একটা বিপজ্জনক বাঁক নিয়ে রিশান কাত হয়ে যাওয়া বাই ভার্বালটি সোজা করে নিয়ে সানির দিকে তাকাল, শিশুটির মুখে কোনো ধরনের অনুভূতি নেই। একটা ছোট শিশু কেমন করে এত নিস্পৃহ হতে পারে রিশান ঠিক বুঝতে পারে না। সে নিচু গলায় সানিকে ডাকল, সানি
সানি তার দিকে না তাকিয়ে বলল, বল।
তুমি কী ভাবছ?
আমি?
হ্যাঁ।
সানি এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, তোমার কি মনে হয় আমার মাকে তুমি বাঁচাতে পারবে?
আমি জানি না সানি– তোমাকে আমি মিছিমিছি আশা দিতে চাই না। তোমার মাকে বাচানোর সম্ভাবনা খুব বেশি নয়। নিক্সিরল গ্যাসটি তৈরিই করা হয়েছে গ্রুনি ধ্বংস করার জন্যে, কাজেই ব্যাপারটি খুব কঠিন।
সানি কোনো কথা না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই শিশুটির ভাবভঙ্গিতে কোনো শিশুসুলভ ব্যাপার নেই। একটি শিশু মনে হয় শুধুমাত্র আরেকটা শিশুর কাছ থেকে শিশুসুলভ ভাবভঙ্গিগুলো শেখে।
রিশান আবার নিচু গলায় ডাকল, সানি
বল।
তোমাকে মনে হয় একটা জিনিস বলা দরকার।
কী জিনিস?
তুমি যাকে তোমার মা বলে সম্বোধন করছ, সে কিন্তু সত্যিকার অর্থে তোমার মা নয়।
সানি ঝট করে ঘুরে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বলছ?
রিশান সাবধানে বাই ভার্বালের নিয়ন্ত্রণটি আয়ত্তের মাঝে রেখে নরম গলায় বলল, তুমি রাগ হোয়ো না সানি, আমার কথা আগে শোন।
না, আমি শুনতে চাই না।
তোমাকে শুনতে হবে সানি। তুমি এই গ্রহে একা একা বেঁচে আছ কেন জান?
কেন?
কারণ তোমার মা কখনো চায়নি তুমিও তার মতো হয়ে যাও। তোমার মা চেয়েছে তুমি মানুষের মতো থেকে একদি নমানুষের পৃথিবীতে ফিরে যাও।
সানি স্থির চোখে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল; কিন্তু কোনো কথা বলল না। রিশান নরম গলায় বলল, আমি কি ভুল বলেছি সানি?
সানি রিশানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল।
সানি, তোমার একটা জিনিস জানতে হবে।
কী জিনিস?
তোমার মা মারা গিয়েছে। এখন যাকে তুমি তোমার মা বলছ সে তোমার মা নয়।
সে তাহলে কে?
সে তোমার মায়ের মস্তিষ্কের অনুকরণে তৈরী একটি প্রাণী।
না– সানি হঠাৎ চিৎকার করে বলল, সে আমার মা!
তুমি যত ইচ্ছে হয় চিৎকার করতে পার; কিন্তু সেটা সত্যিকে পাল্টে দেবে না। তোমার মা মারা গেছে সানি। তার মৃতদেহ মানুষের আবাসস্থলের শীতলঘরে রাখা আছে
থাকুক
রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে সানি আমরা সেটা নিয়ে পরে কথা বলব। এখন আমাকে বল আমরা কি গ্রুনি কলোনির কাছাকাছি এসে গেছি?
হ্যাঁ। ওই বড় পাথরটা পার হয়ে তুমি ডান দিকে থেমে যাও।
ঠিক আছে সানি, তুমি শক্ত করে হ্যান্ডেলটা ধরে রাখ।
বাই ভার্বালটা সাবধানে থামিয়ে রিশান সামনে তাকাল, যেখানে থেমেছে তার সামনে খাড়া দেয়ালের মতো একটা পাহাড় উঁচু হয়ে উঠে গেছে। রিশান তার অবলাল সংবেদী চশমাটি চোখে লাগিয়ে উপরে তাকায়, পাথরের এই খাড়া দেয়ালটি কোনো একটি বিচিত্র কারণে আশপাশের সব পাথর থেকে উষ্ণ। রিশান মাথা ঘুরিয়ে সানির দিকে তাকিয়ে তাকে ডাকল, সানি–
বল।
গ্রুনি কলোনিটা কোথায়?
