রিশান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারে না। রিশান সাবধানে আরো কয়েকটি ছবি দেখে, একসাথে বেশ কয়েকটি গ্রুনি জীবাণু একে অন্যের শুড় স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে আছে। এই ছবিটি তার আরো বেশি পরিচিত মনে হচ্ছে, কোথায় সে দেখেছে এই ছবি?
রিশান ছবিগুলোর নিচে লেখা তথ্যগুলো পড়তে থাকে। মাঝে মাঝে গ্রুনি জীবাণু একে অন্যের গঁড় স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন এই শুড়ের মাঝে দিয়ে এক ধরনের সঙ্কেত আদান প্রদান হয় বলে মনে করা হয়–
হঠাৎ রিশান বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল, নিউরন সেল! এই গুনি জীবাণু দেখতে হুবহু মানুষের মস্তিষ্কের নিউরন সেলের মতো! লম্বা শুড়গুলো হচ্ছে নিউরন সেলের এক্সন আর ডেন্ড্রাইটস। মানুষের মস্তিষ্কে অসংখ্য নিউরন সেলের ডেণ্ড্রাইটস একটি অন্য একটির সাথে সিনাপস দিয়ে জুড়ে থাকে, সেখান থেকে আসে মানুষের বুদ্ধিমত্তা–মানুষের সৃজনশীল ক্ষমতা, চিন্তা করার অনুভূতি! একটি নিউরন সেল পুরোপুরি অর্থহীন কিন্তু মানুষের মস্তিষ্কে যখন এক শ বিলিয়ন নিউরন সেল পাশাপাশি সজ্জিত হয়ে থাকে, ডেন্ড্রাইটস দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় তখন সেটা হয়ে যায় এক বিস্ময়কর রহস্য! এই গ্রুনি জীবাণুও নিশ্চয়ই সেরকম। একটি বা অসংখ্য জীবাণু আলাদাভাবে পুরোপুরি বুদ্ধিহীন নিম্ন–শ্রেণীর একটা প্রাণী, কিন্তু যখন এগুলো কোথাও মানুষের মস্তিষ্কের মতো সাজানো হয়ে যায় সেটা হয়ে যায় ঠিক মানুষের মতো বুদ্ধিমান একটা প্রাণী।
রিশান লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, নিশ্চয়ই তাই হচ্ছে এখানে। তাই মানুষ কখনো বুদ্ধিমান। প্রাণীগুলোকে খুঁজে পায় নি, যখনই জোর চেষ্টা করেছে শুধু গ্রুনিকে পেয়েছে। গ্রুনিই হচ্ছে বুদ্ধিমান প্রাণী। গ্রুনিকে ধ্বংস করে দেয়ার অর্থ হচ্ছে এই বুদ্ধিমান প্রাণীকে ধ্বংস করে দেয়া। শুধু তাই নয়, হঠাৎ করে রিশানের আরেকটা জিনিস মনে হল, গ্রুনি যখন কোনো মানুষকে আক্রমণ করে সেটা সোজাসুজি মানুষের মস্তিষ্ককে আক্রমণ করে–একটা করে গ্রুনি জীবাণু একটা করে নিউরনকে ধ্বংস করে। সেই নিগুলো তখন গিয়ে সেই মস্তিষ্ককে অনুকরণ করে কিছু একটা তৈরি করে। সেটা হয়তো সেই মানুষের মস্তিষ্কের মতো হয়, হয়তো সেই মানুষের বুদ্ধিমত্তা জন্ম নেয়, সেই মানুষের স্মৃতি।
রিশান উত্তেজিত হয়ে মাথা নাড়ল, নিশ্চয়ই তাই হয়–তাই সানির মা মারা যাবার পরও সানির জন্যে তার ভালবাসা এখনো গ্রুনিদের মাঝে বেঁচে আছে। তাই ঘুরেফিরে তার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, তাই অন্য সবাই মারা গেলেও নিরা সানিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। স্কাউটশিপ অকেজো করার কৌশলগুলো তাই মানুষের আশ্চর্য বুদ্ধিপ্রসূত! সানি নিশ্চয়ই এসব জানে। তাই লি–রয়কে দিয়ে অন্যদের কাছে খবর পাঠিয়েছিল! রিশান তাড়াতাড়ি তার কমিউনিকেশান মডিউল স্পর্শ করে ষুনের সাথে যোগাযোগ করল ষুন ব্যস্তভাবে করিডোর ধরে হেঁটে যাচ্ছিল, রিশানের আহ্বানে খুব অবাক হয়ে বলল, তুমি কিছু বলবে?
