কেউ কোনো কথা বলল না। লি–রয় খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘরের এককোনায় হেঁটে গিয়ে তার মহাকাশচারীর পোশাকটা খুলে ফেলতে ফেলতে বলল, এখন শুধুশুধু এটা পরে থাকার কোনো অর্থ হয় না–যা হবার তা হয়ে গেছে।
ষুন এগিয়ে গিয়ে বলল, কিন্তু একটা বাচ্চা ছেলের কথায় বিশ্বাস না করে–
লি–রয় হাত তুলে সুনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সে হয়তো বাচ্চা ছেলে কিন্তু এই গ্রহের ব্যাপারে সে সম্ভবত একমাত্র অভিজ্ঞ মানুষ। তাছাড়া আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার শরীরের মাঝে কিছু একটা ঘটছে। আমি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার আগে তোমাদের। সাথে ব্যাপারটা আলোচনা করতে চাই। তোমরা কাছাকাছি আস।
লি–রয় মহাকাশচারীর পোশাক থেকে বের হয়ে লম্বা একটা বেঞ্চে বসে ক্লান্ত গলায় বলল, মহাকাশযান থেকে হান আর বিটিকে ডাক, আমি শেষবার তোমাদের সাথে কথা বলে নিই। লিরয় সানির দিকে ঘুরে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, সানি–
সানি লি–রয়ের দিকে ঘুরে তাকাল।
আমার কতক্ষণ সময় আছে সানি?
বেশি সময় নাই। ঘণ্টাখানেক পরে তোমার ব্যথাটা কমে যাবে, তখন তোমার খুব ঘুম পেতে থাকবে। এক সময় তুমি ঘুমিয়ে যাবে তখন আর ঘুম থেকে উঠবে না
ঘণ্টাখানেক তো খারাপ সময় নয়। এর মাঝে অনেক কিছু করে ফেলা যায়। সময় নষ্ট করে লাভ নেই, এস তোমাদের আমি কয়েকটা নির্দেশ দিয়ে যাই।
ষুন এগিয়ে এসে বলল, আমি তবু তোমাকে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে চাই লি–রয়। তুমি এখানে শুয়ে পড়।
লি–বয় বাধ্য ছেলের মতো বেঞ্চে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। ষুন তার মাথায় একটা চতুষ্কোণ প্রোব লাগিয়ে একটা মনিটরের দিকে তাকিয়ে একটা ছোট নিশ্বাস ফেলল। লি–রয় মাথা ঘুরিয়ে ষুনের দিকে তাকিয়ে বলল, নিশ্চিত হতে পেরেছ ষুন?
ষুন কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল।
লি–রয় জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, কথাটা খুব খারাপ শোনাবে তবু আমি একটা কথা বলে যাই। আমার ধারণা তোমরা যারা এখানে আছ তোমরা কেউ বেঁচে ফিরে যেতে পারবে না। কাজেই হান আর বিটি যেন কোনো অবস্থায় এই গ্রহে নেমে না আসে।
ষুন মাথা নেড়ে বলল, আমাদের পৃথিবীর নির্দেশমতো গ্রহটিকে জীবাণুমুক্ত করা উচিত ছিল।
লি–রয় উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন সানি এগিয়ে এসে বলল, আমি তোমাকে একটা কথা বলতে পারি?
কী কথা?
তুমি কি আমার মাকে একটা কথা বলবে?
তোমার মাকে?
হ্যাঁ। বলবে আমি এখানে এভাবে থাকতে চাই না। আমার ভালো লাগে না। আমি তার কাছে যেতে চাই।
লি–রয় খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে বলব।
আর বোলো স্কাউটশিপে মূল ভরকেন্দ্র যেন ফিরিয়ে দেয়–যদি তারা রাজি না হয় তুমি নিজে ফিরিয়ে এনো।
লি–রয় অবাক হয়ে সানির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কী বলছ আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
সানি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি যদি না বোঝ কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু তবু তুমি শুনে রাখ। ঠিক আছে?
