লাইনা উঠে বসতেই ঢাকনাটা শব্দ করে খুলে গেল। পাশাপাশি অনেকগুলো ক্যাপসুল। সবগুলোর ওপর একটি করে সবুজ আলো। আস্তে আস্তে জ্বলছে এবং নিভছে। এক জন এক জন করে সবাই উঠবে এখন। সবচেয়ে আগে উঠছে মহাকাশযানের দলপতি কিরি। তারপর সে। সেরকমই কথা ছিল।
ঠাণ্ডা মেঝেতে পা রেখে উঠে দাঁড়াল সে। তার নিরাভরণ সুঠাম দেহের উপর সূক্ষ্ম অর্ধস্বচ্ছ একটি নিও পলিমারের কাপড়। কপালের দুই পাশ থেকে দুটি সেন্সর খুলে সে একটু এগিয়ে যায়। ঘরের দেয়ালে উঁচু আয়না, একটু সামনে যেতেই সেখানে নিজের প্রতিবিম্বের উপর চোখ পড়ল তার। না, গত অর্ধ শতাব্দীর কোনো চিহ্ন নেই তার শরীরে। কুচকুচে কালো চুল মাথার উপর বাধা, হাত দিয়ে খুলে দিতেই ঢেউয়ের মতো নিচে নেমে এল। সে আয়নায় আবার নিজের দিকে তাকাল। কোমল মসৃণ ত্বক ভরাট ঠোঁট, উজ্জ্বল কালো চোখ, সেই চোখে স্বচ্ছ ছবি। সূক্ষ্ম অর্ধস্বচ্ছ কাপড়ের আড়ালে তার সুগঠিত বুক, সুঠাম সজীব দেহ।
লাইনা সামনে এগিয়ে যায়। দেয়ালে তার নাম লেখা বোতামটি স্পর্শ করতেই ঘরঘর শব্দ করে একটা দরজা খুলে গেল। তার ঘরে গিয়ে এখন তাকে প্রস্তুত হতে হবে। কন্ট্রোলরুমে কিরি নিশ্চয় তার জন্যে অপেক্ষা করছে এখন।
২.
সমস্ত মহাকাশযানে কন্ট্রোলরুমটি সবচেয়ে বড়। উপর থেকে হালকা একটা আলোতে ঘরটি আলোকিত রাখা হয়। দেয়ালের চারপাশে বড় বড় স্ক্রিনে নানা ধরনের ছবি। ঘরের ঠিক মাঝখানে মহাকাশযানের মূল নিয়ন্ত্রণ। তার ঠিক সামনে একটি নরম চেয়ারে সমস্ত শরীর ডুবিয়ে কিরি বসে আছে। তার পা দুটি সে তুলে দিয়েছে কন্ট্রোল প্যানেলের উপর। লাইনা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই শব্দ শুনে কিরি তার দিকে ঘুরে তাকাল। তার কোমল মুখটি সাথে সাথে এক ধরনের সহৃদয় হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্যানেল থেকে পা নামিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। কিরির দীর্ঘ ঋজু দেহ। কপালের দুই পাশে চুলে একটু রুপালি রং ছাড়া সারা দেহে বয়সের কোনো চিহ্ন নেই। হাত বাড়িয়ে বলল, এস, লাইনা এস। ভালো ঘুম হয়েছে। তোমার?
হ্যাঁ। কেউ যদি একটানা পঞ্চাশ বছর ঘুমিয়ে থাকে সেটাকে ভালো না বললে কোনটাকে ভালো বলবে?
তা তো বটেই।
তুমি কখন উঠেছ?