হ্যাঁ, ষুন। আমার মনে হয় আমি এখানকার বুদ্ধিমান প্রাণীদের রহস্য ভেদ করেছি।
তুমি রহস্য ভেদ করেছ?
হ্যাঁ।
আমি জানি কেন এখানে বুদ্ধিমান প্রাণী আছে আর কেন আমরা সেই প্রাণীদের খুঁজে পাই না। আমি এখন জানি কেন গ্রুনিদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
ষুন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, রিশান, আমি জানি তুমি অসম্ভব বুদ্ধিমান, আমি জানি তুমি সত্যিই রহস্য ভেদ করেছ। কিন্তু ধরে নাও তার জন্যে দেরি হয়ে গেছে।
দেরি হয়ে গেছে?
হ্যাঁ, আমি আমার পরিকল্পনার কোনো পরিবর্তন করব না। এর মাঝে নিক্সিরল গ্যাস এই গ্রহে পৌঁছে গেছে, গ্যাসের ট্যাংকগুলোর তাপমাত্রা আস্তে আস্তে বাড়ানো হচ্ছে, আর ঘণ্টাখানেকের মাঝে সেগুলো এই গ্রহে ছড়িয়ে দেয়া হবে। আমি আমার পরিকল্পনামতো এগিয়ে যাব।
কিন্তু ষুন–
আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। ষুন মাথা নেড়ে বলল, তোমাকে শারীরিকভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে। আমি এখন তোমাকে মানসিকভাবে বন্দি করব। তুমি এখন আর। কারো সাথে কথা বলতে পারবে না।
ষুন তার হাতে কী একটা সুইচ স্পর্শ করতেই রিশানের চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ করে এক ধরনের ভয়ঙ্কর নীরবতা নেমে এল রিশানকে ঘিরে। রিশান মাথা ঘুরে তাকাল এবং যেন প্রথমবারের মতো আবিষ্কার করল সে একটা ছোট ঘরে বন্দি হয়ে আছে। বাইরে বের হওয়া দূরে থাকুক, সে কারো সাথে মুখের কথা পর্যন্ত বলতে পারবে না।
অসহ্য ক্রোধে হঠাৎ তার সবকিছু ভেঙেচুরে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে।
১২. রিশান দীর্ঘ সময় ঘরে পায়চারি
রিশান দীর্ঘ সময় ঘরে পায়চারি করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে, তাকে দেখায় খাঁচায় আটকে থাকা একটা বুনো প্রাণীর মতো যেটি কিছুতেই নিজের পরিস্থিতিকে মেনে নিতে পারছে না। রিশান সমস্ত ঘরটি আরেকবার ঘুরে এসে বুঝতে পারল তার কিছু করার নেই; কিন্তু তবুও সে কিছুতেই পুরো ব্যাপারটি মেনে নিতে পারবে না। সব মানুষের ভিতরেই নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ যুক্তিহীন এক ধরনের বিশ্বাস কাজ করে যে কারণে একটি অবাস্তব অসম্ভব পরিবেশেও সে একেবারে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যেতে থাকে। রিশান এ রকম একটা পরিবেশে এসে পড়েছে। তার কিছু করার নেই তবু তাকে চেষ্টা করে যেতে হবে।