এই পাথরের পিছনে।
কিন্তু সেখানে তুমি কেমন করে যাও?
সানি হাত দিয়ে উপরে দেখিয়ে বলল, ওই যে উপরে একটা ছোট ফুটো আছে, আমি হামাগুড়ি দিয়ে ভিতরে ঢুকে যাই।
ভিতরে কী আছে সানি।
সানি একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, দেয়ালের মাঝে লেগে আছে ভিজে ভিজে এক রকম জিনিস, প্যাচিয়ে প্যাচিয়ে ভিতরে চলে গেছে। আমি যখন ভিতরে যাই তখন সেগুলো থরথর করে কাঁপে, হলুদ এক রকম ধোঁয়া বের হয়।
তোমার–তোমার ভয় করে না?
সানি কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল।
তখন তুমি কী কর?
আমি তখন আমার মাকে ডাকি।
তোমার মা আসে তোমার কাছে?
মাঝে মাঝে আসে। সাদা ধোঁয়ার মতো দেখা যায়।
তুমি কখনো কথা বলেছ তোমার মায়ের সাথে?
হ্যাঁ। বলেছি।
তোমার মা তোমার কথা বুঝতে পারে?
মনে হয় পারে।
তুমি সত্যি জান?
হ্যাঁ। আমি জানি।
চমৎকার। রিশান একটু ইতস্তত করে বলল, তাহলে তুমি ভিতরে যাও। এই অক্সিজেন সিলিন্ডারটা নিয়ে যাও সাথে। ভিতরে গিয়ে বলবে এই গ্রহে নিক্সিরল ছড়িয়ে দিচ্ছে–মনে থাকবে নামটি?
নিক্সিরল।
হ্যাঁ। বলবে সেটা থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা মাত্র উপায়–পুরোটা অক্সিজেন দিয়ে ভাসিয়ে দেয়া। এই যে লিভারটা আছে টেনে ধরতেই অক্সিজেন বের হতে শুরু করবে। ঠিক আছে?
সানি মাথা নাড়ল, ঠিক আছে।
খুব সাবধান–অক্সিজেন দিয়ে কিন্তু অনেক বড় বিস্ফোরণ হতে পারে। ভিতরে কী আছে আমি জানি না–তাই কোনো স্পার্ক যেন তৈরি না হয়।
হবে না। আমি সাবধান থাকব।
যাও তাহলে। দেরি কোরো না।
তুমি আসবে না?
আমি আসছি। চারদিকে অক্সিজেনের ছোট ছোট উৎস তৈরি করে আসি। কিছু বিস্ফোরকও ফেলে আসতে হবে।
বিস্ফোরক? কেন?
তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্যে। তাপমাত্রা যত বেশি হবে নিক্সিরল তত তাড়াতাড়ি অক্সিডাইজ হবে
ও।
যাও তুমি ভিতরে। আমি আসছি।
সানি ভারি অক্সিজেন সিলিন্ডারটা টেনে টেনে উপরে উঠতে থাকে। রিশান সেদিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় ডাকল, সানি
কী হল।
তোমার কি মনে হয় গ্রুনি কলোনি আমাকে ভিতরে ঢুকতে দেবে?
কেন দেবে না?
আমি যে মানুষ! যে মানুষেরা নিক্সিরল নিয়ে এসেছে
কিন্তু তুমি তো সেরকম মানুষ নও।
তোমার তাই মনে হয়?
হ্যাঁ, রিশান।
ঠিক আছে তাহলে, তুমি যাও। সানি উপরে উঠতে শুরু করতেই রিশান আবার ডাকল, সানি