কেউ কোনো কথা বলল না। ষুন একটা নিশ্বাস ফেলে রবোটগুলোকে বলল, রিশানকে নিয়ে যাও তোমরা।
রিশান একবার ভাবল সে রবোটগুলোকে বাধা দেবে, কিন্তু অপ্রকৃতিস্থদর্শন এই রবোটগুলোকে যতই নির্জীব এবং দুর্বল মনে হোক না কেন, তাদের ধাতব শরীরে নিশ্চয়ই অমানুষিক জোর। তাদের বাধা দেয়া সম্ভবত খুব বড় ধরনের নির্বুদ্ধিতা। রিশান ষুনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সত্যি এটা করছ?
ষুন মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। তুমি আমার জায়গায় হলে তুমিও করতে।
নিডিয়া ক্লান্ত গলায় বলল, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমার সামনে এটা ঘটছে।
ষুন নিডিয়ার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু এটা সত্যি ঘটছে। বিশ্বাস কর।
১১. রিশান ছোট ঘরটিতে চুপচাপ
রিশান ছোট ঘরটিতে চুপচাপ বসে আছে। ঘরটি বাইরে থেকে বন্ধ, সম্ভবত একটা রবোটকে বাইরে পাহারা হিসেবেও রাখা আছে। তার এখান থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই, সে বের হতে চাইছেও না। বের হয়ে তার কিছু করার নেই। ষুন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করে প্রত্যেকটা কাজ করছে, কোথাও কোনো ফাঁকি নেই। সে এই ঘরে বসে যোগাযোগ চ্যানেলে কান পেতে নানা ধরনের সংবাদের আদান প্রদান থেকে সব খবরাখবর পেয়েছে। মহাকাশযানের মূল সরবরাহ থেকে আটত্রিশটা নিক্সিরল গ্যাসের ট্যাংক এই গ্রহটিতে পাঠানো হয়েছে। ট্যাংকগুলো গ্রহটির বিভিন্ন জায়গায় ভাসমান অবস্থায় আছে। নির্দিষ্ট সময়ে ট্যাংকগুলো ফেটে নিক্সিরল গ্যাস বের হয়ে গ্রহটিতে ছড়িয়ে পড়বে। মানুষের জন্যে গ্যাসটি ক্ষতিকর নয়। এক ধরনের ঝাঁজালো গন্ধ রয়েছে এবং দীর্ঘ সময় নিশ্বাসের সাথে শরীরে প্রবেশ করে এক ধরনের সাময়িক অবসাদ ঘটাতে পারে, কিন্তু গ্রুনি জীবাণুর জন্যে এই গ্যাসটি ভয়ঙ্কর। গুনি জীবাণুটির বেশ অনেকগুলো শুড়ের মতো অংশ রয়েছে, এই গ্যাসটির স্পর্শে সেগুলো সাথে সাথে অকেজো হয়ে যায়, তার ত্বকের ভিতর দিয়ে গ্যাসটি ভিতরে প্রবেশ করে। জীবাণুটির মূল অংশটি তখন মিলি সেকেন্ডের মাঝে ফেটে যায়। ভিতর থেকে যে সমস্ত জৈব অণু বের হয়ে আসে সেগুলো তখন অন্য গ্রুনিকে আক্রমণ করে এবং কিছুক্ষণের মাঝে বিশাল গ্রুনির কলোনি ধ্বংস হয়ে যায়। অত্যন্ত কার্যকরী একটি পদ্ধতি, মানুষ দীর্ঘকাল গবেষণা করে এটি বের করেছে। গ্রহটি বেশি বড় নয়, তার বায়ুমণ্ডলে নির্দিষ্ট পরিমাণ নিক্সিরল গ্যাস সৃষ্টি করার জন্যে আটত্রিশটা ট্যাংকই যথেষ্ট। নিক্সিরল গ্যাস অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলে সহজে অক্সিডাইজ হয়ে অকেজো হয়ে যায়। এই গ্রহে অক্সিজেন খুব কম, বলতে গেলে নেই। যেটুকু আছে সেটাই নিক্সিরলকে ধীরে ধীরে অক্সিডাইজ করে প্রায় ছয় ঘণ্টা পরে নিষ্ক্রিয় করে দেবে। ছয় ঘণ্টা অনেক সময় এর পর এই গ্রহটিতে গ্রুনির কোনো চিহ্ন থাকার কথা নয়।
পুরো ব্যাপারটি চিন্তা করে রিশান ভিতরে এক ধরনের অসহ্য ক্ষোভ অনুভব করে। পৃথিবীর বাইরে একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী অথচ তার একমাত্র যোগসূত্রটিকে কী সহজে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। মানুষের কাছে কি এর থেকে বেশি কিছু আশা করা যেত না?
রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে পুরো ব্যাপারটি ভুলে যাবার চেষ্টা করে। তার পক্ষে যেটুকু চেষ্টা করা সম্ভব সে করেছে। পৃথিবীতেও এর আগে নানা ধরনের অমানবিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, এই গ্রহে কেন নেয়া হবে না? সিদ্ধান্তটি তো হঠাৎ করে নেয়া হচ্ছে না, অনেক চিন্তাভাবনা করে নেয়া হয়েছে। এই গ্রহের প্রত্যেকটা তথ্যকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে, সেই তথ্য দীর্ঘদিন থেকে পর্যালোচনা করা হয়েছে, তারপর সেখান থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের পাঠানো হয়েছে। বিশাল মহাকাশযানে আটত্রিশ ট্যাংক নিক্সিরল থাকা কি একটা দুর্ঘটনা? কিছুতেই নয়।
রিশান সবকিছু ভুলে যেতে চেষ্টা করে, কিন্তু সেটা সহজ নয়। মানুষের মস্তিষ্ক অত্যন্ত বিচিত্র একটি জিনিস, সেটি কখন কীভাবে কাজ করবে সেটি বোঝা খুব মুশকিল। পুরো ব্যাপারটি মাথা থেকে সরিয়ে রাখার একটি মাত্র উপায়, অন্য কিছুতে মনোযোগ দেয়া। ষুন তাকে এই ছোট ঘরটিতে বন্দি করে রেখেছে সত্যি কিন্তু তার যোগাযোগ মডিউলটি অকেজো করে দেয় নি। সে ইচ্ছে করলে মূল তথ্যকেন্দ্র থেকে খবরাখবর নিতে পারে, কোনো একটা কিছু নিয়ে পড়াশোনা করতে পারে। যে জীবাণুটি কিছুক্ষণ পর এই গ্রহ থেকে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে সে সেই গ্রুনি জীবাণু নিয়েই সময় কাটাবার সিদ্ধান্ত নিল।
গ্রুনি জীবাণুটি অত্যন্ত নিম্নস্তরের জীবাণু। এককোষী একটা প্রাণী, কোষের মাঝখানে একটি সাধারণ নিউক্লিয়াস এবং তার চারপাশ দিয়ে শুড়ের মতো কিছু একটা বের হয়ে আছে। এমনিতে দীর্ঘ সময় সেটি সম্পূর্ণ জড় পদার্থের মতো বেঁচে থাকে, নির্দিষ্ট তাপ এবং রাসায়নিক পরিস্থিতিতে সেটা ভাগ হয়ে নিজের সংখ্যা বাড়াতে শুরু করে।
রিশান দীর্ঘ সময় নিয়ে এই জীবাণুটির বংশ বিস্তার পদ্ধতি নিয়ে পড়াশোনা করল, পৃথিবীর জৈবিক প্রাণী থেকে পদ্ধতিটি ভিন্ন কিন্তু সেরকম বৈচিত্র্যময় কিছু নয়, কিছুক্ষণের মাঝেই সে সেটা নিয়ে সময় ব্যয় করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে যোগাযোগটি বন্ধ করার আগে নি জীবাণুর কিছু ছবি দেখে খানিকক্ষণ সময় কাটাবে বলে ঠিক করল। এককোষী প্রাণীর ছবি খুব বেশি চিত্তাকর্ষক হতে পারে না, সে মিনিট পাঁচেক এই জীবাণুটির নানা ভঙ্গিমায় কিছু ছবি দেখে পুরো ফাইলটুকু বন্ধ করার আগে হঠাৎ একটি ছবি দেখে থমকে গেল। দুটি গ্রুনি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে, তারা একে অন্যের শুড় স্পর্শ করে আছে। ছবিটি খুব সাধারণ একটা ছবি কিন্তু এর মাঝে কী একটা জিনিস তার খুব পরিচিত মনে হয় যেটা সে আগে কোথাও দেখেছে। সেটা কী হতে পারে?