লাইনা চুপ করে থেকে বলল, যদি দেখা যায় সেটা ভয়ঙ্কর তীব্র? তুমি যদি হঠাৎ অমানুষ হয়ে যাও?
কিরি শব্দ করে হেসে ফেলল, তারপর বলল, না লাইনা, আমি কখনো অমানুষ হব না। রবোট অমানুষ হতে পারে না। শুধুমাত্র মানুষ অমানুষ হতে পারে।
কিরি হেঁটে হেঁটে ঘরের মাঝখানে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে আস্তে আস্তে বলল, আমি যে একজন রবোট সেটা আমি ছাড়া আর কেউ জানত না। কথাটা গোপন রাখার কথা ছিল। কিন্তু আমি সেটা গোপন রাখি নি। আমি সেটা তোমাকে বলেছি। কেন বলেছি জান?
কেন?
আমি তোমাদের দলপতি হতে চাই না। মানুষের একটি দলের দলপতি হবে একজন মানুষ।
কিন্তু তুমি দশম প্রজাতির রবোট। দশম প্রজাতির একজন রবোট মানুষের এত কাছাকাছি যে, মানুষের সাথে তার কোনো পার্থক্য নেই। পৃথিবীর মানুষ যদি তোমাকে দলপতি করতে পারে আমি সেটা মেনে নিতে পারি। তোমার ওপর আমার বিশ্বাস আছে। কিরি।
কিরি খানিকক্ষণ লাইনার দিকে তাকিয়ে বলল, অনেক ধন্যবাদ লাইনা। তুমি আমার বুক থেকে একটা পাথর সরিয়ে দিলে। নিজেকে মানুষের মাঝে লুকিয়ে রাখতে আমার খুব খারাপ লাগছিল। তোমাকে বলতে পেরে আমার বুকটা হালকা হয়ে গেছে।
০৩.
আঠার ঘণ্টা পর মহাকাশযানের মূল চতুরটুকুতে একটা আনন্দমুখর উৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ঘুম ভেঙে তিরিশ জন মহাকাশচারী উঠে এসেছে। ভন্টে রাখা অনেকগুলো রবোটকে বের করে আনা হয়েছে। সবাই চেঁচামেচি করে কথা বলছে। চারদিকে খাবার এবং পানীয়ের ছড়াছড়ি। অর্থহীন কথাবার্তা, হাসি-তামাশা, হইহুল্লোড় দেখে মনে হতে পারে, এদের জীবনে সত্যিকারের কোনো সমস্যা নেই। মনে হয়, আনন্দমুখর একটি বিশাল পরিবারের সবাই বুঝি হঠাৎ করে একত্র হয়েছে।
হইচই যখন চরমে উঠেছে তখন কিরি একটা চেয়ারের উপরে দাঁড়িয়ে বলল, আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
কিরিকে একাধিকবার কথাটি উচ্চারণ করতে হল এবং শেষ পর্যন্ত সবাই কথা থামিয়ে তার দিকে ঘুরে তাকাল। কিরি সবাইকে এক নজর দেখে বলল, তোমরা সবাই জান, আমরা আগামী কয়েক ঘণ্টার মাঝে এই গ্রহটিতে নামতে যাচ্ছি।
সবাই একটা আনন্দধ্বনির মতো শব্দ করল। কিরি শব্দটাকে থেমে যাওয়ার সময় দিয়ে বলল, আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ তথ্য রয়েছে সেটা দেখে মনে হয়, এই গ্রহটি মানুষের জন্যে চমৎকার একটা বসতি হতে পারে। নতুন একটা পৃথিবীর জন্ম দেব এখানে।
সবাই দ্বিতীয়বার একটা আনন্দধ্বনি করল, এবারে আগের থেকে জোরে এবং দীর্ঘস্থায়ী। কিরি হাসিমুখে বলল, আমি তোমাদের দলপতি। আমাকে যেরকম কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে ঠিক সেরকম কিছু দায়িত্বও দেয়া হয়েছে। আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি, আমি চেষ্টা করব আমার দায়িত্ব যতটুকু সম্ভব নিখুঁতভাবে পালন করতে। কিন্তু তার আগে আমি তোমাদেরকে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই।
টকটকে লাল রঙের পানীয়ের একটা গ্লাস হাতে নিয়ে লাইনা কিরির দিকে ঘুরে তাকাল। কী বলতে চায় কিরি?