লি–রয় মাথা নাড়ল।
চারটি রবোট এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল, হঠাৎ তারা চার জন একসাথে উঠে দাঁড়ায়। একজন গলা নামিয়ে বলল, শীতলঘরে জায়গা করতে হবে।
হ্যাঁ সতের নম্বর মৃতদেহটা ডানদিকে সরিয়ে দিয়ে নয় নম্বরটা সামনে নিয়ে এলেই হবে।
অন্য দুইজন কলের পুতুলের মতো মাথা নেড়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। নিডিয়া একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি খুবই দুঃখিত লি–রয়। আমি খুবই দুঃখিত।
লি–রয় খানিকক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, এখানে দুঃখ পাবার কিছু নেই। আমি এখন যা বলি তোমরা মন দিয়ে শোন। আমাদের হাতে একেবারে সময় নেই।
সবাই একটু এগিয়ে আসে।
১০. ষুন দেয়ালে হেলান দিয়ে
ষুন দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে পা ছড়িয়ে বসেছে রিশান আর নিডিয়া। ঘরের মাঝামাঝি হলোগ্রাফিক একটা দৃশ্যে হান এবং বিটি বিষণ্ণ মুখে বসে আছে। সুন সবার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, তোমরা নিশ্চয়ই জান সব মহাকাশচারীর ভিতরেই একটা স্বপ্ন থাকে যে সে একবার পঞ্চম মাত্রার মহাকাশ অভিযানের নেতৃত্ব দেয়। লি–রয় মারা যাবার পর অভিজ্ঞতার দিক থেকে বিচার করে পঞ্চম মাত্রার অভিযান নয় নয় শূন্য তিনের নেতৃত্ব আমাকে দেয়া হয়েছে; কিন্তু এর নেতৃত্বের জন্যে আমার বিন্দুমাত্র মোহ নেই। আমি কখনো এভাবে নেতৃত্ব পেতে চাই নি। কিন্তু যেহেতু এভাবে এটা আমার হাতে এসেছে আমাকে এর দায়িত্ব নিতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে কী করতে হবে সেটা আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে না, সেই সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে নেয়া হয়ে গেছে। আমাকে শুধুমাত্র সেটা কার্যকর করতে হবে। আমি তোমাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি আমি সেই কাজটি খুব সুচারুভাবে করব।
রিশান ষুনকে থামিয়ে বলল, তুমি এই গ্রহটিকে জীবাণুমুক্ত করার কথা বলছ?
হ্যাঁ, তোমরা সেটা নিয়ে যত ইচ্ছে তর্ক–বিতর্ক করতে পার তাতে আর কিছু আসে যায় না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।
ঠিক এ রকম সময়ে চারটি রবোট ঘরে এসে ঢুকল। সবার সামনে যে দাঁড়িয়েছিল সে নিচু গলায় বলল, মহাকাশকেন্দ্রের মহাপরিচালকের কাছে থেকে তোমাদের জন্যে একটি নির্দেশ এসেছে।
ষুন অবাক হয়ে বলল, আমাদের জন্যে? নির্দেশ?
হ্যাঁ।
সেটি কী করে সম্ভব?
রবোটটি কোনো কথা বলল না, সামনে হেঁটে কোথায় জানি স্পর্শ করতেই দেয়ালের বড় স্ক্রিনে মহাকাশকেন্দ্রের সদর দফতরের মহাপরিচালকের ক্রুদ্ধ একটা ছবি ভেসে আসে। কোনোরকম ভূমিকা ছাড়া সে কঠোর গলায় প্রায় চিৎকার করে বলে, আমি তোমাদের নির্দেশ দিয়েছিলাম এই গ্রহটিকে জীবাণুমুক্ত করতে—তোমরা কর নি এবং শুধুমাত্র সেই কারণে তোমরা তোমাদের একজন সহকর্মীকে হারিয়েছ। তোমাদের হাতে সময় নেই, যদি আর কোনো সহকর্মী এই গ্রহে প্রাণ হারায় সেটি হবে সপ্তম মাত্রার অপরাধ এবং সেজন্যে তোমাদের প্রচলিত নিয়মে বিচার করা হবে।