দীর্ঘ সময় পর সে যখন চোখ খুলে তাকাল তখন গুহায় কিছু নেই। রিশান ঘুরে সানির দিকে তাকাল–একটা পাথরে হেলান দিয়ে সে ঘুমোচ্ছ। তার মুখে এক ধরনের বিস্ময়কর প্রশান্তি, একটি শিশু এ রকম একটি গ্রহে একা একা বেঁচে থাকার পরও তার মুখে কেমন করে এ রকম একটি প্রশান্তির চিহ্ন ফুটে উঠতে পারে কে জানে। রিশান আবার ভালো করে তাকাল, শিশুটির মুখে শুধু প্রশান্তি নয় আরো একটা কিছু আছে যেটা সে প্রথমে ঠিক ধরতে পারে না। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝতে পারল, শুধু প্রশান্তি নয় শিশুটির চেহারায় এক ধরনের নিষ্পাপ সারল্য আছে যেটা সে বহুকাল দেখে নি। রিশান এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
রিশান দীর্ঘ সময় চুপচাপ শুয়ে রইল, ঘুরেফিরে তার শুধু নারীমূর্তিটির কথা মনে হতে থাকে। কেন সে বার বার একটি নারীমূর্তি দেখছে? এটি কি দৃষ্টিবিভ্রম নাকি সত্যি?
০৯. সানি একটা উঁচু বেঞ্চে শুয়ে আছে
সানি একটা উঁচু বেঞ্চে শুয়ে আছে, তার উপর উবু হয়ে ঝুঁকে পরীক্ষা করছে ষুন। ষুনের মাথার উপর নানা ধরনের যন্ত্রপাতি, পাশে বড় বড় মনিটর। একটা দশ বছরের শিশুর যেটুকু শান্ত হওয়ার কথা, সানি তার থেকে অনেক বেশি শান্ত। যুনের কথামতো সে দীর্ঘ সময় বেঞ্চে চুপচাপ শুয়ে রয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, তার হাবভাব চালচলনে একজন বয়স্ক মানুষের ছাপ খুব স্পষ্ট।
রিশান আর নিডিয়া বেশ খানিকটা দূর থেকে সানি এবং সুনকে লক্ষ করছিল। ষুন তৃতীয়বারের মতো সানির রক্ত পরীক্ষা করে অস্পষ্টভাবে মাথা নাড়ল, কিছু একটা হিসাব সে মিলাতে পারছে না। রিশান নিচু গলায় নিডিয়াকে জিজ্ঞেস করল, কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে?
হা। নিডিয়া মাথা নাড়ে। সানির শরীরে গ্রুনির বিরুদ্ধে একটা প্রতিষেধক থাকার কথা, সেটা পাচ্ছে না।
ও! রিশান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি কি সানি সম্পর্কে কিছু জান? কোথা থেকে এসেছে, কী বৃত্তান্ত?
হ্যাঁ। কাল রাতে পড়ছিলাম। এই বসতিতে নারা নামে একটা মেয়ে থাকত, খুব সাহসী মেয়ে। যখন বুঝতে পারল দীর্ঘ সময় এই বসতিতে থাকতে হবে তখন সে খুব একটা সাহসের কাজ করল।
ভ্রূণ ব্যাংক থেকে একটা বাচ্চা নিয়ে নিল?
না, সেটা তো খুব সাহসের কাজ হল না। সে ঠিক করল নিজের শরীরে একটা বাচ্চা করবে। আগে যেরকম করে করা হত।
সত্যি?
হ্যাঁ। তারপর সে নিজের শরীরে একটা ক্ৰণ বসিয়ে সেই শিশুটির জন্ম দিল। সেই শিশুটি হচ্ছে সানি।
কী আশ্চর্য! রিশান অবাক হয়ে মাথা নাড়ে–এও কি সম্ভব? পৃথিবীতেও তো মানুষ আজকাল সন্তান গর্ভধারণ করে না।
হ্যাঁ, কিন্তু নারা নামের এই মেয়েটি করেছিল। বাচ্চাটি জন্ম হবার পর মেয়েটির জীবন পাল্টে গেল–কী যে আনন্দে ছিল পরের তিন বছর! নিডিয়া বিষণ্ণ চোখে মাথা নেড়ে বলল, তিন বছর পর মেয়েটি মারা গেল, বাচ্চাটি একা একা বড় হয়েছে তারপর। একজন একজন করে সব মানুষ মারা গেল, তারপর বাচ্চাটি আরো একা হয়ে গেল। চারটি অপ্রকৃতিস্থ রবোট আর এই বাচ্চাটি! কী ভয়াবহ ব্যাপার–
রিশান আবার তাকাল, বেঞ্চে সানি চুপচাপ শুয়ে আছে, তার উপর ষুন খুব চিন্তিত মুখে উবু হয়ে ঝুঁকে আছে। গ্রুনির বিরুদ্ধে যে প্রতিষেধকটি তার শরীরে পাওয়া যাবে বলে সবাই ভেবেছিল সেটি তার শরীরে নেই। ষুন হতচকিতভাবে খানিকক্ষণ একটা মনিটরের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার আরো কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে সানির দিকে এগিয়ে যায়।
রিশান নিডিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, সানির মায়ের নাম ছিল নারা?
হ্যাঁ।
তার কি কোনো ছবি আছে?
হ্যাঁ, মূল তথ্যকেন্দ্রে তার ছবি আছে। কেন?
আমি, আমি একটু দেখতে চাই।
নিডিয়া উঠে দাঁড়াল, বলল, এস আমার সাথে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে রিশান হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল, নিডিয়া অবাক হয়ে বলল, কী হল থামলে কেন?
আমার একটা কথা মনে পড়েছে।
কী কথা?
মনে আছে প্রথম যখন আমরা এসেছিলাম তখন আমরা শীতলঘরে গিয়ে দেখেছিলাম সবগুলো মৃতদেহ পাশাপাশি দাঁড় করানো আছে?
হ্যাঁ। তার মাঝে একটা নিশ্চয়ই নারা।
হ্যাঁ
রিশান কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমি সেই ঘরটিতে আরেকবার যেতে চাই।
কেন?
মৃতদেহগুলো আরেকবার দেখতে চাই
নিডিয়া খানিকক্ষণ রিশানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, চল।
শীতলঘরটিতে যাওয়া পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বলল না। ঘরটির সামনে দাঁড়িয়ে দুজনেই একটু দ্বিধা করতে থাকে, শেষ পর্যন্ত রিশান একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, এস নিডিয়া, আমি একা ভিতরে যেতে চাই না।
ভারি দরজাটা ঠেলে দুজনে ভিতরে ঢোকে, ভিতরে তাপমাত্রা অনেক কম; কিন্তু মহাকাশচারীর পোশাক পরে থাকায় দুজনের কেউ সেটা বুঝতে পারে না। মৃতদেহগুলো। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে, দেখে মনে হয় হঠাৎ বুঝি সবগুলো একসাথে জেগে উঠে এগিয়ে আসবে। রিশান কয়েক পা এগিয়ে যায়। চোখের সামনে কাঁচে জমে থাকা জলীয় বাষ্পটুকু পরিষ্কার করে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মৃতদেহগুলো ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে দেখতে থাকে। প্রথম দুজন পুরুষ, তারপর একটি মেয়ে, তারপর আরো একজন পুরুষ। তারপর দুটি মেয়ে এবং তারপর আরেকজন পুরুষ। এই পুরুষটির পাশে দাঁড়ানো একটি মেয়ে এবং রিশান মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে পাথরের মতো জমে গেল।