কিরি লাইনার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তার দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কী সুন্দর তোমাকে দেখাচ্ছে লাইনা! এত সুন্দরী একটা মেয়েকে মহাকাশযানের মতো ছোট একটা জায়গায় রাখা ঠিক নয়। সৌন্দর্যের অপচয় হয় এতে। এই সৌন্দর্য আরো অনেক বেশি মানুষের জন্যে।
লাইনা মাথা নেড়ে বলল, তুমি দলপতি হয়ে মহাকাশযানের নীতিমালার একটা আইন ভঙ্গ করলে। মহাকাশযানের পুরুষ ও মহিলাকে আলাদা করে দেখার নিয়ম নেই।
কিরি মাথা নেড়ে বলল, মনে থাকে না লাইনা! তোমাকে দেখলে আরো বেশি গোলমাল হয়ে যায়।
লাইনা কিরির স্তুতিবাক্যটি গায়ে মাখল না। হেঁটে নিজের ডেস্কের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। গত পঞ্চাশ বছর এখানে কেউ বসে নি কিন্তু কোথাও সেই চিহ্ন নেই। দেখে মনে হয়, মাত্র গত রাত্রিতে সে এখান থেকে উঠে গেছে। নরম চেয়ারটিতে বসে সে নিজের যোগাযোগ মডিউলের বোতামটি চেপে ধরে বলল, মহাকাশযানের কী খবর কিরি? আমরা কি থামছি কোথাও?
হ্যাঁ।
কোথায়?
সাত দশমিক তিন চার অবলিক আট দশমিক নয়…
লাইনা হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল, থাক, আর বলতে হবে না।
কিরি হেসে বলল, আমরা গিনিস ক্ষেত্রে একটা গ্রহে নামছি লাইনা।
গ্রহটির কী নাম?
এর কোনো নাম নেই লাইনা। শুধু পরিচয়। সংখ্যা দিয়ে পরিচয়।
কী আশ্চর্য! আমরা নামহীন একটা গ্রহে নামছি?
হ্যাঁ। মহাজাগতিক সময়ে মেলা বছর আগে এখানে আরেকটি মহাকাশযান নামার চেষ্টা করেছিল। নামতে পারে নি।
লাইনা শঙ্কিত মুখে বলল, কেন পারে নি?
মহাকাশযানের জ্বালানি নিয়ে একটা সমস্যা হয়েছিল। একটি নক্ষত্রের মহাকর্ষ বল থেকে রক্ষা পেতে গিয়ে জ্বালানি শেষ হয়ে গিয়েছিল। তখন এই গ্রহটি তারা দেখতে পায়। গ্রহটির সাথে পৃথিবীর অনেক মিল, মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত না হলে মহাকাশচারীদের বেঁচে যাবার ভালো সম্ভাবনা ছিল।
পৃথিবীর সাথে মিল?
হ্যাঁ। কিরি তার সামনে একটা সুইচ স্পর্শ করতেই দেয়ালের বিশাল স্ক্রিনে একটা গ্রহের ছবি ফুটে ওঠে। কিরি সেটাকে আরো স্পষ্ট করতে করতে বলল, গ্ৰহটার সাথে পৃথিবীর মিল খুব বিস্ময়কর। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ, প্রাণের বিকাশ
প্রাণের বিকাশ?
হ্যাঁ। কিরি হাসিমুখে বলল, এই গ্রহটায় প্রাণের বিকাশ হয়েছে। যতদূর মনে হয় এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে।
লাইনা তার চেয়ার থেকে উঠে দেয়ালে স্ক্রিনটার কাছাকাছি এগিয়ে যায়। ধূসর গ্রহটির দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, তাপমাত্রা কত? জলীয় বাষ্পের পরিমাণ?
গ্রহটির উত্তর ভাগে কিছু কিছু অংশে তাপমাত্রা পৃথিবীর কাছাকাছি। জলীয় বাষ্প কম বলতে পার, পৃথিবীর মরু অঞ্চলের মতো। এখনো ছবি নেয়া হচ্ছে, যেটুকু তথ্য আছে তাতে মনে হচ্ছে গ্রহটা দেখতে খুব খারাপ নয়। তাপমাত্রা আর জলীয় বাষ্প নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে মনে হয় পৃথিবীর গাছপালা জন্ম দেয়া যাবে। মনে হয় চমৎকার একটা বসতি হতে পারে। তবে–
তবে কী?
গ্রহটা দুটি নক্ষত্রের কাছাকাছি। কক্ষপথের কোথায় আছে তার উপর নির্ভর করে মাঝে মাঝে এটাকে দুই সূর্যের গ্রহ মনে হবে! চিন্তা করতে পার আকাশে একসাথে দুটি সূর্য?