তাপমাত্রা? তখন তাপমাত্রা কত হবে?
অসহ্য মনে হতে পারে, এখনো জানি না। তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
লাইনা দীর্ঘ সময় গ্রহটির দিকে তাকিয়ে থাকে। নামহীন ধূসর একটি গ্রহ। কে জানে হয়তো এই গ্রহে সে তার জীবন কাটিয়ে দেবে। মানুষ তাদের পৃথিবীকে বাসের অযোগ্য করে ফেলেছে। তেজস্ক্রিয় বাতাস, অনুর্বর প্রাণহীন মাটি, বিষাক্ত পানি। তাদেরকে বেঁচে থাকার জন্যে এখন অন্য কোনো গ্রহ খুঁজে বের করার কথা ভাবতে হচ্ছে। বাইরে বসতি স্থাপন করার দায়িত্ব নিয়ে গত শতাব্দীতে যে অসংখ্য মহাকাশযান বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের মহাকাশযানটি ঠিক সেরকম একটি মহাকাশযান। তারা কি সত্যি খুঁজে বের করতে পারে একটি গ্রহ, যেখানে পৃথিবীর মানুষ আবার নতুন করে তাদের জীবন শুরু করতে পারবে? লাইনা ছোট একটা নিশ্বাস ফেলল, তার বিশ্বাস হয় না।
যোগাযোগ মডিউলে চাপা একটি শব্দ শুনে লাইনা সেদিকে এগিয়ে যায়। মহাকাশযানের দ্বিতীয় দলনেত্রী হিসেবে তার পত্বি অনেক। সে দ্রুত অভ্যস্ত হাতে মহাকাশযানের মূল কম্পিউটারে কিছু সংখ্যা প্রকাশ করায়, কাছাকাছি মাইক্রোফোনে নিচু গলায় কথা বলে। স্ক্রিনের ছবিতে হাত দিয়ে স্পর্শ করে যোগাযোেগ ব্যবস্থা চালু করে দেয়। ধীরে ধীরে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে মহাকাশধানের তথ্য ফুটে উঠতে থাকে। গত পঞ্চাশ বছরে অস্বাভাবিক কিছু ঘটে নি। ক্রায়োজেনিক ঘরে তিন সহস্র মানুষের জ্বণ, পশুর শুক্রাণু, ডিম্বাণু, কয়েক লক্ষ গাছের বীজ, জীবিত প্রাণীর ক্লোন তৈরি করার প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল, তাদের রক্ষণাবেক্ষণের কম্পিউটার, রবোট, নির্ভুল নিয়ন্ত্রণবিধি সবকিছু ঠিক ঠিক আছে। লাইনা মহাকাশযানের জ্বালানির পরিমাণ, যন্ত্রপাতির অবস্থা দেখে সৌর ব্যাটারিতে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ, তাদের নিজেদের রসদ, বাতাসে অক্সিজেন পরীক্ষা করে পৃথিবীর খবর নেয়ার জন্যে নির্দিষ্ট মডিউলটি চালু করে দেয়।
লাইনা, তুমি সত্যিই পৃথিবীর কথা জানতে চাও?
লাইনা একটু অবাক হয়ে পিছনে তাকাল। কিরি নিঃশব্দে হাঁটতে পারে, কখন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে কে জানে।
কিরি আবার বলল, সত্যি জানতে চাও?
হ্যাঁ।
কেন লাইনা? খবর জেনে তো শুধু মন খারাপই হয় লাইনা।
কিন্তু কী করব বল?
মানুষ কেমন করে এটা করল লাইনা? বাতাসে তেজস্ক্রিয়তা। মহাদেশের পর মহাদেশ রুক্ষ প্রাণহীন মরুভূমি। নদী হ্রদ সমুদ্র মহাসমুদ্রে বিষাক্ত কেমিক্যাল। মানুষ বেঁচে আছে মাটির নিচে। রোগ শোক মহামারী। বিভীষিকা। বিশ্বাস হয় লাইনা?
