ঝড়ো হাওয়ার একটা বড় ঝাঁপটা হঠাৎ রিশানকে প্রায় উড়িয়ে নিতে চায়, সে সাবধানে একটা পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিল। হলুদ ধুলো পাক খেয়ে খেয়ে উঠতে থাকে, অন্ধকার হয়ে আসে চারদিক। রিশান দাতে দাঁত চেপে এটমিক ব্লাস্টারটি শক্ত করে ধরে রাখে। এই গ্রহের প্রাণীগুলো কি এখন তাকে লক্ষ করছে? গ্রুনি নামের এককোষী প্রাণী তো বুদ্ধিমান প্রাণী হতে পারে না, বুদ্ধিমান প্রাণীটা তাহলে কী রকম? তাদের জৈবিক ব্যবহার কী রকম? জৈৱিক কথাটি কি ব্যবহার করা যাবে এই প্রাণীটির জন্যে? তারা কি সত্যিই বুদ্ধিমান? মানুষের মতো চিন্তা করতে পারে? মানুষের মতো কি বুদ্ধিমান? যদি সত্যিই মানুষের মতো বুদ্ধিমান হয়ে থাকে তাহলে প্রাণীগুলো মানুষকে মেরে ফেলেছে কেন? আর সত্যিই যদি সবাইকে মেরে ফেলে থাকে তাহলে এই বাচ্চাটিকে কেন বাচিয়ে রেখেছে? রিশান জোর করে চিন্তাটুকু ঠেলে সরিয়ে দেয়, তার কাছে এখন যথেষ্ট তথ্য নেই যে ভেবে সে একটা কূলকিনারা পাবে।
রিশান এটমিক ব্লাস্টারটি হাতবদল করে তার অবলাল চশমা দিয়ে দূরে তাকাল। কী ভয়ঙ্কর অশরীরী একটি দৃশ্য, সৃষ্টিজগতে কি এর থেকে কুশ্রী, এর থেকে নিরানন্দ কোনো এলাকা আছে? একটি দশ বছরের বাচ্চা কি তার জীবনে এর থেকে ভালো কিছু পেতে পারে না?
ক্ষীণ একটা শব্দ শুনে রিশান তার যোগাযোগ মডিউলটির দিকে তাকাল, একটা লাল আলো জ্বলছে এবং নিভছে–যার অর্থ বিকন চারটি এই বাচ্চা ছেলেটিকে খুঁজে পেয়েছে। রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে বসতিতে যোগাযোগ করল, নরম গলায় বলল, লি–রয়, বাচ্চাটিকে মনে হয় খুঁজে পাওয়া গেছে।
কোথায়?
এখান থেকে অনেক দূরে। এত ছোট একটি বাচ্চা একা এত দূরে কেমন করে গেল সেটা একটা রহস্য। আমি যাচ্ছি তাকে আনতে।
বেশ। আমরা তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। এদিকে আরো কিছু বিচিত্র জিনিস ঘটেছে–
কী?
