বিকনের সঙ্কেত অনুসরণ করে কিছুক্ষণের মাঝেই সে পাহাড়ের একটা গুহার কাছাকাছি হাজির হল–ভিতর থেকে একটা ক্ষীণ আলোকরশ্মি বের হয়ে আসছে। রিশান বাইরে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে ভিতরে ঢুকল। গুহাটি বেশ বড়, মাঝামাঝি একটা বড় পাথরের উপরে একটা ছোট জিনন ল্যাম্প জ্বলছে, তার কাছাকাছি একটা ছোট ছেলে মহাকাশচারীর পোশাক পরে শুয়ে আছে। রিশানকে ঢুকতে দেখে ছেলেটি বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়ায়, নিচে থেকে কী একটা তুলে নিয়ে লাফিয়ে পিছনে সরে গিয়ে সেটা বিশানের দিকে তাক করে দাঁড়ায়, রিশান জিনিসটি চিনতে পারল, একটা প্রাচীন কিন্তু কার্যকরী অস্ত্র।
রিশান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই সে ছেলেটার রিনরিনে গলার স্বর শুনতে পেল, হাতের অস্ত্র ফেলে দাও না হয় গুলি করে তোমার কপোট্রন ফুটো করে দেব।
রিশান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ছেলেটা আবার ধমক দিয়ে ওঠে, এক্ষুনি
রিশান এটমিক ব্লাস্টারটি ছুঁড়ে ফেলে দিল।
এবার দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াও।
রিশান দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াল।
এবারে ডান হাত নামিয়ে সাবধানে তোমার কপোট্রনের সুইচ অফ করে দাও, একটু ভুল করেছ কি গুলি করে তোমার কপোট্রন উড়িয়ে দেব।
আমার কপোট্রনের সুইচ নেই, আমি একজন মানুষ।
আমি বিশ্বাস করি না। ছেলেটা তীব্র স্বরে বলল, এখানে কোনো মানুষ নেই, সব রবোট।
আমি এখানে থাকি না। আমি পৃথিবী থেকে এসেছি। তোমাকে উদ্ধার করে নিতে এসেছি।
বিশ্বাস করি না। ছেলেটা তার রিনরিনে গলার স্বরে চিৎকার করে অস্ত্রটা বিপজ্জনকভাবে ঝাঁকিয়ে বলল, বিশ্বাস করি না। তুমি কাছে আসবে না।
ঠিক আছে, আমি কাছে আসব না।
কী চাও তুমি?
আমি তোমাকে বলেছি, আমি একজন মানুষ। এই গ্রহ থেকে একটা বিপদ সঙ্কেত পেয়ে নেমে এসেছি। এসে শুনেছি তুমি এখানে আছ। আমি তাই তোমাকে নিতে এসেছি।
আমি যেতে চাই না, কোথাও যেতে চাই না, তুমি যাও।
রিশানের বুক হঠাৎ এই বাচ্চাটির জন্যে গভীর মমতায় ভরে আসে, সে নরম গলায় বলল, তুমি যদি যেতে না চাও আমি তোমাকে জোর করে নেব না সানি। কিন্তু যদি তুমি আমার সাথে কথা বল তাহলে আমি বাজি ধরে বলতে পারি, তুমি আমার সাথে পৃথিবীতে যাবে।
কেন?
সেটা আমি তোমাকে এখন বলব না। আমি কি এখন একটু কাছে আসতে পারি?
না। তুমি কাছে আসবে না।
ঠিক আছে, তুমি যদি না চাও আমি তোমার কাছে আসব না। এই দেখ আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি
না, তুমি চলে যাও
বিশান মাথা নাড়ল, না আমি যাব না।
যদি না যাও, তাহলে আমি তোমাকে গুলি করব।
রিশান আবার মাথা নাড়ল, না তুমি গুলি করবে না। তুমি একজন মানুষ, আমি আরেকজন মানুষ। একজন মানুষ কখনো আরেকজন মানুষকে গুলি করে না।
ছেলেটি খানিকক্ষণ রিশানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি সত্যি মানুষ?
আমি সত্যি মানুষ।
তুমি হাসতে পার?