লাইনা মাথা নাড়ল, না, হয় না।
মানুষ কেমন করে নিজের অস্তিত্বে নিজে আঘাত করে? আমি এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি লাইনা। তোমরা, মানুষেরা গত পঞ্চাশ বছর যখন শীতলঘরে ঘুমিয়ে ছিলে তখন আমি এটা নিয়ে ভেবেছি। আমি এই চেয়ারে গত পঞ্চাশ বছর চুপ করে বসে ছিলাম–
কী বললে? লাইনা চমকে উঠে বলল, কী বললে তুমি?
হ্যাঁ লাইনা, তোমরা কেউ জান না। আমি মানুষ নই লাইনা। আমি একজন রবোট। দশম প্রজাতির রবোর্ট।
রবোট? তুমি রবোট?
হ্যাঁ লাইনা।
লাইন বিস্ফারিত চোখে কিরির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই হৃদয়বান বুদ্ধিদীপ্ত দর্শন মানুষটি একটি রবোট? তার বিশ্বাস হয় না। মাথা নেড়ে বলল, আমি বিশ্বাস করি না, কিরি।
কিরি লাইনার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে আর হঠাৎ সে অবাক হয়ে দেখে, কিরির চোখ দুটি সবুজাভ হয়ে আসে, আর সেখান থেকে বিচিত্র এক ধরনের আলো বের হয়ে আসে। লাইনার এক ধরনের আতঙ্ক হতে থাকে, শক্ত করে চেয়ারটি ধরে বলল, না কিরি, না। না।
কিরির চোখ দুটি আবার স্বাভাবিক হয়ে এল, আবার সেই চোখে সহৃদয় একটি হাসিখুশি মানুষ উঁকি দিতে থাকে।
লাইনা অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, তুমি মানুষ নও! তুমি রবোট!
কিরি নরম গলায় বলল, তোমার কি আশাভঙ্গ হল তাইনা?
লাইনা মাথা নিচু করে বলল, আমি জানি কিরি।
মনে হয় হয়েছে। কিন্তু আমি তোমাকে একটা জিনিস বলি। আমি দশম প্রজাতির রবোট। সব মিলিয়ে আমার মতো রবোর্ট রয়েছে দশ কি বারটি। আমাদের সাথে মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। এই মহাকাশযানের দলপতি একজন মানুষকে না করে একজন রবোটকে করা হয়েছে। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ রয়েছে।
হ্যাঁ। লাইনা মাথা নেড়ে বলল, নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।
সেই কারণটা কী?
আমি জানি না।
গত পঞ্চাশ বছর তোমরা সবাই যখন শীতলঘরে বসে ছিলে তখন আমি সেটা নিয়ে ভেবেছি। পঞ্চাশ বছর দীর্ঘ সময়। মানুষের জন্যে দীর্ঘ, আমার জন্যেও দীর্ঘ। ভেবে ভেবে মনে হয় আমি এই প্রশ্নের একটা উত্তর খুঁজে পেয়েছি।
সেটা কী?
একজন মানুষ খুব সহজে নিজেকে ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে যায়। শেষ মুহূর্তে হয়তো করে না কিন্তু তার খুব কাছাকাছি নিয়ে যায়। আমি সেটা করব না। আমি কখনো মানুষকে ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে যাব না।
কিন্তু তুমি একটু আগে বলেছ তুমি মানুষের মতো।
হ্যাঁ।
মানুষের যেরকম দুঃখ কষ্ট হাসি কান্না আছে তোমারও সেরকম দুঃখ কষ্ট হাসি কান্না আছে?
আছে। ঈর্ষা আছে? হিংসা আছে? ক্রোধ? অপরাধবোধ? দম্ভ?
কিরিকে একটু বিচলিত দেখা গেল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমি যতদূর জানি, আছে। কিন্তু সেইসব অনুভূতি প্রকাশ পাওয়ার একটা কারণ থাকতে হয়। সেরকম কারণ এখনো হয় নি। তাই আমি জানি না কত তীব্র আমার ঈর্ষা বা হিংসা, ক্রোধ বা দত্ত।