কিরি এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, যদি এখন তোমাদের বলা হয়, আমি মানুষ নই, আমি একজন রবোট, তাহলে তোমরা কি আমার নেতৃত্ব মেনে নেবে?
উপস্থিত সবাই চুপ করে যায়। কমবয়সী একজন তরুণ, লাল চুলের ক্রিকি অবাক হয়ে বলল, কিন্তু তুমি তো মানুষ!
না, আমি মানুষ নই।
তুমি মানুষ নও?
না। এখানে লাইনা ছাড়া আর কেউ সেটা জানে না। লাইনা জানে, কারণ আমি তাকে গতকাল বলেছি। সে বিশ্বাস করতে চায় নি। তখন আমি তাকে প্রমাণ দেখিয়েছি।
সবাই ঘুরে লাইনার দিকে তাকাল, লাইনা সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। কিরি আবার বলল, আমি একজন রবোর্ট। দশম প্রজাতির রবোট।
সারা ঘরে হঠাৎ বিস্ময়ের ধ্বনি উচ্চারিত হতে থাকে। রিশা নামের সোনালি চুলের একটা মেয়ে কাঁপা গলায় বলল, দ-দ-দশম প্রজাতি?
হ্যাঁ।
তোমার কপোট্রন ক্লিও লিয়ামের? টেটরা রিজম?
হ্যাঁ, টেটরা রিজম।
নিউরাল নিক্সি?
হ্যাঁ।
এ পর্যন্ত তৈরি হয়েছে মাত্র দশটি?
সঠিক সংখ্যাটি কেউ জানে না, তবে এর কাছাকাছি।
রিশা সবার দিকে তাকিয়ে বলল, এই জন্যে আমরা কেউ কখনো ধরতে পারি নি।
কী আশ্চর্য!
তোমরা এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি। বল, তোমরা কি আমার নেতৃত্ব মেনে নেবে?
মধ্যবয়স্ক ইঞ্জিনিয়ার গ্রুসো উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সত্যি কথা বলতে কী, তোমার কথা শুনে আমার নিজের মাঝে এখন এক ধরনের হীনমন্যতা জন্মে গেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মানুষ না হয়ে একজন দশম প্রজাতির রবোট হয়ে জন্ম নিতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।
ঘরে হালকা হাসির একটা শব্দ শোনা যায়। লাইনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কিরি, তুমি মহাকাশযানের নীতিমালা লঙ্ন করছ। তোমার সাথে একজন মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। তুমি নিজে থেকে না বললে কেউ কোনোদিন এই জিনিসটি জানতে পারত না। তোমার এই তথ্যটি গোপন রাখার কথা ছিল। তুমি কেন বলেছ?
আমি সম্ভবত মানুষের খুব কাছাকাছি। মানুষের ভিতরে যেরকম অনুভূতি কাজ করে আমার ভিতরেও অনেকটা সেরকম অনুভূতি কাজ করে। গত পঞ্চাশ বছর তোমরা–মানুষেরা যখন ঘুমিয়ে ছিলে তখন আমি এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। ভেবে ভেবে মনে হয় আমি আরো পরিণতবুদ্ধি মানুষে—কিংবা রবোটে পরিণত হয়েছি। আমার মনে হয়েছে, আমার তোমাদের জানিয়ে দেয়া প্রয়োজন আমি মানুষ নই, আমি রবোট।
সোনালি চুলের রিশা বলল, সেটা মনে হয় তুমি ভালোই করেছ—কিন্তু তোমাকে কি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা যাবে?