কিন্তু রিশান সেসব কিছু বলল না। তার সুদীর্ঘ সুশৃঙ্খল জীবনে সে নিয়মের বাইরে কিছু করে নি, এবারেও করল না। নরম গলায় বলল, পঞ্চম মাত্রার অভিযানে যাওয়া আমার জন্যে একটা অভাবনীয় সুযোগ। আমাকে সেই সুযোগ দেয়ার জন্যে আমি মহাকাশ কেন্দ্রের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
আমি কি তোমাকে নিয়ে যাবার জন্যে এখানে একটা ছোট বাই ভার্বাল পাঠাব?
রিশান পাহাড়ি নদীটির দিকে তাকিয়ে বলল, না এখানে নয়। আমি ঘণ্টা দুয়েকের মাঝে এই পাহাড় থেকে নেমে যাব। নিচে একটি ছোট লোকালয় আছে, আমাকে তার কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে তুলে নিলেই হবে।
উচ্চপদস্থ মানুষটি হলোগ্রাফিক স্ক্রিন থেকে বিস্মিত হয়ে রিশানের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না। রিশান প্রায় কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলল, এখানে একটি বাই ভার্বালকে অত্যন্ত বিসদৃশ দেখাবে।
নিয়ম অনুযায়ী এই মানুষটির নিজে থেকে বিদায় নেবার কথা, কিন্তু রিশান সেজন্যে অপেক্ষা করল না। তাকে বিদায় জানিয়ে কব্জিতে বাধা যোগাযোগ মডিউলটি স্পর্শ করে তাকে অদৃশ্য করে দিল। রিশান একটি নিশ্বাস ফেলে হাত দিয়ে একবার মাটিকে স্পর্শ করল। আবার তাকে এই মাটির পৃথিবীকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। মহাকাশে ছুটে ছুটে সে। তার জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। মহাকাশচারীর জীবন বড় নিঃসঙ্গ, এক একটি অভিযান শেষ করে যখন তারা পৃথিবীতে ফিরে আসে, তারা অবাক হয়ে দেখে পৃথিবীতে শতাব্দী পার হয়ে গেছে। পরিচিতেরা কেউ নেই, প্রিয়জনেরা শীতলঘরে, ভালবাসার মেয়েটির দেহ জরাগ্রস্ত, মুখে বার্ধক্যের বলিরেখা। শহর নগর পাল্টে গিয়েছে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়, মানুষের মুখের ভাষায় দুর্বোধ্য জটিলতা। শুধু যে জিনিসটি পাল্টে নি সেটি হচ্ছে পর্বতমালা বিশাল অরণ্য আর নীল আকাশ। রিশান আজকাল তাই ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে এই পর্বতমালার খোঁজে, নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় বসে খুঁজে পেতে চেষ্টা করে তাঁর হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীকে। শৈশব কৈশোর আর যৌবনে যেই প্রকৃতিকে অবহেলায় দূরে সরিয়ে রেখেছে এখন তার জন্যে বুকের ভিতর জন্ম নিচ্ছে গভীর ভালবাসা।
রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে একমুঠো মাটি তুলে এনে তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সিলিকনের এই যৌগ কী বিচিত্র রহস্যের জন্ম দিয়েছে পৃথিবীতে! প্রাণ নামে এই অবিশ্বাস্য রহস্য কি আছে আর কোথাও?
০২. হলঘরটি বিশাল
হলঘরটি বিশাল, রিশান উপরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়, ছাদ প্রায় দেখা যায় না! বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভিতরে এত বড় একটা ঘর রয়ে গেছে। ঘরের মাঝখানে কালো গ্রানাইটের একটা টেবিল। টেবিলের চারপাশে সুদৃশ্য চেয়ার, চেয়ারের হাতলে যোগাযোগ মডিউলের জটিল মনিটর। ঘরের মাঝে এক ধরনের নরম আলো, সতেজ বাতাস। চোখ বন্ধ করলে মনে হয় বদ্ধ ঘরে নয়, বুঝি সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। রিশান হেঁটে তার জন্যে আলাদা করে রাখা চেয়ারটিতে বসল। সাথে সাথে কানের কাছে কিছু একটা ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করে, মহামান্য রিশান, আমার নাম কিটি, আপনাকে আমি আজকের এই সভাকক্ষ থেকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। সবার আগে আমি আপনাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। আপনার বাম পাশে বসেছেন নিডিয়া। নিডিয়ার পাশে যিনি বসেছেন তার নাম। হান। টেবিলের অন্য পাশে বসেছেন বিটি এবং ষুন। যিনি এখনো আসেন নি তিনি হচ্ছেন দলপতি লি–রয়। মহাকাশ অভিযানে তার অভিজ্ঞতা অভূতপূর্ব। লি–রয় তিন তারকার অধিকারী হয়েছেন অত্যন্ত অল্প বয়সে। তিনি যেরকম দুঃসাহসী ঠিক সেরকম তার ধীশক্তি। অত্যন্ত প্রখর তার বুদ্ধিমত্তা…
রিশান চেয়ারের হাতল খুঁজে যোগাযোগ মডিউলের লাল বোতামটি চেপে ধরতেই কথা বন্ধ হয়ে গেল। যন্ত্রপাতির কথা শুনতে তার ভালো লাগে না। বিশেষ করে সেই কথাবার্তায় যদি মানুষের আবেগের ভান করা হয় সেটা সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না।
রিশান ভিসুয়াল মনিটরটির দিকে এক নজর তাকিয়ে এই টেবিলের মানুষগুলোর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিয়ে মাথা তুলে তাকাল। সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে সে ঠিক কাউকে উদ্দেশ্য না করে বলল, আমি রিশান, তোমরা নিশ্চয়ই এতদিনে খবর পেয়েছ আমি তোমাদের সাথে যাচ্ছি। টেবিলের অন্য পাশে বসে থাকা বিটি নামের সোনালি চুলের মেয়েটি হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, আমরা সেটা জানি। আমরা সবাই আগ্রহ নিয়ে তোমার সাথে পরিচিত হবার জন্যে অপেক্ষা করছি।
রিশান মাথা নেড়ে বলল, সেটা সত্যি হবার কথা নয়, তোমরা নিশ্চয়ই এতদিনে আমার ফাইলটি পড়ার সুযোগ পেয়েছ এবং ইতিমধ্যে জেনে গেছ আমি নেহাত সাদাসিধে কাটখোট্টা মানুষ।
টেবিলে বসে থাকা লাল চুলের ককেশীয় চেহারার মানুষটি মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ি অন্যমনস্কভাবে চুলকাতে চুলকাতে বলল, আমার নাম হান, কাটখোট্টা মানুষদের যদি প্রতিযোগিতা হয় আমি মোটামুটি নিশ্চিত তোমাকে দশ পয়েন্টে হারিয়ে দেব।
বিটি নামের সোনালি চুলের মেয়েটি শব্দ করে হেসে বলল, রিশান, হান একটুও বাড়িয়ে বলছে না। বিনয় জাতীয় মানবিক গুণাবলি খুব যত্ন করে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
হান বিটির দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আমরা একটা মহাকাশ অভিযানে যাচ্ছি, ধর্ম প্রচারে তো যাচ্ছি না, মানবিক গুণাবলির বিকাশ যদি না ঘটে তোমার খুব আপত্তি আছে?