আমি হাসতে পারি।
ছেলেটি একটু ইতস্তত করে বলল, তাহলে তুমি একবার হাস।
রিশান হাসিমুখে বলল, মানুষ এমনি এমনি তো হাসতে পারে না, তুমি একটা হাসির গল্প বল, আমি হাসব।
আমি হাসির গল্প জানি না। ছেলেটি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি জান?
রিশান আরো একটু এগিয়ে যায়, আমিও খুব বেশি জানি না কিন্তু কয়েকটা জানি। তুমি যদি শুনতে চাও, তোমাকে আমি বলব।
ছেলেটি কোনো কথা বলল না। রিশান আরো একটু এগিয়ে যায়, ছেলেটি তখনো তার দিকে প্রাচীন অস্ত্রটি তাক করে ধরে রেখেছে। রিশান বলল, তুমি যেভাবে নিজেকে রক্ষা করছ আমি দেখে মুগ্ধ হয়েছি! তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে আমার অস্ত্রটি দেখাতে পারি। দেখবে?
ছেলেটি মাথা নাড়ল। রিশান সাবধানে এটমিক ব্লাস্টারটি হাতে তুলে নিয়ে গুহার বাইরে দূরে একটা বড় পাথরের দিকে তাক করে ট্রিগার টেনে ধরে, একটা নীল আলো ঝলসে উঠে সাথে সাথে পুরো পাথরটি চূর্ণ হয়ে উড়ে যায়। ছেলেটি অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল। রিশান এটমিক ব্লাস্টারটি সানির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, তুমি নেবে?
ছেলেটি সাগ্রহে সেটা টেনে নিল। রিশান বলল, এখন তুমি আমাকে কাছে বসতে দেবে?
ছেলেটি মাথা নাড়ল, বলল, বস।
রিশান ছেলেটার কাছে বসে তার দিকে তাকাল, মহাকাশচারীর পোশাকের স্বচ্ছ হেলমেটের ভিতরে একটি কমবয়সী শিশু–চোখে এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে রিশানের দিকে তাকিয়ে আছে। রিশানের খুব ইচ্ছে করল তার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে কোমল স্নেহের একটা কথা বলে। কিন্তু সেটি সম্ভব নয়, বিষাক্ত গ্যাসের গ্রহটিতে মহাকাশচারীর পোশাকের আড়ালে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে, তাছাড়া দশ বছরের এই ছেলেটিকে কেউ কখনো স্নেহের কথা বলে নি। অনভ্যস্ত হাতে যে অস্ত্র ধরে রাখে, তাকে স্নেহের কথা বললে সে কি সেটি বুঝতে পারবে?
রিশান একটি নিশ্বাস ফেলে নরম গলায় বলল, সানি, চল আমরা তাহলে যাই।
কোথায়?
প্রথমে বসতিতে, সেখানে অন্য সবাইকে নিয়ে মহাকাশযানে। ছেলেটা একটু অবাক হয়ে রিশানের দিকে তাকাল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, এখন তো যেতে পারব না।
কেন?
দেখছ না ঝড় উঠেছে। এই ঝড় বেড়ে যাবে তারপর আকাশ থেকে আগুন পড়তে থাকবে–
আগুন?
হ্যাঁ, দেখা যায় না কিন্তু আগুন। যেখানে পড়বে সেটা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে! দেখছ না আমি এই গুহায় বসে আছি।
রিশান বাইরে তাকাল, সত্যি বাইরে ঝড়ের গতি অনেক বেড়েছে আর স্থানে স্থানে সত্যি নীলাভ এক ধরনের আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলছে।
০৮. পাথরে হেলান দিয়ে
পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছে রিশান, তার ডান পাশে সানি গুটিসুটি মেরে বসেছে। তার হাতে এখন কোনো অস্ত্র নেই, সে শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করেছে যে রিশান সত্যিই একজন মানুষ এবং সে সম্ভবত সানিকে সত্যি সাহায্য করতে চায়। তাদের সামনে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় দুটি হলোগ্রাফিক ছবিএকটিতে মহাকাশযান থেকে হান এবং বিটি; অন্যটিতে এই গ্রহে মানুষের এককালীন বসতি থেকে লি–রয়, নিডিয়া এবং স্কুন।