সে প্রথমে ঘরটিকে ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে পরীক্ষা করে। দেখে বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু নিশ্চিতভাবে এখানে কোনো ধরনের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে যেটি তার ওপর দৃষ্টি রাখছে এবং কোনো একটা তথ্যকেন্দ্রে খবর পাঠিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু ঘরটি মানুষের আবাসস্থলে, কাজেই সেটি নিশ্চয়ই এখানে অক্সিজেন সরবরাহ করে যাচ্ছে, বাতাস পরিশোধন করে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় রাখছে। রিশান খুঁজে খুঁজে বাতাস, তাপ এবং আলোর উৎসগুলো বের করে, তারপর নিজের মহাকাশচারীর পোশাক থেকে যন্ত্রপাতির ছোট বাক্সটি বের করে সেগুলো নষ্ট করে দেয়। সাথে সাথে ঘরের মাঝে এক ধরনের ভূতুড়ে অন্ধকার নেমে আসে। ঘরটিতে এখন অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাবার কথা এবং সেটি কোথাও একটি বিপদ সঙ্কেত পাঠিয়ে তাকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করার কথা। তাকে কীভাবে উদ্ধার করা হবে সে জানে না কিন্তু তার জন্যে প্রথমেই দরজাটি খুলতে হবে। একবার দরজা খোলা হলে বাইরে। বের হবার কিছু একটা ব্যবস্থা করা হয়তো অসম্ভব হবে না।
ঘরটিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে আসছে, সে নিজে মহাকাশচারীর পোশাকের মাঝে রয়েছে বলে তার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। তাপমাত্রাও কমে আসছে, কিছুক্ষণের মাঝেই সেটা বিপদসীমা অতিক্রম করে যাবে। তার মহাকাশচারীর পোশাকের যোগাযোগ কেটে দেয়া হয়েছে কিন্তু তবুও নিশ্চয়ই সেটা তার শারীরিক অবস্থার নানারকম তথ্য পাঠিয়ে যাচ্ছে। সে হাতড়ে হাতড়ে সেই যোগাযোগটাও কেটে দিল, এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি কাজ, যার অর্থ সে এই আবাসস্থলের মূল কেন্দ্র থেকে আর কোনো ধরনের সাহায্য পেতে পারবে না। সাথে সাথে রিশান একটি ক্ষীণ শব্দ শুনতে পায়–শেষ পর্যন্ত সে নিশ্চয়ই একটা বিপদ সঙ্কেত তৈরি করতে পেরেছে।
এই আবাসস্থলে কোনো মানুষ নেই, তাকে উদ্ধার করার জন্যে কোনো এক ধরনের রবোট হাজির হবে, তাদের বুদ্ধিমত্তা বা যুক্তিতর্ক সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। সে কী করবে এখনো জানে না; কিন্তু সেটা নিয়ে ভাবার সময় নেই। রিশান হঠাৎ ঘরের বাইরে একটা শব্দ শুনতে পায়–কিছু একটা তাকে উদ্ধার করতে এসেছে বলে মনে হয়।
খুট করে একটা শব্দ হল এবং সাথে সাথে দরজা খুলে একটা প্রাচীন রবোট এসে ঢোকে, তার মাথার উপরে দুটি ফটোসেলের চোখ, পায়ের নিচে ধাতব চাকা। শক্তিশালী যান্ত্রিক দেহে সেটি প্রায় রিশানের দিকে ছুটে আসতে শুরু করে। রিশানের কাছাকাছি এসে সেটি তাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করল, যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট করে রেখেছে বলে কিছু শুনতে পেল না। রবোটটি তার উপর ঝুঁকে পড়ার চেষ্টা করছে, শারীরিক তথ্যগুলো পৌঁছাচ্ছে না বলে সেটি এখনো কিছু বুঝতে পারছে না। রিশান মুখে যন্ত্রণার মতো একটা ভঙ্গি করে মেঝেতে শুয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিল, রবোটটিকে তখন আরো অনেক ঝুঁকে পড়তে হবে। প্রাচীন এই রবোটগুলো এ রকম ভঙ্গিতে কাজ করার উপযোগী নয়, সেটিকে তখন কোনোভাবে বিভ্রান্ত করার সুযোগ পাওয়া যেতে পারে।
