চার জন মানুষের মাঝে যে মানুষটি তুলনামূলকভাবে বয়স্ক একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কিছু করার নেই, তাই—
তাই মূল্যবান তথ্য নষ্ট করবে?
মূল্যবান নয়। সব তথ্য পৃথিবীতে পাঠানো হয়ে গেছে—
লি–রয় চিন্তিত মুখে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে রইল।
রিশান জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার লি–রয়?
এখানে সবকিছু কেমন জানি খাপছাড়া। তথ্যকেন্দ্রে নানা ধরনের গোলমাল রয়েছে। অনেক রকম মূল্যবান তথ্য নষ্ট করা হয়েছে।
কেন?
জানি না। তবে পৃথিবীর একটা নির্দেশ আছে এখানে।
কী নির্দেশ?
এই দেখ, আমি শোনাচ্ছি তোমাদের।
নিডিয়া আর রিশান কাছে এগিয়ে গেল। পৃথিবীর যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা, গোপনীয়তার মাত্রা, প্রয়োজনীয় কোড নাম্বার সবকিছু শেষ করে নির্দেশটি শুরু হল। ছয় লাল তারার একজন বয়স্ক মানুষ হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে জীবন্ত হয়ে আসে। একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে মানুষটি কথা বলতে শুরু করে, আমি মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান এম সাতর। আমি আমার পদাধিকার বলে এবং আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব এবং ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্দেশ দিচ্ছি। সৌরজগৎ থেকে প্রায় এক আলোকবর্ষ দূরে এই গ্রহটি, যার অবস্থান নিষাদ স্কেলে চার চার শূন্য চার তিন এবং পাঁচ পাঁচ আট চার ছয় এবং যেখানে মানুষের অভিযান তিন তিন দুই চার সুসম্পন্ন হয়েছে, আমি সেই গ্রহের মানুষদের কিংবা যারা তাদের সাথে যোগাযোগ করতে এসেছে সেই মানুষদের এই নির্দেশ দিচ্ছি।
এই গ্রহটিতে একটি নিম্নস্তরের প্রাণ আবিষ্কৃত হয়েছে। দীর্ঘ সময় এই প্রাণীটির ওপর গবেষণা করা হয়েছে এবং দেখা গেছে এটি একটি এককোষী প্রাণী। এই প্রাণীটি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য আমাদের সগ্রহ করা হয়েছে এবং এই মুহূর্তে সেটি সম্পর্কে আমাদের কোনো কৌতূহল নেই। কিন্তু এই গ্রহটি সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল রয়েছে। সৌরজগৎ থেকে বের হয়ে ছায়াপথের দিকে যাত্রা শুরু করার সময় এই গ্রহটি পৃথিবীর মানুষের জন্যে একটি সাময়িক আবাসস্থল হতে পারে। এর অবস্থান নানা কারণে আমাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের ধারণা হয়েছে এই গ্রহের এককোষী প্রাণীটি–যেটি একটি জীবাণু ছাড়া আর কিছু নয়, মানুষের নিরাপত্তার জন্যে একটি হুমকিস্বরূপ।
পুরো ব্যাপারটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করে পৃথিবীর মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে এই গ্রহটিকে জীবাণুমুক্ত করা হবে। কাজেই এই মর্মে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই গ্রহের এককোষী প্রাণীগুলোকে ধ্বংস করার জন্যে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। দীর্ঘদিনের গবেষণার কারণে আমরা নিশ্চিতভাবে জানি কীভাবে এই জীবাণুগুলোকে ধ্বংস করা সম্ভব। তার জন্যে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্যাদি প্রস্তুত করার জন্যে কিংবা নিয়ে আসার জন্যে অনুমতি দেয়া হচ্ছে। এ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য রয়েছে মহাকাশ নির্দেশমালা তিন তিন চার নয় অনুচ্ছেদের সাত সাত আট চার অংশে।
লি–রয় মনিটর স্পর্শ করে হলোগ্রাফিক ছবিটি অদৃশ্য করে দিয়ে বলল, নির্দেশটা এখানেই শেষ, এরপরে রয়েছে নানারকম ঘুঁটিনাটি।
রিশান অন্যমনস্কভাবে নিজের চুলে আঙুল প্রবেশ করিয়ে বলল, কিছু একটা গোলমাল আছে এখানে।
সবাই ঘুরে তাকাল রিশানের দিকে। ষুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিশানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কী গোলমাল?
আমি জানি না কী, কিন্তু কিছু একটা গোলমাল আছে। একটা জীবন্ত প্রাণীকে এত সহজে ধ্বংস করার কথা নয়।
ষুন বলল, এটা কোনো জীবন্ত প্রাণী নয়। এটা জীবাণু। মানুষ অতীতে অনেক জীবাণু। ধ্বংস করেছে। আমি যতদূর জানি বসন্ত নামে একটা ভয়াবহ রোগ ছিল পৃথিবীতে, সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে সেটি পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
লি–রয় বলল, এই জীবাণুটি তো পুরোপুরি ধ্বংস করা হচ্ছে না। তার নমুনা নিশ্চয়ই রাখা আছে কোথাও। যদিও আমি জানি না এই নমুনাটি কী কাজে লাগবে!
রিশান চিন্তিত মুখে বসতির চার জন অপ্রকৃতিস্থ মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকে, ঠিক বুঝতে পারছে না কী, কিন্তু কিছু একটা গোলমাল আছে কোথাও সেটা কী ধরতে পারছে না।
ষুন লি–রয়কে বলল, আমাদের কাজ তাহলে খুব সহজ হয়ে গেল। এই চার জন মানুষকে পৃথিবীতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা, গ্রহটিকে জীবাণুমুক্ত করা, তারপর আবার আগের কাজে ফিরে যাওয়া।
কিছু একটা গোলমাল আছে এখানে। রিশান মাথা নেড়ে বলল, কিছু একটা গোলমাল আছে।
ষুন রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যদি না জান গোলমালটা কোথায়, তাহলে সেটা নিয়ে চেঁচামেচি করে তো কোনো লাভ নেই।
রিশান ষুনের কথা শুনল বলে মনে হল না। সে হঠাৎ ঘুরে অপ্রকৃতিস্থ চার জন মানুষের দিকে তাকাল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ কঠোর স্বরে জিজ্ঞেস করল, এখানে সবাই মারা গিয়েছে, তোমরা চার জন কেন মারা যাও নি?
চার জন মানুষ এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। রিশান চোখের দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ করে বলল, তোমরা পৃথিবীতে ফিরে না গিয়ে এই নির্জন গ্রহে রয়ে গেলে কেন?
আমাদের মহাকাশযান নষ্ট হয়ে গেছে।
কেমন করে নষ্ট হল?
আমরা জানি না।
পৃথিবীতে খবর পাঠালে না কেন?