না সানি, আগে আমার সাথে হাত লাগাও। এই যে আস্তরণটা তৈরি করেছি, শক্ত হয়ে যাবার আগে সুড়ঙ্গের মুখটা বন্ধ করে দিতে হবে। তুমি এই পাশে ধর–
সানি কাঁপা হাতে রিশানের সাথে হাত লাগায়, কিছুক্ষণের মাঝেই সুড়ঙ্গের মুখটা বন্ধ হয়ে গেল। রিশান তার মনিটরে লক্ষ করে ভিতরে বাতাসের চাপ বেড়ে যাচ্ছে, সম্ভবত এই গুহাটায় আর বড় কোনো ফুটো নেই।
রিশান আবার সানির দিকে তাকাল, তার মুখে চাপা ভয়, সে মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে। রিশানও আবার চারদিকে তাকাল। হঠাৎ তার বুকটা ধক করে ওঠে, মনে হয় চারপাশের থলথলে জীবন্ত জিনিসগুলো ধীরে ধীরে তাদের ঘিরে ফেলছে। সত্যিই কি এখন তাদের চেপে প্রবে? রিশান জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটা সরিয়ে দিয়ে সানির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, সানি, তুমি তোমার মায়ের সাথে কেমন করে কথা বল?
তোমার সাথে যেভাবে বলি সেভাবে।
রিশান একটু অবাক হয়ে বলল, সত্যি? এমনি বললেই শুনতে পায়?
সবসময় পায় না। তখন আমি আমার মাথাটা পাথরের দেয়ালের সাথে চেপে ধরে কথা বলি, চিৎকার করে কথা বলি–
তার মানে তোমার কথাটা শব্দতরঙ্গ হিসেবে যায়। রিশান তার যন্ত্রপাতির ব্যাগ থেকে ছোট একটা এমপ্লিফায়ার বের করে সানির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও তুমি এর মাঝে কথা বল, কথাটা শব্দতরঙ্গ হিসেবে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া যাবে। তোমাকে তাহলে আর চিৎকার করে কথা বলতে হবে না
সানি এমপ্লিফায়ারটা হাতে নিয়ে বলল, আমি কী কথা বলব?
তোমার মায়ের সাথে কিছু একটা বল। তাকে বল নিক্সিরল গ্যাস ছড়িয়ে পড়ছে, তাই আমরা এভাবে এসে অক্সিজেন ছড়িয়ে দিচ্ছি। বল, বাইরে আমরা বিস্ফোরক বসিয়েছি, সুড়ঙ্গটা বন্ধ করে দিচ্ছি–যা তোমার মনে হয় বল। আমি জানতে চাই উত্তরে তোমার মা কী বলে।
সানি এমপ্লিফায়ারটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল, মা আমি সানি।
সানির কণ্ঠস্বর বহুগুণ বেড়ে গিয়ে সমস্ত গুহার মাঝে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল। রিশান অবাক হয়ে দেখল, থলথলে জিনিসগুলো হঠাৎ কেমন জানি কিলবিল করে নড়ে ওঠে। সানি এমপ্লিফায়ারটা সরিয়ে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করল। তারপর আবার বলল, মা, আমি সানি। তুমি কথা বল। আমার ভয় করছে।
রিশান হঠাৎ চমকে উঠে শুনল–কোথা থেকে জানি কণ্ঠস্বর ভেসে এল, চলে যাও– চলে যাও সানি।
কণ্ঠস্বরটি ঠিক মানুষের কণ্ঠস্বর নয়, শুনে মনে হয় কেউ যেন শব্দ না করে শুধু নিশ্বাস ফেলে কথা বলছে। একসাথে যেন শত সহস্র মানুষ হাহাকার করে নিশ্বাস ফেলছে।
সানি হতচকিত হয়ে রিশানের দিকে তাকাল, তারপর ভয় পাওয়া গলায় বলল, কেন মা? আমি কেন চলে যাব?
রিশান অবাক হয়ে দেখল চারদিকে ঘিরে থাকা থলথলে জীবন্ত জিনিসগুলো আবার সরসর করে নড়তে থাকে, বাতাসে আবার মানুষের হাহাকারের মতো শব্দ হতে থাকে। সানি আবার জিজ্ঞেস করল, কেন আমি চলে যাব মা?
বিপদ… অনেক বড় বিপদ…
রিশান ঠিক শুনতে পেয়েছে কিনা বুঝতে পারল না, সানির দিকে তাকাল। সানিও তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। রিশান এমপ্লিফায়ারটা টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিসের বিপদ?
রিশানের কণ্ঠস্বর শক্তিশালী এমপ্লিফায়ারে করে গুহার মাঝে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে এবং তখন হঠাৎ একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটতে শুরু করে। চারপাশের থলথলে জিনিসগুলো কাঁপতে শুরু করে। কিলবিল করে নড়তে শুরু করে। ক্রুদ্ধ গর্জনের মতো হিসহিস শব্দ হতে থাকে এবং হঠাৎ পাথরের দেয়াল থেকে গলিত স্রোতধারার মতো কিছু একটা ছুটে আসে। কিছু বোঝার আগে কিছু একটা রিশানকে পেঁচিয়ে ধরে তাকে আছড়ে নিচে ফেলে দেয়। রিশান শক্ত হাতে এটমিক ব্লাস্টারটি চেপে ধরে চিৎকার করে বলল, ছেড়ে দাও, না হয় গুলি করে শেষ করে দেব—