রিশান প্রথমে দুই হাতে তার মাথা স্পর্শ করে, তারপর তাল সামলাতে না পারার ভঙ্গি করে ঘুরে নিচে পড়ে যায়। রবোটটি দ্রুত কিছু বিপদ সঙ্কেত তৈরি করে মূল কেন্দ্রে তথ্য। পাঠাতে শুরু করে রিশানের উপর ঝুঁকে পড়ে। তার সমস্যাটি কোথায় রবোটটি এখনো বুঝে উঠতে পারে নি।
রবোটটি বিপজ্জনক ভঙ্গিতে তার উপর ঝুঁকে পড়েছে। সে যদি হঠাৎ করে খুব জোরে ভরকেন্দ্রে একটা ধাক্কা দিতে পারে সেটা তাল হারিয়ে পড়ে যেতে পারে, তখন কপোট্রনের পিছনে পারমাণবিক ব্যাটারিটা অচল করে দেয়ার সময় পাওয়া অসম্ভব নয়। রিশান চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে মুখে যন্ত্রণার একটা ভাব ফুটিয়ে কথা বলার ভঙ্গি করতে থাকে। যোগাযোগ মডিউল বন্ধ করে রাখা আছে, রবোটটির পক্ষে কথা শোনার কোনো উপায় নেই। মাইক্রোফোনে শব্দতরঙ্গ অনুভব করার একটা চেষ্টা করার জন্যে রবোটটি আরো ঝুঁকে পড়ল এবং রিশান তখন তার বুকের কাছাকাছি অংশ স্পর্শ করে জোরে একটা ধাক্কা দিল, রবোটটি তাল হারিয়ে হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে যায় এবং সেটিকে খুব বিচিত্র এবং হাস্যকর দেখাতে থাকে।
রিশান দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে রবোটটির পিছনে ছুটে গিয়ে কপোট্রনের নিচে হাত দিয়ে ঢাকনাটি খুলে দেখে পাশাপাশি দুটি পারমাণবিক ব্যাটারি লাগানো রয়েছে। হ্যাঁচকা টান দিতেই দুটি ব্যাটারিই খুলে গেল এবং সাথে সাথে রবোটটি সম্পূর্ণ অকেজো জঞ্জালের মতো উবু হয়ে পড়ে রইল। রিশান কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কোথাও অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে না। সে ঘর থেকে বের হয়ে এল। তার হাতে কোনো অস্ত্র নেই, থাকলে ভালো। হত।
রিশান সাবধানে করিডোর ধরে হেঁটে যেতে থাকে। ষুন তার যোগাযোগ মডিউলটি অকেজো করে রেখেছে, যদি সেটা চালু থাকত তাহলে এখন কে কোথায় আছে বুঝতে পারত। আশপাশের শব্দ শোনার জন্যে সে তার পোশাকের সবগুলো ইউনিট চালু করে দেয়। করিডোরের শেষে একটি দরজা, তার অন্য পাশে একটা বড় হলঘরের মতো। হলঘরটি থেকে সে বের হয়ে আরেকটি করিডোরে হাজির হল, তার শেষ মাথায় একটা ঘরে একটা আলো জ্বলছে। রিশান সাবধানে সেদিকে হেঁটে যেতে থাকে এবং ঠিক তখন সে প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেল। বিস্ফোরণটি এসেছে তার এটমিক ব্লাস্টারটি থেকে, যেটি সে সানির হাতে দিয়ে এসেছিল। ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটছে এই আবাসস্থলে– ভেবেচিন্তে কাজ করার সময় পার হয়ে গেছে এখন। রিশান বিস্ফোরণের শব্দের দিকে ছুটে যেতে থাকে।