এটি শুধু খেলনা নয়, এটি একটি বিপজ্জনক খেলনা। তুমি এর মাঝে চার মাত্রার বিস্কোরকে তৈরী একটা বুলেট রেখেছ। এটি তোমার হাতে বিস্ফোরিত হবার সম্ভাবনা তের দশমিক চার।
এই গ্রহে আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল চার দশমিক নয়। তুমি আমাকে শুধু শুধু জ্বালাতন করছ।
সুহান নিশ্বাস বন্ধ করে ট্রিগার টেনে ধরল। তার ত্রাতের অস্ত্রটি থেকে ভয়ঙ্কর একটা শব্দ করে বুলেটটি বের হয়ে যায়। দূরে একটি বিক্ষেরণ হয়। তার লক্ষ্যবস্তু থেকে অনেক দূরে।
ট্রিনি বলল, আমি তোমাকে বলেছি, তুমি এটা দিয়ে কখনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারবে না।
এক শ বার পারব। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জন্যে বুলেটটা নিচে নেমে আসছে। লক্ষ্যবস্তুর একটু উপরে তাক করলে—
তোমার যুক্তি হাস্যকর। অস্ত্র মাত্রই এই ধরনের হিসেব করতে পারে। তোমার খালি চোখে আন্দাজ করে নিশানা করা পুরোপুরি অর্থহীন। সময় এবং শক্তির অপচয়। সবচেয়ে বড় কথা—এটি বিপজ্জনক।
হোক বিপজ্জনক। আমি এভাবেই লক্ষ্যভেদ করতে চাই। খালি চোখে আন্দাজ করে। হাতের স্পর্শে।
কেন?
আমার ইচ্ছে।
ট্ৰিনি কোনো কথা না বলে মাথা ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। সুহান শুনতে পায়, তার মাথা থেকে ক্লিক ক্লিক করে এক ধরনের শব্দ হচ্ছে। ট্ৰিনি তার সমস্ত ইন্দ্রিয় সংবেদনশীল করে কিছু একটা শোনার বা দেখার চেষ্টা করছে। নিজে থেকে তাকে কিছু বলল না বলে সুহান কিছু জিজ্ঞেস করল না।
সুহান তার অস্ত্রটিতে বিস্ফোরক ভরে আবার সেখানে একটি বুলেট ঢুকিয়ে নেয়। ভালো করে দেখে সে আবার দুই হাতে অস্ত্রটি তুলে ধরে দূরে তাক করে, আগের বার যেখানে তাক করেছিল এবারে তার থেকে একটু উপরে। সমস্ত ইন্দ্রিয় একাগ্র করে সে লক্ষ্যবস্তুর দিকে তাকায়। তারপর নিশ্বাস বন্ধ করে ট্রিগার টেনে ধরে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে সাথে এক ঝলক কালো ধোঁয়ায় তার সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। ধোয়াটা সরে যেতেই সে অবাক হয়ে দেখে, লক্ষ্যবস্তুর পাথরটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। সুহান আনন্দে চিৎকার করতে গিয়ে থেমে গেল, ট্ৰিনি তখনো সামনে তাকিয়ে আছে। তার সংবেদনশীল চোখে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে। তার সংবেদনশীল শ্রবণযন্ত্র ব্যবহার করে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করছে। সুহান খানিকক্ষণ ট্রিনির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ট্রিনি।
বল।
আমি এইমাত্র আমার অস্ত্রটি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করেছি।
ও।
তুমি শুনে অবাক হলে না? কী ব্যাপার? তুমি কী দেখছ।
না, কিছু না।
সুহান শব্দ করে হেসে বলল, তুমি দ্বিতীয় প্রজাতির রবোট। তোমার পক্ষে মিথ্যা কথা বলা সম্ভব নয়। তুমি যখন চেষ্টা কর সেটা আমি খুব সহজে ধরে ফেলি।
ট্ৰিনি মাথা ঘুরিয়ে বলল, আমি মোটেই মিথ্যা কথা বলার চেষ্টা করছি না। আমি কিছু দেখছি না।
তুমি কি কিছু দেখার চেষ্টা করছ?
আমি তার উত্তর দিতে রাজি নই।
সুহান আবার শব্দ করে হেসে ফেলে বলল, তুমি একেবারে ছেলেমানুষি রবোট! তোমার ভিতরে একেবারে কোনোরকম জটিলতা নেই। তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না। কাল রাত থেকে তুমি খুব বিচিত্র রকম ব্যবহার করছ। আমার কাছে তুমি কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছ।
ট্ৰিনি কোনো কথা বলল না, যার অর্থ সত্যিই সে কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। সুহান বলল, আমি ইচ্ছে করলেই বের করতে পারি তুমি আমার কাছে কী লুকানোর চেষ্টা করছ। করব?
না।
সুহান আবার হেসে ফেলল। বলল, ঠিক আছে, তুমি থাক তোমার গোপন কথা নিয়ে।
সে আবার তার বিচিত্র অস্ত্রটি নিয়ে তার মাঝে বিস্ফোরক ভরতে থাকে। এটি তার একটি নতুন খেলা।
ট্ৰিনি বহুদূরে তাকিয়ে তার সংবেদনশীল চোখটি আরো সংবেদনশীল করে ফেলে। মাটিতে সে কুড়ি হার্টজ তরঙ্গের উপর সাতচল্লিশ কিলোহার্টজ এবং নব্বই মেগাহার্টজ তরঙ্গের সুষম উপস্থাপন অনুভব করেছে। প্রথমত, এই গ্রহে প্রাকৃতিক উপায়ে এই কম্পন তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই। তাছাড়া কুরু মহাকাশযানের মূল ইঞ্জিনের কম্পনের প্রথম হারমোনিক সাতচল্লিশ কিলোহার্টজ। বৈদ্যুতিক জেনারেটরের কম্পন নব্বই মেগাহার্টজ। তাহলে কি সত্যিই একটি কুরু মহাকাশযান নেমেছে এই গ্রহের মাটিতে? সুহানকে সে কি বলবে তার সন্দেহের কথা? যদি সেটা সত্যি না হয়? সুহানের তাহলে খুব আশাভঙ্গ হবে। আশাভঙ্গ একটি মানবিক ব্যাপার, সে আশাভঙ্গ ব্যাপারটি কী জানে না, কিন্তু দেখেছে। আশাভঙ্গ হলে সুহান দীর্ঘ সময় বিমুখে বসে থাকে। এটি অনেক বড় ব্যাপার। এবারে আশাভঙ্গ হলে সুহান কি সেটা সহ্য করতে পারবে?
ট্রিনির কপোট্রনে পরস্পরবিরোধী বেশ কয়েকটি চিন্তা খেলা করতে থাকে। সে দ্বিতীয় প্রজাতির রবোট, পরস্পরবিরোধী চিন্তায় অভ্যস্ত নয়। কিছুক্ষণের মাঝেই সে তার কপোট্রনের একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। কপোট্রনের সেই অংশটি তার শরীরের যে কয়টি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে তার একটি হচ্ছে ডান হাত। সুহান দেখতে পায়, ট্রিনির ডান হাতটি প্রথমে দ্রুত কাঁপতে থাকে, তারপর এক সময় হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নড়তে থাকে।
সুহান আগেও এ ধরনের ব্যাপার ঘটতে দেখেছে। ব্যাপারটির কৌতুককর অংশটি কখনো তার চোখ এড়ায় নি, এবারেও এড়াল না। সে তার বিচিত্র অস্ত্রটি শুইয়ে রেখে উচ্চৈঃস্বরে হাসতে শুরু করে।