তুমি ফিরে এস তখন বলব। তোমার কিছু সাহায্য লাগলে বল
বলব।
রিশান যোগাযোগ কেটে দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। দীর্ঘ পথ, হেঁটে যেতে অনেকক্ষণ লাগবে। একটু আগে যেটা ঝড়ো হাওয়া ছিল, মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে সেটা পুরোপুরি একটা ঝড়ে পরিণত হতে যাচ্ছে।
বিকনের সঙ্কেত অনুসরণ করে রিশান হাঁটছে। খালি চোখে গ্রহটিকে যেরকম দুর্গম মনে হচ্ছিল হাঁটতে গিয়ে অনুভব করে সেটি তার থেকে অনেক বেশি দুর্গম। ছোট একটা বাই ভার্বাল নিয়ে আসার দরকার ছিল, কিন্তু কিছু আনা হয় নি। সেটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সে এখন হাঁটার দিকে মনোযোগ দেয়। পুরো গ্রহটি পাথুরে মাঝে মাঝে বিশাল গহ্বর। সমস্ত পথ উঁচু–নিচু, তার মাঝে হলুদ এক ধরনের ধুলো উড়ছে। মাধ্যাকর্ষণ বল কম বলে প্রতি পদক্ষেপেই সে একটু করে ভেসে উপরে উঠে যাচ্ছে। ঝড়ের গতি আস্তে আস্তে বাড়ছে, তার সাথে সাথে গ্রহের ঘোলাটে আলোটাও মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে তীব্রতর হচ্ছে। তবে আলোটি স্থির নয়, ক্রমাগত নড়ছে, যার ফলে চোখের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ছে।
বিকনের সঙ্কেত অনুসরণ করে হেঁটে হেঁটে রিশান যত কাছে যেতে থাকে যোগাযোগ মডিউলে লাল আলোটি তত স্পষ্ট হতে থাকে। আলোটি কিছুক্ষণ আগেও নড়ছিল, এখন স্থির হয়েছে। মনে হচ্ছে ছেলেটি হাটা থামিয়ে কোথাও বিশ্রাম নিচ্ছে। কাছাকাছি পৌঁছানোর ফলে রিশান যোগাযোগ মডিউলে আরো নানা ধরনের তথ্য পেতে থাকে, ইচ্ছে করলে সে এখন ছেলেটির সাথে কথা বলতে পারে, এমনকি হলোগ্রাফিক ছবিও পাঠাতে পারে, কিন্তু সে কিছুই করল না। দশ বছরের একটি বাচ্চা নেহাতই শিশু, তার সাথে একটু সতর্ক হয়ে যোগাযোগ করা দরকার। বিশেষ করে সে যখন এ ধরনের কিছুই আশা করছে না।
শেষ অংশটি হল সবচেয়ে কঠিন। খাড়া একটি পাহাড় বেয়ে উঠে আবার নিচে নেমে যেতে হল। এখানকার পাথরগুলোও দুর্বল, পায়ের চাপে হয় খুলে আসছিল নাহয় ভেঙে যাচ্ছিল। রিশান প্রচণ্ড পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। একটি বাই ভার্বাল না নিয়ে আসা নেহাতই বোকামি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আর না পেরে শক্ত একটা পাথর খুঁজে বের করে সেখানে হেলান দিয়ে বসে বড় বড় নিশ্বাস নিতে থাকে। চারদিকে কিছুক্ষণের জন্যে অন্ধকার নেমে এসেছে, হঠাৎ কোথায় জানি আলো ঝলসে উঠল, আর রিশান চমকে উঠে দেখে তার সামনে একটি মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। অবিকল মানুষের মতো, একটি নারীমূর্তি।
রিশান চিৎকার করতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ বন্ধ করল, বিড়বিড় করে নিজেকে বলল, দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছে আমার। অতিরিক্ত পরিশ্রমে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গিয়ে নানা ধরনের দৃশ্য দেখছি; যখন খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চোখ খুলব, দেখব কিছু নেই। রিশান বড় বড় কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে আবার চোখ খুলল, সত্যিই কোথাও কিছু নেই।
রিশান বুঝতে পারে এখনো তার বুক ধকধক করছে। নারীমূর্তিটি এত বাস্তব ছিল যে সত্যি সত্যি মনে হচ্ছিল তার সামনে বুঝি একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে মেয়ে কোথা থেকে আসবে? যে বুদ্ধিমান প্রাণীটি রয়েছে সেটি দেখতে পৃথিবীর মেয়েদের মতো হবে। বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। সৃষ্টিকর্তা বলে সত্যিই যদি কেউ থাকে তার কল্পনাশক্তি নিশ্চয়ই এত কম নয় যে, সব বুদ্ধিমান প্রাণীকে মানুষের রূপ দিয়ে তৈরি করবে। রিশান মাথা থেকে চিন্তাটি দূর করে দিল। সে নিজের কাছেও স্বীকার করতে চাইছে না যে সে ভয় পেয়েছে।